বিন্নি ধানের খই পর্ব-৫৬+৫৭+৫৮

0
356

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫৬
#মিদহাদ_আহমদ

টিচারের কথা শুনে তানিয়া হাইপার হয়ে উঠলো। ঝটপট করে বললো,

‘মানে কী? একজন স্টুডেন্ট, যার কিনা দুইদিন পর পরেই এক্সিবিশন আর তার মেন্টরিং এ আমার মেয়েটা, তিনিই কিনা আজ নেই! এইটা তো মানা যায় না। এইটা কেমন কথা।’

তানিয়ার এমন কথা শুনে টিচার বললেন,

‘আসলে উনার একটা সমস্যা পড়ে গিয়েছে তাই,’

‘না এসব সমস্যা তো আমার দেখার বিষয় না। আমি এক্ষুণি স্যারকে কল দিচ্ছি।’

তানিয়া ফারুক স্যারের নাম্বারে কল দিলো। ক্লাসের ভেতরে গল্প আর্টে মন দিয়েছে। অন্য স্যার ম্যাডামরা আছেন। স্যারের মোবাইলে কয়েকবার রিং হলেও কল ধরলেন না তিনি। তানিয়া আবারও কল দিলো। এবার স্যার কল রিসিভ করতেই তানিয়া জিজ্ঞেস করলো,

‘আমি গল্পের মা বলছি। আপনি কি আজ আর আসবেন না?’

‘ইয়ে মানে, আই এম সরি। গল্পকে শেষ মুহূর্তের জন্য প্রিপেয়ারড করতে পারলাম না। তবে নুকুল স্যার আর প্রিয়সী ম্যামকে আমি বলে দিচ্ছি। আপনি কোন টেনশন…’

‘টেনশন মানে? আপনি আপনার দায়িত্ব থেকে এভাবে সরে যেতে পারেন না। দায়িত্ব মানেই দায়িত্ব। কখনো দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আপনার আজ শিডিউল ছিলো, মানে ছিলো। আপনি আজ যদি না আসার হতো, তাহলে আমাকে আগে বলতেন। আমি গল্পকে এক্সিবিশনের জন্য অন্য কোথাও তৈরি করতাম। তার পরও কী হলো? এই তীরে এসে তরী ডুবলো?’

ওপাশ থেকে ফারুক স্যার বললেন,

‘না মানে আপনি আমার কথা…’

‘কী আপনার কথা? এসব শোনার সময় আমার নাই।’

কথাগুলো বলেই তানিয়া কল কেটে দিলো৷ প্রিয়সী ম্যাডাম উঠে এলেন। তানিয়াকে বললেন,

‘আপনি এই কাজটা ঠিক করেননি। স্যারের মেয়ে অসুস্থ আপনাকে বলেছিও।’

তানিয়া শুনেও না শুনার বাহানা করলো।

এদিকে আসিফ সকাল সকাল নাস্তা খেয়ে বের হয়ে গিয়েছে তার সেই চিরচেনা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে। আমি লাগেজ খুলে শ্বশুরের জন্য আনা সিরিয়াল, কর্ণফ্লাক্স, পিনাট বাটার, চিজ এসব এনে দিলাম। শ্বশুর এসব দেখে শাশুড়িকে ইশারায় বললেন,

‘খেতে দিবা না কেমন করে এবার দেখবো।’

শাশুড়ি কাপড় গুছানোয় ছিলেন। উঠে এসে বললেন,

‘গল্প চিংড়ি পছন্দ করে। আমি চিংড়ি এনে রেখেছি। তুমি ওর জন্য চিংড়ি রান্না করতে পারো নুপুর। গল্প অনেক ভালোবেসে খাবে।’

‘আচ্ছা মা। ঠিক আছে। ‘

আমি উঠে গেলাম। রুম থেকে বের হয়ে যাবার সময় শুনলাম পেছন থেকে শ্বশুর শাশুড়িকে বলছেন,

‘এভাবে মেয়েটাকে এখন লাইনে আনতে হবে আসিফের মা। তোমার সাহায্য ছাড়া এইটা সম্ভব না কোনভাবেই।’

আমার মন প্রাণ খুশি হয়ে গেলো। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম আমার মা আগে থেকেই রান্নাঘরে আছেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কেন এসেছি রান্নাঘরে৷ বললাম, চিংড়ি রান্না করবো৷ মা কিছুটা বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘চিংড়ি? গল্পের জন্য?’

‘হ্যাঁ মা। শাশুড়ি মা বলে দিয়েছেন।’

‘দেখছিস মা, সবাই কেমন তোকে হেল্প করছে! দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ চাইলে তোর আর কোন অভিযোগ থাকবে না৷ দেখতে দেখতে দেখবি, গল্প তোর হয়ে যাবে৷ কোন বাধা এখানে কাজ করবে না আর।’

আমি রান্না শেষ করতে না করতেই তানিয়া আপা আর গল্প বাসায় চলে এলো। আমি এগিয়ে গিয়ে গল্পকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আজ ক্লাস কেমন হয়েছে মা?’

‘খুব ভালো। জানো, জানো, আজ আমি আউট লাইন খুব ভালোভাবে করেছি। প্রিয়সী ম্যাম আমাকে অনেক গুলো স্টার দিয়েছেন৷’

‘ওরে বাবারে। আর আমিও তোমার জন্য অনেকগুলো স্টার জমিয়ে রেখেছি।’

‘স্টার? আমার জন্য?’

‘হ্যাঁ মামুণি। তোমার জন্য।’

‘দেখি দেখি’

আমি এগিয়ে গিয়ে গল্পের হাতে ধরলাম। বললাম,

‘আসো রুমে আসো। আমার রুমে রাখা আছে।’

ননাস বলে বসলো,

‘না না নুপুর। ওকে আগে চেইঞ্জ করিয়ে আনি।’

শাশুড়ি মা ননাসকে থামিয়ে গল্পের দিকে চেয়ে হেসে হেসে বললেন,

‘যাও নুপুর। আমার দাদুভাইকে আগে স্টার দিয়ে দাও। তারপর সে চেইঞ্জ করবে ‘

আমি একবার তাকালাম ননাসের চোখে। তার চোখ যেনো কথা বলছে। মুখে কিছু বলছে না। গল্পকে নি আমি রুমে গেলাম। গল্পকে বিছানায় বসিয়ে লাগেজ থেকে স্টার জেলি চকোলেট আর কিটকাটের দুইটা বক্স বের করে এনে গল্পের হাতে দিলাম। গল্প বললো,

‘ওত্তগুলো আমার জন্য বুঝি?’

‘হ্যাঁ মামুণি। তোমার জন্য। আরও লাগবে?’

‘কেভিটি! কেভিটি! এত্তগুলো খেলে যে কেভিটি হবে।’

‘একসাথে খাবা না। আস্তে আস্তে খাবা।’

গল্প কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বললো,

‘আমি স্কুলে নিয়ে, সবাইকে একটা একটা করে দিবো৷ সবাইকে দিবো।’

বলতে বলতে দুই বক্স কিটকাট আর এক বক্স স্টার জেলি চকোলেট নিয়ে গল্প রুম থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। বের হওয়ার আগে পেছন ফিরে গল্প বললো,

‘থ্যাঙ্কিউ’

আমি হেসে হেসে বললাম

‘শুধু থ্যাঙ্কিউ? আর কিছু না?’

ফ্যালফ্যাল চোখে মেয়েটা আমার দিকে তাকালো। আমি হেসে হেসে তার কাছে গিয়ে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম,

‘একটা আদর দিবা না?’

গল্প আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিলো। তারপর হেলেদুলে চলে গেলো ননাসের রুমে।

দুপুরে খাবার টেবিলে শাশুড়ি সবকিছু সাজিয়ে আমাদের ডাক দিলেন। আসিফও বাসায় এসেছে। সবাই একসাথে খেতে বসলাম। শাশুড়ি রান্নাঘর থেকে বাটিতে করে চিংড়ি নিয়ে এসে গল্পকে বললেন,

‘দাদুভাই আজ আরেকটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।’

‘কী দাদুভাই?’

‘এই দেখো।’

‘চিংড়ি’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ চিংড়ি। কে রান্না করেছে জানো?’

গল্প এদিক ওদিক তাকালো শুধু। শাশুড়ি মা আমার দিকে তাক করে বললেন,

‘এইযে, এই লক্ষ্মী মেয়েটা, আমার লক্ষ্মী দাদুভাইয়ের ফেভারিট চিংড়ি রান্না করেছে।’

গল্পের চোখেমুখে আমি খুশি দেখতে পেলাম। উঠে গিয়ে গল্পের প্লেইটে চিংড়ি তুলে দিলাম। গল্প আমার সামনে এই প্রথম তৃপ্তিভরে খেলো। আশেপাশে ভাতগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। আমি এই ছড়ানো ছিটানো ভাতগুলো কুড়িয়ে নিজের প্লেইটে নিলাম৷ বাচ্চার এটো ভাত আর ছড়ানো ভাতের স্বাদ কেমন হয়, এইটা আমি জানি না। এই স্বাদ নেয়ার জন্য কতদিন আমি অপেক্ষা করে এসেছি!

খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই ননাস উঠে গেলো। মোবাইলে ড্রাইভারকে কল করে গাড়ি বের করতে বললো। শ্বশুর জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হলো? এখন এই অসময়ে কোথায় যাবি?’

ননাস বললো,

‘কাজ আছে৷ আমি এসে বলছি।’

মুহূর্তেই উপরে উঠে গেলো ননাস। ড্রেস চেইঞ্জ করে নেমে এলো। গল্প জিজ্ঞেস করলো,

‘কোথায় যাচ্ছো মামুণি?’

‘আমি যাচ্ছি আর আসছি। তোমার জন্য কেটবেরি নিয়ে আসবোনে কেমন?’

তারপর ননাস আমার দিকে চেয়ে বললো,

‘নুপুর তুমি একটু ওর ড্রইংটা দেখো। এক্সিবিশন ডেইট আজ দিয়ে দিবে। একটু সিরিয়াসলি দেখতে হবে। আমি আসছি তাড়াতাড়ি। ‘

‘কোথায় যাচ্ছিস বলে তো যা?’

শাশুড়ি মায়ের কথা শুনেও না শোনার বাহানা ধরে ননাস চলে গেলো বের হয়ে।

তানিয়া ড্রাইভারকে বললো

‘নর্থ ইস্ট মেডিকেলে আমাকে নিয়ে চলো।’

গাড়িতে বসেই প্রেয়সী ম্যাডামকে কল করে জিজ্ঞেস করলো,

‘বেড নাম্বার কত? আপনি কি যাবেন আমার সাথে?’

‘জি আমি বুঝতে পারিনি।’

‘ফারুক স্যারের মেয়ে অসুস্থ না? আমি দেখতে যাবো বাচ্চাটাকে। আপনি আসবেন?’

‘কোথায় আছেন আপনি এখন?’

‘মিরাবাজার।’

‘আপনি জিন্দাবাজার হয়ে যাবেন?’

‘আপনি গেলে বলেন। আমি আসছি এদিকেই।’

‘ওকে। আমার আসতে দশ মিনিট সময় লাগবে।’

দশ মিনিটের মাথায় প্রেয়সী ম্যাডামকে গাড়িতে তুলে, তানিয়া ছুটলো ফারুক স্যারের মেয়েকে দেখতে। ভেতরে ভেতরে তার অনুশোচনা হচ্ছে। অসুস্থ একটা মেয়ের বাবাকে সে কথা শুনাতে কম শুনায়নি!

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫৭
#মিদহাদ_আহমদ

নর্থ ইস্ট মেডিকেলের চার তলার ৪০৮ নাম্বার কেবিনে ফারুক স্যার তার মেয়েকে নিয়ে আছেন৷ প্রেয়সী ম্যাডামকে নিয়ে তানিয়া রুমে ঢুকলো। সাথে করে নিয়ে আসা আঙুর, স্ট্রবেরি, বাটার, ড্রাগন ফলের ব্যাগ একপাশে রাখলো৷ প্রেয়সী ম্যাডাম ইশারায় ফারুক স্যারের মেয়ের দিকে দেখিয়ে দিলেন তানিয়াকে। তারপর বললেন,

‘জ্বর বেশি আর ডায়রিয়া হয়ে যাওয়ায় ডাক্তার ভর্তি দিয়ে দিয়েছে। এখন ঘুমাচ্ছে মেয়েটা।’

তানিয়া পাশে গিয়ে বসলো। হুরহুর করে কান্না শুরু করে দিলো। বাচ্চা মেয়েটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তানিয়া প্রেয়সী ম্যাডামকে বললো,

‘আই এম সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি…’

ফারুক স্যার বললেন,

‘কোন সমস্যা নেই। আমার গল্পের আর্ট ক্লাস কি আজ ভালোমতো হয়েছে? আমি আগামীকাল আপনাদের বাসায় যাবো। কোন টেনশন নিয়েন না।’

তানিয়া স্যারকে বললো,

‘আমি আসলে তখন হাইপার হয়ে গিয়েছিলাম। বাচ্চাটা যে এতটা অসুস্থ আমি বুঝতে পারিনি। আমার বুঝা উচিত ছিলো। আমি নিজের কাছে নিজে এখন লজ্জিত।’

ফারুক স্যার একটা ওয়ান টাইম গ্লাসে জুস ঢালতে ঢালতে কিছুটা হেসে হেসে বললেন,

‘জীবন চলছে এমন। আজ রোদ, কাল ঝড় তো পর্শু বৃষ্টি। মেয়েটার মা আমার একার উপর সব দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলো। আল্লাহ রেখেছেন। মেয়েটার সামান্য কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারি না। আমার দুনিয়া বলতেই আমার এই মেয়ে।’

প্রেয়সী ম্যাডাম ফারুক স্যারের সাথে সাথে বললেন

‘স্যার এই কয়েক বছর ধরেই তো আপনাকে চিনি আমরা। আমাদের এই পুচকে মেয়েটাকে নিয়েই তো আপনার জীবন। মেয়েটার কোনকিছু হলে আপনার আর কোনদিকে মন থাকে না। এই না থাকাটাই তো স্বাভাবিক। আর আজ গল্পের মাও কিছুটা হাইপার হয়ে গিয়েছিলেন৷ আমাকে কল করে বললেন, তিনি হসপিটালে আসতে চান মেয়েটাকে দেখতে। আমিও সাথে চলে এলাম। আপনি কিছু মনে…’

‘আরে কী বলেন ম্যাডাম৷ কিছু মনে করার কী আছে বলেন? আমার মেয়ের যদি এক্সিবিশন হতো, আর স্যার যদি এভাবে না আসতেন, তাহলে বাবা হিসাবে আমার নিজেরও এই একই অবস্থা হতো। সব সময় আসলে নিজের হাতে থাকে না। আমাদেরকে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতাও আমাদের মস্তিষ্ক প্রদান করে না। আমি কোনকিছু মনে করিনি।’

এরমাঝে ফারুক স্যারের মেয়ে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসলো। তানিয়া জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন আছো মা? শরীর কেমন আছে এখন?’

মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো,

‘ভালো।’

ফারুক স্যার মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলেন। মেয়েটাও তার বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। ফারুক স্যার তখন ড্রাগন ফলের দিকে ইশারা করিয়ে বললেন,

‘মুন্নি মা আমার, এই ফলটা তোমার পছন্দের না? দেখো তোমার আন্টি নিয়ে এসেছেন তোমার জন্য।’

স্যারের মেয়ে তখন কোল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে ড্রাগন ফলের ব্যাগ হাতে নিয়ে আবার বেডে চলে এলো। তানিয়া তাকে কোলে করে বিছানায় বসিয়ে দিলো৷ তানিয়াকে নিজ থেকেই জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খেলো মুন্নি। তানিয়াও জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। চুলে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে তারপর ব্যাগ থেকে একটা কিটকাট বের করে হাতে দিলো মুন্নির। কিটকাট দেখে মেয়েটার সে কী আনন্দ!

আরও কয়েক মিনিট বসে প্রেয়সী ম্যাডাম আর তানিয়া নর্থ ইস্ট মেডিকেল থেকে বের হয়ে এলেন। গাড়িতে বসে প্রেয়সী ম্যাডাম তানিয়াকে বললেন,

‘স্যার ওনার ওয়াইফকে অনেক ভালোবাসতেন। আর এই ভালোবাসা থেকেই উনি সেকেন্ড বিয়ে করেননি। পাছে যদি নতুন বউ এসে বাচ্চাটার সাথে অবিচার করে! আর মেয়েটাকে তো দেখেছেন ই। বাপের আদরের মেয়ে। কখনো কোন অযত্ন হয়না মেয়েটার। দিব্যি ভালোমতোন স্যার ওর দেখভাল করেন। মেয়েটার বাপও স্যার, আবার মাও স্যার।’

প্রেয়সী ম্যাডামের কথা শুনে মন ভরে উঠলো তানিয়ার। পুরুষ জাতির উপর তার একপ্রকার ক্ষোভ ছিলো এতদিনের। এই ক্ষোভ যেনো নিমিষেই মিথ্যা হয়ে গেলো আজ!

এদিকে তানিয়া আর প্রেয়সী ম্যাডাম হসপিটাল থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর মুন্নি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘বাবা বাবা ওইযে শাড়ি পরা আন্টি উনি তো পুষি আন্টি। আর নতুন আন্টি কে?’

‘কোনজন বাবা?’

‘ওইযে যে আমাকে এত এত ফ্রুটস আর চকোলেট দিয়ে গিয়েছে। জানো বাবা সেই আন্টি আমাকে যখন জড়িয়ে ধরেছিলো তখন আমার খুব ভালো লেগেছিলো। তার চুল থেকে মিত্তি মিত্তি গন্ধ আসছিলো।’

ফারুক স্যার মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। দুই চোখ দিয়ে তার পানি পড়লো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে মনে আল্লাহর কাছে বললেন, কেন আল্লাহ তার এই মাসুম বাচ্চাটাকে এতিম করে দিলেন! কেন তার এই মাসুম বাচ্চাটা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত!

এদিকে আসিফ গল্পকে নিয়ে আর্ট করতে বসেছে। শাশুড়ি মা আমকে ডেকে বললেন,

‘আসলে হয়েছে কি নুপুর, রক্তের একটা টান আছে না? এই টানের কারণেই দেখো গল্প দাদুভাই তার বাবার মতো আর্ট শিখে নিয়েছে অল্প সময়েই। আর আমরা তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমাদের বাসায় এতবড় একজন চিত্রশিল্পী থাকতে, দাদুভাইকে বাইরে গিয়ে কেন আর্ট শিখা লাগবে! দেখো দেখো মেয়েটা কত সুন্দর আর্ট রপ্ত করে নিয়েছে!’

আমি হাসলাম শাশুড়ি মায়ের কথায়। হেসে হেসে বললাম,

‘শুধু কি আপনার ছেলে? ও যখন পেটে ছিলো, তখন আপনার ছেলে তো আমাকেও আর্ট শিখিয়েছে হাতে ধরে ধরে৷ এই শিখানোটাই এখন আমার মেয়ে পেয়েছে।’

আমি রুমে ঢুকলাম। আসিফ আর তার মেয়ের মাঝখানে গিয়ে বললাম,

‘ ‘আমাকেও আর্ট শেখাও তোমরা। শেখাবে তো?’

গল্প তার দুই হাত দিয়ে আমার গালে ধরে বললো,

‘বসো বসো। আমার বাবার কাছে বসো৷ বাবা অনেক সুন্দর রঙ করে।’

আসিফ গল্পকে বললো,

‘ও তোমার কে হয় বাবা?’

‘সে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কে হয়?’

‘আম্মু হয় বাবা’

‘কিন্তু মামুণি যে বললো সে আমার আন্টি হয়? সে ইয়া বড় বড় মুখ করে আমার সব রক্ত খেয়ে নিবে।’

আসিফ আর আমার বুঝত বাকি রইলো না ননাস আমার সম্পর্কে কী কী বলেছেন আমাদের মেয়েকে। শাশুড়ি কথা কাটিয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন,

‘না না৷ রাক্ষুসি তো গল্পে হয় দাদুভাই। মামুণি তো তোমার মামুণি, আর ও তোমার আম্মু হয়।’

‘আম্মু হয়?’

‘হ্যাঁ দাদুভাই। ও তোমার আম্মু হয়।’

গল্প এবার আমার দিকে তাকালো একবার। ভালোকরে তাকালো। আরেকবার তার বাবার দিকে তাকালো। তারপর তার বাবা বললো,

‘কী? তোমার আম্মু হয় সে। দেখো দেখো সে তোমাকে রান্না করে দেয়, আর্ট ও শেখাবে। হারমোনিয়াম ও শেখায়। সে তোমাকে চকোলেট ও দেয়।’

‘এসব তো মামুণিও দেয় আমাকে। মামুণি আমার এত্তোটা ভালোবাসে।’

‘সে মামুণি, আর সে তোমার আম্মু হয়। বুঝেছো বাবা?’

‘আম্মু?’

‘হ্যাঁ আম্মু।’

গল্প এবার আমার দিকে তাকালো। চোখের সাথে মুখের কথা এক করে আগ্রহভরে সে জিজ্ঞেস করলো,

‘তুমি কি আমার আম্মু হও?’

আমার ভেতর শিহরণ জাগতে শুরু করলো। নিজের পেটের সন্তানের মুখে আম্মু ডাকটা শুনতে পেয়ে নিজেকে আর সামাল দিতে পারলাম না। কান্না করতে করতে জড়িয়ে ধরলাম আমার গল্পকে। গল্প আমার কান্না দেখে বললো,

‘তুমি কি বাচ্চা? আমাদের ক্লাসের সিনথিয়াও তোমার মতো বাচ্চা। সেও এমন কান্না করে।’

আমি চোখ মুছলাম। নিজেকে সামলে নিলাম। গল্পকে বললাম,

‘হয়েছে হয়েছে। এবার বাবার সাথে বসে ছবি আঁকায় মনোযোগ দাও।’

‘মামুণি কোথায়?’

শাশুড়ি মা বললেন,

‘মামুণি এসে যাবে দাদুভাই। তুমি তোমার বাবা আর আম্মুর কাছে বসে বসে ড্রইং করো। আমি তোমার জন্য হরলিক্স নিয়ে আসছি কেমন?’

শাশুড়ি চলে গেলেন। ছোট গল্প আমাদের দুজনের সাথে গল্প করতে করতে ছবি আঁকায় মনোযোগ দিলো। আমি গভীরভাবে আমার মেয়েকে দেখলে লাগলাম। শুধু জন্ম দিয়েছি, এরপর থেকে কখন কীভাবে আমার মেয়েটা এতবড় হয়ে গেলো টেরই পেলাম না!

সেদিন সন্ধ্যার সময় ননাস বাসায় আসার পর গল্প ননাসকে ডেকে এনে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,

‘মামুণি মামুণি, এই দেখো আমি আমার আম্মু পেয়ে গিয়েছি। আম্মু তোমার মতো আমাকে আদর করে, আমাকে ভাত খাইয়ে দেয়, আমাকে গল্প বলে। আর জানো, মামুণি আর আব্বু আমাদের ফারুক স্যারের মতো আর্ট জানে। কী মজা কী মজা তাইনা? তুমি কি আমার চকোলেট এনেছো? আজ সারাদিন তোমাকে মিস করেছি মামুণি।’

বলেই ননাসকে জড়িয়ে ধরলো গল্প। ননাস হাঁটু গেড়ে বসে আমার গল্পকে তার ওড়না দিয়ে চোখ মুখ মুছিয়ে দিলো। কাজের মেয়েকে ডেকে বললো গল্পের জন্য কুসুম গরম পানি নিয়ে আসতে। গল্পের নাকি গলা ধরেছে। অথচ আমরা কেউ ধরতেও পারিনি। ননাস ঠিকই ধরে নিয়েছে। ভেতরে ভেতরে অনুভব করতে লাগলাম, ননাস আমার গল্পের মা হয়ে উঠেছে আসলেই। আমার থেকেও এক ছটাক হলেও যেনো বেশি!

এদিকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফারুক স্যারের মেয়ে মুন্নি, তার বাবাকে বললো,

‘বাবা বাবা ওই আন্টির কাছে আমাকে নিয়ে যাবা একবার? আমি তাকে আবার জড়িয়ে ধরতে চাই। নিয়ে যাবা বলো?’

ফারুক স্যার ভেতরে ভেতরে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

‘আচ্ছা মা। তোমার যদি তাকে দেখতে মনে চায়, তাহলে তার কাছে আগামীকাল নিয়ে যাবো তোমায়। তুমি এখন ঘুমিয়ে যাও কেমন?’

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫৮
#মিদহাদ_আহমদ

‘এইটা কি গল্পের বাসা? আমরা গল্পকে দেখতে এসেছি’

‘দাঁড়ান। আমি ভেতরে জিগাইতাছি। হ এইডা গল্পের বাসা’

দারোয়ান জবাব দিলো ফারুক স্যারকে। ফারুক স্যারের দিকে তার মেয়ে মুন্নি জিজ্ঞেস করলো,

‘এইটা কি ওই আন্টির বাসা?’

‘হ্যাঁ মা। ওই আন্টির বাসা এইটা।’

দারোয়ান ভেতরে এসে ঢুকলো। আমি ডাইনিং রুমে শ্বশুরের সাথে বসে গল্প করছিলাম। দারোয়ান কাকা বললো,

‘বাইরে কে জানি আইছে। গল্পের সাথে দেখা করবো কইছে।’

‘গল্পের সাথে!’

‘হ। খুঁজলো তো গল্পরে’

আমি উঠে গেলাম। বাইরে আসতেই দেখলাম একজন মধ্যবয়স্ক সুন্দর পুরুষ আর তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে। উনি বললেন,

‘আসসালামুয়ালাইকুম। আমি গল্পের আর্ট টিচার। মিস্টার ফারুক। আর এই আমার মেয়ে মুন্নি।’

আমি আবার সালাম দিলাম স্যারকে। তারপর বললাম,

‘আসুন আসুন। ভেতরে আসুন।’

ফারুক স্যার আর তার মেয়েকে ভেতরে এনে বসিয়ে আমি রান্নাঘরে গেলাম খাবার আয়োজন করতে৷ ফিরে এসে দেখি শ্বশুরের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছেন ফারুক স্যার। আমি পাশে বসতেই ফারুক স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আপনি…’

শ্বশুর ফারুক স্যারের কথার জবাব নিজ থেকেই দিলেন। বললেন,

‘এই হচ্ছে আপনার ছাত্রীর মা। আমার পুত্রবধূ নুপুর ‘

‘মানে গল্পের মা আপনি?’

‘জি স্যার। আমি।’

এদিকে বাচ্চা মেয়েটা তার বাবাকে কিছু একটা বললো। তিনি বললেন

‘আসলে আমরা এসেছিলাম গল্পের মায়ের সাথে দেখা করতে। আই মিন মিস তানিয়ার সাথে। আমার মেয়েটা তাকে দেখবে বলে অপেক্ষা করছে অনেক্ষণ থেকে।’

শ্বশুর ডাক দিলেন ননাসকে। ননাস তার রুমেই ছিলেন৷ ননাস সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার আগেই স্যারের বাচ্চা মেয়েটা উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ননাসকে৷ ননাস এসে সোফায় বসলো।স্যারকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। স্যার তারপর বললেন,

‘জানেন আপনি যখন কাল তাকে দেখতে গিয়েছিলেন, সে খুব খুশি হয়েছে। তারপর থেকেই বায়না ধরে আছে যে আপনার কাছে আসবে। আপনাকে দেখবে। মেয়েটা এখনও দুর্বল হয়ে গেলো।’

আমি বুঝতে পারলাম কাল দুপুরে তাহলে ননাস এই বাচ্চাটাকেই দেখতে গিয়েছে। ননাসও জড়িয়ে ধরে অণেক্ষণ আদর করলো বাচ্চা মেয়েটাকে। এমন সময় আসিফ বাসায় এসে ঢুকলো। আসিফকে দেখেই গল্পের আর্ট টিচার দাঁড়িয়ে গেলেন। উঠে বললেন,

‘আপনি আসিফ সাহেব না? আপনি…’

আসিফ কিছুটা অবাক হলো। সালাম দিয়ে বললো,

‘জি। আপনাকে ঠিক…’

ননাস আসিফকে গল্পের টিচারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ফারুক স্যার আসিফকে বললো,

‘আপনার মাদার এন্ড ওয়ার্ল্ড আর্টটাই তো প্রদর্শনী হয়েছিলো ল্যুভর মিউজিয়ামে। এম আই রাইট? আর পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য থেকে যাওয়া দুইটা ছবির মধ্যে একটা আপনার৷ অন্যটা সম্ভবত চারতের চিনাই রাজপুতের ছিলো তাইনা?’

‘না না। চিনাই রাজপুত না, মাহেন্দ্র রাজপুতের।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে৷ আর আমি যাস্ট অবাক হচ্ছি, এতবড় একজন গুণী আর্টিস্টের মেয়েকে আমি আর্ট শেখাচ্ছি!’

আসিফ স্যারের হাত ধরে বললো,

‘স্যাররা সবসময় স্যার হোন৷ আমি আমার মেয়েকে এমন সময় দিতে পারিনি৷ কিন্তু আমার মেয়েকে আপনি সময় দিয়েছেন, আগলে রেখেছেন৷ সব কৃতিত্ব আপনার।’

এভাবে তাদের বেশ কিছুক্ষণ আলাপ চললো৷ আমি খেয়াল করলাম স্যারের ছোট মেয়ে মুন্নি একা একাই ননাসের কাছাকাছি চলে এলো৷ সিঁড়ি বেয়ে উপরেও উঠেছে সে। ননাসও তাকে নিয়ে মেতে আছেন। গল্প ঘুমে ছিলো। সেও ঘুম থেকে জেগে উঠেছে৷ গল্প আবার দেখলাম সহজে সবার সাথে ভাব করে নেয়৷ সে মুন্নির হাতে ধরে তার রুমে নিয়ে গেলো। একবার গিয়ে দেখে এলাম দুজনে খেলা করছে। শাশুড়ি মা স্যারকে খেয়ে যেতে বললেন৷ এর মাঝে আমি আর শাশুড়ি মা খাবারও রেডি করে নিলাম।

টেবিলে সবাই একসাথে খেতে বসেছে৷ আসিফ আর স্যার কথা বলছেন আর্টের নানাকিছু নিয়ে৷ গল্পও বসলো চেয়ারে। ননাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্পকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিলো। গল্পের পাশের চেয়ারেই স্যারের মেয়ে৷ স্যারের মেয়েকে আমি প্লেইটে তুলে চিকেন দিলেও সে কেমন জানি ননাসের দিকে চেয়ে আছে! আমার বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটা ননাসের আমার মেয়েকে খাইয়ে দেয়া দেখে সেও খেতে চাচ্ছে! আমি মুন্নির পাশে গিয়ে কানে কানে বললাম,

‘আমি খাইয়ে দেই মুখে তুলে মা?’

মুন্নি বললো,

‘ওই আন্টিকে বলে আমাকে খাইয়ে দিতে ‘

টেবিলে থাকা সবাই কথাতা শুনতে পেলো। ফারুক স্যার মেয়ের দিকে চোখ ইশারায় গলা ঝেড়ে বললেন,

‘না মা। খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি৷ আন্টিরও কাজ আছে তাইনা বাবা?’

ননাস মুন্নিকে গল্পের পাশে এনে বসিয়ে ভাত আরেকটু মাড়লো। ভাত মেড়ে বললো,

‘এবার দুজন একসাথে খাবে আমার সাথে। দুজনে বড় বড় করে হা করো দেখি’

ননাসের এমন কাজের প্রতি আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি যে এতটা মানবিক হবেন আমি বুঝতেও পারিনি৷ খাওয়া শেষ হলো। তিনটা নাগাদ রফিক স্যার উঠতে চাইলেন৷ মুন্নিকে ডাক দিলেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু সে আসলো না৷ কিছুক্ষণ পর ননাসের হাত ধরে সে নিচে এলো। গল্পও সাথে। গল্পের অনেক ভাব হয়ে গিয়েছে মুন্নির সাথে এই কিছু সময়ের ভেতরে। ফারুক স্যার মেয়েকে বললেন,

‘কী? এখন আমাদের বাসায় যেতে হবে না?’

মুন্নি মুখ মলিন করে চুপচাপ তার বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো৷ তানিয়া আপা বললেন,

‘স্যার আপনি ওকে নিয়ে আবার আসবেন বাসায়। কত লক্ষ্মী একটা মেয়ে!’

‘আচ্ছা। বলেছেন যখন অবশ্যই আসবো।’

‘তুমি কি আমার আম্মু হবা?’

হুট করে সবার সামনে কথাটা বলে বসলো মুন্নি। ফারুক স্যার অগ্নিশর্মা চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। বুঝতে পারলাম অনেক আদরের মেয়ে তাই খুব কষ্টে নিজের হাতকে সংযত করে রেখেছেন। আর কোন কথাই তিনি বললেন না। মেয়েকে হাতে ধরে সোজা বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। কিন্তু আমার কানে তখন থেকে শুধুই ধ্বনিত হতে লাগলো বারেবারে বাচ্চাটার বলা সেই কথা, ‘তুমি কি আমার আম্মু হবা?’

চলবে।