বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব-৪৭+৪৮

0
463

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৭
জাওয়াদ জামী

কুহুর রা’গ দেখে তাহমিদ আর বিছানায় থাকেনা। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে।

খাবার টেবিলে সবাই একসাথে জড়ো হয়েছে। আফরোজা নাজনীন, তাহমিনা আক্তার মিলে খাবার পরিবেশন করেছেন। কুহুও তাদেরকে সহযোগিতা করতে চেয়েছে, কিন্তু তারা রাজি হননি। জোর করেই কুহুকে খেতে বসিয়েছেন। তারা কুহুকে খুব একটা কাজ করতে দিতে চাননা।

সানাউল রাশেদিন স্বভাবসুলভ ভাবেই গম্ভীর মুখে বসে পরোটা খাচ্ছেন।
কিন্তু তাহমিদের এই মুহুর্তে তাকে শান্তিতে খেতে দিতে ইচ্ছে করছেনা।

” ও ফুপু শ্বাশুড়ি, আমার ফুপা শ্বশুরকে আরেকটা পরোটা দিন। এত বড় পেটে দুইটা পরোটায় কিচ্ছু হয়না। আমার মনে হয় পেটের এক কোনাও ভরেনা। ”
তাহমিদের কথা শুনে শফিউল রাশেদিন হো হো করে হেসে উঠেন।
আর সানাউল রাশেদিন দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকিয়ে থাকে তাহমিদের দিকে।
আফরোজা নাজনীন আর তাহমিনা আক্তার মিটমিটিয়ে হাসছেন।

” আফরোজা, এই বেয়াদব ছেলেকে আমার পেছনে লাগতে নিষেধ করে দাও। কিসের ফুপা শ্বশুর হ্যাঁ? সে যদি আমাকে সম্মান করতে তাহলে যেন আমাকে সবরকম সম্মোধন বন্ধ রাখে। ”

” মা, তোমার বেয়াইকে হাইপার হতে নিষেধ কর। শেষে দেখা গেল ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাবে। পরে তাকে নিয়ে আমাকেই দৌড়াতে হবে। কিন্তু আমার শরীরের যে অবস্থা তাকে কোলে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার স্বাস্থ্যতো মাশা-আল্লাহ। ”

” আফরোজা, আমি কিন্তু এখনই উঠে যাব। তখন সব খাবার এই বেয়াদবটাকে খাইও। এরকম একটা ছেলে বাড়িতে থাকলে, সেই বাড়ির মানুষের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার অন্য কোন কারন লাগবেনা। আর শফিউল, তোমাকে বলছি, ছেলেকে একটু শাসন কর। নইলে দেখবে ভবিষ্যৎ বংশধরও তার মত বেয়াদব জন্মাবে। ”

” বাবা, তুমি আমার ফুপা শ্বশুরকে বলে দাও, আমার ছেলে-মেয়েদের শিষ্টাচার দিয়েই গড়ে তুলব। তারমত শুধু শরীরসর্বস্ব জীব বানাবনা। সে আর কিছু না পারুক তেজ দেখানোর বেলায় ভদ্রলোক এক্সপার্ট। ”

কুহু অসহায় চোখে ফুপার দিকে তাকিয়ে আছে। পারলে সে তাহমিদকে চিবিয়ে খায়।

” তাহমিদ, তুমি আমার ভাইকে এভাবে বলছ কেন? মনে হচ্ছে আজকাল বড়দের সম্মান দিতে ভুলে গেছ! এখন যদি তুমি চুপ না কর, তবে আমি রে’গে যাব। আমার ভাইয়ের নাহয় একটু ভুঁড়ি আছে, তাই বলে কি তুমি তাকে এভাবে বলবে! ” শফিউল রাশেদিন মিটমিট করে হাসছেন৷

” আজ বুঝলাম, তোমার ছেলে এতটা বেয়াদব কেন হয়েছে। যার বাপই বড় ভাইকে সম্মান করতে জানেনা, তার ছেলের কাছ থেকে সম্মান আশা করা বোকামি। ”

আয়েশা সালেহা বুঝতে পারলেন তিনি হস্তক্ষেপ না করলেন,ঘটনা বহুদূর গড়াবে। এই দুই বাপ-ছেলে মিলে তার বড় ছেলেকে আরও পঁচাবে।

” তোরা কি শুরু করেছিস বলত? আমার ছেলেটাকে এভাবে বিরক্ত করছিস কেন? তোরা যদি এখন না থামিস, তবে আমি না খেয়ে উঠে যাব বললাম। ”

বৃদ্ধার হুমকি শুনে ওরা দুজনেই মিইয়ে যায়। চুপচাপ খেতে থাকে।
সানাউল রাশেদিন হাসতে হাসতে খেতে থাকেন।

” ও ফুপু শ্বাশুড়ি, আপনার জামাইকে ভালোমত খাওয়ান। তিনি আজ ভিষণ খুশি। খুশিতে দুই-চারটা পরোটা বেশিও খেতে পারেন। আহারে, বয়স্ক ভদ্রলোক কতদিন এমন খুশি হননি। ”

” বাপ, এবার খেয়ে নে। চাচ্চুকে অনেক বিরক্ত করেছিস। আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে। ”

” আফরোজা! কি বললে তুমি? আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে, মানে কি? তুমি ওকে আবার ভবিষ্যতের জন্য উস্কে দিলে! এখন বুঝলাম, ঘরেই যদি বিভীষণ থাকে, তখন বাইরের শত্রুর দরকার পরেনা। ”

” তুমি এমন কেন বলত! তাহমিদ যে তোমার সাথে মজা করে, এটা বুঝতে পারনা! তুমি যতই রে’গে যাও, ও তোমাকে ততই রা’গা’য়। তাই বলে তুমি কি মনে কর, ও তোমাকে ভালোবাসেনা?
মাঝেমাঝে এত অবুঝ হও কেন তুমি? ”
সানাউল রাশেদিন স্ত্রীর কথার কোন প্রত্তুত্যর করেনা।

” বড়মা, বাদ দাও।তার বয়স্ক ব্রেইনে এসব ঢুকবেনা। মিছেই তুমি অরন্যে রোদন করছ। বড়মা শোন , আজ কিছুক্ষণ আগে দৃষ্টির সাথে কথা হয়েছে। আমি ওকে কাল আনতে যাব বলেছি। দুপুরের মধ্যে সেখানে চলে যাব। একটু জামাই আদর খেয়ে বিকেলেই আবার রওনা দিব। অনেকেই জামাই আদর পেতে হা হুতাশ করে। কিন্তু আমি দেখ ফ্রীতেই পাচ্ছি। একই বাড়ির দুইজন মানুষের একটাই শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু একজনের কপাল দেখ, আর আমার কপাল দেখ। আমার শ্বশুর আমাকে কত ভালোবাসে আমাকে। কিন্তু আরেকজন এতিমের মত থাকে। ” সানাউল রাশেদিনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে তাহমিদ।
সানাউল রাশেদিন দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে।

দৃষ্টি ঘরে বসে কাঁদছে। তার সাথে কেন এমন হল? ওর জন্য আব্বু মানসম্মান সব হারাল। আম্মু সবকিছু খোয়ালো৷ ভবিষ্যতে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে তা ভাবতেই ওর বুক শুকিয়ে যায়। আজ মায়ের ওপর ওর ভিষণ অভিমান হচ্ছে। যদি সে প্রথম থেকে দৃষ্টিকে আটকাত, শাসন করত, তবে আজ এতবড় ভুল দৃষ্টি করতনা।
এদিকে সবুজ বারবার ফোন করছে। কিন্তু দৃষ্টি রিসিভ করেনা।
দৃষ্টির ফোনে ওকে না পেয়ে, সবুজ শিউলির ফোনে ফোন দেয়। কিন্তু সবুজের নাম দেখে শিউলিও ফোন রিসিভ করেনা। সে দৃষ্টিকে জানায়, সবুজ ফোন করেছে। দৃষ্টি তাকে রিসিভ করতে নিষেধ করে।

সবুজ দৃষ্টিকে না পেয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে। যেকোন মুল্যেই দৃষ্টিকে তার চাই। দৃষ্টি সোনার ডিম দেয়া হাঁস। ওকে কিছুতেই হারাতে দেয়া যাবেনা। দৃষ্টিকে নিজের কাছে রাখতে পারলেই ওর লাভ।
আবার দৃষ্টিকে ফোন দেয় সবুজ। একের পর এক ফোন করতেই থাকে।

দৃষ্টি পরেছে বিপদে। তাহমিদ ওকে ফোনের সুইচড অফ করতে নিষেধ করেছে। তাই ফোন অফ করতে পারছেনা। সবুজের নম্বর সে ব্লক করে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবার নতুন নতুন নম্বর থেকে ফোন করছে সে। দৃষ্টি রিসিভ করে সবুজের গলা শুনলেই সেই নম্বরও ব্লক করছে।
দৃষ্টি ফোন হাতে নিয়ে অসহায়ের মত বসে আছে। এমন সময় টুং করে ম্যাসেজ আসে।
সবুজ দৃষ্টিকে ফোনে না পেয়ে ম্যাসেজ দিয়েছে।

” তুই যদি আজকের মধ্যে আমার বাড়িতে না আসিস, আর মামলা তুলে না নিস, তবে তোর যে আমি কি হাল করব, তা তোর কল্পনায়ও নেই। নিজের ভালো চাইলে, তোর ঐ হা’রা’মী বাপের সাথ না দিয়ে আমার বাড়িতে আয়। ”
দৃষ্টি সবুজের ম্যাসেজ দেখে সাথে সাথেই সবুজকে ফোন করে। সবুজ সাথে সাথে ফোন রিসিভ করে।

” তুই কেন বারবার আমাকে বিরক্ত করছিস? তোর কি একটুএ লজ্জা নেই? আমার বাড়িতে এসে অপমানিত হলি? তারপরও এমন ছ্যাঁচড়ার মত করছিস? ” সবুজ ফোন রিসিভ করতেই দৃষ্টি ওকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলতে শুরু করে।

” তোর তেজ দেখছি খুব বেড়েছে রে হা’রা’ম’জা’দি! এত বাড়িসনা, এমন ডোজ দিব যে ধপ করে নিচে পরবি। ভালো চাইলে আমি যা বলছি তাই কর। ”

” আমি তোর বাড়িতে যাবনা। আর না মামলা তুলব। তুই যা পারিস করে নে। তবে আমি তোকে জেলের ভাত খাইয়েই ছাড়ব। ”

” তুই আজ খুব ভুল করলি। এর জন্য তোকে পস্তাতে হবে। ”
সবুজ ফোন কেটে দিলে দৃষ্টি হাঁফ ছাড়ে।

তাহমিদ নিজের রুমে ডিভানে বসে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। কুহুকে ভেতরে আসতে দেখে সে উঠে বেলকনিতে যায়। কুহু বুঝতে পারল, তাহমিদ চায়না কুহু ওর কথা শুনুক।
কুহু ঠোঁট একটু বাঁকা করে সেন্টার টেবিল থেকে বই নিয়ে বিছানায় বসে।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পর তাহমিদ রুমে আসে।
কুহু এক মনে পড়ছে। তাহমিদ বারবার কুহুর মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

” আমার বউটা কি করে? ও বউ, একটু তাকাওনা কতক্ষণ তোমার মুখটা দেখিনি। আমার বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করছে। ”

” হয়েছে। এত ঢং করার দরকার নেই। নিজেই এতক্ষণ যাবৎ কার সাথে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে এসে এখন বলছে, কতক্ষণ দেখিনা। ভালোবাসা যেন উপচে পড়ছে। ”

” আমার বউ দেখি রা’গ করেছে! আমি এতক্ষণ একটা ছেলের সাথে কথা বলছিলাম। যদি কোন মেয়ের সাথে কথা বলতাম, তাহলে রা’গ করলে মানাত। আমার বউ আজকাল হিং’সু’টে হয়ে যাচ্ছে! রাগ করলে আমার সোনা পাখিকে একদমই পঁচা লাগে৷ ও বউ, একটু হাসোনা।” তাহমিদ কুহুকে জাপ্টে ধরে।

” ভাই, রুমে আছো? এই অধম অনেকক্ষণ যাবৎ নিচে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দয়া করে তোমার মুখটা একটু দেখাবে। ” দরজার বাইরে থেকে আনান কথা বলে।
আনানের আওয়াজ পেয়ে তাহমিদ কুহুকে ছেড়ে দেয়।

” এভাবে চোরের মত ডাকছিস কেন? ভেতরে আয়। ”
আনান ভেতরে আসে।

” ভাইয়া, তুমি কেমন আছো? ফুপু কেমন আছে? আরোশি, ফুপা ওরা কেমন আছে? ”

” আমি এখানে আসলেই তোর সবার কথা মনে পরে? এমনিতে তো খোঁজ নিসনা। এতদিন শুনেছি বিয়ের পর ভাই পর হয়ে যায়। কিন্তু তোকে দেখে সেই ধারনা পাল্টে গেছে। কেম্নে পারলিরে কুহু, সবাইকে এত তারাতারি ভুলে যেতে! এখন বর তোর কাছে আপন হয়ে গেল! ”

” তুই আমার বউকে এভাবে বলছিস আনান ! বউ আমার, সময় দিবে আমাকে, এতে তোর এত জ্ব’ল’ছে কেন! একটামাত্র বউ আমার। তাকে এভাবে বললে আমার হাত চুলকায় , বুঝেছিস? আর তাছাড়া, এগুলো বড় ভাইয়ের কথা? ”

” ভাই, তুমিও আজকাল আগের মত নেই। আর খোঁজ খবর নাওনা। শুধু সারাদিন বউ বউ কর। বিয়ে তো তোমার দাদা করেছে, তোমার বাবাও করেছে, তারা তো এমন বউ বউ করেনা! যদিওবা তোমার দাদার কথা আমার মনে নেই। কিন্তু চোখের সামনে তোমার বাপ-চাচাকে দেখছি। ”

” আমার বউ নিয়ে তোর এত মাথা ব্যথা কেন! তুই নিজের দিকে নজর দে। এখনই যেমন ছ্যাঁচড়ার মত পেছন পেছন ঘুরিস, বিয়ের পর মনে হয় এক বছর রুম থেকে বেরই হবিনা। ”

” আসতাগফিরুল্লা, তুমি না বড় ভাই! একটুতো লজ্জা কর। তোমার কথা শুনে আমি লজ্জা পাচ্ছি। ” আনান লজ্জা পাওয়ার ভান করে।

” ওরে লজ্জাবতী বানর রে। থাক এত লজ্জা পেতে হবেনা। শেষে দেখা যাবে…..

” আমি কি একটু কথা বলতে পারি? নিজেরা যেভাবে আজাইরা প্যাচাল শুরু করেছেন, মনে হচ্ছে ইহকালে আপনাদের এই প্যাচাল শেষ হবেনা। আজাইরা পাব্লিকদের আজাইরা প্যাচাল৷ ”

” ওহে, আনান, আজকাল তোর বোন ভিষণ ঝ’গ’রু’টে হয়ে গেছে। কথায় কথায় আমার সাথে রা’গ করে, গাল ফুলিয়ে থাকে। আগে ভেবেছিলাম বউ আমার ভিষণ শান্ত, ঠান্ডা মাথার। কিন্তু এখন দেখছি পুরাই উল্টো। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহু আর রুমে থাকেনা। তাহমিদের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুম ত্যাগ করে।

” দিলে তো ওকে রা’গি’য়ে। পরে তোমার খবর আছে। উইমেন পাওয়ার কি রাতে টের পাবে। এক মিনিট তুমি আমাকে বানর বললে কেন? আমি বানর হলে, তোমার ভবিষ্যৎ ভাগ্নে-ভাগ্নীও বানর হয়ে জন্মাবে, বুঝলে? ” চোখ টিপে বলে আনান।

” মনে রাখিস তুই ছোট বোনের বিষয়ে কথা বলছিস। তোর ছোট বোন রাতে কি করবে এটা ভাবছিস তুই! তুই দেখছি বেশি পেকে গেছিস! ভবিষ্যৎ পোলাপানের কথাও ভেবে রেখেছিস? ”

” মাফ চাই, ভাই আমার। এবার আসল কথায় এস। ডেকেছ কেন? ”

” শোন, সবুজের কোন খোঁজ আমার ছেলেরা পায়নি। শা’লা যে কোন গর্তে ঢুকেছে, আল্লাহই জানে। ওকে পেলে এবার কে’টে টু’ক’রো টু’ক’রো করব। আমার শ্বশুরকে ওই শা’লা ভিষণ প্যারা দিচ্ছে। তুই তোর ছেলেদের ভালো করে বলে দে, ওকে যত তারাতারি পারুক খুঁজে বের করতে। ”

” ভাই, আমি ওদের বলে দিয়েছি। কাল ফুলতলা যাওয়ার পথে ওদের সাথে দেখা করতে হবে। ওদেরকে কিছু টাকা-পয়সাও দিতে হবে। ”

” আমি একটু আগেই আমার ছেলেদের সাথে কথা বলেছি। টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছি। কালকে তোকে টাকা দিব, তুই ওদেরকে দিস। ”

” ভাই, আমার কাছে টাকা আছে। তোমার দিতে হবেনা। ”

” কি করতে হবে আর না হবে সেটা আমি বুঝব। কিন্তু এবার বল, তুই এত আগেই এখানে এসেছিস কেন? আমরা ফুলতলা যাব কালকে। কিন্তু তুই আজ দুপুর না হতেই হাজির হয়েছিস! আমি তোকে রাতে আসতে বলেছিলাম। ”

তাহমিদের কথা শুনে আনান মাথা চুলকে হাসে।

” বুঝোইতো ভাই। তবুও এভাবে প্রশ্ন করে লজ্জা দাও কেন। জানোনা আমি একটু লাজুক টাইপের। ”

” জানিতো তুই কেমন লাজুক। তবে এখন থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত তুই আমার সাথে থাকবি। নো হাংকিপাংকি। ”

” ভাই, এত নির্দয় হয়োনা। তোমার এই হিরো মার্কা চেহারায় অমরেশ পুরীর রোল ভিষণ বেমানান। আরেকটা গোপন কথা, তোমার বোনও কিন্তু তোমার মতই। ঠিক যেন অমরেশ পুরীর লেডিস ভার্সন। আমি যদি তার সাথে একটু ইয়ে সিয়ে না করি, তবে সে আমার দিকে ফিরেও তাকাবেনা। ”

” তুই আমাকে আর আমার বোনকে ইনসাল্ট করছিস! আবার আমার থেকে সুযোগও চাচ্ছিস! নো ওয়ে। তুই আজ রাতেও আমার কাছে ঘুমাবি। ”
” তোমার বউকে আলাদা রেখে আমার কাছে ঘুমাবে! এটা একদমই ঠিক হবেনা ভাই। আমি জানি বউকে দূরে রেখে তোমার ঘুম আসবেনা। আমি এতটাও নির্দয় নই যে, আমার জন্য সারারাত তোমাকে নির্ঘুম কাটাতে হবে। আমি এটা হতেই দিবনা। ” দাঁত কেলিয়ে বলে আনান।

” আমার চিন্তা তোকে না করলেও চলবে। এবার চল একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। রাতের হিসেব রাতে হবে। ”

আনান মুখ কাঁচুমাচু করে তাহমিদের পেছনে হাঁটতে থাকে।

চলবে….

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৮
জাওয়াদ জামী

” তোর বাপের ভুঁড়ির দিনদিন উন্নতি হচ্ছে, বুঝলি? কেম্নে কি! আমি হাজার খেয়েও এক ইঞ্চি ভুঁড়ি বাড়াতে পারিনা, কিন্তু তোর বাপ একবেলা খেয়েই ড্রামের মত ভুঁড়ি হয়েছে, ভাবা যায়! ” সিক্তার রুমে এসে বিছানায় বসতে বসতে বলে আনান।

” তুমি আবার শুরু করেছ! আর একবার যদি আমার বাবাকে নিয়ে কিছু বলেছ, তবে ভালো হবেনা বলছি। ”

” তুই কি করবি রে! ভুঁড়িয়াল বাপের মেয়ে। তোদের দৌড় আমার জানা আছে। তোর বাপের পেট ভর্তি ভুঁড়ি, আর তোর মাথা ভর্তি ব্রেইনের পরিবর্তে ভুঁড়ি গিজগিজ করছে। ”

” আনাইন্না রে, তুই যদি এবার না থামিস, তবে তোর সাথে ব্রেকআপ। সারাজীবনের জন্য তোর এই বাড়িতে আসার পথ রুদ্ধ করে দিব। ”

আনানের জন্য এই কথাটুকুই যথেষ্ট। চুপসানো মুখে তাকিয়ে থাকে সিক্তার দিকে।

” তুই আর তোর ভাই দুজনেই হিটলারের বংশধর। তোদের মনে দয়ামায়া কিচ্ছু নেই। এভাবে ব্রেকআপের কথা শুনলে আমার বুকের ভিতর হাতুড়ির ঘা পরে। কিন্তু তুই যদি এসব বুঝতি। ”

” এতই যদি কষ্ট পাও, তবে আমার বাবাকে নিয়ে এমন কথা বল কেন? গুরুজনকে সম্মান করতে জানোনা। ”

আনানের মুখের দিকে তাকিয়ে সিক্তার খুব খারাপ লাগে। বেচারার ব্রেকআপের কথা শুনেই চোখমুখ কালো হয়ে গেছে।
সিক্তা কিছু না ভেবেই টুপ করে আনানের কপালে চুমু দিয়েই, দৌড়ে রুম থেকে পালায়।

আনান সিক্তার এমন কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেছে।
সিক্তা যে এমন কিছু করতে পারে তা ওর কল্পনায় ছিলনা।

” বাছা, আনান। এ কি হলো তোর! প্রেমিকার ঠোঁটের ছোঁয়া আকস্মিকভাবে পেয়ে গেলি! সাধু বাছা, সাধু। আহা, এমন প্রেমিকা যেন বাংলার ঘরে ঘরে হয়। ” আনান বুকে হাত দিয়ে ধপ করে সিক্তার বিছানায় শুয়ে পরে।

স্যারের ফোন পেয়ে তাহমিদ সন্ধ্যার পরে মেডিকেলে গিয়েছিল। ওর বাসায় ফিরতে রাত হয়।
কুহুকে ফোন করে জানিয়েছিল, ওর আসতে রাত হবে। ওর অপেক্ষা না করে কুহু যেন খেয়ে নেয়।
তাহমিদ মেডিকেলের কাজ শেষ করে, স্যারের সাথে তার বাসায় যায়। সেখানে রাতের খাবার খেয়েই তবে বাসায় ফিরে।

তাহমিদ রুমে এসে দেখল কুহু ঘুমিয়ে পরেছে। সে আর কুহুকে না জাগিয়ে, ফ্রেশ হয়ে এসে, কুহুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরে।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলে কুহু নিজেকে তাহমিদের বুকে আবিষ্কার করে। ওর ঘুম ঘুম চেহারায় হাসির রেশ ফুটে ওঠে। সে নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার প্রানপ্রিয় মানুষকে।

ভোরের আলো ফুটতেই তাহমিদ আর আনান বেরিয়ে পরে ফুলতলার উদ্দেশ্যে। তারা সকাল দশটার মধ্যেই ফুলতলা পৌঁছাতে চায়। আজ সন্ধ্যায় তাহমিদকে মেডিকেলে যেতে হবে, তাই ওরা ভোরেই যাত্রা শুরু করেছে।

দৃষ্টি ঘুম থেকে জেগে ফোনের দিকে নজর যেতেই দেখল, সবুজের অনেকগুলো ম্যাসেজ।
সবুজ বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে ওকে। সাইলেন্ট থাকায় দৃষ্টি বুঝতে পারেনি।
সবুজ ওকে কোন ম্যাসেজে ফোন রিসিভ করতে বলেছে। কোন ম্যাসেজে ওকে অ’শ্লী’ল গা’লি দিয়েছে। কোন ম্যাসেজে দৃষ্টির বাবাকে গালি দিয়েছে। আবার কোন ম্যাসেজে মামলা তুলে নিতে বলেছে।
এতসব ম্যাসেজের মাঝে একটা ম্যাসেজ দৃষ্টির মনোযোগ আকর্ষন করে। ম্যাসেজটায় একটা লিংক দেয়া। দৃষ্টি কৌতুহলী হয়ে লিংকে ক্লিক করে।

সকালে কায়েসের ঘুম ভাঙ্গলো ফোনের রিংটোনের শব্দে। সে ফজরের নামাজ আদায় করে আবার ঘুমিয়েছিল। কয়েকদিন থেকে চিন্তায় ঘুম আসেনা, বিধায় ফজরের নামাজের পর আবার ঘুমায়।
কায়েস চোখ কচলে, ফোন হাতে নিয়ে দেখল আননোন নম্বর থেকে ফোন এসেছে।
কায়েস ফোন রিসিভ করেই বুঝল সবুজ ফোন দিয়েছে।

” এই, জা’নো’য়া’র, তোকে আমি ফোন দিতে নিষেধ করেছি এটা তোর মাথায় থাকেনা? এখন তোর জন্ম নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। আর যদি তুই আমাকে ফোন করিস তবে আমি পুলিশের কাছে যাব। ” কায়েস ঘৃণার সাথে বলে উঠে।

” আব্বে শা’লা, তোর সাথে কথা বলার জন্য আমি পস্তাচ্ছিনা বুঝলি? আমি তোকে একটা কথা জানাতে ফোন দিয়েছি। তোর ফোনে দেখ একটা ভিডিও পাঠিয়েছি। শালা শু’য়ো’র, তোর মুখে থুথু মারি শা’লা। ফোন রাখ শা’লা। ” সবুজের কথা শুনে কায়েস স্তম্ভিত। কোন মানুষ এতটা বেয়াদবও হতে পারে!

কায়েস ফোনের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে একটা ভিডিও পায়। কোন কিছু না ভেবেই ক্লিক করে ভিডিওতে।

শিউলি ঘরে এসে দেখল কায়েস বিছানায় মাথা নিচু করে বসে আছে।
সে বেশ কয়েকবার ডাকলেও কায়েস সাড়া দেয়না।
শিউলি চিন্তায় অস্থির হয়ে কায়েসের শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকে। কায়েস শুধু চোখ তুলে তাকায়। শিউলিকে কিছুই বলেনা।
শিউলি কায়েসের এমন ব্যবহারে ভয় পাচ্ছে।
তার একসময় নজর যায় কায়েসের হাতে থাকা ফোনের দিকে। সেখানে কোন একটা ভিডিও চলছে।
শিউলি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ফোন হাতে নেয়। ভিডিওর দিকে চোখ যেতেই তার হাত-পা কাঁপতে থাকে।

” শিউলি, দৃষ্টি কোথায়? এই মুহূর্তে আমারদের মেয়েটার পাশে থাকা দরকার। তুমি তারাতারি ওকে ডাক দাও। ” কায়েস অনেকক্ষন পরে ধাতস্থ হয়ে শিউলিকে বলে।
কিন্তু সে যতই নিজেকে শক্ত দেখাক না কেন ভেতর থেকে সে ভেঙে পরেছে। মনে হচ্ছে তার বুকের পাঁজরে কেউ যেন পে’রে’ক মে’রে’ছে।

কায়েস কয়েকবার বললেও শিউলির ওঠার নামই নেই। এসব কি দেখল সে! তার মেয়ের জীবনটা যে নষ্ট হয়ে গেল।
সে নিজে মেয়ের ভালোবাসাকে সাপোর্ট দিয়েছিল। আজ কি তার কারনেই মেয়েটার এই দুর্দশা?

” কি ব্যাপার, শিউলি! তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছনা? তুমি এখনই দৃষ্টিকে ডাক। ” কায়েসের ধমক শুনে শিউলি উঠে ধীর পায়ে দৃষ্টির রুমের দিকে যায়।

শিউলি ধীরে ধীরে দৃষ্টিকে ডাকছে। তার শরীরে একফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই।
শিউলি বেশ কয়েকবার দৃষ্টিকে ডাকে। কিন্তু দৃষ্টি কোন সাড়া দেয়না। শিউলি ভাবল দৃষ্টি বোধহয় এখনও ঘুমাচ্ছে।
এদিকে সকাল দশটা বেজে গেছে সেই খেয়াল শিউলির নেই। শিহাব এসে মায়ের কাছ থেকে খাবার চাচ্ছে। কিন্তু শিউলি এখন পর্যন্ত রান্নাই করেনি।

কায়েস ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল শিউলি এখনো দৃষ্টিকে ডাকেনি। এতে কায়েসের ভিষণ রা’গ হয়। সে শিউলির দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে, নিজেই যায় দৃষ্টিকে ডাকতে।

অনেকক্ষন ডাকার পরেও যখন দৃষ্টি দরজা খোলেনা, তখন কায়েস ভয় পায়। সে জোড়ে জোড়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে। এত ডাকার পরেও যখন দৃষ্টি দরজা খুললনা, কায়েস তখন শিহাবকে সাথে নিয়ে অনেক কষ্টে দরজা ভেঙে ফেলে।
ঘরে ঢুকেই ওরা সবাই স্তব্ধ হয়ে ফ্যানে ঝু’ল’ন্ত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে।
সম্বিৎ ফিরলে শিউলি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কায়েস ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। আর শিহাব ভয়ে কাঁপছে।
শিউলির চিৎকার ঘরের চার দেয়ালের মাঝেই আছড়ে পরে। বাইরে থেকে কেউই জানতে পারলনা, নিজের স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়ে এক কিশোরী নিজের জীবনের অধ্যায়ের ইতি টেনেছে।
কায়েস মেঝের সাথে সেঁটে গেছে। সে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়েছে। শিউলি চেষ্টা করছে মেয়েকে নামানোর, কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। এরপর ছুটে যায় কায়েসের কাছে।

” ও, দৃষ্টির আব্বু। তুমি আমার মাইয়ারে নিচে নামাওনা। আমার মাইয়ার কষ্ট হইতাছে, তুমি দেখতাছো না। আমার মাইয়াডা মইরা যাবো তো। তুমি এত নি’ষ্ঠু’র কেন? ” এই কথা বলেই শিউলি জ্ঞান হারায়।
কায়েস একবার মেয়ের দিকে আরেকবার শিউলির দিকে অসহায়ের মত তাকায়।

শিহাবের যখন হুঁশ আসে তখন ও দৌড়ে বাবার রুমে এসে, বাবার ফোন নিয়ে তাহমিদকে ফোন করে।

ওরা যখন ফুলতলার রাস্তায় ঢুকেছে তখনই কায়েসর ফোন আসে। তাহমিদ শ্বশুরের নম্বর দেখে রিসিভ করে।

” আসসালামু আলাইকুম, বাবা। আমরা আর কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে পৌঁছে যাব। ”

” ভা..ভাইয়া, আমি শিহাব। তুমি তারাতারি এস। ” কাঁপা কাঁপা গলায় এতটুকু বলেই শিহাব ফোন কেটে দেয়।

তাহমিদ কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।

” কি হয়েছে, ভাই? তোমাকে এমন চিন্তিত লাগছে কেন? মামা ফোন করেছিল? ”

” নাহ্। শিহাবের ফোন ছিল। কিন্তু ও কিছুই বললনা। শুধু তারাতারি যেতে বলল। কি হয়েছে বলতো? শিহাব তো এরকম করেনা। ”
কথা বলতে বলতে তাহমিদ কায়েসের ফোনে ফোন দেয় । কিন্তু কয়েকবার ফোন করার পরও কেউ রিসিভ করেনা। এবার তাহমিদের ভয় হচ্ছে।

আরও পনের মিনিট পর ওরা কায়েসের বাড়ির সামনে আসে। ড্রাইভার কয়েকবার হর্ন দেয়। অনেকক্ষণ পর শিহাব এসে দরজা খুলে দেয়।
ওরা দুজন শিহাবের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে।
শিহাবও কিছু না বলে দৌড়ে ঘরের দিকে যায়। তাহমিদ আর আনানও শিহাবের পিছুপিছু যায়। দৃষ্টির ঘরে ঢুকেই ওরা যেন জমে যায়।

শিউলি মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে পরে রয়েছে। কায়েস স্থীর হয়ে বসে রয়েছে। আর সামনেই ফ্যানে ঝু’ল’ছে দৃষ্টি ।

” ভাই, জলদি পুলিশকে ফোন কর। ” আনান ব্যস্ত হয়ে যায় মামা-মামীকে নিয়ে।

তাহমিদ এক পা দু পা করে এগিয়ে আসে দৃষ্টির দিকে।

” আরেকটু সময় অপেক্ষা করতে পারলিনা! আমি তোকে বলেছিলাম, আজকেই আসব। কিসের এত তাড়া ছিল তোর? আমি কুহু, বড়মাকে কি জবাব দিব! তোর বাবা-মা’কে কেমন করে সামাল দিব? এতটা অধৈর্য্য হলি কেন! ” তাহমিদের চোখে পানি।
হাতের উল্টোপিঠে পানি মুছে ফোন করে বড়মার কাছে। তাকে জানায় যত তারাতারি পারুক ফুলতলা আসতে।

চলবে…