#বিনিময় (৫)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
সাবিনা বের হতে সবাই ঘিরে ধরলো। সবার একটাই কথা, আলতাবের মতো জঘন্য লোককে সে ঘরে তুললো কেন? একজন তো বলে বসলো,“লোকটার যে নজর ভালো না সেটা তো আমি আগেই বুঝতে পারছিলাম। শুধু প্রমাণের অভাবে কিছু বলতে পারিনি।”
“আপনাদের না ডিভোর্স হয়েছে?
তাহলে আপনার স্বামী এখানে কী করছে? দেখুন, আপনার স্বামী মেয়ের বয়সী একটি মেয়ের সঙ্গে যা করেছে তারপর আমরা একই বিল্ডিং এ তার সঙ্গে থাকার ভরসা পাবো না। তাই তাকে ঘরে রাখলে আমরা বাড়ি ছেড়ে দিবো।”
একজন এই কথা বলে উঠলে অন্য একজন প্রতিবাদ করে বলে,“আমরা বাড়ি ছাড়বো কেন? ডিভোর্স হওয়ার পর তারা স্বামী, স্ত্রী একই বাসা থাকলে তো আমরা এদের সালিস করবো। এসব নোংরামি তো চলবে না।”
“দেখুন আমি তার সঙ্গে থাকতেও চাই না৷ সে জোরপূর্বক বাসায় এসে উঠেছে। এসে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমিও চাই সে আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাক।”
সাবিনার এই কথাগুলো সবার মুখ বন্ধ করে দিলো। এতক্ষণ তারা ভাবছিলো সাবিনা ডিভোর্সের পরও তার স্বামীকে ঘরে জায়গা দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টা যে অন্য৷ আলতাব জোর করে বাসায় উঠে রয়েছে। এটা বুঝতে পেরে সবাই বলে,“তারমানে ঐ লোকটা জোর করে এখানে থাকছে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না। ঘটনা এমন হলে ওনার মতো নোংরা লোককে কিভাবে বের করতে হয় সেটা আমরা জানি। আমরা আপনার হয়ে কাজটা করে দিচ্ছি।”
এরপর সবাই গিয়ে আলতাবের ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয়। তাকে দরজা খুলতে বলে। আলতাবে ভেতরে বসে ভয়ে কাঁপছিলো। বিল্ডিং এর সবাই যে ইতিমধ্যে তার বাসের ভিডিও দেখেছে এবং তাকে এই বাড়িতে আসতে দেখে চলে এসে ঝামেলা করছে সেটা বুঝতে পেরে আলতাব ভয় পায়। এখন সবাই মিলে তাকে তাড়িয়ে দিলে তো তার যাওয়ার কোন জায়গা থাকবে না। তার তো কিছুই নেই। বাহিরে গিয়ে কারো সাহায্য চাইবে তেমন আত্মীয়ও নেই। প্রিয়ার মতো সুন্দরী ছোট এক মেয়ে তাকে ভালোবেসেছে, এটা তার কাছে স্বপ্নের মতো ছিলো। তার ভালোবাসার মায়ায় পড়ে আলতাব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সব হারালো। বাসের ঐ ঘটনার পর সে বাসায় কিভাবে এসেছে একমাত্র সে জানে? একটি অটোতে ওঠার পর সেখানে এক যাত্রী তাকে চিনতে পারে। সে অটো ড্রাইভারকে বলতে সেই অটো থেকে তাকে ধাক্কা মেরে বের করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাকে বাধ্য হয়ে মুখ লুকিয়ে অন্য অটোতে উঠতে হয়। অতঃপর এখানে আসা। সে আগেই বুঝেছিলো, সাবিনা তাকে এখানে থাকতে দিবে না। তাই সাবিনাকে ভয় দেখিয়ে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে নিবে ভেবেছিলো। কিন্তু এখন সবাই মিলে তাকে তাড়ালে তো তার কিছু করার থাকবে না। এসব ভেবে আলতাব খুব ভয় পাচ্ছিলো। বাহিরে সবাই দরজা ধাক্কাচ্ছে। এত জোরে ধাক্কাচ্ছে মনে হয় ভেঙেই ফেলবে। আর চিৎকার করে বলে,“কু ত্তার বাচ্চা বের হ৷ আমাদের ঘরে মেয়ে বউ আছে। তোর মতো কুলাঙ্গারকে এখানে রেখে দিয়ে আমরা তো নিজেদের বিপদ বাড়াতে পারি না। বের হ।”
আলতাব না পেরে দরজা খুলে। সে দরজা খুলতে সবাই তার দিকে তেড়ে আসে। সে হাতজোড় করে বলে,“দয়া করে আমার কথাটা শুনুন।”
“চুপ। তোর মতো বাজে লোকের কথা কী শুনবো?”
কেউ একজন এই কথা বলে উঠতে আলতাব অনুনয়ের স্বরে বলে,“দেখুন আমি আমার মান সম্মান, বাড়ি, ঘর, স্ত্রী সন্তান সব হারিয়েছি। এখন এই মূহুর্তে আমার যাওয়ার কোন জায়গা নাই৷ আমাকে অন্তত আমার একটা ব্যবস্থা করার সময় দিন।”
আলতাবের কথায় কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। আলতাব সাবিনার পাশে এসে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। সে বলে,“তুমি একটু বোঝাও। আমি আমার মাথা গোজার একটা ঠাঁই পেলে চলে যাবো। অন্তত দুইটা দিন আমাকে থাকতে দাও।”
“মগের মুল্লুক পেয়েছেন?
দুইটা দিন থাকবেন? কার সঙ্গে? যে স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছেন তার সঙ্গে?”
এসব কথা শুনে আলতাব সাবিনাকে আবারও পুরনো কথা মনে করিয়ে দেয়। সাবিনা এবার সবার উদ্দেশ্য বলে,“আমি একটা কথা বলি?”
সবাই থেমে যায়। সাবিনা শান্ত গলায় বলে,“আজ হয়তো তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু একটা সময় সে আমার স্বামী ছিলো। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলো। এখন তার রাত কাটানোর মতো মাথার উপর একটা ছাদ নেই। তাছাড়া তার আসল রূপ যেহেতু প্রকাশ পেয়েছে সেহেতু কেউ তাকে বাসা ভাড়াও দিবে না। কিন্তু আমি তো তাকে ফেলে দিতে পারছি না।”
”তার মানে আপনি আপনার ডিভোর্স দেওয়া স্বামীর সঙ্গে থাকবেন?”
এই কথাটি একজন বলতে সবাই ছি ছি করে উঠলো। সাবিনা সবাইকে থামিয়ে বললো,“প্লীজ আমার কথাটা শুনুন। আমি তার সঙ্গে থাকতে চাচ্ছি না। বা আমার ঘরে রাখতে চাচ্ছি না। তাছাড়া আমার ঘরের একটি রুম আমি মেঘাকে ভাড়া দিয়েছি। এখন এখানে তাকে রেখে আমি মেঘার ক্ষতি করতে পারি না। তার যা স্বভাব। আমি শুধু তাকে একজন ভাড়াটিয়ার মতো ভাড়া দিতে চাই আমার ঘর। তবে সেটা এখানে নয়। আমাদের দারোয়ান যেখানে থাকে সেখানে। কয়েকটা দিনের জন্য আমি শুধু তাকে সেখানে থাকার অনুমতি দিতে চাই। তবে হ্যাঁ তার বিনিময়ে ভাড়া অথবা দারোয়ানের কাজে সাহায্য করতে হবে তাকে। শুধুমাত্র এই শর্তেই থাকতে দেওয়া হবে।”
সবাই আলতাবকে গা ল মন্দ করলেও এই কথায় তেমন দ্বিমত জানায় না। তাছাড়া আলতাব তাদের কাছে হাতজোড় করে বলছে,“আমি তো এতদিন ছিলাম। আপনাদের কোন ক্ষতি হয়েছে। হয়নি তো। দয়া করে কয়েকটা দিন থাকতে দিন। বাহিরে বের হলে লোকজন আমাকে ধরে মে রেই ফেলবে। আমি নাহয় একটা ভুল করেছি। তার জন্য ক্ষমা চাই। এই ভুলের শা স্তিস্বরূপ আপনারা আমাকে মৃ ত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন না।”
সবাই তাই দয়া দেখিয়ে রাজি হয়। মেঘা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সবার কান্ড দেখছিলো। লোকজন ধীরে ধীরে যার যার ফ্লাটে চলে যায়। তবে দুইজন বলে যায়,“আমরা এখানে থাকবো না। স্যরি এমন খারাপ মানুষ যেখানে আছে সেখানে আমাদের থাকা সম্ভব নয়।”
তারা দু’দিনের মধ্যে বাসা ছেড়ে দিবে জানিয়ে চলে যায়। সাবিনা তাদের কিছুই বলে না। সবাই চলে গেলে সাবিনা আলতাবকে বলে,“তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও গিয়ে দারোয়ানের সঙ্গে কাজ করো। এখন থেকে সেখানেই থাকবে। এখানে আসার চেষ্টাও করবে না।”
“সুযোগ পেয়ে এভাবে আমাকে দারোয়ানের ঘরে পাঠালে? তুমি চাইলে অন্য ব্যবস্থা করতেই পারতে। কিন্তু সেটা করলে না।”
আলতাবের এই কথা শুনে সাবিনা তার দিকে আঙুল তুলে বলে,“তোমার মতো মানুষকে থাকতে দিয়েছি এটাই অনেক। তাই এটা নিয়ে খুশি থাকো।”
“সাবিনা?”
আলতাব চোখ রাঙিয়ে উঠে। সাবিনা সেটায় গুরুত্ব না দিয়ে বলে,“একদম নয়। তুমি যদি ভেবে থাকো আমি তোমাকে ভয় পাই তাহলে ভুল ভাবছো। আমি ভয় পেয়ে তোমাকে এখানে থাকার অনুমতি দেইনি। বরং দয়া দেখিয়ে দিয়েছি। হ্যাঁ দয়া দেখিয়ে। ভয় মোটেই পাই না। তাই তোমার যা ইচ্ছা করতে পারো। তোমার কথা আমার সন্তানরা বিশ্বাস করবে না। করলেও তারা বুঝবে তাদের মা কোন পরিস্থিতিতে কী করেছে।”
এটা বলে সাবিনা আলতাবকে বেরিয়ে যেতে বলে। আলতাব কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে যায়। আলতাব বেরিয়ে যেতেই সাবিনা সোফায় বসে পড়ে। সে বসে কান্না করে দেয়। সেদিন আলতাব তার কথা শুনে তাকে ডিভোর্স না দিলে আজকের দিনটা তাকে দেখতে হতো না। তাদের পঁচিশ বছরের সংসার জীবন। আর ক’টা বছর নাহয় কাটিয়ে দিতো। তা না করে হাঁটুর বয়সী এক মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। দিলো তো মেয়েটা এভাবে বাসের মধ্যে অপদস্ত করে। এসব বিরবির করে সাবিনা কান্নায় ভেঙে পড়ে। মেঘা অবাক হয়ে বলে,“মেয়েটা ফাঁসিয়ে দিয়েছে মানে?”
সাবিনা মেঘার কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকায়। মেঘা এসে তার পাশে বসে। সাবিনা শান্ত গলায় বলে,“আমি আলতাবের কথা বিশ্বাস করি। ওর চরিত্রের দোষ আছে। কিন্তু তাই বলে যে ভিড় বাসে ও কোন মেয়ের সঙ্গে নোংরামি করবে, এত সাহস ওর নেই। তাছাড়া এই মেয়ের সঙ্গে যে ওর সম্পর্ক ছিলো সেটা আমি সেদিনই জেনেছি। সেদিন ওর ফোনে আমি এই মেয়ের ছবি দেখেছি। তাই এই মেয়েটাই যে প্রেমের নামে একে ফাঁসিয়েছে এটা মিথ্যা নয়। হয়তো টাকা পয়সার জন্য ওকে ধরেছিলো। যেই শুনেছে সব আমার নামে। তখন নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। নয়তো এত ছোট মেয়ে এমন বুড়ো বয়সের পুরুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়বে কেন? নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে। টাকা দেখলে এরা বুড়োও দেখে না। এতটাই খারাপ এরা।”
সাবিনা শেষ কথাগুলো খুব রাগ নিয়ে বলে। মেঘা তার কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে বলে,“আপনি নিশ্চিত এই মেয়ের সঙ্গে ওনার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো? সত্যি? এতটুকু মেয়ের সঙ্গে?”
সাবিনা হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালে মেঘা অবাক হয়ে যায়। তার বয়সী মেয়েটা। এই মেয়ে নাকি তার বাবার চেয়েও মনে হয় বড় আলতাব তার সঙ্গে প্রেম করেছে। তাও টাকার জন্য৷ অতঃপর টাকা না পেয়ে তাকে অপমান করলো। মেঘা এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে বাসের ঘটনাই সত্যি। কিন্তু সাবিনা খুব জোরের সঙ্গে কথাটি বলে। মেঘা তাই চুপ করে যায়। সাবিনা মন খারাপ করে বসে থাকে। সাবিনার মন খারাপ দেখে মেঘা বলে,“ঘুরতে যাবেন?”
“মানে!”
সাবিনা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। মেঘা নরম গলায় বলে,“যে আপনাকে ঠকালো তার কথা ভেবে মন খারাপ করে না থেকে বরং একটু ঘুরতে চলুন। দেখবেন মনটা ফ্রেশ লাগবে। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে দেখুন খুব ভালো লাগবে। মনের ভেতরে থাকা সব ভারি জিনিস নেমে যাবে।”
“তুমি আমার মতো বুড়ো একজনকে নিয়ে ঘুরতে যাবে? তোমার বোরিং লাগবে না?”
সাবিনার এই প্রশ্নটা শুনে মেঘা নাসূচক মাথা নাড়ায়। অতঃপর বলে,“আপনাকে না আমার খুব কাছের মানুষ মনে হয়। আমি জানি না, আমি সবসময় সুখ দুঃখ বিনিময়ের কথা যাকে বলি তাকেই খুব আপন লাগে সেজন্য নাকি অন্য কারণে। তবে আপনাকে অন্যদের চেয়ে বেশি আপন লাগে। তাই তো আপনার বাসায় থাকতে চলে এলাম। এজন্যই আমার মনে হয় আপনার সঙ্গে ঘুরলে আমার ভালো লাগবে। হয়তো খুব ভালো লাগবে।”
মেঘার মুখে এই কথা শুনে সাবিনা কিছুটা হকচকিয়ে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“জানি না আমার সঙ্গে কী হচ্ছে। তবে তোমার মুখটা যখন থেকে দেখেছি তখন থেকেই খুব মায়া লাগছে। যখন তুমি বললে তুমি রাতটা পার্কে কাটিয়েছো তখন আমার খুব খারাপ লেগেছে। আমার মনে হয়েছে, ঐ সময়ে যদি কোন শকুনের নজর তোমার দিকে পড়তো তাহলে তোমার কী হবে? আমি সচরাচর এক কথায় কাউকে বাসা ভাড়া দেই না। নিজের ফ্লোরের একটা ঘর ছাড়া তো দূরের কথা। সেখানে তোমাকেই কেন জানি দিয়ে দিলাম। আচ্ছা তুমি কী আমার কাছের কেউ?”
এটা শুনে মেঘা মুচকি হাসি দেয়। হাসি মুখে ধরে রেখেই বলে,“না। আমি আপনার কাছের কেউ নই। তবে আমি আপনাকে দেখে মনের যে টান অনুভব করেছি আপনার মাতৃ হৃদয় হয়তো সেই একই টান অনুভব করেছে। তাই মনের টানে আমাদের কাছের লাগছে একে-অপরকে।”
এটা শুনে সাবিনা জবাব দেয় না। সে অদ্ভুত এক মায়ার নজরে মেঘার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘা এটা লক্ষ্য করে শান্ত গলায় বলে,“চলুন না ঘুরে আসি।”
’
’
’
চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন।)