বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব-৪৫+৪৬

0
481

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৫
জাওয়াদ জামী

গভীর রাতে কুহুর ঘুম ভাঙ্গলে আবিষ্কার করল, তাহমিদ এখনও জেগে আছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসে কুহু। অতঃপর ঘড়ির দিকে তাকায়।

” আপনি এখনও জেগে আছেন! রাত তিনটা বাজে, অথচ আপনি ঘুমাননি! এমন পাগলামো কেন করেন? দয়া করে এবার শুয়ে পরেন। ” কুহু তাহমিদের হাত ধরে শোয়াতে গেলেই, তাহমিদ কুহুর হাত ধরে ফেলে, এক হ্যাঁচকায় নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

” নি’ষ্ঠু’র বউ আমার। এখন আমি ঘুমালে তোমাকে আদর করবে কে! এতক্ষন তোমার জাগার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন আমার সাথে তোমাকেও জাগতে হবে। কাল দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে রাতের ঘুম পুষিয়ে নিব। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুক ধুকপুক করতে শুরু করে।
ও কিছু বলার জন্য মুখ খোলে। কিন্তু তাহমিদ ওকে কিছু বলার সুযোগ দেয়না।

সকালে বিছানা থেকে নামতেই কুহুর মাথায় চক্কর দেয়। পুরো শরীরে ব্যথারা রাজত্ব করছে। সেই সাথে একটু জ্বরের অস্তিত্বও টের পাচ্ছে।
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। নিজেকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দেয়। এরপর উঠে ওয়াশরুমে ঢোকে।

ফজরের ওয়াক্ত সেই কখন শেষ হয়েছে। এখন কাযা নামায আদায় করতে হবে। এদিকে তাহমিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তার উঠার কোন নামই নেই। কুহু তাহমিদকে ডাকতে যেয়েও ডাকেনা। জায়নামাজ নিয়ে কাযা নামায আদায় করতে দাঁড়িয়ে যায়।

সকাল আটটা বেজে গেছে। কুহু বাইরে বেড়োতে ভিষণ লজ্জা পাচ্ছে। তাহমিদকে ডেকে লাভ হয়নি, সে জানিয়েছে ঘুম থেকে এখন কিছুতেই উঠবেনা। কিভাবে সবার সামনে যাবে সেই চিন্তাতেই ওর মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ওকে এই অবস্থা থেকে নিস্তার দিতেই দরজায় নক করে সিক্তা। চিল্লাতে চিল্লাতে বলে দরজা খুলতে।

কুহু দরজা খুলে দিলে সিক্তা নাচতে নাচতে রুমে ঢোকে।

” এই-যে নতুন বউ, সকাল আটটা পার হয়ে গেছে অথচ তুই নিচে যাসনি, ঘটনা কি? দিদুন তোকে ডাকছে। এক্ষুনি নিচে চল। ”

” এই সিক্তা, ফুপা বাসায় আছে? আর আমার শ্বশুর বাবা? শোন ফুপা অফিসে না যাওয়া পর্যন্ত আমি নিচে যাবনা। আমার ভিষণ লজ্জা করছে। আর শোন বাবাকে মানে আমার শ্বশুর বাবাকে বাজারে পাঠিয়ে দে কিছু কিনতে। আর তোর মামাকেও পাঠাবি। তারা থাকলে আমি নিচে যেতে পারবনা। ”

” ওরে লজ্জাবতী রে। কবুল বলার সময় এই লজ্জা কোথায় ছিল! যখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে কাকিমনির সাথে এই রুমে আসলি, তখন লজ্জা করেনি? কাল বিয়ে হয়েছে কিন্তু লজ্জা পাচ্ছে আজ! ”

” এই বুঁচি, শোন। তুই এই মেয়েকে নিয়ে যেয়ে নর্দমার পানিতে চুবিয়ে আন। এতে যদি তার লজ্জা পালায়। সেই কখন থেকে লজ্জা লজ্জা করে আমার মাথা খাচ্ছে। একবার নর্দমার পানি খেলে দেখবি সব লজ্জা পালাবে। ” তাহমিদ পাশ ফিরতে ফিরতে কথা বলে।

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর নিচে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। মুখ কালো করে সিক্তার সাথে সুড়সুড় করে নিচে যায়।

” এই যে আমার মেয়ে এসে গেছে। এদিকে আয়, দেখত পায়েস খেতে কেমন হয়েছে। তোর জন্য আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। ” কুহু রান্নাঘরে এসে দাঁড়াতেই তাহমিনা আক্তার হেসে বলেন।

কুহু একটা বাটিতে একটু পায়েস নিয়ে মুখে দেয়।

” অসাধারণ হয়েছে, মা। তোমার হাতের পায়েস সত্যিই অনেক মজার। অনেক ভালোবাসা মা, আমার জন্য কষ্ট করে পায়েস বানিয়েছ। ”

” আমার কোন কষ্ট হয়নি। আনন্দ নিয়ে আমার মেয়েটার জন্য পায়েস বানিয়েছি। আরেকটু নে। এরপর একটা পরোটা খা। পরে তোর শ্বশুর, ফুপা বাইরে থেকে আসলে তাদের সাথে আবার খাবি। ”

” বাবা, ফুপা কোথায় গিয়েছে, মা? ”

” আমার ছোট বেয়াই তার মেয়ের শ্বশুর বাড়ির জন্য বাজার করতে গেছে । তার সাথে গেছে তোর শ্বশুর আর ফুপা। ”
তাহমিনার কথার ধরন শুনে কুহু ফিক করে হেসে দেয়।

” আমি এখন কিছু খাবনা, মা। বাবারা আসুক, একবারে তাদের সাথেই খাব। কিন্তু তুমি রান্নাঘরে একা কেন! ফুপু কোথায়? আমাকে বল দেখি কি করতে হবে। ”

” তোর ফুপু বোধহয় ছাদে গেছে। এখনই এসে যাবে। আর তোর কিছু করতে হবেনা। আমার পাশে বসে থাক তাহলেই হবে। ”

” শুধু শুধু বসে থাকতে ভালো লাগে! কিছু একটা কাজ দাও। আমি করে দিচ্ছি। ”

” তোকে কিছু করতে হবেনা। তারচেয়ে বরং আমার সাথে গল্প কর। ”

” সোনা মা, ঘুম থেকে উঠেছিস। অনেক বেলা হয়েছে কিছু খেয়ে নে। এখন থেকে নিজের ইচ্ছেমত খাবার খাবি। আগেরমত যেন ডেকে খাওয়াতে না হয়। শ্বশুর-শ্বশুড়িকে খেতে দিবি। দিদুনের দিকে নজর রাখবি। এখন আর তুই এই বাড়ির মেহমান নেই। এই বাড়ির বউ হয়েছিস। নিজের পাশাপাশি সবার খেয়াল রাখতে শিখতে হবে। ” তাহমিনা আক্তারের কথার মাঝেই আফরোজা নাজনীন এসে কুহুতে কথাগুলো বললেন।

” ওকে কিছু শেখাতে হবেনা, ভাবি। আপনার মত ফুপু যে মেয়ের আছে তাকে কিছুই শেখাতে হয়না। শুধু শুধু মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছেন। ওর এখন এসব কিছুই করতে হবেনা। আগে পড়াশোনা শেষ করুক তারপর সবাইকে সামলাবে। এখন আপাতত আমার ছেলেটাকে সামলাক। আর কিছুই চাইনা আমি। ”

” সোনা মা, তোর শ্বাশুড়ির কথা মাথায় নিবিনা একদম। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের দিকেও নজর দিতে হবে। তাছাড়া দেখবি তাহমিনা তোকে অলস বানিয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা শোন, তাহমিদ কিছু বলেছে তোকে? রা’গ করেছে তোর ওপর? গতকাল সবুজের ওপর খুব রে’গে’ছি’ল। আমার ভয়ই হচ্ছিল ওর রাগ তোর ওপর না দেখায়। ”

” উনি আমাকে সেই বিষয়ে কিছুই বলেননি। আমিই বরং কথা তুলেছিলাম। কিন্তু সে আমার কথা শুনতেই চায়নি। একদম ঠান্ডাভাবে আমাকে সেসব কথা বলতে নিষেধ করেছে। ”

” তাহমিনা, আমার ভিষণ চিন্তা হচ্ছে। তাহমিদের রা’গ সম্পর্কে আমরা জানি। সেকি মনে মনে কিছু পরিকল্পনা করছে! সবুজকে ছেড়ে দেয়ার ছেলে ও নয়। যতই ওর বড় চাচ্চু ওকে বোঝাক। তার কথা যে তাহমিদ আমলে নেয়নি সেটা আমি কালই বুঝতে পেরেছি। ”

” এই চিন্তা আমিও করছি, ভাবি। ও ঘুম থেকে উঠলেই আমি কথা বলব ওর সাথে। যে করে হোক ওকে বুঝাতেই হবে। ”

ড্রয়িংরুমে সানাউল রাশেদিনের কথা শুনতে পেয়ে তাদের আলোচনা থেমে যায়। আফরোজা নাজনীন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে যান।

দুপুরের খাবার পর কায়েস বিদায় নেয়। ছেলেকে নিয়ে রওনা দেয় ফুলতলার পথে। কুহু বাবার যাওয়ার সময় কেঁদে ফেলে। শিহাবও কাঁদছে। ওর ইচ্ছে নেই আজকে যাওয়ার। কিন্তু বাবাকে একা যেতে দেয়ার সাহস নেই ওর। তাই বাবার সাথে অনিচ্ছায় ওকেও যেতে হল।

কায়েস বাড়িতে ফিরে দেখল সবুজ এখনও সেখানেই আছে। সবুজকে দেখেই তার মাথায় র’ক্ত চড়ে যায়। এদিকে রাত দশটার মত বেজে গেছে। তাই এত রাতে সে কোন ঝামেলা চায়না বলে, সবুজকে কিছুই বলেনা।
দৃষ্টি বাবার কাছে থেকে জানতে চায়, ফুপু কেন যেতে বলেছিল?
কায়েস জানায়, কুহুর বিয়ের জন্য যেতে হয়েছিল। গতকালই তাহমিদের সাথে কুহুর বিয়ে হয়েছে। কায়েস কথা বলতে বলতে সবুজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। সে ভালোভাবে খেয়াল করল, কুহুর বিয়ের কথা শুনেই সবুজের চোখমুখে একটা হিং’স্র’তা ফুটে ওঠে, তা আবার মুহুর্তেই মিলিয়ে যায়। সবুজের এই আচরণই কায়েস বুঝে নেয়, এই ছেলেটার মনে পাপ আছে।
কুহুর বিয়ের কথা শুনে দৃষ্টি খুব খুশি হয়। আবার আফসোস করে, একটামাত্র বোনের বিয়েতে থাকতে পারলনা দেখে। শিউলির মুখে কোন কথা নেই। কুহুর এতবড় বাড়িতে বিয়ে হয়েছে শুনে তার একটু হিং’সা হয়।
শিহাব বোনকে দেখায় তাহমিদ ওকে কতকিছু কিনে দিয়েছে।

পরদিন সকালে খাবার পর দৃষ্টি বাবার কাছে থেকে বিদায় নেয়। ওরা এখনই বেড়িয়ে পরবে। দৃষ্টি আজকাল বাবাকে না দেখে থাকতে পারেনা। বিয়ের আগে এই টান কখনোই অনুভব করেনি।

” আব্বু, তুমি একদিনও আমার শ্বশুর বাড়িতে গেলেনা। আম্মুকেও যেতে দিলেনা। একদিন তোমরা সবাই মিলে সেখানে যেও। ”

” আমরা কখনোই সেখানে যাবনা, মা। তোর মন খারাপ করলে তুই একা চলে আসবি। তোর বাবার বাড়িতে আসতে হলে কাউকে লাগবেনা। আমাকে ফোন করলেই আমি সিএনজি পাঠিয়ে দিব। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি তুই ঐ বাড়িতে থাক এটা আমি চাইনা। তুই লেখাপড়া করলে একটা যোগ্য ছেলের হাতে তোকে তুলে দিতে পারতাম। তবে যদি মনে করিস চলে আসবি, তবে আমাকে জানাস। যা ব্যবস্থা করার আমি করব। ” কায়েস সরাসরি জানিয়ে দেয় সবুজকে তার পছন্দ নয়। এবং সবুজকে এখানে আসতে পরোক্ষভাবে নিষেধ করে।

সবুজ বুঝতে পারে কায়েস ওকে এই বাড়িতে আসতে মানা করল। ও রাগে ফুঁসতে থাকে।
দৃষ্টি বাবার কথা শুনে চোখের পানি ফেলে। আজ বাড়ি গেলে সবুজ এ নিয়ে বেশ অশান্তি করবে এটা বুঝতে পারছে।
শিউলি আক্তার স্তব্দ। এ কি বলছে তার স্বামী! মেয়ের জামাইকে আসতে নিষেধ করছে!

সেদিন থেকেই কায়েস গোপনে তার শুভাকাঙ্ক্ষী কয়েকজনকে সবুজের ব্যাপারে সকল তথ্য সংগ্রহ করতে বলে। তারাও রাজি হয়।

তাহমিদ, কুহু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চলছে তাদের দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি। তাহমিদ যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ কুহুকে এক সেকেন্ডের জন্যও কাছ ছাড়া করেনা।
তবে এরমাঝে একদিন ফ্রি ক্যাম্পিংয়ের জন্য তাহমিদ ঢাকার বাইরে গিয়েছিল। একদিন পরেই আবার ফিরে এসেছিল।

পঁচিশ দিন হলো কুহুর বিয়ের। তাহমিদ আজ মেডিকেলে যাবার সময় বলে গেছে, বিকেলে কুহুকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। মেডিকেল থেকে এসে কুহুকে যেন তৈরি হয়ে থাকতে দেখে। তাহমিদের আসার আগেই কুহু তৈরি হয়ে নেয়। হালকা বাদামী শাড়ি পরেছে ও। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে হিজাব বাঁধবে। আলমিরা থেকে হিজাব বের করতেই একটা বক্সের দিকে চোখ যায়। যেটা বিয়ের পরদিন থেকেই দেখে আসছে। কিন্তু ভেতরে কি আছে তা দেখেনি। আজ কৌতুহলী হয়ে সেই বাক্সটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে।
বাক্সটা খুলেই কুহু হতবাক হয়ে যায়।
অনেকগুলো শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলি ফুল। তাহমিদের দেয়া সেই প্যাকেট যা কুহু সেই রাতে ছাদে তাহমিদকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কুহুর একটা পুরোনো ওড়না। চুলের কাঁটা। তবে এতকিছু আপাতত কুহুর চোখে পরছেনা। ওর চোখতো শুকনো ফুলগুলোর দিকে। এইগুলো সেইসব ফুল নয়, যেগুলো কলেজের সামনে প্রতিদিন অজানা কেউ ফুলওয়ালী মেয়েটাকে দিয়ে পাঠাত! সেসব ফুল রাগে কুহু ছুঁড়ে ফেলত!
আজ তাহমিদের বলা সেই কথা কুহুর পরছে। যে রাতে প্যাকেটটা ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাহমিদ বলেছিল, একদিন তুমি এসবের জন্য অনুশোচনা করবে। আজ সত্যিই কুহুর অনুশোচনা হচ্ছে।

তাহমিদ বাসায় এসে ফ্রেস হয়েই কুহুকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। অনেকবার বলার পরও খায়না। কুহু আজ বায়না ধরেছে রিক্সায় ঘুরবে। তাহমিদ বাধ্য হয়ে রিক্সা নিয়েছে। কুহু তাহমিদকে বলে ওর পুরোনো কলেজের সামনে যেয়ে ঝালমুড়ি খাবে। তাহমিদ কুহুর নির্দ্দেশ মত রিক্সাওয়ালাকে কলেজের সামনে নিতে বলে।
সেখানে পৌঁছেই কুহু এদিকওদিক তাকায়। তাহমিদ ভ্রু কুঁচকে কুহুর কান্ডকারখানা দেখছে।
একসময় কুহুর নজর যায় সেই ফুলওয়ালী মেয়েটা আসছে। মেয়েটা একটু এগিয়ে আসতেই কুহু ওকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে।
মেয়েটা কাছে আসলে কুহু তাহমিদকে বলে ফুল কিনে দিতে।
এদিকে সেই মেয়েটা পালাক্রমে দুজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সে খুব অবাক হয়েছে, এটা বোঝাই যাচ্ছে।

” তোমার কাছে প্রতিদিন এই ভাইয়াই ফুল পাঠাত আমাকে দেয়ার জন্য? ” কুহু মিটিমিটি হেসে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে।
মেয়েটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।
” এই ভাইয়াই বখাটে ছেলেদের পি’টি’য়ে’ছি’ল?”
মেয়েটি আবারও মাথা নাড়ায়।

তাহমিদ কিছু না বলে মেয়েটির কাছ থেকে সবগুলো ফুল কিনে নেয়।

” শোন ছোট্ট আপু, আগে লুকিয়ে তাকে ফুল দিতাম, আজ তার সামনেই তাকে ফুল কিনে দিচ্ছি। তাকে বলে দাও, আমি তাকে অনেক ভালোবাসি। এই ফুলগুলো একদিন শুকিয়ে যাবে, এদের ঘ্রান মিলিয়ে যাবে। কিন্তু আমার ভালোবাসা ফুরাবার নয়। ”

তাহমিদ ফুলের পেছনে অনেক টাকা খরচ করেছে জন্য কুহু আর দূরে কোথাও যায়না। কাছের একটা পার্কে বসে সারা বিকেল কাটিয়ে দেয়। মাগরিবের আজানের সময় ওরা বাড়ি ফিরে।

পরদিন দুপুরে কুহু ফুপুর কাছ থেকে শুনলো, সবুজকে কারা যেন খুব মে’রে’ছে। ওর দুই হাত, একটা পা মে’রে ভেঙে দি’য়ে’ছে পাঁজরের দুইটা হাড় ভেঙেছে। মাথা থেঁ’ত’লে দিয়েছে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ওকে রাজশাহী মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা ওকে মে’রে’ছে তার কোন হদিস মেলেনি।

দৃষ্টি বাবার কাছে এসে হাউমাউ করে কাঁদছে। সবুজের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। ওর শ্বশুর বারবার দৃষ্টিকে বলছে বাবার বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসতে। সেই সাথে এ-ও বলে দিয়েছে, টাকা নিয়ে গেলেই দৃষ্টি সবুজকে দেখতে পাবে। তার আগে নয়। দৃষ্টি বাবার কাছে এসে টাকা চাইলে কায়েস টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
শিউলি আক্তার কায়েসের কাছে অনেক অনুরোধ করেছে। তবুও কায়েস তার সিদ্ধান্তে অটল। বাধ্য হয়ে শিউলি আক্তার তার কাছে জমানো যে কয়েকটা টাকা ছিল, সেগুলো দৃষ্টিকে দেয়।

রাতে তাহমিদ বাসায় আসলে কুহু তাকে জানায় সবুজের কথা। কুহুর কথা শোনামাত্র তাহমিদ ওর দিকে চোখ গরম করে তাকায়।

” ঐ জা’নো’য়া’র’টা’র জন্য তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে! দেখতে যাবে তাকে? তাহলে চল নিয়ে যাই। নাকি ঢাকায় নিয়ে এসে তার চিকিৎসা করাব। আমাকে বল। সে অনুযায়ী কাজ করব আমি। ”
কুহু বুঝতে পারে তাহমিদ রেগে গেছে। তাই ওকে না ঘাঁটিয়ে বই নিয়ে বসে।

তাহমিদ পেছন থেকে জাপটে ধরে কুহুকে।

” বউ, আমাদের দুজনের মধ্যে কখনোই ঐ হা’রা’মী’টা’কে নিয়ে এসোনা। ওর কথা শুনলেই আমার মাথার ভেতর দা’উ’দা’উ করে আ’গু’ন জ্বলে উঠে। ও জাহান্নামে যাক। তাতে তোমার কি! যার যার কর্মফল সে সে পাবে। যতটুকু সময় আমি বাসায় থাকব, সে সময়টুকু শুধুই উপভোগ করবে। আমাকে বেশি বেশি ভালোবাসবে। তারথেকেও বেশি আমার ভালোবাসা নিবে। কোন বাজে মানুষের কথা মুখে এনে সময়টা কখনোই নষ্ট করবেনা বুঝলে? ”

কুহু বেশ বুঝতে পারছে লোকটা আজ রোমান্টিক মুডে আছে। আর তার রোমান্টিক মুড মানেই কুহুর পড়াশোনার বারোটা বাজবে।

সবুজের অবস্থার একটু উন্নতি হলে, তার মা জানায় ওর শ্বশুর বাড়ি থেকে কেউ দেখতে আসেনি। এমকি চিকিৎসার জন্য একটা টাকাও দেয়নি। সে ইচ্ছে করেই শিউলি আক্তার দৃষ্টিকে যে টাকা দিয়েছে তার কথা গোপন রাখে।
সবুজ মায়ের কথা শুনে গর্জে উঠে। ওর মনে পরে কিছুদিন আগেই কায়েস ওকে ফুলতলা যেতে নিষেধ করেছে।

” আমি আগে সুস্থ হই , মা। তারপর ওদের শিক্ষা দিব। ওরা আমাকে এখনও চিনেনা। সুস্থ হওয়ার পর ওদের চিনিয়ে দিব আমি কি। ”

” তোর বউয়ের সাহস কত দেখ, আমি হাজারবার বলার পরও সে তোকে দেখতে আসলনা। ” সবুজের মা মিথ্যা বলে দৃষ্টির নামে। অথচ দৃষ্টি সবুজকে দেখতে আসার জন্য পাগল হয়ে গেছে।

” ঐ হা’রা’ম’জা’দি’র তেজও আমি কমাতে জানি। তার বাপ মুখের ওপর নিষেধ করল আমাকে ঐ বাড়িতে না যেতে। কিন্তু সে কিছুই বলেনি, সেই কথা আমি ভুলিনি। আমার সেই অপমানের প্র’তি’শো’ধ আমি নিয়েই ছাড়ব। একবার খালি সুস্থ হই। ”

দৃষ্টি চেয়ারম্যান বাড়িতে একা একা ছটফট য।কেউই ওকে সবুজের কাছে নিয়ে যায়না। শিউলি যে দশ হাজার টাকা দিয়েছিল, তা সে ওর শ্বশুরের কাছে সেদিনই দিয়েছে, তবুও সে দৃষ্টিকে সবুজের কাছে যেতে দেয়নি।

দেখতে দেখতে কেটে গেছে দুইমাস। এরই মধ্যে কুহু আর তাহমিদ এসে ফুলতলা ঘুরে গেছে । ওরা সকালে এসে বিকেলেই ফিরে গেছে। কুহু থাকতে চাইলেও তাহমিদ থাকেনি। ওর একটাই কথা কুহুকে কখনো এখানে রাতে থাকতে দিবেনা।

সবুজও এরইমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছে। ও বাড়িতে ফিরেই দৃষ্টির সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করেছে। দৃষ্টির বাবা-মা কেন ওর কোন খোঁজ নেয়নি কিংবা চিকিৎসার টাকা দেয়নি, সেসব নিয়ে দৃষ্টিকে অত্যাচার করছে। দৃষ্টি অনেক বলেও কোন কাজ হয়নি।

কায়েস এই দুইমাসে সবুজের বিরুদ্ধে অনেক প্রমান সংগ্রহ করেছে। সে যে ছয় লাখ টাকা সবুজকে ব্যবসার জন্য দিয়েছিল তা সবুজ পুরোটাই জু’য়া খেলে, ম’দ খেয়ে উড়িয়েছে। এই খবরও পেয়েছে। এবং শিউলি আক্তারের গহনাও যে সবুজ চুরি করেছিল, সেই কথাও কায়েস জানতে পারে। সবুজের বিরুদ্ধে যতটুকু প্রমান সংগ্রহ করেছে, সেগুলো সবুজের আজীবন জেলে পঁচে ম’রা’র জন্য যথেষ্ট।

সেদিন বাড়িতে এসে কায়েস শিউলির কাছে তার গহনাগুলো দেখতে চায়। কিন্তু শিউলি দেখাতে পারেনা। কায়েসের ধমকে এবং তার রাগ দেখে শিউলি অবশেষে স্বীকার করে তার গহনাগুলো দৃষ্টিকে পরার জন্য দিয়েছিল। পরে সেগুলো হারিয়ে গেছে।
কায়েস এবার আর নিজেকে সামলাতে পারেনা। সপাটে কয়েকটা থা’প্প’ড় মারে শিউলির গালে।
শিউলির দাঁড়িয়ে থেকে থা’প্প’ড় হজম করা ছাড়া কোন পথ নেই।

রাত একটা বেজে গেছে অথচ সবুজ এখনও বাড়িতে ফিরেনি। দৃষ্টি বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে।
দৃষ্টির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একসময় সবুজ বাড়িতে আসে। টালমাটাল অবস্থায় ঘরে ঢুকে।
তার অবস্থা দেখে দৃষ্টি বুঝতে পারে, সে ম’দ খেয়ে এসেছে। এবং তখনই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে বসল দৃষ্টি।

” তুমি ম’দ খেয়ে বাড়িতে এসেছ? আমি তোমার জন্য সেই সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছি। কিছুদিন আগেও তুমি অসুস্থ ছিলে সেই চিন্তা করেছ? একটুও লজ্জা কি তোমার নেই? ” সবুজের সাথে চিৎকার করে বলতে থাকে দৃষ্টি।

” হা’রা’ম’জা’দি, কু’ত্তা’র বাচ্চা, তোর এতবড় সাহস, আমাকে ধমক দেস! আমি যা খুশি তাই করব, তুই বলার কে? আমি তোর বাপের টাকায় ম’দ খাই, যে তুই এত কথা বলবি? ” দৃষ্টির চুলের মুঠি ধরে, তলপেটে একটা লাথি দিয়ে বলে সবুজ।

ওর মত দশাসই মানুষের লাথি দৃষ্টি সহ্য করতে পারেনা। ছিটকে পরে যায় মেঝেতে। ব্যথায় নীল হয়ে যায় ওর ফর্সা মুখ। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরতে থাকে।
দৃষ্টির চোখের পানি দেখেও সবুজের দয়া হয়না। মেঝেতে পরে থাকা দৃষ্টিকে এলোপাতাড়ি লা’থি মারতে থাকে।

” আর আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে আসবি? খু’ন হতে না চাইলে, আজ থেকে চুপ করে থাকবি। তোর ঐ হা’রা’মী বাপকে আমি পথে বসাব। আমাকে তার বাড়িতে যেতে নিষেধ করে! তার অ’হ’ঙ্কা’র যদি আমি পায়ে না পি’ষে’ছি তবে আমার নাম সবুজ না। ” কায়েসকে আরও অ’শ্রা’ব্য গালিগালাজ করতে থাকে সবুজ।

দৃষ্টি নিজের বাবার নামে এরূপ গালিগালাজ শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

” তুমি আমাকে যা বলছ বল। কিন্তু আমার আব্বুকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবেনা। তাহলে ভালো হবেনা বলে দিলাম। ” নিস্তেজ গলায় বলে দৃষ্টি।

” তোর বাপকে আরও গালি দিব। তুই কি করবি? তোর বাপের চৌদ্দ গোষ্ঠির ক্ষমতা নাই আমার মাথার একটা চুল ছেঁড়ার। শা’লী তোর বড় বোনকে মনে ধরেছিল। সেদিন রাতে তার দরজায়ও গেলাম, কিন্তু সেই শা’লী দরজা না খুলে, তার না’গ’র’কে ডেকে নিল। পরদিনই তোর বাপ ঢাকা যেয়ে না’গ’রে’র সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিয়ে আসল। তোর বাপ কি মনে করেছে, এভাবে দূরে রাখলেই তার মেয়েকে আমি ছেড়ে দিব? ” আজ সবুজকে নেশায় পেয়েছে। নিজের অজান্তেই হড়বড়িয়ে সব কথা দৃষ্টিকে বলে দিচ্ছে। আর দৃষ্টি শুধু হতবাক হয়ে শুনছে।

” তুমি এত খারাপ! আপুর দিকে কুনজর দিয়েছ! আর আমি কিনা তোমাকে প্রান দিয়ে ভালবাসি! তোমাকে বিশ্বাস করি! তবে কি আম্মুর গহনা চুরি হয়নি? ” দৃষ্টির চোখেমুখে অবিশ্বাস।

” আমিই নিয়েছি তোর ডা’ই’নি মায়ের গহনা। মেয়েকে কয়েকদিনের জন্য গহনা পরতে দিছে। নিজের মেয়েকে গহনাগুলো দিতে তার কষ্ট হয়! শ’য়’তা’ন মহিলা। ”

” তোমার ঐ নোংরা মুখে আমার আম্মুকে শ’য়’তা’ন বলছ? তুমি তো নিজেই একটা শ’য়’তা’ন। তোমার বাপ শ’য়’তা’ন, তোমার মা শ’য়’তা’ন। এই বাড়িতে আসার পর থেকে আমাকে শান্তি দেয়নি। শ’য়’তা’নে’র ঘরে শ’য়’তা’ন জন্ম নিছে৷ ”

দৃষ্টির কথা শুনে সবুজের রাগ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দৃষ্টিকে একের পর এক লা’থি দিতে থাকে। সবুজের মার সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে দৃষ্টি জ্ঞান হারায়।

যখন ওর জ্ঞান ফিরে, চারপাশে তখন ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে মুখরিত। দৃষ্টির সমস্ত শরীরে ব্যথা। রক্তের চিকন রেখা দেখে বোঝা যাচ্ছে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরেছে। জ্বরে শরীর পু’ড়ে যাচ্ছে।
বিছানায় তাকিয়ে দেখল সবুজ ঘুমে বিভোর। অনেক কষ্টে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়ায় দৃষ্টি। আলনা থেকে বোরখা নিয়ে কোনমতে শরীরে ঢোকায়। পার্স থেকে একশো টাকার দুইটা নোট নেয়। এরপর ড্রেসিংটেবিলে থাকা ফোন হাতে নিয়ে ব্যথাতুর শরীরে বেরিয়ে আসে। হাঁটতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে চুপিচুপি অতিক্রম করে চেয়ারম্যান বাড়ির সীমানা।

চলবে….

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৬
জাওয়াদ জামী

এই ভোরে দৃষ্টিকে বাড়িতে দেখে কায়েস ও শিউলি দুজনেই চরম অবাক হয়। দৃষ্টি মুখ থেকে ওড়না সরালে আৎকে উঠে কায়েস, শিউলি। একি অবস্থা হয়েছে তার মেয়ের! শিউলি তড়িঘড়ি করে দৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে আসে। কোন কথা বলার আগেই দৃষ্টি আরেকবার ঢলে পড়ে মায়ের বুকে।

বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করবার পর দৃষ্টির জ্ঞান ফিরে। শিউলি কোন কথা না বলে দৃষ্টিকে কয়েক টুকরা আপেল খাইয়ে, জ্বরের ঔষধ খাইয়ে দেয়।
ব্যথায় জর্জরিত দৃষ্টি বাবার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
এবার মুখ খোলে কায়েস।

” দৃষ্টি আমি আন্দাজ করতে পারছি তোর সাথে কি ঘটেছে। তবুও একবার আমাকে সবকিছু খুলে বল, মা। ” মেয়ের মাথায় স্নেহের পরশ দিয়ে জিজ্ঞেস করে কায়েস।

” আব্বু, সবুজ খুব খারাপ মানুষ। আমি এতদিনেও ওকে চিনতে পারিনি। একটা জ’ঘ’ন্য মানুষের মিথ্যা ভালোবাসার ফাঁ’দে আমি পা দিয়েছি। আমি আর ওর কাছে ফিরে যাবনা, আব্বু। ” দৃষ্টির কান্না কিছুতেই থামছেনা।

” আমি সব জানতাম, মা। সবুজ খুব খারাপ ছেলে জন্যই আমি ওর সাথে তোর বিয়েতে রাজি হইনি। কিন্তু তোরা আমার কথা শুনিসনি। ”

” ঐ জা’নো’য়া’র তরে মা’র’ছে ক্যান, মা! তারে আমি ছাড়বনা। আমার মাইয়াডারে মা’ই’রা ফালাইছে গো। এমুনভাবে কেউ মা’র’বা’র পারে!”
শিউলি আক্তার আর্তনাদ করছে।

” দৃষ্টি, তুই আমাকে সবকিছু বল। তুই চাইলে আমি ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব। যা করার তারাতারি করতে হবে। আমার মেয়েকে করা অ’ত্যা’চা’রে’র শাস্তি ওকে পেতেই হবে। ”

বাবা-মা’ কাছে দৃষ্টি গতরাতের সকল ঘটনা খুলে বলে। কায়েস সবুজের সম্পর্কে আগে থেকেই জানত তাই দৃষ্টির কথা শুনে অবাক হয়না। কিন্তু শিউলি সব শুনে পাথর হয়ে গেছে। যে ছেলেকে সে মাথায় করে রেখেছিল, সেই ছেলেই তার সব গয়না চুরি করেছে! আবার কুহুর সাথে অ’স’ভ্য’তা’মি করতে চাইছিল!

কায়েস দেরি না করে বড় বোনের কাছে ফোন করে। তাকে সবটা জানায়। তবে আফরোজা নাজনীন কোন পরামর্শ না দিয়ে, তার স্বামীর কাছে ফোন ধরিয়ে দেন। সব শুনে সানাউল রাশেদিন দৃষ্টিকে নিয়ে কায়েসকে থানায় যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে নারী নি’র্যা’ত’ন, চুরি, এবং ফ্রড কেস করতে বললেন। তিনি এসপি কে ফোন দিয়ে সব জানাতে চাইলেন।
এরপর কায়েস ফোন করে তার চাচাতো ভাইকে। যিনি বর্তমানে খুলনার একটা জেলায় এসপি হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও সব শুনে কায়েসকে দ্রুত থানায় যেতে বললেন। তিনি আগেই থানায় ফোন করবেন বলে জানালেন।

কায়েস দেরি না করে দৃষ্টিকে নিয়ে থানায় যায়। সানাউল রাশেদিন এবং তার চাচাতো ভাইয়ের কথামত যা যা করার করেন।

ফজরের নামাজ আদায় করে কুহু আবার শুয়েছে। বাড়িতে এতকিছু ঘটে গেছে, তা ওর জানা নেই। ও ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল আটটা বাজে। তড়িঘড়ি করে উঠতে যেয়ে দেখল তাহমিদ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। অনেক চেষ্টা করেও তাহমিদের কাছ থেকে ছাড়া পায়না।

” এই যে, দয়া করে একটু ছাড়বেন? তাহলে আমি উঠতে পারতাম। সকাল আটটা বেজে গেছে, এখন যদি দয়া না করেন তাহলে আপনার ক্লাস আমার ক্লাস সব বিসর্জন দিতে হবে। ”

” উুুুঁহু, বউ ঝামেলা করোনাতো। আমাকে একটু ঘুমাতে দাও। ”

” আপনি যত খুশি ঘুমান। কে মানা করেছে! কিন্তু আমাকে ধরে রেখেছেন কেন! ছাড়ুন বলছি। ”

” তুমিই তো আমার ঘুমের ঔষধ। তোমাকে জড়িয়ে ধরলে ভালো ঘুম হয় বুঝলে? এখন কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাক। ”

” আপনি যদি এখন আমাকে না ছাড়েন, তবে আজ রাতে,আমি দিদুনের কাছে ঘুমাব। আপনি চাইলেও আমাকে এই রুমে নিয়ে আসতে পারবেননা। ” কুহুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই তাহমিদ ওকে ছেড়ে দেয়।

” আনরোমান্টিক মেয়ে একটা। দয়ামায়াহীন। আমি বেশি বেশি আদর করতে চাই, তাই তোমার এত বাহানা। যদি আদর না করতাম, তবে আমার কাছে ইনিয়েবিনিয়ে আদর চাইতে। না চাইতেই বেশি ভালোবাসা পাচ্ছ, তাই আমার দাম দিচ্ছনা। তুমি ভালো করেই জানো, তোমাকে ছাড়া আমার রাত কাটবেনা, তাই এভাবে ব্ল্যাকমেইল করছ! যাও এখনকার মত ছেড়ে দিলাম। রাতে কিন্তু এর প্রতিশোধ ঠিকই নিব। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু মিটিমিটি হাসছে। ও ভালো করেই জানে, তাহমিদকে এখন প্রশ্রয় দিলে আজ আর ওর ক্লাস করা হবেনা।

” কোন কথা না বলে এবার উঠুন। ইদানীং ক্লাস মিস দিচ্ছেন। এভাবে করলে রেজাল্ট খারাপ হবে। আমি পালিয়ে যাচ্ছিনা। সারাজীবন আপনার কাছেই থাকব। রোমান্স করার অনেক সুযোগ পাবেন। আর কয়েকটা মাস পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। এখন পড়াশোনায় মনযোগ দিন। সব সময়ই ভালো রেজাল্ট করে এসেছেন। কিন্তু বিয়ের পর রেজাল্ট এলোমেলো করে বউয়ের দুর্নাম করবেননা। লোকে বলবে বিয়ে করে ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে। ”

” কার এতবড় সাহস আমার বউকে কথা শোনাবে? সবাই জানে আমার বউ কেমন। আর তাহমিদ তার বউয়ের জন্য কতটা পাগল সেটাও সবাই জানে। তাই নো টেনশন। তোমার কাজ কোন টেনশন না করে লেখাপড়া করা, আমাকে একটু ভালোবাসার বিনিময়ে আমার কাছ থেকে লক্ষগুন ভালোবাসা রিটার্ন নেয়া। তোমার সাথে আমার ভালোবাসার কারবার। তাই তোমার মুখে, বুকে এমনকি সমস্ত শরীরে শুধু ভালোবাসাই থাকবে। শুধু তাহমিদের নামের ভালোবাসা। ” তাহমিদ আবার কুহুকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরেছে। কুহুর সমস্ত মুখ চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে।

সকালে মায়ের ডাকে ধরফরিয়ে বিছানায় উঠে বসে সবুজ। রাতের হ্যাংওভার এখনও কাটেনি। মাথা ভারী হয়ে আছে।

” এত সকালে আমাকে ডাক দিকে গুষ্টি উদ্ধার করতে আসছো, মা ? ” সবুজের কথা জড়িয়ে গেলেও ঝাঁঝ কমেনি একটুও।

” আমার এত শখ জাগেনি, তোর মত ছেলেকে জাগিয়ে গালি শোনার। তোর বউ কই? তাকে দেখতে পাচ্ছিনা। ”

” দেখ আছে কোথাও। সে আর কোথায় যাবে। ” রাতের ঘটনা কিছুই মনে নেই সবুজের। সে নেশার ঘোরে কি করেছে, তার সবটাই ভুলে গেছে।

” আমি সবখানেই দেখছি। কিন্তু সে নাই। আবার বাড়ির মূল দরজাও সকালে খোলা পাইছি। সারা পাড়া দেখছি, কিন্তু সে নাই। আমার মনে হয়, সে মেয়ে বাপের বাড়ি গেছে। রাতে তুই তারে যে মা’ই’র দিছিস। আমি দুইজনের গলার শব্দ শুনে দরজার বাইরে দাঁড়ায় দাঁড়ায় তোর মা’রে’র শব্দ শুনছি। অবশ্য তোর কোন দোষ নাই। মেয়ে মানুষকে মাঝে মধ্যে শাসন না করলে ওরা মাথায় উঠে। ”

এবার সবুজ নড়েচড়ে বসে। ও রাতে দৃষ্টিকে মে’রে’ছে! কই কিছু মনে পরছেনা তো! সবুজ মোবাইল হাতে নিয়ে দৃষ্টির নম্বরে দেয়। কিন্তু দৃষ্টি ফোন সুইচড অফ করে রেখেছে। দৃষ্টিকে না পেয়ে সবুজ শিউলি আক্তারকে ফোন দেয়। কিন্তু কয়েকবার ফোন করার পরও শিউলি ফোন রিসিভ করেনা।
সবুজ বুঝতে পারছে রাতে সে কোন ঘটনা ঘটিয়েছে।
এরপর সবুজ ফোন করে কায়েসের কাছে। কিন্তু একের পর এক ফোন বেজে গেলেও কায়েস রিসিভ করেনা।

এমন সময় সবুজের বাবা হন্তদন্ত হয়ে সবুজের ঘরে ঢোকে।

” ঐ হা’রা’ম’জা’দা, রাতে তুই বউয়ের সাথে কি করছিস? সকালে তোর বউ তার বাপের সাথে থানায় যেয়ে তোর নামে নারী নি’র্যা’ত’নে’র মামলা দিছে। ভাগ্যিস থানার ঐ কনস্টেবল আমার খুব কাছের মানুষ। তার কাছ থেকে থানার সব খবরাখবর পাই। তাই এসব আমি জানতে পারলাম। শু’য়ো’রে’র বাচ্চা উঠ। কোথাও যেয়ে গা ঢাকা দে। আমি এদিককার পরিস্থিতি সামাল দিলে তুই আসিস।” চেয়ারম্যান তার ছেলেকে ঠেলে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।

কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান বাড়িতে পুলিশ আসে। সারা বাড়ি চিরুনি তল্লাশি করেও সবুজকে পায়না। দৃষ্টি সবুজের মা’কেও নারী নির্যাতন মামলায় আসামি করেছে। পুলিশ সবুজকে না পেলেও ওর মা’কে থানায় নিয়ে যায়। চেয়ারম্যান খুব চালাক হওয়ায় ছেলেকে বের করে দেয়ার পরপরই নিজেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।

সবুজ এক বন্ধুর বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে। সেখানে বসে বসেই সে সব খবর পাচ্ছে। ওর মা’কে পুলিশ নিয়ে গেছে শুনে রা’গে দুনিয়া তোলপাড় করতে উদ্যত হয়। কিন্তু বন্ধুরা ওকে আটকে দেয়।
এদিকে চেয়ারম্যান কায়েসের সাথে কথা বলে মামলা মিমাংসা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সেদিন দুপুরেই সে কায়েসের বাড়িতে আসে। দৃষ্টি তার সাথে দেখা করেনি। সে কায়েসকে মামলা তুলে নিতে পরোক্ষভাবে হু’ম’কি’ধা’ম’কি দেয়। কিন্তু কায়েস ভয় পায়না। কায়েস ফাইনালি বলে দেয় সে মামলা তুলবেনা।

কায়েসের বোনেরা একটু পরপর ফোন করে ওদের খবর নিচ্ছে। সাহস দিচ্ছে। তারা বলেছেন, একটু সময় পেলেই গ্রামে আসবেন।

আফরোজা নাজনীন কুহুকে এখনও ওদের বাড়ির পরিস্থিতি জানাননি। যদিও এখন কুহু ভার্সিটিতে আছে। তবে ও বাড়ি ফিরলেই তিনি সবটা জানাবেন।

বিকেলে সবুজের সাঙ্গপাঙ্গরা কায়েসের পাঁচ বিঘা জমি দখল নিয়ে, জমির ধান কেটে নেয়। আশেপাশের লোকজন বাঁধা দিলে তারা জানায়, এটক সবুজের জমি। সবুজের জমির ধান তারা কাটছে। এই খবর সেখানকার কয়েকজন কায়েসকে ফোন করে জানায়। সন্ধ্যার পর সবুজ দলবল নিয়ে এসে কায়েসের তিনটা শো-রুমে এসে হা’ম’লা চালায়। শো-রুমের তত্বাবধানে থাকা সবাইকে বের করে দিয়ে সেখানে নিজের লোকজনকে বসায়। সেই সাথে ক্যাশ কাউন্টার থেকে সব টাকা নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে শো-রুমের ম্যানেজারকে বলে, আজ থেকে তিনটা শো-রুমের মালিক সবুজ। ওর শ্বাশুড়ি শো-রুম ওর নামে করে দিয়েছে।

এসব শুনে কায়েসের মাথায় যেন বাজ পরল। সে বাড়িতে এসে শিউলিকে জিজ্ঞেস করল, সবুজ কেন বলে বেড়াচ্ছে জমি এবং শো-রুমগুলো শিউলি তাকে লিখে দিয়েছে?
কিন্তু শিউলি জানায়, সে সবুজকে এসব লিখে দেয়নি।

সেইদিন রাত দশটার পর চেয়ারম্যান আবার কায়েসের বাড়িতে আসে৷ এবার সে একা আসেনি। কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গসহ হাজির হয়েছে।
সে কায়েসকে মামলা তুলে নিতে হুমকিধামকি দেয়। কিন্তু কায়েস কিছুতেই মামলা তুলে নিতে রাজি হয়না। এমন সময় দৃষ্টি রুমে এসে চেয়ারম্যানকে জানিয়ে দেয়, যাই হোক না কেন ও কিছুতেই মামলা তুলবেনা। এবং জিজ্ঞেস করে সবুজ কেন ওদের শো-রুম এবং জমি দখল করেছে? ওরা এ বিষয়ে আইনের আশ্রয় নিবে। তখন চেয়ারম্যান দুইটা দলিলের ফটোকপি দেখায় কায়েসকে। যেগুলো পাঁচ বিঘা জমি এবং শো-রুমের। যেগুলো শিউলি স্বেচ্ছায় সবুজকে দিয়েছে। এবং দলিলে শিউলির সই দেয়া।
কায়েসসহ সবাই দলিল দেখে চরম অবাক হয়ে গেছে। শিউলি বারবার বলছে সে কখনোই সবুজকে কোন কিছু লিখে দেয়নি।
তখন চেয়ারম্যান কায়েসকে বলে প্রয়োজনে সব জায়গায় খোঁজ নিতে, দলিলগুলো সত্যি না জাল তা জানতে।
এরপর কায়েস চেয়ারম্যানকে একপ্রকার অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। চেয়ারম্যানও জানায়, এই অপমানের শোধ সে নিবে।

কায়েসের সামনে শিউলি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কায়েসের র’ক্ত’চ’ক্ষু’র সামনে সে মিইয়ে গেছে। কায়েস তাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে কবে সে সবুজকে জমি এবং শো-রুম লিখে দিয়েছে। কিন্তু শিউলি বারবারই বলছে, সে সবুজকে কোন কিছুই লিখে দেয়নি।
কায়েস এত টেনশন আর নিতে পারছেনা। সে ঠাসঠাস করে পরপর কয়েকটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয় শিউলির গালে।

” তুই যদি সবুজকে সবকিছু লিখেই না দিবি তবে দলিলে তোর স্বাক্ষর আসল কিভাবে? তুই আমাকে বুঝাস? আমার জীবনে যেদিন থেকে তোর আবির্ভাব হয়েছে, সেদিন থেকেই আমি একটু একটু করে শেষ হয়ে গেছি। আইরিন আর তোর মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। একজন আমার জীবনকে গড়তে সাহায্য করেছে আর তুই আমাকে ধ্বংস করছিস। সব দোষ ঐ আইরিনের। সে ম’রে গিয়ে বেঁচেছে কিন্তু আমাকে তিলে তিলে শেষ করতে রেখে গেছে। আমার আব্বার সম্পত্তি, আমি তোর নামে করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই সব শেষ করে দিলি। আজ থেকে আমার টাকা কিংবা সম্পত্তির কোন ভাগ তুই পাবিনা। আমি আমার ছেলে-মেয়েদের নামে সব করে দিব। ” কায়েসের এহেন কথার আঘাত শিউলির সহ্য করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আজ কায়েস তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কুহুর মা তার জীবনে কি ছিল।

” বিশ্বাস কর, আমি হেই সবুজরে কিছুই দিই নাই। কোন কাগজে সই দিই নাই। খালি একদিন একটা সরকারি কাগজে সই দিছিলাম। ”

” কিসের কাগজে সই করেছিলে? সরকারি কাগজে সই দিয়ে তোমার কি লাভ! ” কায়েস চরম অবাক।

” কয়েকমাস আগে হেয় আইছিল। তার বাপে নাকি কইছিল সরকার থাইকা খাদ্য অনুদান আইছে। হের লাইগা কার্ড করন লাগব। ঐ চেয়ারম্যান আমার মা, ভাইরে হেই অনুদান দিব। কিন্তু তারা এই ইউনিয়নের না, তাই চেয়ারম্যান কইছে আমার সই লাগব। তাইলে আমার নামে কার্ড কইরা দিব। সেইজন্য সবুজ কয়েকটা কাগজ আইনা, আমার সই নিছে। দৃষ্টিও কইল, তার শ্বশুর কইছে আমার মা, ভাইরে সাহায্য করব। ” শিউলির কথা শুনে কায়েস হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

” আরও কি কি বিষয় তুমি আমার কাছে গোপন করেছ, একটু বলবে। আমাকে শেষ করার সব রাস্তাই বোধহয় ঠিক করে রেখছ! তোমার মা-ভাইয়ের জন্য সরকারি ত্রান লাগবে! আমি যে প্রতি মাসেই তাদের জন্য বস্তা বস্তা চাল, ডাল, মাছ,মাংস, টাকা পাঠিয়ে দিই, এতে তোমার মন ভরেনা! আমি তাদের কোন কিছুরই কমতি রাখিনা। তবুও অন্যের কাছে ছোট হতে, আমাকে ছোট করতে একটুও বাঁধলোনা! আজ বুঝতে পারছি, তোমাকে বিয়ে করা আমার জীবনের চরম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কাককে আমি ময়ূর বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি ভুলেই গেছিলাম, ময়ূরের পালক লাগালেই কাক ময়ূর হয়না। ” শিউলি এভাবে কায়েসের কাছে অপমানিত হবে তা ওর কল্পনায়ই ছিলনা। সে সবুজকে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু সবুজ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাকে ঠকিয়েছে।

চার-পাঁচ দিন ধরে সবুজ পলাতক। পুলিশ ওকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।
রাত দেড়টা। কায়েসসহ বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎই দরজায় জোড়ে জোড়ে ধাক্কার শব্দ শুনে ওদের ঘুম ভেঙে যায়। একটু ধাতস্থ হতেই বুঝতে পারে সবুজ এসেছে।
সবুজ দরজায় লাথি দিচ্ছে সেই সাথে গালিগালাজ করছে।
এতরাতে সে যেভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছে, এখনই দরজা না খুললে হয়তো সে ভেঙ্গেই ফেলবে। আবার পাড়ার লোকজন এভাবে দরজা ধাক্কাতে শুনলে কি না কি ভাববে। তাই অনেকটা মান-সম্মানের ভয়েই কায়েস দরজা খুলে দেয়।
রা’গে সবুজের চোখমুখ বি’কৃ’ত হয়ে গেছে। । সে একা এসেছে। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই সে দৃষ্টিকে জোড়ে জোড়ে ডাকতে শুরু করে।
সবুজের ডাক শুনে দৃষ্টি বাইরে আসে।

” দৃষ্টি আমার সাথে এখনই বাড়ি চল। আর কাল সকালে থানায় যেয়ে কেস তুলে নিবে। আমি আজ কয়েকটা দিন থেকে বাড়িছাড়া। ”

” কক্ষনো না। আমি কোনদিন তোমার বাড়িতে যাবনা। তোমাকে ডিভোর্স দিব। তুমি যদি এখনই এখান থেকে না যাও, তবে কাল সকালেই থানায় যাব। সেখানে গিয়ে বলব, তুমি আমাদের বাড়িতে এসে ভাঙচুর করেছ। ”

” কু’ত্তা’র বা’চ্চা, তোর খুব বাড় বেড়েছে? তুই আমাকে ডিভোর্স দিবি? এতবড় সাহস তোর? যা তোর যা খুশি করিস। মনে করেছিস, বাপের দালানের নিচে থাকলেই তুই বেঁচে যাবি? তোর বাপ কেন, তার চৌদ্দ গোষ্ঠিও আমার একটা চুল ছিঁড়তে পারবেনা। শেষ বারের মত বলছি, তুই কি আমার বাড়িতে যাবি? ”
সবুজের এমন উদ্ধত কথা শুনে কায়েস এসে ওর গালে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে থা’প্প’ড় মারে।

” আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা, বেয়াদব। তোর বাপ-মা নাহয় তোকে শিক্ষা দেয়নি, তাই রাত বিরেতে ভদ্রলোকের বাড়িতে এসে অসভ্যতামি করছিস। কিন্তু আমরা তোর মত অসভ্য নই। আমরা যা করব আইনের পথেই করব। ”

” ঐ প’ঙ্গু, বউয়ের হাতে মার খেয়েও শিক্ষা হয়নি তোর? আবার আমার হাতের মার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে? শা’লা, তুই আমাকে শিক্ষা দিস? তোকে মে’রে মাটিচাপা দিয়ে দিব বা’ন্দি’র’পু’ত। আমাকে থা’প্প’ড় দিস? ”
এমন সময় শিউলি হাতে একটা দা নিয়ে এসে সবুজের সামনে দাঁড়ায়।

” কারে তুই বা’ন্দি’র’পু’ত কস হা’রা’ম’জা’দা? ফ’কি’ন্নি’র পুত চালাকি কইরা আমার কাছ থাইকা সব লিখা নিয়া ফুটানি করস? আমি যদি নিজের স্বামীরে মারবার পারি, তবে তরেও খু’ন করবার পারি, এডা মনে রাখস। এহনই যদি তুই এহান থাইকা না যাস, তয় এখনি তরে আমি কা’ই’টা ফালামু। ” শিউলি কায়েসের অপমান সহ্য করতে না পেরে তেড়ে আসে।
সবুজ শিউলির হাতে ধারালো দা দেখে ভয় পেয়ে যায়। সে সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে। তবে বেরোনোর সময় দৃষ্টির দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

” তুই খুব ভুল করলি। নিজে অপমান করলি আবার বাপ-মাকে দিয়েও অপমান করালি। এর দাম তোকে দিতেই হবে। ”

শুক্রবার জন্য তাহমিদ নিজেও বেলা করে ঘুমাচ্ছে আবার কুহুকেও আটকে রেখেছে। কুহু অনেক অনুনয় করেও তাহমিদের থেকে এক বিন্দুও ছাড় পায়নি।

” এবার তো ছাড়ুন। অনেক বেলা হয়েছে। কতদিন পর বাবা বাসায় এসেছে। সে যদি দেখে তার ছেলের বউ এখনও ঘরে আছে, তাহলে তিনি ভাববে বলুনতো? ”

” আমার বাবা ভালো করেই জানে, তার ছেলে নতুন বিয়ে করেছে, এখন বউয়ের সাথে একটুআধটু সময় কাটাবেই। সে কিছুই ভাববেনা। তুমি নিশ্চিন্তে শুয়ে থাক। এখন একটুতো রোমান্স করতে দাও। রাতে শুধু পালাইপালাই কর। তুমি যত পালাইপালাই করবে, আমার রোমান্সের স্থায়িত্ব ততই বাড়বে। এখন চুপচাপ থেকে আমাকে একটু ভালোবাসতে দাওতো। ”

” সারারাত রোমান্স করেও আপনার সাধ মেটেনি! ”

” তোমাকে যতই ভালোবাসি, ততই আরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে বউ। এ তৃষ্ণা কিছুতেই মিটবার নয়। ”

” আপনি আছেন আপনার রোমান্স নিয়ে। আমি যে চিন্তায় ম’র’ছি, সে চিন্তা আপনি একবারও করেননা। ” কুহু মুখ ফুলিয়ে বলল।

” বউ, কি হয়েছে তোমার? কিসের চিন্তা করছ তুমি? তোমার শরীর ঠিক আছে? ”

” আমি ঠিক আছি। কিন্তু চিন্তা হচ্ছে বাবা আর দৃষ্টিকে নিয়ে। না জানি তারা কি পরিস্থিতিতে আছে। সেদিন ফুপুর কাছে থেকে সব শোনার পর বাবাকে ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু বাবা কিছুই বলেনা। শুধু আমার থেকে সব লুকাচ্ছে। এদিকে দৃষ্টির ফোনও সুইচড অফ। আর আপনি ছোটমার কাছে ফোন করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। আবার ফুপুও তেমন কিছু বলছেনা।”

” তুমি টেনশন করবে জন্য বড়মা কিছু বলছেনা। আর আমার শ্বশুর বাবা সেও একই কারনে তোমাকে কিছু বলেনা। তবে তার সাথে আমি নিয়মিত যোগাযোগ করছি। তুমি চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

” ঐ ছেলেটা এত খারাপ! বাবাকে কত টেনশনে রেখেছে। ”

” ভুল আমারই ছিল। সেদিনই যদি ওকে শেষ করে দিতাম, তবে ওদের আজ এই দিন দেখতে হতনা। আর না কেউ জানত, কে মে’রে’ছে ওকে। ” কথাটা বলেই তাহমিদ চুপ করে যায়। তাহমিদ বুঝতে পারে সে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলেছে।

” কি বললেন আপনি! ওকে শেষ করে দিতেন মানে? ”

” এই মেয়ে, এতক্ষণ নিচে যেতে চাইছিলে না? এখন নিচে যাও। তোমার শ্বশুরের সেবাযত্ন কর গিয়ে। তারাতারি যাও, দুপুর হতে চলল। ” তাহমিদ কুহুকে বিছানা থেকে ঠেলে তুলে দেয়। কিন্তু কুহু উঠেনা। সে তার প্রশ্নের উত্তর চায়। উত্তর না নিয়ে সে উঠবেনা।
এদিকে তাহমিদও ফ্যাসাদে পরেছে। মুখ ফসকে কি বলে ফেলেছে!
কুহুও নাছোড়বান্দা। সে বিছানায় খুঁটি গেড়েছে। তাহমিদের উত্তর না শুনে কিছুতেই উঠবেনা।
তাহমিদ ইতিউতি করে মুখ খোলে,

” সবুজকে সেদিন আমি লোকজন ঠিক করে ঠে’ঙ্গি’য়ে নিয়েছিলাম। ” ব্যাস এতটুকু বলেই থেমে যায় তাহমিদ।
কুহু স্তব্ধ হয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে।

” আপনি এমন কাজ করতে পারলেন! আল্লাহ, আমি কিছু বলতে পারছিনা কেন! ” কুহুর মাথা ঘোরাচ্ছে।

” তো, আমি কি করতাম? ঐ জা’নো’য়া’র তোমাকে অপমান করেছে। আমি তাকে এমনি এমনিই ছেড়ে দিতাম? আমার কলিজায় হাত দিয়েছে ও। নেহাৎই আমার ইমারজেন্সি ক্লাস ছিল, তাই আমি সেখানে যেতে পারিনি। নইলে আমি যদি সেখানে থাকতাম, তবে ওকে আর দিনের আলো দেখতে হতোনা। তবে ঐ ইডিয়টকে নিজের হাতে মা’রা’র আফসোস আমার রয়েই গেছে। সুযোগ পেলে সেই আফসোসও মিটিয়ে নিতে চাই। ”
কুহু তাহমিদের কথা যতই শুনছে, ততই বিস্মিত হচ্ছে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই ওর ফোন বেজে ওঠে।
কুহু ফোন হাতে নিয়ে দেখল, দৃষ্টির নম্বর। অবশেষে মেয়েটা ফোন অন করেছে। কুহু হেসে ফোন রিসিভ করে।

” দৃষ্টি, কেমন আছিস? আমি তোকে কতবার ফোন দিয়েছি, জানিস? বড্ড চিন্তা হচ্ছিল তোর জন্য। ”

” আপুরে, আমি কি এখন ভালো থাকতে পারি। ভালো থাকার কারন আমি নিজ হাতে শেষ করে দিয়েছি। তোমার সাথে যত অন্যায় করেছি, তার ফল এতদিনে পাচ্ছি। একেই বুঝি বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। আমি তোমার সাথে যা যা করেছি, প্রকৃতি তার হাজার গুন আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। ”
” দৃষ্টি, এসব কি বলছিস তুই? তুই কি করেছিস আমার সাথে! তুই আমার ছোট বোন। হয়তো না জেনেই কিছু ভুল করেছিস, কিন্তু তার জন্য এতটা কষ্ট তোর পাওনা নয়। আর আমি সেসব মনে রাখিনি। প্রকৃতি আবার কিসের প্রতিশোধ নেয় রে! প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলে। সে কিসের প্রতিশোধ নিবে রে? তুই এসব আজেবাজে চিন্তা না করে ঐ পঁচা-নর্দমা থেকে বেরিয়ে আয়। নিজের মত করে বাঁচ। তুই ভালো থাকলে আমরা সবাই ভালো থাকব। তুই…. ”

কুহু কথা শেষ করার আগেই দৃষ্টি কথা বলে,

” আপু, তাহমিদ ভাইয়া তোমাকে বুঝি খুব ভালোবাসে? ”
কুহু দৃষ্টির প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ওর লজ্জা লাগছে। তবুও ছোট্ট করে উত্তর দেয়।

” হুম। ”

” সবুজ আমাকে কেন ভালোবাসলনা আপু? আমিতো তাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে নিয়ে খেলল! সত্যিকারের ভালোবাসা আমার কাছে ধরা দিলনা। ”

” তুই ভুল মানুষকে মন দিয়েছিলি। ভুল জায়গায় ভালোবাসা সঁপেছিলি। যে ভালোবাসার মানেই জানেনা, সে কি কখনো সত্যিকারের ভালোবাসতে জানে? ”

” তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ, আপু? তুমি ক্ষমা না করলে আমি কোনদিন সুখী হতে পারবনা। ”

” আমি আগেও বলেছি, তুই আমার ছোট বোন। তোকে আমি ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি, নিজের মত করে বড় করেছি। আমার মত করে কথা বলতে শিখিয়েছি। তোর কোন অন্যায়ই যদি মনে রাখব,তবে কিসের বড় বোন হয়েছি! তুই ওই ছেলেটাকে ছেড়ে দে। এরপর ঢাকা চলে আয়। তোকে এখানকার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিব।আবার নতুন করে জীবন শুরু করবি। দুই বোন একসাথে থাকব। বাবার কোন চিন্তা থাকবেনা। ”

” তোমার মত আমি কেন হলামনা আমি? না রাখতে পারলাম বাবার সম্মান, না পারলাম নিজের সম্মান রক্ষা করতে। সমাজের চোখে আমি ছোট হয়ে গেলাম। আজীবন নর্দমার কীটের ন্যায় বাঁচতে হবে আমাকে। ”

” আবার আজেবাজে বকছিস? তুই না জেনে আবেগে পরে ভুল করেছিস। যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস, তখন শোধরাবার পথও খোলা আছে। যখন সব দুঃসহ স্মৃতি পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবি, অনেক বড় হবি, তখন দেখবি সবাই তোকে বাহবা দিবে। কেউ মনে রাখবেনা তোর অতীত। ”

” আমি আমার ঘৃণার অতীত কখনোই ভুলতে পারবনা, আপু। আমার সকল কাজেই, এই অতীত পিছু টেনে ধরবে। আমি হেরে গেছি। জীবন আমাকে…..
এতটুকুই বলতে পারল দৃষ্টি।
তাহমিদ কুহুর কাছ থেকে ফোন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে।

” দৃষ্টি, তুই কি খুব বড় হয়ে গেছিস? আমরা চেষ্টা করছি তোকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে, আর তুই নিজেকে পিছিয়ে নিচ্ছিস! বড়মা তোর চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে। আমরা সবাই তোর ভালোর জন্য কতকিছু করতে চাইছি, কিন্তু তুই আমাদের সাহায্য না করে নিজেও হতাশ হচ্ছিস, আমাদেরও হতাশ করছিস! শোন তুই ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি থাক। আমি আগামীকাল ফুলতলা তোকে নিতে আসছি। শোন জীবনে যেমন দুঃখ-কষ্ট থাকে তেমনি সুখও থাকে। সুখ-দুঃখ একই মুদ্রার দুই দিকে অবস্থান করে। দুঃখ কখনোই চিরস্থায়ী হয়না। দিনের পর দিন দুঃখ-কষ্টে থাকার পর একটু সুখও স্বর্গের অনুভূতি জাগায়। আর এই স্বর্গীয় অনুভূতির রেশ আজীবন রয়ে যায়। তখন দুঃখ আশেপাশে ভিড়তে পারেনা। তোর এই কষ্ট সাময়িক। নিজের জন্য ভুল মানুষ বেছেছিলি তুই। কিন্তু যখন সঠিক মানুষ খুঁজে পাবি, তখন আজকের হওয়া এই হতাশার জন্য হাসি পাবে তোর। আমি কি বলতে চেয়েছি তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিস? ”

” হুম, বুঝেছি ভাইয়া। আপু ভাগ্যবতী তোমাকে পেয়ে। ”

” সেটাতো তোর বোন স্বীকার করেনা। সে শুধু আমাকে ল্যাজেখেলাতে চায়। ”

” কি যে বলোনা। আমার আপু কত ভালো। সেদিন যখন তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল, আমি তার চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। ”

” কিন্তু এখন তো আর সেভাবে জড়িয়ে ধরেনা। এই, তোরা দুই বোন কি একই রকম? একজন রোমান্স করতে দেয়না, আরেকজন রোমান্সের চৌদ্দটা বাজাতে সকালে ফোন দিয়েছিস! ”
কুহু তাহমিদের কথা শুনে বিষম খায়। আর দৃষ্টি দাঁত দিয়ে জিভ কা’টে৷

” সরি, ভাইয়া, আমি বুঝতে পারিনি তোমরা রোমান্স করছিলে। এখন আমি রাখছি। তুমি রোমান্স চালিয়ে যাও। ”

” এখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাচ্ছে রে। আমি চাইলেও তোর নিরামিষ বোন রোমান্স করতে দিবেনা। জীবনটাই করলার রসের ন্যায় তিতা হয়ে গেছে, বুঝলিরে দৃষ্টি? মাঝে মাঝে মনে হয় আমি করলার রসের মধ্যে শুয়ে আছি। আর ভাল্লাগেনা। ”

তাহমিদের কথা শুনে দৃষ্টির হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মত অবস্থা। সে আর কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়।

ফোন রেখে কুহুর দিকে তাকিয়েই তাহমিদের গলা শুকিয়ে যায়। কুহু ওর দিকে কটমটিয়ে চেয়ে আছে। ওর চোখমুখে রা’গে’র ছটা।

চলবে…