বিনিময় পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
8

#বিনিময় (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

মেঘার কথা শুনে সাবিনা হতভম্ব হয়ে যায়। সে বিষ্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে মেঘার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘা এটা দেখে উপহাসের হাসি দিয়ে বলে,“আমাকে মে রে ফেলতে ইচ্ছে করছে? খুব রাগ হচ্ছে আমার উপর, তাই না? ইশ। খাল কেটে কুমির ঘরে নিয়ে আসলাম, তাই না?”

“তোমাকে আমি খুব ভালো মেয়ে ভাবছিলাম। তোমার প্রতি মায়া করে ঘরে জায়গা দিয়েছি। আর তুমি?”
সাবিনা কথাগুলো থেমে থেমে বলে। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। তবুও বহুকষ্টে বলে। এটা শুনে মেঘা শব্দ করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে,“ফ্রীতে আপনার বাড়ি উঠিনি। বিনিময়ে টাকা দিয়েছি। তাই এসব ন্যাকামি করবেন না যেন। আর হ্যাঁ সত্যি আমি ভালো মেয়ে নই। আপনি আমাকে ভালো ভেবেছেন, এটা আপনার ভুল। আমার নয়। আমি তো ভালো মানুষ নই।”
একটু থেমে মেঘা কঠিন গলায় বলে,“আমাকে আপনি ভালো মানুষ হতে দেননি।”

সাবিনা এই কথা শুনে অবাক চোখে মেঘার দিকে তাকায়। সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। মেঘা ব্যঙ্গ করে বলে,“হ্যাঁ আপনি। আপনি আমাকে ভালো মানুষ হতে দেননি। আপনার লোভ, আপনার স্বার্থপরতা, আপনার বেঈমানী আমার সারা জীবন নষ্ট করেছে। আমি সারা জীবনে কখনো সুখ পাইনি। আমার দুঃখের জীবনের উপর পা রেখে আপনি পঁচিশ বছর ধরে সুখের জীবন কাটিয়েছেন। এটা আমি কিভাবে মেনে নেই বলুন তো কাকী মা? অনেক তো সুখ করলেন। এবার দুঃখটাকে সঙ্গী করে নিজের শেষ অব্দি কাটান। আপনার দুঃখ, আপনার কান্না, সমাজের চোখে আপনার ছোট হওয়া, মানুষের ঘৃণায় মুখ লুকিয়ে আপনার বেঁচে থাকা আমাকে আনন্দ দিবে। সারাজীবন আমি যে সুখ পাইনি সেই সুখ আপনার এই দুঃখ আমাকে দিতে পারে। তাই আপনাকে তো লোক সমাজে অপমানিত হতেই হতো।”

মেঘা প্রচন্ড রাগ নিয়ে কথাগুলো বলে। সাবিনা বিষ্ময়ের গলায় বলে,“তোমাকে তো আমি চিনিও না। তাহলে তোমার দুঃখের কারণ আমি কিভাবে হলাম? তোমার ভুল হচ্ছে মেঘা। তুমি আমাকে ভুল বুঝে আমার সঙ্গে ভুল করলে। আমি তোমাকে মেয়ের মতো…।”

“চুপ।”
মেঘা চিৎকার দিয়ে বলে। সাবিনা কেঁপে উঠে। মেঘা চোখ গরম করে তার দিকে তাকিয়ে বলে,“তোর ঐ নোংরা মুখে আমাকে মেয়ে বলবি না। তোর মতো বে…. আমার মা হতে পারে সেটা তো আমি নিজের কল্পনাও ভাবি না।”

“বে….।”
সাবিনা পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। মেঘা মাথা নাড়িয়ে বলে,“তো তুই বে…. নোস। তুই তো প তিতার থেকেও খারাপ। তাদের যতটা সম্মান করা যায় তোকে ততটাও করা যায় না।”

”কে তুমি?
কেন এসব করেছো? কী শত্রুতা তোমার সঙ্গে আমার?”
সাবিনার মুখে এই কথা শুনে মেঘা চুপ করে যায়। সে উঠে নিজের ঘরে যায়। সাবিনা তাকে চলে যেতে দেখে বলে,“আমি জানতে চাই কে তুমি? কেন এমন করলে? আমার কথার জবাব দাও মেঘা।”

মেঘা কোন কথা না বলে ঘরে গিয়ে রাতে গুছিয়ে রাখা ব্যাগ নিয়ে বের হয়। মেঘাকে তার ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেখে সাবিনা জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকায়। মেঘা শান্ত গলায় বলে,“আমার কাজ হয়ে গেছে। আমি এবার যাই।”

মেঘার মুখে এই কথা শুনে সাবিনা হতভম্ব হয়ে যায়। সেই মূহুর্তে সাবিনার ফোনটা বেজে উঠে। যেটা মেঘার ব্যাগে ছিলো। সাবিনা এটা দেখে আরও অবাক হয়ে যায়। মেঘা ফোনটা বের করে সাবিনার কাছে দিয়ে বলে,“নে তোর ছেলে, মেয়েরা ফোন করছে। হয়তো তোর পাপের জন্য তাদের জীবনটাও শেষ হয়ে গিয়েছে। দেখ তারা তোকে ফোন দিয়ে গা লি দেয় কি-না।”

“কেন করেছিস তুই এসব?”
এবার সাবিনা প্রচন্ড রাগ নিয়ে কথাটি বলে। এতক্ষণ অব্দি সে ভেঙে পড়েছিলো। তবে এবার সন্তানদের জীবনেও এসব প্রভাব ফেলছে বুঝতে পেরে সে নিজেকে সামলে নেয়। তার এখন জানতেই হবে মেঘা এসব কেন করেছে? সাবিনা উঠে দাঁড়ায়। সে মেঘার বাহুচেপে ধরে বলে,“সুচ হয়ে ঢুকে তুই ফাল হয়ে বের হচ্ছি। বল কেন করলি এসব? তোর মতো হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ের সঙ্গে আমার কিসের শত্রুতা?”

“তুই নিজেই ভাব।”
এটা বলে মেঘা সাবিনাকে ছাড়িয়ে চলে যেতে নেয়। সাবিনা আবার ধরে ফেলে। সে রাগান্বিত হয়ে থাপ্পড় মারতে নিলে মেঘা সেটা ধরে নেয়। অতঃপর বলে,“একদম না৷ এখন আমি চিৎকার দিয়ে লোক জড়ো করে যদি বলি আপনার মতো নোংরা মানুষের বাড়ি থাকবো না বলায় গায়ে হাত তুলছেন, তারপর কী হবে বুঝতে পারছেন তো?”

“তুই চিৎকার করবি কর।
এবার তো আমি পুলিশ ডাকবো। তোর বিরুদ্ধে চুরির মামলা করবো।”
সাবিনার মুখে এই কথা শুনে মেঘা হাসতে থাকে। সে পাগলের মতো উচ্চ শব্দে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে,“আচ্ছা ডাক।”
মেঘার কন্ঠে কিছু একটা ছিলো যেটা দেখে সাবিনা চুপ হয়ে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে অনুরোধের গলায় বলে,“লোক সমাজে আমার তো মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা আর রইলো না। অন্তত এটা বলো যে কেন তুমি এমন করলে? আমার ভুলটা কোথায়? সেটা জানলে অন্তত আমি শান্তি পেতাম।”

“কত সহজেই নিজের পাপ ভুলে গেলেন। এখন আপনার ভুল কোথায় সেটা খুঁজে পাচ্ছেন না। বাহ্। পাপের পর পাপ করে এখন নিজেকে এতটাই সাধু ভাবছেন যে নিজের নূন্যতম ভুল খুঁজে পাচ্ছেন না। বাহ্।”
এটা বলে মেঘা আবার উপহাসের হাসি দেয়। সাবিনা স্তব্ধ হয়ে যায়। মেঘা ঠান্ডা গলায় বলে,“তোর পেটের বাচ্চাটা একা একা ম রছিলো নাকি নিজে হ ত্যা করেছিস? তাকে তো অবৈধভাবে পেটে ধরেছিলি। সেই পাপে নিজে হ ত্যা করেছিস। নাকি অন্য কারণে? তুই যা মানুষ। আমার তো বিশ্বাস হয় না ঐ বাচ্চা তোর হাত ছাড়া নষ্ট হয়েছে।”

এটা শুনে সাবিনা কেঁপে উঠে। তার চোখেমুখে ভয় দেখা দেয়। তার স্মৃতিতে ভেসে উঠে সেই সময় যখন আলতাব তাকে বাচ্চা নষ্ট করার ঔষধ এনে দিয়েছিলো। অতঃপর সাবিনা নিজ হাতে সেটা খেয়ে বাচ্চাটি নষ্ট করেছে। সেই সময়ে সে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে অব্দি সাতদিন থাকতে হয়। এই কথাটি মনে পড়তে সাবিনা কয়েক পা পিছিয়ে যায়। সাবিনার অবস্থা দেখে মেঘা হেসে বলে,“বুঝে গেছি। তুই নিজের কোন নোংরা স্বার্থের জন্য তাকে নষ্ট করেছিস। এত পাপের পরও নিজেকে সাধু ভাবছিস।”

“আমি যদি আমার বাচ্চার সঙ্গে কিছু করেও থাকি সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে তুই এত কথা বলছিস কেন?”
সাবিনা কঠিন গলায় কথাটি বলে উঠে। মেঘা ম্লান হেসে বলে,“তোর সন্তানরা তো সবে তোর অপকর্ম দেখলো। তোকে অপদস্ত হতে দেখেছে। খুবই সামান্য। ফোনটা ধরে দেখ এই সামান্য কারণে হয়তো তোকে এখন গালাগালি করছে। তাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে। তো তারা যদি জানতে পারে তারা দুজনেই তোর অবৈধ বাচ্চা। তাদের জন্মের কোন বৈধতা নেই। কারণ তোর আর আলতাবের বিয়েটাই বৈধ নয়। তোরা যা করেছিস সবটাই নোংরামি। তখন তারা সহ্য করতে পারবে তো? এখনই তাদের জীবনটা শেষ। তখন কী হবে বল তো?”

মেঘার এসব কথা শুনে সাবিনা অদ্ভুত দৃষ্টিতে মেঘার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করে। মেঘা সেটা বুঝতে পেরে হাসি নিয়ে বলে,“সবাই বলে আমি নাকি আমার বাবার মতো দেখতে। আফসোস তুই আমার সেই বাবার মুখটা মনে রাখলি না। যদি রাখতি তাহলে আজ তোকে আমাকে জিজ্ঞেস করতে হতো না, আমি এসব কাজ কেন করেছি?”

মেঘার এই কথাটি সাবিনার বুকে ঝড় তোলার জন্য যথেষ্ট। সে যা বোঝার সব বুঝে গেছে। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। এতটা যুগ পর তার অতীত তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ তাও ভয়াবহ রূপ নেই। যে তাকে লোক সমাজে অপমানিত করতে দু’বার ভাবেনি। এটা বুঝতে পেরে সাবিনা হতভম্ব হয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলে,”তুমি না বলেছিলে তোমার বয়স পঁচিশ।”

”না। একদম না।
আমি বলেছি আমার বয়স পঁচিশ পেরিয়ে গেছে।”
এটা বলে মেঘা অদ্ভুত এক বিজয়ের হাসি দিয়ে সাবিনার ঘর ত্যাগ করার জন্য পা ফেলে। সাবিনা কাঁপা হাতে মেঘার ডান হাতটি ধরে ফেলে। মেঘা ঘুরে কঠিন চোখে সাবিনার দিকে তাকায়। সাবিনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,“তোমার প্রতি আমার চোখে জন্ম নেওয়া মায়াটা মিথ্যা নয়।”

এটা শুনে মেঘা উপহাসের এক ঝাঁঝালো হাসি দিয়ে সাবিনার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। সাবিনা সেখানেই বসে পড়ে। তার ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। পরিচিত সবাই তাকে ফোন দিচ্ছে। সঙ্গে রানা এবং রিমাও। হয়তো সাবিনা এবং আলতাবের এই অবস্থা ভাইরাল হওয়ার পর রানা এবং রিমার জীবনেও ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। তাদের ওখানে টিকে থাকা হয়তো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। সবটা বুঝতে পেরে সাবিনা একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার চোখের সামনে মেঘার বিদ্রুপের হাসি মাখা মুখটি ভেসে উঠে। সাবিনার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে।

_____

মৌমিতা কলিংবেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে মেঘাকে দেখে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর বলে,“অফিসের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই চলে আসলি। ভিডিওটা দেখলাম জোশ ছিলো।”

মেঘা ম্লান হাসে। অতঃপর ঘরের মধ্যে চলে যায়। মৌমিতা এটা দেখে নরম গলায় বলে,“মন খারাপ?”
মেঘা দু’পাশে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ না। মৌমিতা তাও বলে,“মন খারাপ?”

“না। তোকে ধন্যবাদ। তুই এগিয়ে না আসলে এতকিছু সম্ভব ছিলো না। ঐ ঘটনার পর তোকেও অনেক লোক বাজে কথা বলছে। বাসের ঘটনায় প্রায় মানুষ তোর পক্ষে থাকলেও কিছু লোক তো তোকে বাজে কথা বলেছে। এমনটা হবে জেনেও তুই বন্ধুত্বের জন্য এমন পদক্ষেপ নিলি সেটার জন্য আমি তোর কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো মৌমিতা।”
এটা শুনে মৌমিতা মেঘাকে জড়িয়ে ধরে। হাসি মুখে বলে,“ভাগ্যের চাকায় আমরা দুই অনাথ এক হয়ে গেলাম। আমাদের তো একে-অপরকে এতটা ভালোবাসা উচিতই।”
এটা শুনে মেঘা মুচকি হাসি দেয়। সত্যি তাই। ভাগ্য তাদের মিলিয়ে দিয়েছে। সারাজীবন যে ভালোবাসা মেঘা চেয়েছিলো সেটা কেউ তাকে দেয়নি। একমাত্র এই মেয়েটা ছাড়া। সাবিনা মেঘার বাবাকে ছেড়ে আলতাবের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পর মেঘার জীবনটা নরক হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ সাবিনা মেঘার মা৷ সেই মা যে মেঘাকে গর্ভে নিয়ে আলতাব নামক এক ধনী ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। মেঘার বাবা খলিল সাধারণ এক দিনমজুর ছিলো। অভাবের সংসারে ভালোবাসা থাকলেও সাবিনা সেই ভালোবাসায় খুশি হলো না। তার টাকার প্রয়োজন ছিলো। তাই তো মেঘার জন্মের চার মাসের মাথায় আলতাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়াতে দু’বার ভাবেনি। সেই সময়ে খলিলের সঙ্গে তর্ক করে তাকে দূরে সরিয়ে দিতো সাবিনা। খলিল বুঝতে পারছিলো সাবিনা অন্য কারো সাথে জড়িয়ে গেছে। তাই সে দুঃখে কষ্টে বন্ধুদের সঙ্গে নেশা পান করা শুরু করে। সে যে সাবিনাকে খুব ভালোবাসতো। তাই সাবিনার এমন পরিবর্তন সে মেনে নিতে পারেনি। এভাবে বাবা নেশায় ডুব হয়ে থাকতো আর মা পরপুরুষের সঙ্গে। সারাদিন একলা বিছানায় বসে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কান্না করে দিন কাটতো মেঘার। তার ছয় মাসের মাথায় সাবিনা গর্ভবতী হয়ে যায়। এই বাচ্চার আলতাবের ছিলো। সেই বাচ্চার দোহাই দিয়ে আলতাবের বাড়ি গিয়ে উঠে সাবিনা। আলতাবও সাবিনার রূপ যৌবনে এতটাই পাগল হয়ে গিয়েছিলো যে সে সাবিনাকে বিয়ে করে নেয়। অন্যদিকে স্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার শোকে খলিল পুরোপুরি ভেঙে পড়ে৷ সে ছোট মেঘাকে তার বাবা, মা অর্থাৎ মেঘার দাদা, দাদীর কাছে দিয়ে নিজে সারাদিন জুয়া, নেশা নিয়ে পড়ে থাকতো। ততদিনে এসবে আসক্ত হয়ে গেছে খলিল। এভাবেই একদিন নেশার টাকা চুরি করতে গিয়ে পাবলিকের গনধোলাই খেয়ে মা রা যায় খলিল। আর মেঘা। দাদা, দাদীর কাছে অবহেলা অনাদারে বড় হয়। ছেলেকে হারিয়ে দাদী মেঘাকে সহ্য করতে পারছিলো না। তার সমস্ত রাগটা ছিলো সাবিনার উপর। তবে সেটা প্রকাশ করতে না পেরে মেঘার উপর সব ঝাড়ে। কারণ সাবিনা যে পাশে ছিলো না। এভাবেই অনাদার অবহেলায় মেঘা বড় হয়। একটা সময় দাদা, দাদী মা রা গেলে জায়গা হয় চাচা, চাচীর ঘরে। তবে সেটা কাজের মেয়ে হিসাবে। সারাদিন ঘরের সমস্ত কাজ সে করতো। বিনিময়ে তাকে দু’বেলা খাবার দিতো। সেই সঙ্গে গালি ফ্রী। বে…. মেয়ে বে…। সাবিনার নোংরামির বর্ননা শুনতে শুনতে মার খেতে খেতে বড় হয় মেঘা। তার পুরো জীবনটা চোখের পানি বিসর্জন দিতে দিতে শেষ হয়। একটা সময় পর গার্মেন্টস চাকরি নেয়। দুই পয়সা রোজগার করার পর সে একা থাকতে শুরু করে। শুধুমাত্র ভালো থাকার জন্য। তবে সেটাও থাকতে পারছিলো না। এই সমাজে মানুষ যে গার্মেন্টস কর্মীদের ভালো চোখে দেখে না। এখানে যেসব মেয়ে আসে সেসব ভদ্র সমাজে বে…. হিসাবেই পরিচিতি পায়। তবুও সবকিছু সহ্য করে মেঘা সব মেনে নেয়। নিজের জীবনটা মেনে নেয়। চাকরি ক্ষেত্রেই তার পরিচয় হয় মৌমিতার সঙ্গে। দু’জনে অনাথ হওয়ায় ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে একে-অপরের সঙ্গে। অতঃপর টাকা বাঁচাতে দু’জনে একসঙ্গে থাকা শুরু করে। এসব কিছুর মধ্যে মেঘার হৃদয়ে এক আকাশ সমান ঘৃণা জন্মায় সাবিনার উপর। সাবিনা খলিলকে না ছেড়েই গিয়ে আর একটা বিয়ে করেছে। সে ভালো আছে। অথচ তার জন্য মেঘার পুরোটা জীবন মানুষের ঘৃণায় কেটেছে। রাগ, ঘৃণা মিলিয়ে মেঘার হৃদয়ে প্রতিশোধের আগুন জেগে উঠে। তার মনে হয় সাবিনা যতদিন ভালো থাকবে ততদিন সে কখনো সুখী হতে পারবে না। সে সুখী হতে পারবে একমাত্র সাবিনার দুঃখে।

অতঃপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেঘা সাবিনার ঠিকানা পেয়ে যায়। সে তার সম্পর্ক সব জেনে যায়। সাবিনা দুই সন্তানকে নিয়ে এত সুখে জীবন কাটাচ্ছে দেখে তার হিংসা হয়। এরকম হিংসা তার চাচীর সময়ও হতো। তার যেই চাচী তাকে কু কুরের মতো মা রতো সেই চাচী নিজের মেয়েকে কতটা আদর যত্ন নিয়ে বড় করেছে। ঘরের নূন্যতম কাজ তাকে দিয়ে কখনো করায়নি। এই তো একদিন চাচাতো বোন ভাত খেয়ে থালাটা রেখে দিয়েছিলো। পরে খাবার খাওয়ায় মেঘার সেটা ধুয়ে রাখতে মনে ছিলো না। সেজন্য কত মেরেছে৷ মেঘা সেদিন ভুল করে বলেছিলো, এই সমান্য জিনিসটা তো বোন করতে পারতো। সেজন্য তার চাচী গালি দিয়ে বলে,“ওর মা কি তোর মায়ের মতো নাগর ধরা। বে….গিরি করে বেড়ায় যে ওর ধুয়ে রাখতে হবে। কু ত্তার বাচ্চা ও আমার মেয়ে। রাজরানীর মতো বড় হবে।”

সবার সন্তান সবার কাছে রানীর মতো। শুধুমাত্র মেঘাই হলো না তার মায়ের রানী। তার মায়ের আদরের। সে ভেবেছিলো তার মা অর্থাৎ সাবিনা বুঝি সন্তানদের মায়াই বুঝে না। কিন্তু না। রানা এবং রিমার সঙ্গে তার ভালোবাসা দেখে মেঘা বুঝে যায়, তার মায়ও মা হিসাবে ভালো। তবে সেটা শুধুমাত্র রানা এবং রিমার জন্য। কারণ তারা তার সন্তান। কিন্তু মেঘা সন্তান নয়। মেঘাকে বাধ্য হয়ে জন্ম দিয়েছে৷ তাই তো এক বছরের মেঘাকে রেখে পালিয়ে আসতে সে দু’বার ভাবেনি৷ সাবিনার এই সুখ মেঘার সহ্য হয় না। একদম না। তার মনে হয়, তার দুঃখের উপরে সাবিনা নিজের এই সুখের গল্প লিখেছে। এবার সময় এসেছে, মেঘার সুখের। যেই সুখ সাবিনার দুঃখের বিনিময় আসতে পারে। সাবিনা যেমন তার দুঃখের উপরে দাঁড়িয়ে নিজের সুখের গল্প লিখেছে সেভাবে সেও সাবিনার দুঃখের উপর দাঁড়িয়ে নিজের সুখের গল্প লিখবে৷

একদিকে মেঘার যেমন দুঃখের জীবন ছিলো অন্যদিকে সত্যি সাবিনা সেই দুঃখেই নিজের সুখের গল্প লিখেছে। সে আলতাবের সঙ্গে পালিয়ে এসে বিয়ে করে। যদিও আলতাব চাচ্ছিলো না। তবে সাবিনা খুব চতুর মহিলা ছিলো। সে বাচ্চা নিয়ে থানায় যাবে, এখানে ওখানে যাবে আলতাবের মান সম্মান সব শেষ করবে। এরকম নানা ভয় এবং কৌশল করে তাকে বিয়ে করে নেয়। তাদের বিয়ে হয়ে গেলেও আলতাবের সন্দেহ হচ্ছিলো সাবিনার গর্ভের বাচ্চা তার না৷ যদিও সাবিনা নিশ্চিত ছিলো এটা আলতাবের। কারণ মেঘার জন্মের পর সে খলিলের সঙ্গে কখনো শারীরিক সম্পর্ক গড়েনি। তবে আলতাবের যেহেতু সন্দেহ হচ্ছে এবং অন্যের সন্তান সে বড় করতে পারবে না। বাবার পরিচয় দিতে রাজি নয় তখনও সাবিনা খুব কৌশলে বাচ্চা নষ্ট করার কথা এবং তার রূপ যৌবনের মোহ দেখিয়ে আলতাবের বাড়ি এবং কিছু জমি লিখে নেয়। আলতাব সবকিছুতে রাজি হয়৷ তার রাজি হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ সাবিনা তাকে বাহিরে যা ইচ্ছা করার স্বাধীনতা দিয়েছে৷ শুধুমাত্র কাউকে সাবিনার স্থানে নিয়ে আসা যাবে না মানে বিয়ে করা যাবে না। এত স্বাধীনতা পেয়ে কে বা না করবে। তাই সব লিখে দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে সব লিখে নেয় সাবিনা। যে কারণে দ্বিতীয়বার আর আলতাব বিয়ে করতে পারেনি। বিয়ের ইচ্ছে জাগলেও হয়নি৷ সাবিনা ঘর থেকে তাড়ানোর ভয় দেখাতো। আলতাবও এসবে বুঝতে পারে সাবিনারও অন্যসব মেয়ের মতো তার সম্পদেরই প্রয়োজন ছিলো সুখে থাকার জন্য। তাই তো তাকে যা ইচ্ছা করার অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ আলতাবের চরিত্রে তার সমস্যা ছিলো না। আলতাব এবং সাবিনা একই চরিত্রের বলেই বোধহয় তাদের মিল হয়েছে।

এসবও মেঘা জানতে পারে। তাই তো সে মৌমিতাকে দিয়ে প্রথমে আলতাবকে প্রেমে ফেলে। অতঃপর বিয়ের স্বপ্ন দেখায়৷ মেঘা এবং মৌমিতা আগেই জানতো সব সম্পত্তি সাবিনার নামে। বিয়ের কথা বললে আলতাব এটা বলবে। এই কথার পরই সব মেয়ে তাকে ছেড়ে যেতো৷ কারণ যার কিছু নেই তাকে কেন বিয়ে করবে? তবে মৌমিতা এবং মেঘাতো তাদের সম্পত্তি নয় চাচ্ছিলো তাদের বিচ্ছেদ। সমাজে তাদের ছোট করতে৷ তাই মৌমিতা যে লোভী নয় এবং তার নিজেরই প্রচুর টাকা রয়েছে এমনটা বলে খুব কৌশলে আলতাবকে ফাঁসায়। এতদিন আলতাব এবং সাবিনার সঙ্গে যা হয়েছে সবই মেঘার পরিলকল্পনা ছিলো। মেঘা তাদের চরিত্রটাই শুধু সবার সামনে তুলে ধরেছে। এখানে বাড়তি কিছুই করেনি।

অতীতের এসব স্মৃতিচারণ করে মেঘা একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ মৌমিতা এসে তার পাশে বসে তার কপালে চুমু দিয়ে বলে,“মনে কোন দ্বিধা কাজ করছে না তো?”

“না।”
এটা বলে মেঘা মৌমিতার দিকে শান্ত চোখে তাকায়। শীতল গলায় বলে,“আমার এত বছরের জীবনে প্রথমবার আমার ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে।”

এটা শুনে মৌমিতা মুচকি হাসি দেয়। মেঘাও হাসে। দু’জনের এই মিষ্টি হাসির মাঝে মৌমিতার ফোনটা বেজে উঠে। সে ফোনটা ধরে যা শুনে তাতে খুশি হয়ে যায়। মেঘা তার খুশি দেখে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকাতে মৌমিতা বলে,“তুই দারোয়ানকে যত টাকা দিতে বলছিলি আমি তার চেয়ে একটু বাড়িয়ে দিয়ে তাকে দিয়ে সাবিনার মুখোশটা খুলে দিয়েছি। সে যে পরকীয়া করে আলতাবকে বিয়ে করেছে, তার আগের ঘরে সন্তান ছিলো সব প্রকাশ করে দিয়েছি। এই ঘটনার পর বিল্ডিং এ সাংবাদিক আসে। তারা সাবিনার সঙ্গে তো কথা বলতে পারেনি তবে দারোয়ানসহ বাকিদের সাথে কথা বলে। তাতেই সব কাজ হয়ে যায়।”
মেঘা এটা শুনে খুশি হয়েও হয় না। ম্লান গলায় বলে,“রানা এবং রিমা দোষ না করেও ভোগান্তিতে পড়লো।”
এটা শুনে মৌমিতা চুপ হয়ে যায়। সে মেঘাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শান্ত গলায় বলে,“বড় কিছু পেতে হলে ছোট ছোট বলিদান দিতেই হয়। তবেই তো একটা বিনিময় পূর্ণতা পায়।”
মেঘা মাথা নাড়ায়। অতঃপর দু’জন লম্বা এক ঘুম দেয়। এই ঘুম ভাঙলে তাদের জন্য নতুন এক সকালের আগমন ঘটবে। যেই সকাল তাদের দুজনার জন্যই নতুন এবং প্রানবন্ত। হয়তো এই ভোরের আড়ালে তাদের অতীতের এই ভয়াবহ বিনিময়ের গল্প চাপা পড়ে যাবে৷ তারা চাপা দিতেই লম্বা ঘুম দেয়। দুঃখ বিনিময়ের মাধ্যমে তারা যে সুখ পেয়েছে সেটা যে তারা আর মনে রাখতে চায় না। তাই তো নতুন ভোরের নতুন আলোর সঙ্গে সব বিনিময়ের গল্প চাপা দিতে হয়।

(সমাপ্ত)