বিন্নি ধানের খই পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0
376

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৭
#মিদহাদ_আহমদ

আসিফ ছাড়া আমরা সবাই তামান্নার বাড়িতে গেলাম তামান্নার স্বামী রাজীবকে বিদায় দেয়ার জন্য৷ গাড়ি থামতেই রাজীবের মা এসে শাশুড়িকে হাস্যরসে বলে বসলেন,

‘জামাই যাওয়ার সময় এলেন বেয়াইন। এতদিন আর এসে দেখলেন না একবারও।’

‘হা হা৷ কী যে বলেন! আসা শুরু করলে আর পরে বন্ধই হবে না।’

‘না না। বুঝতে পেরেছি। মেয়ে একটা নিয়ে কত ঝামেলা, কত কাহিনি। সবকিছু বুঝতে পেরেছি বেয়াইন। এমন অভাগা মেয়ে যার কপালে জুটে সেই বুঝে। আমাদের কাজের মেয়ে যে কুলসুমা, ওর মেয়েরও দুই দুইবার জামাই তালাক হয়েছে৷ প্রতিদিন এসে বিলাপ করে আমাদের বাড়িতে।’

আমি একবার ননাসের দিকে তাকালাম। ননাসের মুখটা একেবারে ছোট হয়ে গিয়েছে দেখলাম। তামান্নার শাশুড়ি আবার বললেন,

‘তা খাবার দাবাড়ের গাড়ি কই? পেছনে বুঝি?’

‘আরে না বেয়াইন। আপনি তো আর হাতি না৷ আপনি আমার মতোই পিঁপড়া। তাই এই গাড়ির ভ্যানে করেই এনেছি। পিঁপড়ার জন্য হাড়ির জল সমুদ্র সমান। আপনি হাতি হলে সুরমা নদী তুলে নিয়ে আসতাম।’

কথাটা শ্বশুর বলতে বলতে এক গাল হেসে দিলেন। তামান্না বাইরে এলো৷ আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলো৷ তামান্নার ননাস নাস্তা এনে দিলো৷ ট্যাংক তুলে দিলো একে একে আমাদের সবার হাতে। আমার ননাসের হাতে ট্যাংক তুলে দেয়ার সময় বললো,

‘ওরে আল্লাহ! একী! তুমি এখনও হাতে চুড়ি পরছো? এগুলা তো বিয়াইত্তা বেটিদের নিশানা। তোমার তো ডিভোর্স হয়েছে শুনলাম। এখন নিশিবালাদের মতো হাতে চুড়ি পরবা নাকি? কেমন দেখায় না?’

আমার রাগে কেমন যেনো কড়মড় করতে লাগলো৷ তামান্নার স্বামী রাজীব সামনেই ছিলো৷ সে এসে বললো,

‘আপা তুমিও না! কিচ্ছু মনে করবেন না আপা এসব মজা করছেন। আমাদের সাথে কত মজা যে করেন! আমাদের সেঝো আপা আমাদের বংশের মাঝে সবার কাছে এই মজার জন্য প্রসিদ্ধ।’

আমি থেমে গেলাম৷ খেয়াল করলাম রাজীব তার বোনকে চোখ ইশারায় চুপ করতে বলছে। বুঝতে বাকি রইলো না যে রাজীব কেন এসব বলেছে। বোনকে বন্ধ করাতেই এসব বলা। একদিক দিয়ে ভালো লাগলো যে যাক, যার সাথে আমাদের সম্পর্ক সে হয়তো বুঝতে পেরেছে৷ আর এরচেয়ে বড় কোন পাওনা আমাদের হতে পারে না ৷ আমি শাশুড়ির দিকে তাকালাম। শাশুড়ি চোখ ইশারায় তথমথ খাওয়ার অবস্থা৷ ননাসের চোখ দুইটা ছলছল করছে৷ শুধু চোখ টপকে অশ্রুকণা বের হতে পারছে না এই যা। আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো৷

দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসেছি আমরা৷ টেবিলে নানা পদের খাবার সাজানো। তামান্নার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে মাছভাজা তুলে দিতে দিতে বললেন,

‘বেয়াই এইটা আমাদের পুকুরের মাছ। ভালো লাগবে খেয়ে৷ একেবারে তাজা। বিয়েতে যে আপনারা মাছ খাইয়েছিলেন, উফ! কী গন্ধ ছিলো! আমি বাপু খেতেই পারিনি। আমাদের এখানে এসে সবাই বদনাম করেছে শেষে। আপনি এই মাছটা খান।’

টেবিলের পাশে ওভেন কেবিনেটের উপর তানিয়া আপার বানানো কেক রাখা। তামান্না জিজ্ঞেস করলো,

‘আপা এইটা তোমার বেকিং করা কেক?’

আমি বুঝতে পারলাম জেনেও তামান্না এইটা জিজ্ঞেস করছে কারণ সে চাচ্ছে তার বোনের অপ্রস্তুত ভাবাপন্ন সময়টা দূর করতে।

ননাস তখন আগ্রহভরে তামান্নাকে বললো,

‘হ্যাঁ। জানিস এইটার উপরের ফর্মিং করতে কত যে সময় লেগেছে আমার! দুইটা কেক টাইমিং ওলট পালট হওয়ায় আর ওভেন আগেই হিটে দেয়ায় জ্বলে গিয়েছে। এইটা হতে হতে ভোর প্রায়৷ আজান দেয়নি এই যা।’

তামান্না তার বোনকে জড়িয়ে ধরলো৷ তারপর কেকটা টেবিলে এনে কেটে যেই না মুখে দিবে ওমনি তামান্নার শাশুড়ি বললেন,

‘বউমা দুইদিন পর তুমি পোয়াতি হবা। আর এমন মেয়ের বানানো কেক খেয়ে আমি তোমার সংসার ভাঙ্গাতে চাই না৷ এখন এসব খাওয়ার সময় না। সবকিছু ভেবেচিন্তে করতে হয়। হুটহাট করে ফেললাম আর হয়ে গেলো জীবন এতো সহজ নয়৷ তোমাকে আর কত বুঝাবো? নুহাসের বউকে দেখেছো? পর্শুদিন ই তো নিয়ে গিয়েছি৷ দেখেছো শহরের মেয়ে হলেও কলসি ভরে ধান চাল দিয়েছে? উগারে যে ধান ফেলতে হয়, এইটা সেই যুগের হওয়া লাগে না৷ এই যুগের হলেও জানা যায়।’

আমি আর মুখ বন্ধ করতে পারলাম না৷ উঠে গিয়ে কেকটা কাটলাম৷ একপিস মুখে পুড়ে তামান্নার শাশুড়িকে বললাম,

‘খালা আমারও নতুন বিয়ে হয়েছে৷ আমি খেয়ে নিলাম এক পিস৷ তারপর দেখি কী হয়। আমার আবার এসব ঘর করা, সংসার করা ভালো লাগে না। সব কেমন জানি বন্দি বন্দি লাগে।’

তারপর আবার বললাম,

‘আহা! আহা! বাহাত খুব৷ কী দারুণ স্বাদ! আমি এই কেকটা গাড়িতে রেখে আসি কেমন? আপনারা তো খাবেন না৷ তারচেয়ে আমার ননাসের বানানো কেক আমি ফ্রিজে রেখে একা একাই খাবো৷ আমার শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেরই ডায়াবেটিস৷ সব একা আমাকেই খেতে হবে ‘

পুরো মহল তখন থ বনে গেলো৷ রাজীব খেয়াল করলাম উঠে গেলো টেবিল থেকে। মুখে কিছু বললো না। রাজিবের বোন আর মায়েদের চোখেমুখে তাকানো যাচ্ছে না যেন৷

খাওয়া শেষে তামান্নাকে নিয়ে তার রুমে গেলাম। তামান্নার সে কী কান্না! তামান্নার সব কথার শেষে শান্তি পেলাম সেখানেই যখন তামান্না বললো রাজীব তাকে বুঝে৷ রাজীবের দিক দিয়ে সে সেটিসফাইড আছে। আমি যেনো মরুতে এক পশলা বৃষ্টির মতো প্রশান্তি খুঁজে পেলাম। মানুষের জীবন সঙ্গী যদি জীবনের সাথে মিলে যায়, নারী জীবনের জন্য এরচেয়ে খুশির আর ভাগ্যের কিছু হতে পারে না। তামান্নাকে বললাম বুঝিয়ে যে এসব যেনো মা জানতে না পারেন৷ শত কষ্ট হলেও মানিয়ে নিতে নিজেকে। আজ দুঃখ আছে, কাল এই দুঃখের শেষে পুরো সংসার তার হবে৷ তামান্না আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করলো৷ আমিও তাকে থামালাম না৷ কান্না করলে ভেতরে জমে থাকা কষ্ট হালকা হয়৷ মেয়েটার এখন আর কে আছে যার কাছে গিয়ে এভাবে কান্না করবে!

বিকালেই আমরা গাড়িতে করে বাসায় ব্যাক করলাম। ননাস একেভারে দন্ডায়মান দন্ডের মতো শক্ত হয়ে আছে। শাশুড়ি বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

‘এজন্যই বলেছিলাম তাকে না নিতে। আল্লাহ আমাকে কেন এই দিন দেখাচ্ছেন আল্লাহ জানেন৷ আমার কোন জন্মের পাপের সাজা আল্লাহ আমাকে দিচ্ছেন। আমি কার কোন ক্ষতি করলাম।’

শাশুড়ি এসব বলায় আমি ভিমড়ি খেয়ে বসলাম। ননাস যে জায়গায় নিজের কষ্ট নিজের কাছে জমা রেখে আড়াল করতে চাচ্ছে, সে জায়গায় কেন তিনি এখন এসব বলছেন! ননাস এবারও কোন কথা বললেন না। ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন৷ আমি ননাসের সাথে উপরে যাবো এর আগে শ্বশুর ডেকে বললেন,

‘বউমা মাথায় বড্ড ধরেছে৷ কাজের মেয়েদের হাতের চা আমার খেলে পোষাবে না। তুমি যদি এক কাপ..’

‘না না বাবা৷ আপনি বসেন৷ আমি এক্ষুণি আপনার জন্য চা বানিয়ে আনছি ‘

আমার গন্তব্য রুমে না হয়ে রান্নাঘরে হয়ে গেলো। শ্বশুরের জন্য চা বানাতে গেলাম। শাশুড়ি পাশে এসে দাঁড়ালেন। আহাজারি করতে করতে বললেন,

‘বলেছিলাম না তাকে নিয়ে গেলে সমস্যা হবে? দেখেছো?’

আমি শাশুড়িকে চেয়ারে বসালাম। বসিয়ে বুঝিয়ে বললাম, এখন এই বিষয়টা আমরা যতো চেপে যেতে পারবো ততোই ভালো। কিন্তু যদি আমরা এই বিষয় নিয়ে কথা বলি তাহলে আপার কষ্টটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে৷ ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাওয়া মানুষটা একেবারে বাঁচতে বাঁচতে মরে যাবে।

শাশুড়ি মা আমার কথাগুলো বুঝলেন কিনা বুঝতে পারলাম না৷

এদিকে রুমে এসে দরজা লাগালো তানিয়া। টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ আর কলম এনে কাগজের মধ্যে লেখলো,

‘আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও বাবা মা। তোমাদের মেয়ে হয়ে তোমাদের সম্মানের কারণ না হয়ে তোমাদের অপমানের কারণ হতে হয়েছে আমাকে। মেয়ে হিসাবে এরচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর আমার হতে পারে না। সব দুঃখ বলা যায় না৷ কিছু দুঃখ মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর হয়তো আমাকে লাশকাটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে৷ জীবনানন্দের কবিতাটা হয়তো ভেসে উঠে ধ্বনিত হবে,

“লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেলো তারে…”

সবকিছু হারিয়ে একটু একটু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিলাম এই কয়দিন। কিন্তু না৷ পারলাম না৷ অনেক চেষ্টা করেছি। চেষ্টায় আমার কোন কমতি ছিলো না৷ হয়তো দুনিয়া আমাকে পারতে দিলো না। আর যতদিন বেঁচে থাকবো দুনিয়া আমাকে বাঁচতে দিবে না। এরচেয়ে ভালো আমিই দুনিয়া ছেড়ে দেই৷ এতে করে সবাই ভালো থাকবে। নুপুর, যখন আমার এই লেখাটা সবাই পড়ছে, আমি জানি তুমিও সবার সাথে কান্না করছো বসে বসে। হয়তো বলছো আমাকে অভয় দিয়ে, আমি কেন এই কাজটা করলাম। তোমার সামনে গিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার মুখ আমার নেই। হয়তো কোনদিন আমার ভাই কোন একটা ভালো কাজ করেছিলো। সেই ভালো কাজের ফল হিসাবে উপরওয়ালা তোমাকে আমার ভাইয়ের জীবনের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। একজন উপযুক্ত জীবনসঙ্গী পাওয়া যে জীবনের জন্য কতবড় আশীর্বাদ তা শুধুমাত্র সঙ্গীহীনারাই অনুধাবন করতে পারছে৷ কতকিছু করেছি তোমার সাথে। ভাবতেও আমার লজ্জা করছে৷ আর এই লজ্জা নিয়ে আমি তোমার সামনে দাঁড়াতে পারবো না। আমার এই দুর্বলতা তাই লিখে প্রকাশ করলাম। আমার এতকিছুর বিনিময়ে শুধু তোমার ভালোবাসা ছাড়া, একটুও ঘৃণা আমি পাইনি। কারো কাছে আমার কোন আফসোস নেই, আবদার নেই, ঘৃণা নেই, দাবিও নেই। তবে যে পাপ আমি করেছি, সেই পাপ আমাকে পরকালে শাস্তি দিবে। এও জানি, এখন যে পাপ করতে যাচ্ছি এই পাপের কারণে আমার স্থান জাহান্নামে হবে। তবে তোমরা কি জানো, দুনিয়ায় মরে মরে বাঁচার নাম আসলেই জাহান্নাম?’.

তাতের ওড়না ফ্যানের সাথে প্যাচিয়ে দিলো তানিয়া। এই ওড়নাটা ওর খুব প্রিয়৷ এষ কালারের মাঝে ফিরোজা রঙের ছোঁয়া। একেবারে নিসর্গ যেনো তার সবকিছু ঢেলে দিয়েছে এর মাঝে! ড্রেসের সাথে মিলিয়ে যখন তানিয়া এই ওড়নাটা গায়ে জড়াতো, বদরুল তখন বলতো, ‘তোমাকে আবার বিয়ে দেওয়া যাবে। একেবারে লাল টুকটুক বউয়ের মতো লাগছে’
গতবার বদরুলের সাথে যখন মানালি গিয়েছিলো, তখন এই ওড়নাটা এনেছে তানিয়া৷ তার চোখের সামনে ভাসছে মানালির উঁচুনিচু রাস্তা৷ হিমাচল প্রদেশের সব ঠান্ডা যেনো তাকে ভর করে আছে এই মুহূর্তে। কাশ্মীরি মেয়েদের বিড়াল চোখ যেনো মোহিত করে রেখেছে এক পশলা। ভারতের সবচাইতে এডভেঞ্চার ওয়ালা ট্রিপ ছিলো মানালির রাস্তায় রাস্তায় বাস দিয়ে ঘুরা। ড্রেসিং টেবিলের সাথের ছোট চেয়ারটা খাটের উপর তুললো তানিয়া৷ দাঁড়িয়ে গেলো চেয়ারের উপর। ফাস লাগালো গলায়। একবার উপরের দিকে তাকালো। আরেকবার জানালার দিকে চেয়ে আকাশ দেখলো। গলা বরাবর ওড়না এনে ঝুলে গেলো ওড়নায়। ফেলে দিলো টুলটা। ঘনঘটা অন্ধকার ছেয়ে গেলো চোখের সামনে। এ যেনো এক নতুন বিভীষিকা।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৮
#মিদহাদ_আহমদ

আমি শ্বশুরকে চা দিয়ে আরেক কাপ চা ননাসের জন্য নিয়ে তার রুমের সামনে গেলাম। দেখলাম ভেতর থেকে দরজা লক করা। সচরাচর এমন সন্ধ্যার সময় তিনি দরজা লক করেন না। আমি ডাক দিলাম। কোন শব্দ নাই। আবার ডাক দিলাম। কয়েকবার ডাক দিয়ে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি চা নিয়ে রুমে চলে এলাম। ভাবলাম হয়তো ওয়াশরুমে গিয়েছেন তিনি৷ আমিও ফ্রেশ হয়ে কল দিলাম মাকে। মা কল রিসিভ করে আর কথা বলতে পারছেন না যেনো। কাশতে কাশতে শেষ৷ মা বললেন,

‘গিয়েছিলি আজ তোর ননদের বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ মা গিয়েছিলাম। তুমি আবার ঠান্ডা লাগিয়েছো? এখন যদি শ্বাসকষ্ট হয় আবার?’

‘না রে মা। আচ্ছা আমি রাখি এখন৷ আজান দিবে। গাইল ছিয়া সামলে রাখতে হবে ‘

‘গাইল ছিয়া? এখন কী করছো এসবের?’

‘জমিরের বাড়ির নিচে যে ধান হয়, ওখানের জমি বর্গা দিয়েছিলেন তোর বাবা। কাল বিকালে চাউল তিন বস্তা এনে দিয়েছে৷ গতবার দিয়েছিলো সাত বস্তা। মানুষটা নাই দেখে সব লোক যেনো সবকিছু খেতে শুরু করেছে৷ করুক গিয়ে। আমরা তিন মা ছেলের ঘর তিন বস্তা চালে অর্ধেক বছর চলে যাবে।’

‘আচ্ছা এটা তো বুঝলাম। তুমি চাল কুটতেছো কেন মা? তুমি না অসুস্থ’

‘মেয়ের বাড়ি পিঠা দিবো না? কী বলে বোকা।’

মায়ের সাথে কথা বলে আমি কল রাখলাম। বুঝতে পারলাম না আসলে হচ্ছেটা কী! মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে কেন বাবা মায়েরা ভাবে যে মেয়ের বাড়িতে আজীবন এইটা সেইটা দিতে হবে! আর না দিতে পারলে মেয়ের অপমান হবে? এমন ভাবাটাই মেয়েদের জন্য আসল অপমানের কারণ না?

টেবিলে চায়ের কাপের দিকে নজর গেলো৷ মনে পড়লো ননাসকে চা দেয়া হয়নি। উঠে গেলাম। ওভেনে চা গরম করে আবার ননাসের রুমের সামনে গেলাম। দরজা বন্ধ এখনও। ডাক দিলাম৷ কয়েকবার ডাক দিলেও কোন সাড়াশব্দ নেই৷ আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সিঁড়ির কোণার বক্সে চায়ের কাপ রেখে দুই হাত দিয়ে দরজায় থাবা দিতে লাগলাম৷ ভাবলাম হয়তো ঘুমিয়ে আছেন। পরক্ষণে কী যে মনে হলো আমি মাকে ডাক দিলাম। মা আসছেন না দেখে নিচে গেলাম। মা নামাজ পড়ছেন। শ্বশুর জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে নুপুর?’

‘বাবা তানিয়া আপা দরজা খুলছেন না৷ একটু আসেন তো।’

শ্বশুর তড়িঘড়ি করে উপরে উঠে এলেন। কান্নাভেজা গলায় শ্বশুর ডাকতে লাগলেন,

‘ও তানিয়া, তানিয়া মা আমার দরজা খোল। ঘুমে নাকি তুই? চা খাবি না?’

কোন শব্দ নাই৷ আমার আতঙ্ক আরও বেড়েই চলছে৷ কোন বোধশক্তি কাজ করছে না। কিছু বুঝতে পারছি না যেনো। ভাবলাম কল দিবো আসিফকে৷ এর মাঝে শ্বশুর মাটিতে বসে গেলেন ধপাস করে৷ বিলাপ করে ডাকতে লাগলেন

‘ও তানিয়া মা, তানিয়া দরজা খোল।’

শাশুড়ি নামাজ পড়ে তড়িঘড়ি করে উঠে এলেন। সাথে করে চাবি নিয়ে এলেন রুমের। শাশুড়ি চাবি দিয়ে দরজা খুললেন। সামনে যা দেখলাম, তা দেখার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷ তানিয়া আপা ফ্যানের সাথে ঝুলানো। মুখ দিয়ে থু আর ফেনা ঝরছে। শ্বশুর কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে পায়ে ধরলেন ননাসের। আমি কোনকিছু বুঝতে পারলাম না৷ মুহূর্তেই চেয়ার টেনে বিছানার উপর তুললাম। শ্বশুরকে অভয় দিয়ে বললাম

‘বাবা আপনি আপার পায়ে ধরে রাখেন। আমি ছুটাচ্ছি তাকে ‘

শাশুড়ি জমে শক্ত হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার যেনো কোন চেতনাশক্তি কাজ করছে না এমন। আমি অনেক কষ্টে গিট্টূতা খুললাম। শ্বশুর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ধরে ছিলেন৷ আমি ননাসের বাহুতে ধরে রাখলেও আমি ভারক্ষমতা হারিয়ে তাকে ছেড়ে দেই। ননাসের মাথা গিয়ে খাটের একপাশে লেগে রক্তক্ষরণ শুরু হয়৷ আমি তার হাতে পার্লস দেখি। বুঝতে অসুবিধা রইলো না, পার্লস আর যৎসামান্য আছে৷ হসপিটালে যেতে যেতে কি হবে বুঝতে পারলাম না৷ আমি বাইরে গিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলি। সাথে ড্রাইভারকে নিয়ে এসে ননাসকে নিয়ে নিচে আনি৷ গাড়িতে তুলে হসপিটালে যাই৷ আসিফকে কল করে জানাই। শ্বশুর শাশুড়িও আমার সাথে চলে আসেন হসপিটালে। ডাক্তারকে দেখতে বললে আসে আরেক বাধা। নার্সরা জানিয়ে দেয় যে সুইসাইড কেইস পুলিশ ছাড়া তারা গ্রহণ করবে না। এদিকে আমি বারবার ননাসের নিথর দেহের দিকে তাকাচ্ছি৷ পার্লস আছে আছে নাই নাই। নার্সদের বলতে লাগলাম, পার্লস থাকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে না নিলে অঘটন ঘটে যাবে৷ আমি যেই না এই কথাটা বললাম শ্বশুর হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করে দিলেন৷ বলতে লাগলেন,

‘ও আমার তানিয়া, তোর থেকে প্রথম বাপ ডাক শুনেছি আর আজ তুই একী করলি!’

আমি শ্বশুরকে চেয়ারে বসালাম৷ ঠিক তখনি কোতোয়ালি থানার এস আই সহ আসিফ হসপিটালে এলো। এস আই নার্স আর ডাক্তার ডেকে বলে দিলেন কেইসটা তিনি হ্যান্ডেল করবেন। রোগীকে নিয়ে যেতে। আসিফ আসতেই শাশুড়ি তাকে জড়িয়ে ধরলেন। এই প্রথম শাশুড়ি কান্না করলেন৷ বুঝতে বাকি রইলো না, মা বাবারা তাদের পেটের সন্তানদের কাছে নিজের দুর্বলতা আর ভরসা যেভাবে করতে পারেন সেভাবে পুত্রবধূর সামনে পারেন না। আসিফ তার মাকে সামলে নিলো৷ পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

‘কিচ্ছু হবে না আপার। দেখে নিও মা কিচ্ছু হবে না৷ তুমি চিন্তা করো না।’

ডাক্তার ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো ননাসকে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বাইরে এসে বললো রোগীর অবস্থা শংকটে একেবারে। পার্লস রেট নাই বললেই চলে৷ এই মুহূর্তে তাকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে।

শ্বশুর কান্নায় ভেঙ্গে বললেন,

‘লাইফ সাপোর্ট থেকে আর আমার মেয়ে জিন্দা বের হবে না। আর আমার মেয়ে শ্বাস নিয়ে বের হবে না।’

আসিফ আমাকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কী করবে। আমি কোনকিছু ভেবে চিন্তে না বলে বললাম লাইফ সাপোর্টে নিয়ে নিতে। উপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে উপর ওয়ালার কাছে বললাম তিনি যেনো তার গায়েব থেকে সবকিছু ঠিক করে দেন। এখন তার গায়েবি ইচ্ছা ছাড়া আর কোনকিছু সম্ভব না৷ আমি এভাবে আমার চোখের সামনে কাওকে চলে যেতে দেখতে পারবো না।।

আসিফ তামান্নাকে কল করলে তামান্নার ননাস কল ধরে বলে যে তামান্না রান্নাঘরে আছে। আসিফ তামান্নার ননাসকে বলে যে তানিয়া সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। এখন সে লাইফ সাপোর্টে আছে। যদি সম্ভব হয় তাহলে তামান্নাকে নিয়ে হসপিটালে আসতে। বাঁচবে কিনা না এইটা সিওর না।

তামান্নার ননাস যেই না এই কথা শুনলো ওমনি গিয়ে তার মাকে বললো,

‘হুনছোনি গো আম্মা অইছে কিতা? তোমার ঝিয়ারি বেটিয়ে গলাত ফাস দিছইন। খাইল যাইতোগিয়া রাজীব। এখন বুঝিল তামান্নারে লইয়া যাইতাম। ভালা অইছে ফোন আমি ধরিলাইছি। তুমি তাইরে চউকো চউকো রাখিও। দেখিও দেন মোবাইল কান্দাত ফায়না যেলা। আমার ভাইগুতা খাইল ভালায় ভালায় যাউক গিয়া বাদে তাইর যেছাতা খরউক। আমরার বংশত ইলান হুনছোনি খেউ গলাত দড়ি লাগাইতে। দোহাই আল্লাহর ইতা টাউনি ফুড়িন বিয়া করাইয়া আনিয়া তুমি এখ মুছিবতো ফড়ছো গো মাই।’

লাইফ সাপোর্টে দুইদিন থাকার পর ডাক্তার জানালো ননাসের অবস্থা কিছুটা ইম্প্রুভের দিকে। কিন্তু মাথায় চোট পাওয়ায় সাথেসাথে সেখানে রক্তক্ষরণ হয়েছে৷ সন্ধ্যায় শাশুড়ি মা আর শ্বশুর ননাসকে দেখতে গেলে একেবারে অচেতন অবস্থায় দেখে আসেন। ওইদিন রাতেই ডাক্তার ননাসকে কোমায় ট্রান্সফার করে দিলো। কোমার কাছাকাছি দুটি শব্দ হলো ‘ব্রেইন ডেথ’ আর ‘ভেজিটেটিভ স্টেট’। ব্রেইন ডেথ হলো মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি বা মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম থেমে যাওয়া। আর ভেজিটেটিভ স্টেট হলো রোগীর মস্তিষ্ক সজাগ থাকে, কিন্তু চেতনা দিয়ে বা স্বেচ্ছায় কিছু করতে পারে না। ডাক্তার জানালো আপার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে। কোন কোমায় আছেন এইটা এই মুহূর্তে জানাতে পারছে না। এখন সব উপরওয়ালার হাতে।

এদিকে বদরুলের মা কে লন্ডন থেকে বদরুলের মামী কল দিয়ে বললেন,

‘আপা জানেন তো আমার মেয়ে ব্রিটিশ সিটিজেন৷ একইভাবে আমার মেয়ের এখনও বিয়ে শাদী হয়নি৷ আপনার ছেলের এরইমাঝে বিয়েও হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিলেও আপাতত আমি চাচ্ছি না তারা কন্টিনিউ করুক ‘

খোদেজা বেগম যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। কী বলবেন বুঝতে পারলেন না৷ মুহূর্তেই বলে বসলেন,

‘আমরা উকিলকে বলে দিয়েছি বদরুলের দরগা মহল্লায় কেনা ৫২ লাখ টাকার ফ্ল্যাটটা বউমার নামে রেজিস্ট্রি করে নিতে।’

ওপাশ থেকে মেয়ের মা বললো

‘অহ আচ্ছা। সত্যি সত্যি তো আপা?’

‘কেন রুমানা? আমি মিথ্যা বলবো কেন বলো? আমার একমাত্র ছেলের বউ তোমার মেয়ে। আর সম্পর্কে সে আমার আপন ভাইজি। তাকে দেয়া আর আমার ছেলের নামে থাকা দুটোই তো এক হলো৷ তাইনা?’

‘এহ হে! তা অবশ্য ভুল বলেননি আপা।’

‘কোন ভুল না৷ আমি সন্ধ্যার পর পরই কমলা ভান্ডার জুয়েলার্সে যাচ্ছি বউমাকে দশ ভরির সীতাহার বানিয়ে দেয়ার জন্য৷ বিয়েতে তো তেমন কিছু দেয়াই হয়নি।’

‘অহ আচ্ছা। সে আপনার ভাইজি আর পুত্রবধূ৷ যা ইচ্ছা দেন। আসলে আপা বুঝছেন ই তো সিটিজেনশিপ ওয়ালা মেয়ে আমার। আবদার একটু বেশি থাকেই। আজকালকার দুনিয়া দেখছেন ই তো। আর ভাগনা আমার এমনিতেই এক বিয়ে করে ফেলেছে এর মধ্যে। তাই এসব বলছি আমি আরকি। আমি রাখছি আপা এখন।’

‘ রুমানা শুনো, ভাগনা তো এখন মেয়ে জামাই তোমার। তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।’

‘যেমন দিবেন তেমন পাবেন আপা।’

এই বলে কল কেটে দিলো মেয়ের মা।

এভাবে মেয়ে সওদা হওয়া শুরু হলো আবার নতুন করে। চিরায়ত চলে আসা সওদার এক নতুন নিয়ম। শাড়ি ভিসায় সিলেটিদের ইংল্যান্ড যাওয়া অব্যাহত থাকা যেনো পুরোনো সিলসিলাকে বাঁচিয়ে রাখা। সিলসিলা মরে না, রক্তে মিশে যায়।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৯
#মিদহাদ_আহমদ

এর মাঝে মাস দুই কেটে গেলো। ননাস সুইসাইড করার দুইদিন পরেই আমার এইচ এস সি’র রেজাল্ট বের হয়। আমি সব বিষয়েই প্লাস পাই। আসিফ সেদিন খুব খুশি হয়েছিলো। আবার একসাথে পুরো মহল স্থবির হয়ে উঠেছিলো ননাসের সুইসাইডে। আমার রেজাল্টের পর মা কল করে বলেছেন, আমি যেনো মন দিয়ে পড়ি। আমি যেনো সত্যি সত্যি মেডিকেলে চান্স পাই৷ আমার মায়ের কাছ থেকে এই সায় পাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হয়ে উঠেছিলো সেদিন। আমার যে মা কোনদিন আমাকে পড়তে বলেন নি, সেই মা আমাকে বলছেন আমি যেনো ডাক্তার হই! আমি যেনো অর্ধেক সাহস সেদিন পেয়ে গিয়েছিলাম আমার মায়ের কথায়। এদিকে বাসার সবাই কেমন জানি একটা মুষড়ে গিয়েছে৷ শাশুড়ি আর আগের মতো সিরিয়াল দেখেন না। নানা পদের খাবার রান্না করেন না। শ্বশুর ইজি চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়েন না। আমাকে চা এনে দেয়ার কথাও বলেন না। আমিই মাঝেমধ্যে চা নিয়ে যাই। শ্বশুর তখন বলে উঠেন,

‘মা গো, পড়াশোনা করছো তো গো মা? তুমি ডাক্তার হও এই স্বপ্নটা আমি যে কয়েকদিনে নিজের মধ্যে বুনন করতে শুরু করেছি।’

আমি শ্বশুরের দোয়া নেই। বাবার জায়গাটা যেনো ধীরে ধীরে আমার শ্বশুর পূরণ করতে চলেছেন। আসিফ তার কাজে ব্যস্ত। এদিকে আমার ননাস পড়ে আছেন কোমায়। আমি সেই চিঠিটা যেদিন পেয়েছিলাম ননাসের রুমে, সেদিন চিঠিটা ধরে খুব কান্না করেছিলাম। একজন মানুষ আমাকে আপন করে নিতে চাচ্ছেন। কাছে টানতে চাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন নিজের ভুলগুলা। এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! সেদিন রাতে খুব কান্না করেছিলাম আর বলছিলাম, যদি আমার ননাসকে আমি একবার ফিরে পেতাম, জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করে তার কাছে আমার বড় বোনের জায়গা চেয়ে নিতাম। আমার আফসোসের জায়গা থাকতো না যে আমার কোন বড় বোন নেই। বিধাতা আমাকে সেই আফসোস আজন্মের জন্য রেখে দিলেন হয়তো।

আসিফ অফিস থেকে আসতে আসতে রাত নয়টা। আসিফকে ভাত টেবিলে দিয়ে শ্বশুরকে ডাকতে গেলাম৷ শ্বশুর না করে দিলেন তিনি খাবেন না। ইদানীং শ্বশুর এমন করেন৷ খান না নিয়মিত। মাকে ডেকে আনলাম। ছেলের সাথে এসে তিনি টেবিলে বসেন শুধু৷ ইচ্ছা হলে খান, না হলে খান না। আসিফ মাকে বললো,

‘বসো না। কী হলো? খেয়ে নাও।’

‘তুই খা বাবা। আমি বসি। তানিয়ার অবস্থার কিছু জেনেছিস আর?’

‘আজ আর কল করা হয়নি মা। আমি খেয়ে কল দিবো হসপিটালে। আর নুপুর পর্শুদিন তোমার পরীক্ষা। এখন এখানে আমাকে ভাত বেড়ে দেয়ার সময়? সবাই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন।’

শাশুড়ি আমার দিকে চেয়ে বললেন,

‘যাও বউমা। এখন গিয়ে একটু পড়তে বসো৷ আমি আসিফকে খাইয়ে দিবো কেমন? আর শুনো যাওয়ার আগে দুধ গরম করে এক গ্লাস নিয়ে যেও সাথে৷ রাতে পড়তে পড়তে খাবা৷ আমি শেষ রাতে কর্ণফ্লাক্স নিয়ে যাবো৷ দরজা খুলা রেখো কেমন?’

শাশুড়ির দিকে চেয়ে একটা হাসি দিয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলাম নিজের রুমে। টেবিলে বই খুলে বসতে যাবো এমন সময় তামান্নার নাম্বার থেকে কল এলো। একবার ভেবেছিলাম কল রিসিভ করবো না এখন। পরে কী ভেবে কল রিসিভ করলা। তামান্না ফোনের ওপাশ থেকে বললো,

‘ভাবি ভাবি ভাবি! আমি মা হতে চলেছি৷ আমি মা হতে চলেছি।’

আমি চোখ বন্ধ করে আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলাম। আজ কতদিন পর একটা খুশির খবর শুনলাম! আমি কল রেখে নিচে নেমে গেলাম৷ শাশুড়ি আর আসিফ টেবিলে বসা। শুরুতেই বাবার রুমে গিয়ে বাবাকে ডেকে আনলাম টেবিলে। তারপর বললাম,

‘একটা গুড নিউজ গুড নিউজ গুড নিউজ। এটেনশন প্লিজ।’

আসিফ খেতে খেতে বললো

‘কী হয়েছে বলবে তো?’

‘আমি মামি হতে চলেছি আর তুমি মামা।’

তারপর শ্বশুরের হাতে ধরে বললাম,

‘বাবা এখন আপনি আপনার নাতি বা নাতিনকে এই আঙুল দিয়ে ধরে লেকের পারে হাঁটবেন। কেমন? আপনি আর জওয়ান না, এখন নানা হতে যাচ্ছেন।’

আমি খেয়াল করলাম শ্বশুর শাশুড়ি দুজনের মুখে যেনো হাসি ফুটে উঠলো৷ শাশুড়ি উপরে হাত উঠিয়ে বললেন,

‘আল্লাহ গো! আমারে অতোদিনে এখান খুশির খবর হুনাইলায়।’

আসিফ খাবার না খেয়ে উঠেই মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিলো তামান্নাকে। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে বললো,

‘আমি আগামীকাল ই আসছি৷ সাবধানে থাকিস তুই কেমন?’

সবাইকে খুশি দেখতে পেয়ে আমার মন ভরে উঠলো। রুমে এসে পড়তে লাগলাম। আজ এতদিন পর যেনো এক প্রশান্তি অনুভব হতে লাগলো আমার। পরিবারের একটা খুশির খবর যে মানুষকে এতটা আন্দোলিত করে তা এই খারাপ সময়ে না পড়লে হয়তো বুঝতেই পারতাম না!

পরেরদিন আসিফ অফিস থেকে এসে মায়ের রুমে গেলো৷ আমাকেও ডাক দিলো৷ আমি পড়া ছেড়ে উঠে গেলাম। আসিফ বললো,

‘ডাক্তার বলেছে আপা এখন কিছুটা সাড়া দিচ্ছে।’

শাশুড়ি মা আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলেন। আসিফ বললো,

‘না মা। তোমাকে শক্ত হতে হবে৷ ডাক্তার জানিয়েছেন এই ট্রমা থেকে বের হয়ে আসা পসিবল না। তার পরও এমন পজেটিভ সাইন দেখে তারা আশ্চর্য হচ্ছেন। আমাকে কল করেছিলেন ডাক্তার জাবেদ ইমতিয়াজ স্যার। আমাকে বসিয়ে বলেছেন যে এর কোন সুরাহা নাই। এখন যা হবে সব উপর ওয়ালার ইচ্ছাতে আর হুকুমে হবে। হয়তো আপা রিকভার করবে আর না হলে আমাদের সবাইকে স্ট্রং থাকতে বলেছেন যে আপা চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আজ গিয়েছিলাম তামান্নাকে দেখতে৷ সে সুস্থ আছে।’

মহলটা এই ভালো এই খারাপ এমন আমেজে চলে গেলো। আসিফ রুমে এসে আমাকে অভয় দিলো, আমি পড়ছি না কেন মনোযোগ দিয়ে৷ আসিফকে হেসে হেসে বললাম,

‘পর্শুদিন যদি ভাগ্য আমার সহায় থাকে তাহলে ভালো কিছু হবে। নচেৎ…’

‘না৷ নচেৎ না। সবকিছু ভালো হবে। এবং তুমি চান্স ও পাবা। ‘

আসিফের চোখেমুখে আমি আমার জন্য স্বপ্ন ভাসছে দেখতে পেলাম। এতকিছু না ভেবে সানি স্যারের নোট পড়া শুরু করলাম। বায়োলজি বইয়ের শেষে থাকা কুয়েশ্চন রিভাইজ দিলাম। কেমিস্ট্রির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলায় চোখ বুলালাম। জোবায়ের জিকে আমার বরাবর পছন্দের। মেডিকেলের জিকের জন্য এতকিছু পড়ার দরকার হয় না৷ তবুও মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর এগুলায় চোখ বুলিয়ে নিলাম একবার।

আজ দেখতে দেখতে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ চলে এলো৷ আমার বাবার স্বপ্ন, আমার আসিফের স্বপ্ন, আমার মায়ের দোয়া আর আমার নিজের জন্য কিছু করার ইচ্ছা চোখে ভেসে উঠছে যেনো মুহুর্মুহু করে। আসিফ ভোরেই আমাকে কর্ণফ্লাক্স এনে দিয়ে পাশে বসে রইলো। শাশুড়ি মা একবার রুমে এসে জিজ্ঞেস করে গেলেন কিছুর দরকার আছে কিনা। আটটা চল্লিশে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম আমি আর আসিফ। দশটায় পরীক্ষা শুরু হলো। এক ঘন্টার পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসে এক প্রশান্তির ঘুম দিলাম। আসিফ আমার হাতে হাত ধরে বললো,

‘উপরওয়ালা যাই করবেন তাই যেনো মঙ্গলের হয়।’

আমি আর চিন্তা করলাম না বেশিকিছু। যা হবার হবে।

দুইদিন চলে গেলো। কাল রাতে দেখলাম আজ সকাল বারোটার পর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট পাবলিশড হবে। সকাল থেকেই মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছি আমি। বারোটা বাজলো। দুপুর গড়ালো। সন্ধ্যা হলো। রেজাল্ট এখনও দিলো না। প্রতিটা মুহূর্ত যেনো এক বছর সমান লম্বা লাগছে আমার। যেকোনো মুহূর্তে রেজাল্ট দিয়ে দিতে পারে।

বিকালের দিকে নিউজ দেখালো যে রেজাল্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে৷ কিছুক্ষণ পর দেখলাম দেশের প্রথম হয়েছে অতসী সুনন্দা, জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে৷ তার এবারের প্রাপ্ত মার্কস ৮৯.৮৫। আমার ভেতরের কম্পন আরও বেড়ে যেতে লাগলো। এদিকে আসিফ বাসায় চলে এলো। আসিফ এসেই শাশুড়িকে জানালো, তানিয়া আপার সেন্স ফিরে এসেছে এবং ডাক্তার বলেছেন তার পজেটিভ রিকভারি হচ্ছে। আশাকরা যায় সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। শাশুড়ি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন৷ উপরে দুই হাত তুলে বললেন,

‘আল্লাহ আমার পরিবারে যেনো সব সুখ দিয়ে দেন। আল্লাহ তুমি আমার সব সুখ আবার ফিরিয়ে দেও।মালিক আর সহ্য হচ্ছে না এসব।’

আসিফ আমার দিকে তাকালো। আমার চিন্তাযুক্ত মন দেখে বললো,

‘কোন চিন্তা করো না নুপুর। দেখবা সব যখন ঠিক হচ্ছে তখন তোমারও রেজাল্ট ভালো আসবে।’

আমার অজানা শঙ্কা মনে দেখা দিলো। আমি কি চান্স পাবো মেডিকেলে? নাকি স্রস্টা সবকিছু দিয়েও নিয়ে নিবেন আমার থেকে? সব সুখ কি মানুষের কপালে একসাথে চলে আসে?

মুহূর্তের মাঝে মোবাইলে রেজাল্টের একটা মেসেজ এসে ঢুকলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ দেখতে গেলাম। মেসেজে লেখা…

(চলবে)