বিন্নি ধানের খই পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
306

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৩১
#মিদহাদ_আহমদ

বায়োলজির ব্যবহারিক পরীক্ষার দিনেও আমার বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো আসিফের দেহাবয়ব। মনের মাঝে জায়গা করে নিচ্ছিলো এক অজানা শঙ্কা। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগের দিনই আসিফ আমাদের বাসায় এসে হাজির। তার টয়োটা প্রভোক্স নিয়ে এসেছে সে। সাথে আমার ছোট ছোট ভাই দুইটার জন্য কতকিছু সে এনেছে! চকোলেট গুলার গায়ের মূল্য না দেখেই আমি আন্দাজ করতে পারলাম এগুলোর দাম আট দশ হাজারের কম হবে না। দুইটা ব্যাগ ভর্তি গরুর মাংস, মোরগ, বড় মাছ, চাল-ডাল সহ পুরো বাজার সদাই কম করে হলেও বিশ হাজার টাকার হবে। আমি আসিফকে জিজ্ঞেস করলাম এত টাকা সে কোথায় পেলো। এগুলো উপার্জন করতে তো তার মাস দুইয়েক লেগে যাবে। আসিফ হেসে হেসে আমাকে বললো, এতকিছু নাকি আমার ভাবার দরকার নাই। সে এনেছে আমার মায়ের জন্য, ভাইয়ের জন্য৷ আর আমার ভাই আমার মা নাকি তারও ভাই, তারও মা। তারও অধিকার ও দায়িত্ব আছে তাদের প্রতি। আমার মা এসে হাসি মুখে আসিফকে বললেন,

‘বাবা এতকিছুর কী দরকার ছিলো বলো?’

‘মা এতকিছু কই? গরুর মাংসেট কালা ভূণা আর মোরগের পাতলা ঝোল রান্না করেন তাড়াতাড়ি। আপনার হাতের কালা ভূনার সে কী স্বাদ! আমার একদম মুখে লেগে থাকে সব সময়।’

‘আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। আমি রান্না করতে গেলাম। তুমি আসবে জেনে তোমার পছন্দের চুটকি সেমাই রান্না করে রেখেছি দুপুরেই৷ নারিকেল দিয়ে। আর নারকেল পুলিও করেছি। দিচ্ছি এনে।’

‘আচ্ছা মা নিয়ে আসেন তাড়াতাড়ি।’

জামাই-শাশুড়ির এই কথোপকথন শুনে আমি আর আমার নিজের কথা আগ বাড়িয়ে বাড়াতে গেলাম না। মনের কথাগুলো মনের মাঝেই চেপে রাখলাম।

পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসতে আসতে দুপুর দুইটা বেজে গেলো। আসিফকে দেখলাম রুমে বসে মোবাইল টিপছে৷ পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আমি আশা করেছিলাম আসিফ আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে হয়তো। হয়তো সে আমার পছন্দের চালতার আচার হাতে নিয়ে জাম গাছের ছায়ায় দাঁড়ানো থাকবে। কিন্তু তা আর হলো না৷ অথচ ঠিকই আমার বান্দবি টগর, অবন্তী, নোহাদের প্রেমিক তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে! সবাই আমার চোখের সামনে দিয়ে নদীর দিকে চলে গেলো!

বাড়িতে আসতেই আসিফ তার মোবাইল আমার সামনে এনে দেখিয়ে বললো,

‘নুপুর দেখো দেখো, জায়গাটা কেমন?’

আমি জোর করে হাসি এনে বললাম,

‘সুন্দর।’

মনে মনে আশা করেছিলাম আসিফ জিজ্ঞেস করবে আমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে। কিন্তু এর কোনটাই যেনো ঘটলো না৷ তারপর আসিফ আবার যুক্ত করলো,

‘সেখানে যাওয়ার প্ল্যান করছি। জান জায়গাটা কোথায়?’

‘না জানালে জানবো কীভাবে?’

‘মালদ্বীপ৷ কী জোস না দেখতে? রিসেন্টলি যাবো আমরা দুজনে। কেমন?’

‘তোমার সেভিংসয়ে কি মালদ্বীপ ট্যুর দেয়ার মতো টাকা জমা আছে এখন?’

‘উহু! এসব নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার।’

কথাটা বলতে না বলতেই মা মোবাইল এনে আমার কানে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘তোর শাশুড়ি কল করেছে। কথা বলে নে।’

শাশুড়ি মা আমাকে কলে বললেন, সাথে করে যেনো মাকে নিয়ে আসি। এদিকে তামান্নার বিয়ের তারিখও কাছিয়ে এসেছে। কল রেখে মাকে বললাম আমাদের সাথে চলে আসতে। মা না করে দিলেন। বললেন, বিয়ের আগে যাবেন নাকি। এখন ভাইদের স্কুল আছে। আমিও আর জোর করলাম না মাকে।

দুপুরে খেয়েদেয়ে আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম। মা আমার বিদায়ের বেলা ঠিকই এই ঘর ওই ঘর থেকে চাচি খালাদের ডেকে এনে গাড়ি দেখাতে লাগলেন এইটা বুঝতে আর আমার বাকি রইলো না।

বাসায় ঢুকতেই শাশুড়ি মা এগিয়ে আসলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘পরীক্ষা কেমন হলো?’

আমার জবাবের আগেই আমার ননাস বললো,

‘তা আর কেমন হবে বলো? টেনেটুনে পাশ করবে হয়তো। মেয়েরা সাইন্স পড়ে নাকি আবার?’

আমি আমার ননাসের মাথা থেকে পা পর্যন্ত চেয়ে দেখলাম এবার। ননাসের এমন ভূষণ আমি এর আগে দেখিনি কখনো। কাতান শাড়ি গায়ে জড়ানো, মাথায় বড় করে একটা খোপা, নাকে কানপাশার মতো বড় একটা নাকফুল, কানে মোটা মোটা দুইটা কানপাশা, উপরের কানে দুইটা মোটা, শক্ত রিং যেই রিংগুলো আমরা সাধারণত নিচের কানেই পরে থাকি। বাহুতে হাতপাশা, হাতপাশা দেখানোর জন্য ব্লাউজ যেনো হাফ হাতা থেকেও অল্প একটু উঁচুতে রেখে বানানো, হাতের আঙুল বরাবর দুই আংটি জড়ানো রতনচুর, গলায় ভারি হাসলি, হাসলির পরে সীতা, কন্ঠ বরাবর কন্ঠচিক যেনো গলা বিধে আছে। হাতভর্তি পাতলা পাতলা চুড়ির দুইপাশে দুইটা দুইটা করে গোলাপ বালা! আমার উপর থেকে নিচে আর নিচ থেকে উপরে চোখ উঠানামা করতে লাগলো। আমার ননাসের বয়সও যেনো এক ধাপে বেড়ে গিয়েছে বছর পনেরো, এমন মনে হতে লাগলো।

ননাস আমার দিকে চোখ ইশারায় বললো,

‘কী? ভূত দেখলা নাকি?’
ননাস আমার হাতে ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে এসে বললেন,

‘এখন বাপু জোর হাতে এই ঘরের কাজ করতে বসো। এখন এসব পড়াশোনার ঝাক্কি ঝামেলা শেষ। ঘরের বউ, ঘরের বউয়ের মতো চলো এবার। বুঝলে? আর আমাকে দেখে এমন ঘাবড়ে গেলে কেন?’

‘না আয়ায়া মানে আপনি কি আজ কোথাও…’

আমার শেষ হওয়ার আগেই আমার ননদ তামান্না ফোন টিপতে টিপতে এসে বললো,

‘ওসব তুমি জানো না ভাবি। আমাদের দাদির আমলের গহনা যা যা ছিলো সব ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে। সমান সমান তিন ভাগ। আপুর ভাগে এসব এসেছে। তোমারও সেইম। বিশ ভরির মতো হবে। তোমার গুলা মায়ের কাছে আছে। আর আপু আজ দশদিন ধরে তার এসব পরে আছে। এই হলো কাহিনী।’

ননদের দিকে তাকিয়ে দেখি আরেক কাহিনী! তার গলায় একটা না, দুইটা না, চার চারটা ভারি চেইন। হাত ভর্তি চুড়ি। এ যেনো সব আঁকড়ে ধরেছে নিজেদের কাছে কেউ নিয়ে যাবে এমন!

ননাস বললো,

‘এখন ঘর সামাল দাও। বুঝলে?’

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। রুমে গেলাম। কাপড়চোপড় সব এক পাশে রাখলাম। আসিফ আমাকে দিয়েই বাইরে চলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর শাশুড়ি এসে বললেন,

‘তোমাকে জানানো হয়নাই, তামান্নার জন্য দুই সেট ফার্ণিচার অর্ডার দেয়া হয়েছে।’

‘দুই সেট? তারা তো কোনকিছু চায়নি মা। তাহলে এসব কেন?’

‘তারা চায়নি তো কী হয়েছে? এসব কি আজকাল কেউ চায় বলো? আমি আর তোমার শ্বশুর মিলে ঠিক করেছিলাম কাঁঠাল কাঠের এক সেট ফার্ণিচার দিবো। দেখো এক সেটে একটা গাছ ডিজাইনের খাট, একটা পূবালি, একটা আলমারি, একটা ওয়ারড্রব, খাটের পাশেত দুইটা সাইড বক্স, একটা আলনা, একটা শাড়ি বক্স, একসেট সোফা, সোফার সাথের তিনটা টেবিল, একটা চার দরজার ওয়াল কেভিনেট, একটা তিন দরজার কিচেন কেভিনেট, একটা গ্লাসের দশ চেয়ারের টেবিল চেয়ারের সেট, নামাজের ছোট খাট, দুই দরজার বড় ওয়ালটনের ফ্রিজ আর একটা দুই টনের এসি দিবো একটা। ফার্ণিচার সেটের ই দাম এসেছে সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা।’

শাশুড়ির কথা আর এত ফার্ণিচারের ফিরিস্তি শুনে আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। নিজেকে সামলে বললাম,

‘এতকিছুর পরও দুই সেট কেন আবার?’

‘আরে সবকিছু নিয়ে যেতে হবে না? একবারে সব না নিয়ে গেলে হয়?’

আমার কথার পিঠে কথা বলে, গায়ে ভারি ভারি গহনা পরা আমার ননাস রুমে এসে ঢুকলেন। তারপর একটা পান মুখে ঢুকাতে ঢুকাতে কোন এক প্রাসাদের গিন্নির মতো বলে বসলেন শাশুড়িকে,

‘সব দিয়ে দিবা নাকি খালি করে?’

‘সব কী দিচ্ছে? কী দিচ্ছে সব? তুমি কি কম নিয়েছো? তোমাকে কি কম দিয়েছে? বিয়েতে পাঁচ হাজার লোক খাইয়েছে, তোমার জামাইকে নগদ দশ লাখ টাকা দিয়েছে, এসব কি ভুলে গেছো? নাকি আমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে?’

‘আরে আরে আরে! এসব তো আমি বলেকয়ে নেইনি। তারা চাইছে তাই দেয়া হয়েছে। তোর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কি চেয়েছে এসব? তাদের তো শুনলাম একটা লক্ষ্মীমন্ত বউ দরকার। তাদের এসব দরকার নাই। তাহলে কেন তুই এসব নিচ্ছিস?’

‘অহ তাদের দরকার নাই বলে আমি ছেড়ে দিবো নিজের অধিকার?’

‘অধিকারের প্রশ্ন এখানে কেন আসছে? কে কাকে বলেছে অধিকার নিয়ে কথা বলতে? অহ এখন নিজের অধিকার চাইতে এসেছো এখানে? বাহ বাহ’

‘আপু বেশি বাড়াবাড়ি করো না কিন্তু বলে দিলাম। ভালো হবে না। আমার যা ইচ্ছা আমি তাই নিবো।’

‘যা ইচ্ছা তাই নিবি মানে?’

এবার আমার ননদ তার মায়ের দিকে ফিরে বললো,

‘আমার চয়েজ করা হাতিলে ফার্ণিচার সেট তিন লাখ একুশ হাজার টাকা দাম। ওইটা তো দিতে হবেই হবে সাথে কাঁঠাল কাঠের ফার্ণিচার সেট যেইটা দেখে এসেছো তোমরা, ওইটারও কোন কম যেনো না হয়৷ তুমি আপুকে বিয়ের সময়ে তোমার বিয়ের হাসলি হার দিয়েছিলা, আমাকে তোমার সীতাহার দিতে হবে এবার।’

এবার ননাস আমার ননদকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,

‘হাসলির দ্বিগুণ স্বর্ণ সীতাহারে। তোকে এখন সীতাহার দিলে মায়ের হাতের চূড় দুইটা আমাকে দিতে হবে।’

‘ব্যস! তোদের হলে এবার দুজন দুজনের রুমে যা। আমার যা আছে সব দিয়ে দিবো। সব নিয়ে যাস দুজনে।’

‘দেখি কে কতটুকু নিয়ে যায় একা একা।’

বলে আমার ননাস রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো।

ননদ বললো,

‘আমিও দেখি কাকে ছেড়ে কাকে দেয়া হয় এসব।’

ননস, ননাদ দুজনে তাদের রুমে চলে গেলো। শাশুড়ি বিছানায় বসে হাউমাউ ডাকিয়ে কেঁদে আমাকে বললেন,

‘আজ একটা মাস ধরে এসব চলছে নুপুর। দুজনের মধ্যে কে বেশি নিবে কে কম নিবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতা যেনো!’

আমি শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলাম। শ্বশুর বাড়ি থেকে কিছু মেয়ে যৌতুক না, কিছু মেয়ে যেচে যেচেই যৌতুক নিয়ে যায় যেনো! তারা চায় সবকিছু শোষণ করে তার অবস্থাসম্পন্ন বাবা মায়ের ঘর থেকে যতো পারা যায় নিয়ে যেতে। অথচ এই যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ যে নারীর করার কথা, সেই নারীই যেনো গর্ব করে আসবাব সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে তার নতুন বাড়িতে! হায়রে সমাজ! সমাজের নারীরাই তাদের সম্মান দিতে জানে না, তখন সমাজের অন্যরা তাকে সম্মান দিবে কীভাবে?

রাত দুইটার দিকে আসিফ বাসায় এলো। আমি তার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষায় ছিলাম। আমি খাইনি তাকে রেখে। আসিফ বাসায় ঢুকতেই হাতমুখ ধূয়ে তাকে খেতে আসতে বললে আসিফ বললো,

‘তুমি খেয়ে নাও। আমি খেয়ে এসেছি।’

আসিফের এই কথা শুনে আমার মন সমুদ্রে বইতে লাগলো দুঃখের বন্যা। এক বিস্তর ভূমিকম্প আমাকে কাঁপিয়ে তুললো। আমি যেনো ভালোবাসার শূন্যতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম নতুন করে।

কিছু খাবার আর ইচ্ছা আমার রইলো না। বাসার সবাই ঘুমে। রান্নাঘরে প্লেইট, বাসন রেখে রুমে এলাম। রুমে ঢুকতেই দেখি আসিফ উপুড় হয়ে বাথরুমে কাশি দিচ্ছে। বাথরুমের দরজা খোলা। আমি ঢুকতেই দেখি পুরো বেসিন লাল হয়ে আছে আসিফের রক্তে!

চলবে।

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৩২
#মিদহাদ_আহমদ

আমার টের পেয়েই আসিফ আমার দিকে ফিরে হাত ইশারায় আমাকে ঠেলে বাথরুমের বাইরে বের করে দিলো। তড়িঘড়ি করে দরজা লাগিয়ে নিলো। এত দ্রুত এসব হয়ে গেলো যে আমি কোনকিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না সহজে। আমি বাথরুমের বাইরে থেকে দরজায় হাত দিয়ে থাবা দিতে লাগলাম জোরে জোরে। আসিফ কোন কথা বললো না। পানি ছাড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম ভেতরে। কিছুক্ষণ পর পানির আওয়াজও বন্ধ হয়ে গেলো৷ ননাস আমার রুমে এস জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে? দরজার এতো জোরে জোরে থাবা দিচ্ছো কেন? তাও এতো রাতে? সবাই যে ঘুমাচ্ছে এদিকে কোন খেয়াল নেই? বদরুল অফিস থেকে এসে ঘুমিয়েছে। ওর মাথা ব্যথা করছে। এদিমে দিলে তার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। আসিফ কই?’

‘না আপা আসিফ আছে ভেতরেই।’

‘যত্তসব কান্ড। এখনও বাচ্চা রয়ে গেলা নাকি?’

কথাটা বলে ননাস চলে গেলেন রুম থেকে।

আসিফ বাথরুম থেকে বের হতেই আমি তাকে ধরে বসলাম। সে তোয়ালে দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে আমার দিকে চেয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলো। তারপর চুল মুছে আয়নার দিকে চেয়ে মাথার চুল একপাশে এনে রেখে বললো,

‘কী হয়েছে সুইটহার্ট? এমন কুম্বকর্ণের মতো মুখ করে বসে আছো যে? আমাকে দেখতে আজ একেবার নায়কের মতো লাগছে না? বাংলা সিনেমার বাপ্পারাত! ভারতের সুপারস্টার সাকিব খান! নাকি ওয়ান এন্ড অনলি অনিল কাপুর? হেই?

‘ওসব কী দেখলাম আমি?’

‘আচ্ছা শুনো না নুপুর…’

‘কোন শুনাশুনি নাই। আমি ওসব কী দেখেছি?’

‘কিছু না।’

কথাটা শর্টকাট করে বলেই আসিফ একটা ট্রাউজার পরে খালি গায়ে বিছানায় ওপাশ হয়ে ফিরে ঘুমিয়ে গেলো। আমি তাকে বার কয়েক ডাকলেও তার কোন সাড়াশব্দ আমি পেলাম না। এক অস্থিরতার মাঝে আমার রাত যেনো পার হতে লাগলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠলাম শাশুড়ির ডাকে। রাতে অনেক কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম সেদিকে আমার কোন খেয়াল নেই৷ শাশুড়ি ডেকে তুলে বললেন,

‘আসিফ কই? রুমের দরজা খুলা দেখলাম। আসিফও নাই দেখি। আর তোমার চোখ ফোলা ফোলা লাগছে কেন নুপুর?’

শাশুড়ির এতসব প্রশ্ন একসাথে শুনে আমিও ভিমড়ি খেয়ে গেলাম। পেছনে ফিরে দেখলাম আসিফ নাই। কাঁথা এক পাশে ফেলে রাখা আছে। শাশুড়ি আবার জিজ্ঞেস করলেন,

‘আসিফ কোথায়?’

‘জানি না মা। আমাকে তো বলে যায়নি। আমি ঘুমে ছিলাম।’

‘অহ আচ্ছা। তুমি উঠে তাড়াতাড়ি ঘর গুছিয়ে নাও বউমা। তামান্নার হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক আসবে এখন।’

‘কেন?’

‘ওই তারা গহনা নাকি আজকেই অর্ডার দিয়ে আসবে তামান্নার। আগে কিছুই জানায়নি। তামান্নার সাথে তুমিও যাবা।’

‘অহ আচ্ছা।’

আমি উঠে গেলাম বিছানা থেকে। ঘরদোর পরিস্কার করতে লাগলাম। এদিকে রান্নাঘরে যাওয়ার সময়ে শুনতে পেলাম আমার ননাস আর শাশুড়ির কথা কাটাকাটি হচ্ছে কী নিয়ে যেনো! ননাস শাশুড়িকে বলছে, আমি কেন যাবো তামান্নার সাথে। সে যাবে তামান্নাকে নিয়ে। ননাসকে শাশুড়ি বলছেন, তামান্নার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এতে হিতে বিপরীত ভাবতে পারে। আর এভাবে কনের বড় বোনের এসবে যাওয়া মানায় না। আমি আর এদিকে কান দিলাম না। রান্নাঘরে তাদের জন্য নাস্তা রেডি করতে করতে আসিফের নাম্বারে কল দিলাম। দুইটা রিং হতেই আসিফ কল ধরলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘কোথায় আছো?’

‘কাজে আছি। কোন দরকার?’

‘কী কাজে?’

‘দরকার কিছু?’

আসিফ তারপর খক খক করে কয়েকবার কাশি দিলো। আমি বুঝতে পারলাম মোবাইলের মাইক্রোফোন হাত দিয়ে চেপে ধরে ওপাশে সে কাশি দিচ্ছে। আমি বললাম,

‘কাশি দিচ্ছো কেন?’

আসিফের জবাবের আগেই ওপাশ থেকে কে যেনো আসিফকে বললো,

‘রেডি করা শেষ উস্তাদ। এখন মাল খাইয়া বইসা আছে এমনডা করন লাগবো। মাল ছাড়া কোন কথা হবে না।’

আসিফ আমাকে বললো

‘কোন কাজ না থাকলে আমি রাখি এখন নুপুর?’

এইটা বলতে বলতে সে আবার কাশি দিলো বার কয়েক। আমি কল কেটে দিলাম। অঝোর ধারায় চোখ থেকে বর্ষণ বইতে শুরু করলো যেনো। তামান্না পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘ভাবি ভাবি ভাবি, দেখবা আজ আমি মন ভরে গয়না কিনবো। আমার যা যা লাগবে সব কিনে নিয়ে আসবো।’

‘দেখি কত কিনতে দেয় ওরা। যা বলবে এর বাইরে তো আর কিনা যাবে না।’

ননাস দরজার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললো। এদিকে আমি আমার চোখ মুছে নিলাম। মোবাইল রেখে দিলাম এক পাশে। শাশুড়ি এসে দেখতে লাগলেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। কিছুক্ষণের মাথায় তামান্নার হবু দুই ননাস আমাদের বাসায় এসে হাজির হলেন৷ তাদের দুই হাত ভর্তি মিষ্টির কার্টুন। দুজন বাসা ঢুকতে ঢুকতে বলতে লাগলেন,

‘আরে এসি অন করা নাই আপনাদের? বাইরে আজ কী যে গরম পড়েছে!’

শাশুড়ি মা আমাকে ইশারায় এসি অন করতে বললেন৷ আমি এসি অন করলাম। তামান্নার হবু ননাসেরা কোল্ড ড্রিংকস হাতে নিতে নিতে তামান্নার দিকে চেয়ে তামান্নার বড় ননাস বললো,

‘একী তামান্না! গায়ের রঙ আর হাতের রঙ দুই হয়ে গেলো যে! নাকি মায়ের ঘরে শেষমেশ সব কাজ করে দিয়ে যাচ্ছো?’

আমরা সবাই চেপে গেলাম। কোন উত্তর দিলাম না। নাস্তা শেষে তামান্নার হবু ননাস শাশুড়ি মাকে বললো,

‘খালা, আমাদের এখান থেকে স্বর্ণ পাঁচ ভরি দেয়া হবে। বিয়েতে খরচাপাতি যা বেশি হচ্ছে বুঝলেন! মা বলে দিয়েছে আপনাকে যেনো আগে বলে দেই।’

কথাটা বলতে বলতে তামান্নার ননাস ব্যাগ খুলে একটা বক্স বের করে শাশুড়ির হাতে দিয়ে বললো,

‘এইটায় কান-গলার সেট আছে। তিন ভরির। স্বর্ণ আমার বিয়ের সময়ের। আমি ইউজ করি না। ভাবলাম দিয়ে দেই নিজের ভাইয়ের বউকে। আঠারো ক্যারেটের। চাইলে ওজন করিয়ে নিতে পারেন।’

শাশুড়ি মা মুখে হাসি এনে বক্স টা হাতে নিতে নিতে বললেন,

‘আরে না না। এসব আর দেখার কি আছে।’

‘আচ্ছা তামান্না চলে আসো। আমরা জুয়েলার্সে যাই। কেউ যাবে এখান থেকে?’

‘হ্যাঁ। নুপুর যাবে মা তোমাদের সাথে।’

‘আচ্ছা। চলে আসো’

মা গাড়ির ড্রাইভারকে কল দিয়ে গাড়ি বের করতে বললেন। তামান্নার ছোট ননাস বললো,

‘আন্টি আমাদের সাথে গাড়ি আছে। আপনাদের আর লাগবে না গাড়ি বের করা।’

তামান্না আর আমি তাদের দুজনের সাথে বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম। তামান্নার বড় ননাস বললো,

‘একী? এভাবেই চলে যাবা তোমরা?’

আমি কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে উঠলাম। এভাবে চলে যাবো মানে! তামান্নার হবু ননাস শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললো,

‘খালা আমাদের ঘরের বউ এখন সে। সে এভাবে বাইরে যাবে? তার কি বোরকা টুরকা নাই? বেপর্দা হয়ে সে বাইরে চলে যাচ্ছে?’

শাশুড়ি মা তামান্নাকে নিয়ে ভেতরে এলেন৷ অথচ তামান্নার হবু ননাস দুজনের একজনের গায়েও বোরকা জড়ানো নাই। দুজনেই মাথায় হিজাব পরে আছে শুধু! তামান্নাকে শাশুড়ি ভেতরে নিয়ে চললেন। আমাকে ডেকে বললেন,

‘তোমার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলে না ওই নীল রঙের খিমার, ওইটা কোথায় রেখেছো?’

‘মা এগুলা তো আপনার আলমারিতে সব।’

শাশুড়ি মা খিমার বের করলেন। তামান্না বললো,

‘ওসব সস্তা খিমার পরে আমি বের হবো?’

‘চুপ। কোন কথা বলবি না আর। যেভাবে তারা যা বলে তাই করিস।’

তামান্না আমাকে বললো এবার,

‘ভাবি দেখেছো মাত্র পাঁচ ভরি স্বর্ণ দিচ্ছে তারা।’

আমি তামান্নার কথার কোন উত্তর দিলাম না। ননাস বললো, ‘পাঁচ ভরি অনেক দিচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছিস তো বিশ ভরি। সবাই কি আর তোর দুলাভাইয়ের মতো যে বিয়েতে হার সীতাহারে একদম গা ভরিয়ে দিবে।’

বড় বোনের কথা শুনে ছোট বোন একেবারে চুপসে গেলো যেনো। যাবার সময় শাশুড়ি মা আমাকে বলে দিলেন, তামান্না যেনো এমন কোনকিছু তাদের সামনে না করে বসে যাতে হিতে বিপরীত হয়ে যায়।

জুয়েলার্সে গিয়ে বাঁধলো আরেক বিপত্তি। জুয়েলার্সে সে এই জড়োয়া, এই সীতা গায়ে দিচ্ছে। এই কানের দুল, সেই মালা এসব দেখত লাগলো এক পাশ থেকে। তারপর তামান্না একটা হালকা দেখে সীতাহার চয়েজ করলে তামান্নার হবু ননাস বলে,

‘এইটা কি এমনি এমনি গলায় দিয়েছো?’

‘না আপা। এইটায় আমাকে সুন্দর লাগবে না? আমার বান্দবি মুনমুনের বিয়েতে এই একই ধাচের হার সে পরেছে। আমার তখন কী যে ভালো লেগেছিলো! আমি এইটা নেই?’

তামান্নার দুই ননাস একে অন্যের দিকে চেয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো। আমার দিকে চেয়ে বললো,

‘অহ তুমি তো ভাবি। ভাবি তার ননদকে উপহার দিচ্ছে বুঝি? এই সীতাহার নেয়া যাবে না তামান্না।’

তামান্নার ননাসের এই কথা বলার মূল প্রতিপাদ্য হলো তিন ভরির একটা জড়োয়া সে দিয়ে এসেছে বাসায়। সাথে কানের দুলও ছিলো। এখন শুধু একজোড়া চুড়ি কিনতে পারবে সে। আমি বুঝতে পারলাম তামান্নার ভেতর কেমন করছে যেনো! তামান্নাকে হাত ইশারায় চেপে কানে কানে বললাম,

‘যা বলছে তাই কিনে নাও। আমি আমার গহনা থেকে তোমাকে দিয়ে দিবো। এখানে এখন কোন কথা বলো না।’

এক জোড়া চুড়ি আর একটা আংটি কিনে আমরা আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। জিন্দাবাজার থেকে গাড়িতে উঠার সময়ে খেয়াল করলাম, একটা গাড়ি থেকে মধ্যবয়সী সুন্দরি এক মেয়ে নেমে প্রথমে ছেলেটার হাত ধরলো, তারপর ওই ছেলেটাকে তার পাশের সিটে বসিয়ে কারে উঠে গেলো সে নিজেও। আমি বার কয়েক তাকালাম সেদিকে। কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই কারটা আমার সামনে দিয়ে টান মেরে চলে গেলো।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৩৩
#মিদহাদ_আহমদ

চোখ আমার সেখানে আটকে গেলো৷ বাসায় আসতেই তামান্না শাশুড়ির সাথে এই সেই নিয়ে কথা বলতে লাগলো। শাশুড়িও শুনে অবাক যে তামান্নার হবু ননাস যে আঠারো ক্যারেটের হারটা দিয়েছেন, সেটা ওই পাঁচ ভরির মধ্যেই। আমরা সবাই ভেবেছিলাম ওগুলো ননাস হিসাবে ছোট ভাইর বউকে দিচ্ছেন উনি।

দুইবোন আর মা মিলে কথাবার্তা বলছিলো। আমি রুমে চলে এলাম। কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না নিজের মনের সাথে। সেই ছেলেটা নিশ্চিত আসিফ। একদম তার মতো দেখতে! আমার চোখের দেখায় এতবড় ভুল হতে পারে না৷ আসিফের নাম্বারে কল দিলাম। আসিফ কল উঠালো না। আবার কল দিলাম। ধরেই কিছুটা শক্ত গলায় বললো,

‘কাজে আছি আমি। আমাকে বিরক্ত করো না এখন ‘

বলেই সে কল রেখে দিলো। একবারও প্রয়োজন মনে করলো না আমাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার! শাশুড়ি মা রুমে আসলেন। আমার আর নিজেকে সামলে রাখার শক্তি রইলো না। ওনাকে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম। শাশুড়ি মা জিজ্ঞেসা করলেন আমি কান্না করছি কেন। বললাম আসিফের কথা৷ সে কোন ভাবেই যেনো আগের মতো না আর। কাল রাতের কাশির সাথে রক্ত যাওয়ার বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম। এইটাও এড়িয়ে গেলাম যে আমার ধারণা আসিফ আবার নেশা করছে আগের মতো। শাশুড়ি মা আমাকে অভয় দিয়ে বললেন,

‘ছেলেটা সংসারি হচ্ছে নুপুর। যখন তোমরা বাইরে গিয়েছিলা জুয়েলার্সে, তখন সে বাসায় এসেছে। খাসির মাংস দুই কেজি দিয়ে গেছে৷ রাতে কোরমা করবো বলেছে। ছেলের আমার কোরমা পছন্দ।’

আমি অনেকদিন ধরে মনে পোষণ করে রাখা প্রশ্নটা এবার শাশুড়ি মা কে করেই বসলাম। বললাম,

‘মা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

‘হ্যাঁ মা বলো।’

‘আপনারা কি আসিফকে এখন কোন টাকা দিচ্ছেন? সে যে এসব করছে, এসব কিনে আনছে, এইসব করার টাকা সে কোথায় পাচ্ছে? তার বেতন তো মাত্র ষোল হাজার টাকা।’

‘না তো! আমরা তাকে কোন টাকা দেই না। গাড়ি শুধু চালাচ্ছে এই যা। আর গাড়িতে তোমার শ্বশুর গ্যাস ভরে রাখেন সব সময়৷ এছাড়া সে যে বাজারহাট করছে, তার সবকিছুই তার নিজের টাকায় করছে। ওসব নিয়ে এতো চিন্তা করো না তো তুমি। চলো খাবার রেডি করা আছে।’

রুম থেকে বের হওয়ার আগেই ননদ চলে এলো। এসেই বললো, আমি বলেছি তাকে আমার গহনা থেকে একটা সীতাহার দিয়ে দিবো। সেইটা দিতে। আমার গহনা সব শাশুড়ির কাছে রাখা। শাশুড়িকে বলে ওনার আলমারি থেকে গহনা বের করে সব সামনে রাখলাম তামান্নার। তামান্না আমার বিয়ের সময়ে এই বাড়ি থেকে দেয়া সীতাহার তুলে নিলো। টিকলিও তুলে নিতে নিতে বললো,

‘এইটা নিয়ে নেই ভাবি?’

আমি হাসিমুখে আরেকটা মান্তাসা আংটি তামান্নার হাতে তুলে দিয়ে বললাম

‘এইটাও রাখো। আমার একমাত্র ননদ বলে কথা।’

তামান্না আমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর সব গহনা শাশুড়ি আবার তার আলমারিতে তুলে রাখলেন। শাশুড়ি কিন্তু একবারের জন্যও মেয়েকে নিষেধ করলেন না যে পুত্রবধূর গহনা যেনো না নেয়। আমি আমার সরল মনেই দিয়ে দিয়েছি৷ ওসব ভারিক্কি জিনিসপত্র আমার ভালো লাগে না পরতে।

দুপুরে সবাই একসাথে বসে ভাত খেলেও আমার ভাত যেনো পেট দিয়ে যাচ্ছে না৷ আমি একেবারে থ বনে বসে আছি৷ ওই মেয়েটার সাথে কারে করে কোথায় গেলো আসিফ! মেয়েটাই বা কে!

বাসায় আসতে আসতে আসিফের সেদিন রাত এগারোটা হয়ে গেলো। বাসায় ঢুকেই সে তামান্নাকে ডেকে এনে তামান্নার হাতে একটা ছোট মতোন বক্স তুলে দিয়ে বললো,

‘এইটা তোর জন্য। ডায়মন্ডের ফিঙ্গার রিং৷ তোর ওয়েডিং গিফট।’

ননাস বললো,

‘বাহ রে! আর আমার নাই বুঝি?’

‘দিবো।’

‘বউয়ের জন্যও এনেছিস বুঝি?’

আসিফ তখন ব্যাগ থেকে একটা ডার্ক চকলেটের বার বের করে ননাসের হাতে দিয়ে বললো,

‘এইটা তোমার জন্য আর এই বেলী ফুলের গাজরা আমার বউয়ের জন্য’

ভাত খেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসিফ তার বেডে বসে মোবাইল টিপছিলো। আসিফকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম এবার,

‘ওই মহিলা কে ছিলো?’

‘কোন মহিলা?’

‘ওই মহিলা কে ছিলো? যে তোমাকে তার কারে তুলে নিলো?’

‘হুয়াট! কার কথা বলছো তুমি?’

‘ডায়মন্ডের ফিঙ্গার রিং কেনার সামর্থ্য তোমার ছয় মাসের বেতন এক করলেও কি হবে?’

আসিফ আমার এসব কথা কাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। আমার জোরাজুরি দেখে আসিফ চিৎকার করে বললো, জানতে চাও আমি কী করি? দেখতে চাও আমি কী করি? আচ্ছা ঠিক আছে। আগামীকাল সকালেই তুমি আমার সাথে চলবা। আগামীকাল সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমি কী করছি, কোথায় যাচ্ছি এসবের জন্য এভাবে জাছুছি করছো? আমা পেছনে লোক লাগিয়েছো? সন্দেহ করছো আমাকে?

আমার নিজের ভাবতেই কেমন লাগছে নুপুর। তুমি? তুমি এসব করছো?

আচ্ছামত আমাকে কথা শুনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো আসিফ৷ আমি একদম অবুঝের মতো বসে রইলাম। কী করবো ভেবে উঠতে পারলাম না। বসে রইলাম খাটের উপর চুপ করে।

আসিফ রুম থেকে বের হয়ে ড্রইং রুমে চলে যায়। আসিফের পেছন পেছন তানিয়াও চলে যায় ড্রইংরুমে। আসিফের কাছে গিয়ে বসে তানিয়া জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছে ভাই? এভাবে রুম থেকে বের হয়ে চলে এলি যে?’

ডিভানে মাথা চাপিয়ে আসিফ শুয়ে পড়লো। তানিয়া আবার বলতে লাগলো,

‘আসলে সন্দেহ এমন এক জিনিস যা মানুষের সম্পর্ককে নষ্ট করে দেয়। আর যখন নিজের পার্টনার একজন অন্যজনের উপর সন্দেহের চোখে দেখে, তখন আর সেই সম্পর্ক, সম্পর্কে থাকে না। সবকিছু শেষ হয়ে যায় এক মুহূর্তে। আর সন্দেহ নিয়ে ভালোবাসা যায় না। এগিয়ে নেয়া যায় না নিজেদের। জানি না তোদের কি হয়েছে, তবে সন্দেহ নামক কোনকিছু হলে এই সম্পর্কও এখানে শেষ।’

কথাগুলো বলে তানিয়া চলে গেলো ড্রইংরুম থেকে। আসিফ আর নুপুরের রুমের বাইরে থেকে সন্দেহ শব্দটা সে শুনতে পেয়েছিলো। আর এই সুযোগে সন্দেহ জিনিসটা নিয়ে ভাইয়ের ভেতরে ভরে দিলো এক গভীর বিষ!

বোন চলে যাওয়ার পর ডিভানের একটা বালিশে পাথা রেখে আসিফ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখলো। বারবার কানে ভেসে উঠলো বোনের বলে যাওয়া সেই কথাগুলো। সম্পর্কে কেউ সন্দেহ করা শুরু করলে সম্পর্ক আর এগিয়ে নেয়া যায় না।

এসব চিন্তা করতে করতে রাত গভীর হয়। আসিফ ঘুমিয়ে যায়। নুপুরের ঘুম আসে না। বাইরে কুকুরের ডাক। এক নাগাড়ে ডাক যাকে বলে।আগামীকাল কী দেখাতে নিয়ে যাবে আসিফ? সিলেটে হুটহাট বৃষ্টি নামে। এখনও বৃষ্টি দিচ্ছে। কারেন্ট চলে গেলো। জেনারেটর অন হলো।

আমার ঘুম আসছে না চোখে। বিছানা ছেড়ে উঠলাম। একটা কাঁথা নিলাম। ড্রইংরুমে গিয়ে ফ্যান কিছুটা স্লো করলাম। কাঁথাটা আসিফের গায়ে জড়িয়ে দিলাম। তার গোলাপি ঠোঁট আর গভীর চোখের উপর গড়ে পড়া লম্বা চুলে তাকে অদ্ভুত মোহনীয় লাগছে দেখতে। কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে চুপিসারে নিজের খাটে এসে বসলাম। বাইরের বৃষ্টির সাথে করে আমার চোখ দিয়েও যে বৃষ্টির ধারা বইতে শুরু করলো, তা হয়তো আমি ছাড়া আর কেউ টের পেলো না। আসিফের গলায় দৈববানী হয়ে কানে আসছে যেনো করিমের সেই গান,

‘বসে ভাবি নিরালা
আগে তো জানিনা
বন্ধের পিরিতের জ্বালা
যেনো ইটের ভাটায় দিয়া
কয়লা আগুন জ্বালাইছে
দেওয়ানা বানাইছে
কী জাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে’

(চলবে)