#বিনিময় (৭)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
সাবিনা খুব সংক্ষেপে বিষয়টি খুলে বলে। সে গর্ভবতী হয়ে যাওয়ায় আলতাবকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। অতঃপর চার মাসের গর্ভবস্থায় তাদের বিয়ে হয়। আলতাবের কথাটি পুরোপুরি সত্যি নয়। সেই সন্তান বেঁচে থাকলে তার বয়স ২৬ হতো না। এই কথাটি সে রানা এবং রিমার সামনে এজন্য বলেছে যাতে খুব সহজে তারা বুঝতে পারে সাবিনা বিয়ের আগেই গর্ভবতী হয়েছিলো। সেজন্য বাড়িয়ে বলেছে। সেই সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায়। পে টের মধ্যেই মা রা যায়। সেজন্য থাকেনি। এই কথা শোনার পর মেঘা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না৷ সাবিনা বুঝতে পেরে বলে,“কোন মা চায় না তার সন্তানদের কাছে খারাপ হতে৷ আমিও চাইনি। আমি বিয়ের আগেই একটি ভুল করে ফেলেছিলাম। এটা সন্তানদের কাছে প্রকাশ পাওয়া শোভনীয় নয়। সেজন্য ভয় পাচ্ছিলাম৷ আর সেই ভয়টা কাজে লাগিয়ে আলতাব আমার থেকে টাকা নিতে চাচ্ছিলো। লাভ না হওয়ায় এমনভাবে সবটা বললো যে রানা এবং রিমা সব বুঝে গেল।”
সাবিনা কথাটি বলে নিরবে চোখের পানি ফেলে। মেঘা নিজের হাত দিয়ে চোখের পানিটা মুছে দিতে সাবিনা কিছুটা কেঁপে উঠে। সে পরম মায়ায় মেঘার দিকে তাকায়। মেঘা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,“জীবন এমনই। মানুষের জীবনে কত কিছুই তো ঘটে যায়। সব মনে রেখে চোখের পানি নাই বা ফেললেন।”
“আমার পরিস্থিতি তুমি বুঝবা না গো মেয়ে।”
সাবিনার এই কথায় মেঘা কিছুটা উপহাস করে হেসেই বলে,“সব বুঝি। এত অবুঝ নই। না বলা অনেক কথাও বুঝে নেই।”
সাবিনা মেঘার এই কথার ভাবার্থ বুঝতে পারে না। মেঘা শান্ত গলায় বলে,“তেমন কিছুই নয়। শুধু বললাম। আমার জীবনেও তো বহু ঘটনা ঘটে গেছে। তাই মানুষের পরিস্থিতি একটু হলেও বুঝি।”
এটা বলে মেঘা পরিস্থিতি বদলাতে নিজের ব্যাগে থাকা দু’টো চকলেট বের করে বলে,“চলুন মজা করে চকলেট খাই।”
“আমার বয়সের সঙ্গে এসব পাগলামি যায়? চকলেট খাওয়া মানায়?”
”চকলেটের গায়ে তো লেখা নেই এই বয়সসীমার মানুষই তাকে খেতে পারবে। তাহলে আপনার বয়সের সঙ্গে যায় কি-না বুঝবো কিভাবে কাকী মা?”
কথাটি মেঘা খুব মজারস্বরে বলে। সাবিনা ম্লান হাসে। মেঘা চকলেটের খোসা ছাড়িয়ে সাবিনার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,“এটা দিয়ে নাহয় সুখ দুঃখ বিনিময় করি?”
“তোমার যা জীবন। তাতে তো এত সুখ নেই। তাও তুমি সুখ বিলাও কেন?”
সাবিনার মজার স্বরে বলা কথাটি শুনে মেঘা হাসতে হাসতে জবাব দেয়,“যতটা সুখ আছে ততটাই নাহয় বিনিময় করি।”
এটা বলতে সাবিনা চকলেট মুখে নেয়। মেঘাও খায়। অতঃপর মেঘা সাবিনাকে তার জীবনের মজার মজার কিছু ঘটনা বলে। যেগুলো এমন ভাবভঙ্গি নিয়ে বলে যে সাবিনা হাসতে বাধ্য হয়। সাবিনার মুখে হাসি ফুটতে মেঘাও খুশি হয়। সাবিনা মেঘার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে,“এত ভালো একটা মেয়ের বাবা, মা নেই। ইশ কতই না কষ্টের জীবন তার। ইচ্ছে করে তার মায়ের অভাবটা দূর করে দিতে।”
______
আলতাব তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে ফোন রাখে। তার এক বন্ধুর সাহায্য যে প্রিয়া অর্থাৎ মৌমিতার ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু যার সাহায্য ব্যবস্থা নিবে সে অনেক টাকা দাবি করে। সেই টাকাই চাইতে গিয়েছিলো সাবিনার কাছে। কারণ আলতাবের কাছে কিছুই নেই। কিন্তু সেটা পেলো না। তার বন্ধু তাকে মাত্র জানালো টাকা ছাড়া কিছুই হবে না। তাই আলতাব সাবিনাকে ফোন দেয়। সাবিনা তার নাম্বার দেখে কেটে দেয়। আলতাব বারবার ফোন দিতেই থাকে। অতঃপর সাবিনা এসব বিরক্তি নিতে না পেরে ফোন বন্ধ করে দেয়। এটা দেখে আলতাব রেগে যায়। তবে সে নিজেকে সামলে নেয়। সে আবার সাবিনার ঘরের সামনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে এমনটা ভাবছিলো সেই সময়ে সাবিনার ফোন থেকে ম্যাসেজ আসে। আলতাব কিছুটা অবাক হয়। মাত্রই তো ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলো। এখন খুলে আবার ম্যাসেজ দিচ্ছে। আলতাব ম্যাসেজটি বের করে পড়ে। সেখানে সাবিনা লিখেছে,“আমাকে বিরক্ত করবে না। তোমার টাকা চাই তো সেটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। তবে এখন নয়। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে নিতে এসো। আমি চাই না কেউ তোমাকে আর আমাকে কথা বলতে দেখুক। বা আমি তোমায় টাকা দিচ্ছি সেটা দেখুক। তবে হ্যাঁ টাকা নিয়ে অবশ্যই বিদায় হবে।”
এটা দেখে আলতাব খুশি হয়। সে তার টাকা পেয়ে যাবে এটা জানতে পেরেই খুশি। বাকি কিছুই তার ভাবার বিষয় নয়। আপাতত প্রিয়াকে একটা শিক্ষা দিয়ে নিক। পরে বাকিটা দেখবে সে। প্রিয়া মেয়েটার জন্য তার সব মান সম্মান গিয়েছে। মেয়েটা সেদিন যাবার সময় তার ফোন থেকে তার সঙ্গে আলতাবের গড়ে ওঠা সম্পর্কের সকল প্রমাণ মুছে দিয়েছিলো। তাই সে প্রমাণ করতে পারেনি কিছু। সেদিন এই কাজের জন্যই সে ফোন নিয়েছিলো। ঐ মেয়েকে শিক্ষা না দিতে পারলে আলতাব শান্তি পাবে না। তাই তাকে শায়েস্তা করতে যত টাকা দিতে হয় আলতাব দিবে। এটাই সে ভেবে রেখেছে।
____
গভীর রাত,
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই সময়ে সাবিনা আলতাবকে ডাকে। আলতাব সাবিনার ডাকের অপেক্ষাই করছিলো। সে দ্রুত তিন তলায় চলে আসে। অর্থাৎ সাবিনার ঘরের সামনে। সে দরজা ধাক্কা দিতে নিয়ে দেখে সেটা খোলা। শব্দ যাতে না হয় তাই সাবিনাই খুলে রেখেছে৷ আলতাব ভেতরে প্রবেশ করে সোজা সাবিনার ঘরে চলে যায়।
আলতাব ঘরে এসে সাবিনাকে বিছানায় শোয়া দেখে অবাক হয়। সে শান্ত গলায় বলে,“সাবিনা? সাবিনা?”
সাবিনা ডাকে সাড়া দেয় না। আলতাবকে ডেকে সে চোখ মেলে রাখতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আলতাব এটা বুঝতে পেরে বিরক্ত হয়। সে সাবিনাকে আর একটু জোরে ডাকে। সেই মূহুর্তে বাড়ির দারোয়ান এসে বাহির থেকে তাদের বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। আলতাব সেটা বুঝতে পারে না। সে সাবিনাকে ডাকতে ব্যস্ত। কয়েকবার চেষ্টা অবশেষে সাবিনা চোখ খুলে। সে চোখের সামনে আলতাবকে দেখে অবাক হয়। সে আলতাবকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেই। সে রাগান্বিত গলায় বলে,“তুমি?”
“এতরাতে তুমি আমার ঘরে এলে কোন সাহসে?”
এটা বলে সাবিনা চিৎকার দেয়। সে এসে দরজা খুলতে নেয় দেখে দরজা খুলে না। ইতিমধ্যে দারোয়ান কাছাকাছি থাকা ফ্লাটের লোকজন ডেকে নিয়ে আসে। তারা এসে দরজা খুলে দিতে সাবিনা তাদের দেখে অবাক হয়। আলতাবও বেশ অবাক হয়। দারোয়ান এদের একসঙ্গে দেখে বলে,“মাফ করবেন ম্যাডাম। তালাক দেওয়া স্বামীর সঙ্গে একঘরে থেকে আপনি সমাজে কোন নিয়মের ছড়াছড়ি শুরু করছেন বলুন তো?”
“ছিঃ। আপনাদের বাসায় আমরা থাকি। আমার তো ভাবতেও লজ্জা লাগছে৷ আপনাদের দু’জনার চরিত্র এত খারাপ।”
দারোয়ান সঙ্গে করে যাদের নিয়ে এসে তাদের মাঝে একজন বলে৷ অন্য আর একজন বলে,“আপা আপনাকে তো ভালো ভাবছিলাম।”
“দেখুন আপনারা যা ভাবছেন তা ঠিক নয়?
এই অমানুষটা লুকিয়ে রাতে আমার ঘরে ঢুকেছে? সব দোষ ওর?”
সাবিনা এই কথা বলতে আলতাব প্রতিবাদ করে উঠে,“মিথ্যা কথা বলবা না। তুমিই তো আমাকে ডেকেছো।”
“জানোয়ার চুপ। একদম বাজে কথা বলবি না। তোর মতো মানুষকে ডাকবো আমি?”
এক কথা দুই কথায় শোরগোল বেঁধে যায়। সেই সময়ে আলতাব বলে,”তুমি আমাকে না ডাকলে আমি ঘরে ঢুকলাম কিভাবে? ঘুমানোর সময় বুঝি চোরের জন্য দরজা খুলে রাখছিলে?”
এই কথায় সবাই সহমত জানায়। একজন বলে,“ঠিকই তো। আপনি ঘরে না ঢোকালে সে ঢুকলো কিভাবে? ছিঃ ছিঃ। আপনারা মুরব্বী মানুষ হয়ে যদি এসব কাজ করেন তাহলে এই পাড়ায় তো থাকা যাবে না কারো।”
এটা বলে দারোয়ান সবাইকে উষ্কে দেয় সাবিনা এবং আলতাবকে ধরে বাঁধার জন্য। দারোয়ান বলে,“এরা যে পাপ করেছে সেটা তারা বুঝবে না।তাই এদের একটা উচিত শিক্ষা দিতে হইবো।”
দারোয়ান খুব রষিয়ে বলে আলতাব তার পাশ থেকে উঠে আসতেই তার সন্দেহ হয়। তাই সে পিছু নেয়। অতঃপর এই কান্ড দেখে। একটু বাড়িয়ে বলে,“ঘরের মধ্যে দুজন তো ঢলাঢলি করছিলো। সেই কাজে এত ব্যস্ত ছিলো যে আমি দরজা বন্ধ করছি তাও আলাপ পায় নাই।”
এসব শুনে সবাই ছিঃ ছিঃ করতে থাকে। দুজনকে এনে সোফায় সবার মাঝে বসানো হয়। ইতিমধ্যে দুই একজন আলতাবকে কয়েকটা লাগিয়ে দিয়েছে। সবার এখন মতামত হলো তারা সাবিনা এবং আলতাবকে শা স্তি দিবে। এসব অপরাধ যাতে না করে৷ সেই সঙ্গে আলতাবকে এই বাড়ি থেকে লাথি মে রে বের করে দিবে। তাকে এই এলাকায় আর দেখলে ধরে মে রে ফেলা হবে। সাবিনা যেহেতু এই বাসার মালিক তাই তাকে সরানো যাবে না। তবে অপরাধের শা স্তি দেওয়া যাবে। সিদ্ধান্ত হয়, আগেকার মতো মাথা নাড়া করে চুন কালি মাখিয়ে, গলায় জুতোর মালা পড়িয়ে সারা এলাকা ঘোরানো হবে। এসব শুনে সাবিনা এবং আলতাব ভয় পেয়ে যায়। সাবিনা বারবার তাদের সত্যিটা বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। সেই মূহুর্তে একজন বলে,“এই আমাদের ভাড়াটিয়াদের যে গ্রুপটা রয়েছে সেটা একটা ভিডিও আসছে। দেখুন সবাই।”
সবাই সেই ভিডিও দেখে অবাক হয়ে যায়। এটা সকালের সেই ভিডিও যেখানে আলতাব এবং সাবিনা ঝগড়ার ফাঁকে ফাঁকে বলে দেয় যে বিয়ের আগেই সাবিনা গর্ভবতী হয়। অতঃপর তাদের বিয়ে হয়। সবার মাঝে আবার ছিঃ ছিঃ লেগে যায়। দারোয়ান বলে,“তারমানে আপনাদের পাপ বোধ কখনো ছিলোই না। আগে থেকেই পাপ করে বেরিয়েছেন।”
এই ভিডিওর কথা শুনে সাবিনা এবং আলতাবও অবাক হয়ে যায়। সেই সময়ে তো তারা শুধু পরিবারের লোক ছিলো তখন ভিডিও কে করেছে? সেই সময়ে সাবিনার নজর যায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘার দিকে। মেঘা নিরব চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘার মুখটা দেখতে সাবিনার মনে পড়ে যায় সেই সময়ে মেঘাও ছিলো। তবে মেঘা এই কাজ করেছে। এই প্রশ্ন সাবিনার মাথায় আসতে মেঘা মাথা নাড়ায়। সাবিনা হতভম্ব হয়ে যায়। সে এক দৃষ্টিতে মেঘার নির্বাক চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে বেশিক্ষণ পারে না। এরই মাঝে সাবিনা এবং আলতাবের নোংরামির শা স্তি এখনই দেওয়ার কথা উঠে। ইতিমধ্যে আরও লোক জড়ো হয়েছে। রাত পেরিয়ে প্রায় ভোর হতে চলেছে। সাবিনা এবং আলতাবের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। অতঃপর চুন কালি মিশিয়ে তাদের মাথায় দেওয়া হয়। সাবিনা বারবার বলতে থাকে তারা ভুল ভাবছে। তারা ঠিক করছে না। এর দাম দিতে হবে। সবাই এসব শুনে আরও তাদের গালাগালি করছে। অতঃপর তাদের জু তোর মালা গলায় দিয়ে সারা পাড়া ঘোরানো হয়। তাদের সঙ্গে হওয়া এই সমস্ত দৃশ্য ভিডিও করা হয়। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। শুধু সেটা নয়, আগের ভিডিওটাও। এবং ক্যাপশনে বলা হয়,“বিয়ের আগে পেট বাঁধিয়েছে এখন ডিভোর্সের পর আবার একই কাজ করছে। তাই এদের টুকটাক শা স্তি দেওয়া হলো।”
অপমান অপদস্ত হয়ে সাবিনা একদম ভেঙে পড়ে। সে এসে ঘরের মেঝেতে বসে পড়ে। সেই মূহুর্তে মেঘা এসে তার পাশে বসে। সাবিনা তার উপস্থিতি বুঝে শান্ত গলায় বলে,”তোমাকে মেয়ের মতো দেখেছিলাম। মায়া করে ঘরে জায়গা দিলাম। আর তুমি কি-না এসব ভিডিও করে ছাড়লে। কেন বলো তো? আলতাবকে ঘরে ঢোকানোর পিছনেও তুমি ছিলে? আমার এত বছরের সব মান সম্মান নষ্ট করে দিলে? কেন গো?”
মেঘা শান্ত চোখে সাবিনার দিকে তাকায়। তার চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বলে,“বিনিময়। ঐ যে বললাম আপনার সঙ্গে বিনিময় করতে এসেছি। তবে কিঞ্চিৎ মিথ্যে ছিলো। আপনার সঙ্গে সুখ নয় দুঃখ বিনিময় করতে চাই। এতগুলো বছর তো খুব সুখে ছিলেন। এবার একটু দুঃখকে বরন করুন।”
’
’
চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন।)