বিন্নি ধানের খই পর্ব-৮+৯+১০

0
353

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_০৮
#মিদহাদ_আহমদ

আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমার ননদ ফোনে কার সাথে বলছে যে আজ রাতে সে সেখানে থাকবে। হোটেলের রুম সেইফ থাকা চাই। বাসায় বলবে যে সে তার বান্ধবীর বাসায় আছে।

কথাগুলো শুনেই যেনো আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেলো। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। পেছন থেকে আমার ননাস আমাকে ডাক দিয়ে বললো,

‘কী? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন নুপুর? ভেতরে যাও। রান্নাঘরে গিয়ে দেখো কী করছে কাজের লোকেরা। দেখতে শুনতে হবে না নাকি? বাড়ি ভর্তি মেহমান!’

ননাসের কথা শুনে আমি আমার ননদের রুম অতিক্রম করে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলাম। আমার ননাসের ননাস এমন সময় সামনের দিক থেকে আসতে লাগলো। এইটা দেখেই আমার ননাস আমাকে ডাক দিয়ে বললো,

‘আরে নুপুর! রান্নাঘরের দিকে কেন যাচ্ছো? ওখানে কাজের মেয়েরা তো আছেই। তুমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো। যা গরম পড়েছে আজ! আর নাহলে আসো আমার রুমে। আমরা গল্প করি।’

তারপর আমার ননাস আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে তার ননাসের সামনে গিয়ে বলল,

‘আপা দেখো না! আমার ভাইয়ের বউটা কত সুন্দর না! কী লক্ষ্মী দেখতে!’

ননাসের ননাস আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। আমার হাত ধরে সে আমার ননাসকে বললো,

‘তানিয়া, তোমার ভাইয়ের বউয়ের আঙুলের এই আংটিটা কোথা থেকে করেছো? কী সুন্দর ডিজাইন!’

ননাস বললো,

‘আপা! ওই মান্তাসা আংটিটা! দেখো আপা পুরো আঙুল জুড়ে বসে থাকে। আমি এই ধাচের আংটি এর আগে কখনো দেখিনি। মা নিজে এই ডিজাইন দিয়ে বানিয়েছেন আংটিটা নিজের একমাত্র পুত্রবধূর জন্য। যতোই হোক আদরের বউ তো! ওজনও আছে। পাক্কা দেড় ভরি!’

‘দেড় ভরি!’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’

আমার ননাস আর তার ননাসের এসব আলাপ আলোচনা চলতেই লাগলো। আমি অবাক হলাম, যে গহনাগুলো আমি মাত্র পরার অধিকার পেয়েছি, সেই গহনাগুলো কী সুন্দর করে তিনি তার ননাসের সামনে প্রেজেন্ট করে চলছেন! যে মানুষটা মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে বলেছে যে আমাকে রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে, সেই মানুষটা মুহূর্তেই আবার বলে বসলো রান্নাঘরে না গিয়ে এসি চালিয়ে রুমে যেতে!

আমি তাদেরকে কাটিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। শুনতে পেলাম ননাসের ননাস তাকে বলছে,

‘শুনো তানিয়া, এসব ভাইর বউদের টাইট দিয়ে রাখতে হয় শুরু থেকেই। নাহলে একবার ছাড়া পেয়ে গেলে মাথায় উঠে নাচে। তাদেরকে এইটা বুঝিয়ে দিও যে এইটা তাদের স্বামীর বাড়ি, আর তোমার বাপের বাড়ি। এই বাড়িতে সে আসার আগে তুমি এসেছো। এখানে তার কোন অধিকার নেই। সে শুধু তোমার ভাইয়ের বিয়ে করে আনা স্ত্রী। আর কিচ্ছু না। এখানে সব রাজত্ব, সব আয়ত্ব, সবকিছু শুধু তোমার চলবে। যেমনটা আমাদের ঘরে শুধু আমার কথা চলে, ঠিক তেমন’

আমার ননাস বললো,

‘না আপা। আমরা আমাদের ভাইয়ের বউটাকে এই ঘরের একজন মানি। আর কেন বাপের বাড়ি এসে কর্তৃত্ব দেখাবো আমি বলেন? এখানে মেয়ের কর্তৃত্ব ফলানোর কিছু নেই। আসলে কিছুকিছু জিনিস না আপা, ছেড়ে দিতে হয়। সব সময় এভাবে হাতের কাছে আর নিজের আয়ত্বে রাখলে, লেবু এমন বেশি চিপলে তিতা হয়ে যায়, মানুষও তেমন। তখন আর মুখের স্বাদও থাকে না, ভালোবাসাও না। আমার এই বাড়ির সবকিছুই তো আসিফের বউয়ের। এই বাড়ির পুত্রবধূর। আর আমরা আসলে কি সে করবে না বলেন? আমাদের তো কোন খাতির যত্নে কমতি হচ্ছে না কখনো। বেশ ভালোই তো চলে যাচ্ছে আপা সবকিছু। ‘

এভাবে তাদের পেছনে আলাপ চললো। আমার বুঝতে বাকি রইলো না আমার ননাসেরও তার স্বমীর ঘরে তার কথা চলে না। সেখানে তার ননাসের সব কথা চলে। অথচ শেষে আমার ননাস কী মিথ্যাই না বললো আমার সম্পর্কে! আর আমার ননাসের ননাস তো আরও ভয়াবহ!

আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা চলে আসলাম আমার শাশুড়ির রুমে। শাশুড়ির রুমে ঢুকতেই শাশুড়ি প্রথমে শুরু করলেন,

‘পোলাও দেখেছো? হাত নিয়ে দেখলাম তেল কম। এখনও ইফতার করার সময় হয়নি। জানি না ইফতারে বসলে কী দেখবো খেতে কেমন হয়েছে। তা তোমার বাপ কি তেলের লিটার দুইশো টাকা দেখে দুই লিটার তেল কম দিয়েছে পোলাওয়ে? বলে দিতা আমি দুই লিটার তেলের দাম দিয়ে দিতাম তোমাকে দিয়ে।’

শাশুড়ির এহেন কথার কোন জবাব আমি কোনদিন দেইনি। এবারও আমি জবাব দিলাম না। শাশুড়িকে নিচু স্মরে বললাম,

‘মা একটা কথা বলার ছিলো আপনাকে।’

‘কী কথা? ঈদে কাপড় দিতে পারবে না তোমার বাপ এই কথা নাকি? শুনো মেয়ে বলে দিলাম, কাপড় দেয়া লাগবেই। আর এখানে আমার মান সম্মানের বিষয় জড়িত। আমাকে না দিক, তোমার বাপকে বলে দিও আমার বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে সে যেনো শরম না পায়। আড়ং থেকে কাজ করা শাড়ি একটা আমার মেয়ের শাশুড়িকে, একটা আমার মেয়েকে, একটা আমার মেয়ের শ্বশুরকে তাতের পাঞ্জাবি, তসরের পাঞ্জাবি আমার মেয়ে জামাইকে যেনো ভালো দেখে দেয়। এগুলায় যদি কোন হেরফের হয় তাহলে আমার মেয়ের আর মাথা থাকবে না। বলে দিও তোমার বাবাকে এগুলো আমাদের এখানের নিয়ম। এগুলো রক্ষা করেই তবে চলা লাগবে।’

শাশুড়ির এবারের এই ভয়াবহ লিস্ট শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমি এবারও কোন কথার জবাব দিলাম না। শাশুড়িকে আবার বললাম,

‘একটা জরুরী কথা বলার ছিলো মা।’

শাশুড়ি মা ইশারায় আমাকে তার পা টিপে দিতে বললেন। আমি বসলাম খাটের এক কোনে। তারপর ইশারা করে বললেন,

‘বল’

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। জানি না তার মেয়ের কথা বললে তিনি কী রিয়েক্ট দেখাবেন এখন। তার পরও মনে সাহস নিয়ে বললাম,

‘মা, কিছুক্ষণ আগে আমি আমার রুম থেকে বের হয়ে আসছিলাম রান্নাঘরের দিকে। এমন সময় আমি তামান্নাকে তার রুমে কার সাথে কলে কথা বলতে দেখতে পাই।’

শাশুড়ি এবার হাক ছেড়ে বসলেন। বললেন,

‘অহ! তার মানে এখন কানাঘুষা শুরু করেছো? কে কী করছে তারও জিম্মাদার হয়ে উঠেছো? ছোট ঘরের মেয়েদের এসব স্বভাব থাকে তাও প্রমাণ করতে বসেছো নাকি এখন? এসব স্বভাব কে শিখিয়েছে?’

আমি নীরবে শুনে গেলাম শাশুড়িমার কথাগুলো। তিনি চুপ করার পর আমি শুরু করলাম

‘মা, তামান্না কার সাথে কলে বলছে যে আজ রাতে সে বাইরে যাবে তার ফ্রেন্ডের বাসায় যাবে এমন বলে। আর হোটেলের কথা, হোটেল সেইফ কিনা এসব…’

শাশুড়ি মা সাথে সাথে আমার বুকে একটা লাত্তি দিলেন। আমি হাত ছেড়ে দিলাম তার পা থেকে। কেশে উঠলাম সাথে সাথে। বিছানায় উঠে বসে শাশুড়ি ডাক দিলেন তার মেয়ে দুজনকে। সাথে সাথে মুখ ছেড়ে বলতে লাগলেন,

‘ইচ্ছা হচ্ছে গালিগালাজ করে একদম শেষ করে দেই ছোটলোকের বাচ্চাটাকে। ছোটলোকের বাচ্চার মুখে যা আসছে, সে তাই বলে বেড়াচ্ছে যেনো!

শাশুড়ি মায়ের ডাকার সাথে সাথে দুজনে এসে হাজির মুহূর্তেই! আমার ননদ এসেই তার মাকে বললো,

‘কী হয়েছে মা?’

ননাস আমার দিকে চেয়ে বললো,

‘কী? এই মেয়ে কিছু করেছে নাকি?’

ননদ বললো,

‘দেখো কোন কান্ড ঘটাচ্ছে মনে হয় মনে মনে ‘

শাশুড়ি বললেন এবার,

‘এই নুপুর এখন আমার মেয়েদের নামে বদনাম তুলছে। এই তামান্না, দেখেছিস তোর নামে কী বলছে? শুনেছিস? তুই আমাকে কাল বলে রেখেছিলি না যে আজ রাতে অবন্তীর বাসায় যাবি তুই? বলেছিলি না? ভাগ্যিস আগে বলে রেখেছিলি আমাকে। এখন এই মেয়ে কী বলছে দেখছিস? তোকে বুঝি কোন ছেলের সাথে কথা বলতে শুনেছে তুই নাকি হোটেলে….

চিহ! আমার মুখে আনতেও লজ্জা করছে এসব।’

‘কী? তুমি এসব বলেছো মাকে? চিহ! গার্বেজ! নোংড়া মহিলা? তোমার সাহস কীভাবে হয় এসব বলার? চিহ! ছোট ঘরের মেয়েরা যে এত নোংড়া হয় তোমাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। কোন মাটিতে গড়া তুমি? চিহ চিহ!’

শাশুড়িও বললেন,

‘আমার মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা তোর মুখে আটকালো না? আরে সম্পর্ক বলেও তো একটা কথা আছে তাইনা? সেই সম্পর্কের খাতিরেও তো তুই এতো জঘন্য কথা না বললেও পারতি! আমার নিজের কানের কাছে নিজের ঘৃণা হচ্ছে এসব শুনে। চিহ চিহ চিহ!

ননদের সাথে সাথে ননাস তেড়ে এলো। ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো সে আমার গালে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘটে গেলো এই ঘটনাটা। আমি এবার আর নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারলাম না৷ বললাম,

‘আমি কি নিজের জন্য বলছি কিছু? আর আমি যা শুনেছি তাই বলেছি৷ তাই বলে তানিয়া আপা আমাকে এভাবে চড় মারতে পারেন? আমি ভুল বলেছি কিছু? আর তামান্না, তুমি নিজে বলো বুকে হাত দিয়ে যে আমি মিথ্যা? আমি এই ঘরে আসার পর থেকে কী না সহ্য করে আসছি? এই ঘরে যেনো আমার কোন দামই নেই! আমিও একটা মানুষ তাইনা? আমিও তো এই ঘরের একজন সদস্য। আমার যে বাবা মা আমাকে বড় করেছেন, সেই বাবা মাও আমাকে জীবনে চড় মারেননি। আর আপা আপনি? আপনিও তো কারোর মেয়ে। নিজের মায়ের ঘর ছেড়ে থাকতে কেমন লাগে এইটা তো আপনিও ভালোকরে বুঝেন। এসব অন্যায় করে কি জীবনে খুব বেশিকিছু পাওয়া যায়?’

শাশুড়ি অগ্নিশর্মা হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। শেষে বললেন,

‘মুখের খই ফুটেছে? আতপ চালের খই থেকে এখন বড় ঘরের বউ হয়ে এসেছো বলে বিন্নি ধানের খই হয়ে উঠবা? মেয়ে তোমার ওকাতে থাকো। সীমা লঙ্ঘন করার চেষ্টাও করবা না।’

‘কী হয়েছে বেয়ান? মা মেয়ে বউ মিলে কী করছেন? এদিকে আজানের সময় হয়ে এলো যে ‘

কথাগুলো রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন আমার ননাস তানিয়ার শাশুড়ি। আমার শাশুড়ি তার বেয়ানকে বললেন,

‘আরে না না। এই কথা বলছিলাম আরকি যে ইফতারের পর ডেজার্ট আইটেম কোথায় সার্ভ করবো এই নিয়ে। বউমা, ও বউমা আমার ওয়ারড্রব এর উপরে এসির রিমোট রাখা আছে। তুমি একটু অন করে দাও এসিটা। আজকের গরম কেন জানি একটু বেশিই পড়ে গিয়েছে। যা দিনকাল আসছে, একেবারে সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। আমি ভাবছি কখন না আমাদের দেশ আরবের মরুভূমির মতো হয়ে যায়। মানুষ তখন এসি ছাড়া তো বাঁচতে পারবেই না বরং গরমে মারা যাবে। তাইনা বেয়ান?’

আমি তাজ্জব বনে গেলাম আমার শাশুড়ির ব্যবহারে! এক মুহূর্তে যেনো তিনি বদলে গেলেন! আমাকে বউমা বউমা করে ডাকতে লাগলেন!

আমি এসি অন করে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। মানুষের এই বদলানো আমার ভয় করে প্রচন্ড। একবার আমার গ্রামে, আমাদের রহিম মেম্বারও ঠিক এমন করেই পালটে গিয়েছিলো৷ যে মেয়ের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো, যে মেয়েকে সে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ভোগ করেছিলো শরীর মন, সেই মেয়েকেই সে যখন তার প্রাপ্য চাইতে এলো, সে বানিয়ে দিলো তাকে আগন্তুক! সে যেনো সেই মেয়েকে চিনেই না! আমার সামনেই ঘটা ঘটনাগুলো। অথচ আমার বান্ধবির কাছ থেকে মেম্বারের কতোই না তারিফ শুনতাম আমি! মানুষ বদলে যায়। আসলেই বদলে যায়। মানুষ মাঝেমধ্যে হয়ে উঠে আরও ভয়ংকর। খুব ভয়ংকর। রাস্তায় আটকালো আমার ননদ তামান্না। আটকিয়ে আমার হাত চিপকে বললো,

‘বড়ো বাড়ন্ত হয়েছো দেখছি? সবকিছু বন্ধ করে দিবো একেবারে? যা শুনেছো সব সত্যি শুনেছো৷ সন্ধ্যার পর আমি যাবো আর রাতে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে থাকবো। কী করবে তুমি? তোমার মতো দুই টাকার মেয়েকে আমাদের বড় ঘরের কেউ কখনো বিশ্বাস ই করে না। এখানে তো ভাইয়াকে অন্যকোন মেয়ে বিয়ে করবে না বিধায় তোমাকে বউ করে আনা হয়েছে। যার জন্য আনা হয়েছে, তার জন্য আর তার মতোই থাকো। কোন বেশিকিছু করতে যেও না। করার সাহস ও করো না। খারাপ হতে থাকলে খারাপ কোথায় গিয়ে মোড় নিবে ধারণাও করতে পারবা না বলে দিলাম। তাই যে কাজ করতে লেগেছে, সেই কাজ করো। নিজের ঘর সংসার করো৷ ঘর আর সংসার এর কোনটা করতেও পারবা বলে মনে হয় না৷ যা মাতাল তোমার স্বামী, দেখো কতদিন এই ঝামেলা নিয়ে চলতে পারো।

এক কোণায় দাঁড়িয়ে নিজের বোনের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেলো আসিফ।

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_০৯
#মিদহাদ_আহমদ

আমার ননদ অন্য ছেলের সাথে রাত কাটাবে, আমাকে হুমকি দিয়ে গেলো যেনো এইটা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করি। বাসার কাওকে যেনো না জানাই। আর কোণে দাঁড়িয়ে সব শুনতে পেলো আসিফ। আমি রুমে যেতেই আসিফ জিজ্ঞেস করলো,

‘তুমি কি মাকে জানিয়েছিলে এই কথাগুলো?’

‘হুম’

‘তারপর মা কী বললো?’

‘মা বলেছেন যে আমি এসব মিথ্যাচার করছি।’

‘হুয়াট? আর ইউ সিরিয়াস? তুমি সত্যি বলছো?’

‘আমি মিথ্যা বলি না।’

‘তারমানে মা এসব জেনেও এসবে সায় দিচ্ছে?’

আমি নীরবে থাকলাম। এবার আর জবাব দিলাম না আসিফকে। ননাস এসে ডাক দিয়ে বললো,

‘ইফতারের সময় হয়ে গিয়েছে। বাইরে আসো এবার রুম থেকে। লোকজন সবাই বলাবলি করছে যে নতুন বউ কোথায়। আর আসিফ, তুই তো ইফতার করবি না সবার সাথে। অন্তত সিগারেট টিগারেট এখন ধরাস না। লোকের অসুবিধা হবে।’

আমাকে ধরে নিয়ে গেলো আমার ননাস। ডায়নিং রুমে সব সাজানো গোছানো আগেই। হুট করে কোথা থেকে আমার খালাশাশুড়ির জাল আমার শাশুড়িকে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এই টেবিল এসেছে বুঝি? আজকালকার দিনে গ্লাসের টেবিলের চল। এই কাঠের টপ ওয়ালা টেবিল এখনও কেউ তার বোন ভাগ্নিকে দেয় বিয়েতে?’

আমার শাশুড়ি দেখলাম হাসতে হাসতে জবাব দিলেন,

‘আরে না। এসব তারা দিয়েছে জোরেই। আমরা আনতে চাইনি। আমাদের ঘরে কম আছে নাকি? ডায়নিং রুমে একসাথে বিশ চেয়ারের ডায়নিং টেবিল আপনি কয় বাসায় দেখেছেন? বসেন বসেন। ইফতারের সময় হয়ে গেলো।’

ওনাকে বসাতে বসাতে আমার কাছাকাছি এসে শাশুড়ি আমাকে কানে কানে বললেন,

‘ছোটলোকের মেয়ে, মাথার ঘোমটা একটু টেনে সামনে আনো। দেখছো আমার সব জায়গায় বেইজ্জতি হতে হচ্ছে তোমার জন্য।’

কিছুক্ষণের মধ্যে সব আয়োজন শেষ হলো। বাসার ছাদে সব পুরুষ মেহমানরা আছেন৷ আমার বাবাও সেখানে আছে। ইমাম সাহেব এসে দোয়ায় বসলেন। আজান দিয়ে দিবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আমিও টেবিলের এক কোণে বসা আছি সবার সাথে। হুট করে খেয়াল করলাম এমন সময়ে আসিফ তার রুম থেকে বের হয়ে এলো৷ তার পরনে ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা। আমার চোখ যেনো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসলো। একী দেখছি আমি! যে আসিফকে আমি আজ পর্যন্ত পরিবারের কারো সাথে খেতে দেখিনি সেই আসিফ আজ বের হয়েছে রুম থেকে? তাও টু-কোয়ার্টার ছাড়া? পাঞ্জাবি পরে?
এই মানুষটাকে এভাবে আমি দেখিনি কখনো। লম্বা ছিমছাম দেহ, গালভর্তি দাঁড়ি গোঁফ, মাথার লম্বা চুল, গালের টোল আর মুখে লাগা হাসি, টানটান চোখের আসিফকে দেখতে কোন অংশেই কোন রাজকুমারের চেয়ে কম লাগছে না। সব সময় সেন্ডু গেঞ্জি পরা থাকে তাই তার মাসল দেখা গেলেও ওভাবে চোখে পড়েনি আমার। এখন পাঞ্জাবির ভেতর থেকে তার পেটানো বড় মাসল যেনো আরও আকর্ষণীয় হয়ে বের হয়ে এসেছে। আমি আমার জীবনে এমন সুন্দর পুরুষ আর দ্বিতীয়টা দেখিনি। আমাদের সামনে দিয়েই আসিফ দরজা খুলে ছাদের দিকে গেলো৷ মানে সে সবার সাথে বসে ইফতার করবে! আমার ভেতরের আনন্দ আর দেখে কে। আমি যারপরনাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। আজান দিয়ে দিলো মসজিদে। খেজুর আর পানি খেয়ে আমি রোজা ভাঙ্গলাম। ননাস বললো

‘নুপুর বন প্লেইট নিয়ে আসো তো কয়েকটা। এখানে নাই দেখছি।’

ইফতার রেখে আমি উঠে গেলাম বন প্লেইট আনতে৷ প্লেইটের পোলাও যেনো আমার দিকে মুখিয়ে আছে তার পরও আর মুখে তুলতে পারলাম না৷ মিনিট দুয়েক পর এসে বসতেই আমার শাশুড়ি নাকি গলায় বলাবলি করতে লাগলেন,

‘ওসব মাল্টা মনে হয় পুরানা অনেক দিনের। কেমন জানি একটা ঝাঝালো গন্ধ বের হচ্ছে! আপেলেও স্বাদ নাই৷ জানি না ওসব কোথা থেকে যে কিনে এনেছে ওর বাবা!’

টেবিল ভর্তি সবার সামনে শাশুড়ি আমার বাবার বাড়ি থেকে আসা ইফতারির অপমান করলেন। আমার আর খাবার রুচি রইলো না। পাশ থেকে ননদ কানে কানে বললো

‘কী? মানুষ সামনে বসা। খাবার খাও। নাহলে সবাই অন্যকিছু ভাববে। এসব কেন করছো তুমি? তোমার কি কোন কান্ডজ্ঞান নেই ভাবি?’

তামান্নার কথা শুনে বিষ খেয়ে বিষ হজম করার মতো আমি পোলাও গিলতে লাগলাম৷ ইফতার শেষ করে উঠার সময়ে শাশুড়ি বললেন,

‘নুপুর, নামাজ পড়ে চা বানিয়ে নিও। সবাই অপেক্ষা করবে।’

‘আচ্ছা।’

আমি চলে এলাম। রুমে এসে দেখলাম আসিফ চলে এসেছে। কাপড় চেইঞ্জ না করেই একটা সিগারেট ধরিয়ে বিছানায় বসে বসে ধূয়া ছাড়ছে। আমি আসিফকে বললাম,

‘তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লেগেছে। আর থ্যাঙ্কিউ সবার সাথে বসে ইফতার করার জন্য।’

আমার কথা আসিফ শুনলো ঠিকই কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আশা করেছিলাম হয়তো একটা হাসি মুখে এনে ধন্যবাদ জানাবে। কখনো দেখিনি মানুষটার হাসি দেখতে কেমন লাগে!

নামাজ পড়েই রান্নাঘরে গিয়ে চা বানালাম ত্রিশ কাপ। সবাইকে চা দিতে গেলাম। ইতোমধ্যে দেখলাম তামান্না রেডি হয়ে আছে। শাশুড়িকে বলে সে বাইরে যাচ্ছে। আমি সবার সামনে সাহস নিয়ে তামান্নাকে বললাম,

‘কোথায় যাচ্ছো এখন? মাত্রই না ইফতার শেষ হলো?’

খেয়াল করলাম তথমথ খাওয়া আমার ননদের চোখ মুখ থেকে যেনো আগুন ঝরছে। আমি সাহস করে বললাম

‘চা হয়ে গিয়েছে তামান্না। চা খেয়ে যাও।’

বাসাভর্তি লোকের সামনে কিছু বলতে পারলো না সে আমাকে। তবুও অপারগ হয়ে বসলো টেবিলে। আমি হয়তো কয়েক মিনিটের জন্য তাকে আটকাতে পেরেছি। কিন্তু বাইরে যাওয়া থেকে? ভেতরে ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, মা হয়ে নিজের মেয়েকে এভাবে একা খারাপ পথে যাচ্ছে যেনেও কীভাবে কেউ ছেড়ে দেয়? মানুষ কীভাবে পারে এসব?

চা খেয়েই তামান্না বাইরে চলে গেলো। আমি রুমে এলাম। আসিফকে বললাম,

‘তামান্না বাইরে চলে গিয়েছে। তুমি কি এবারও কোনকিছু বলবে না? আমি নাহয় মাকে বলে বুঝাতে পারলাম না। তুমি? তুমি অন্তত বলতে একবার। ও তোমার বোন হয় না?’

আমার কথাগুলোর কোন প্রভাব আসিফের উপর পড়লো না। সে আরেকটা সিগারেট ধরালো। বারান্দায় গিয়ে গিটার হাতে নিলো। গিটারের সুরে সুরে গান তুললো,

বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে
সইগো বসন্ত বাতাসে

***

মন নিলো তার বাঁশির সুরে, রূপে নিলো আঁখি
তাইতো বাউলা আবদুল করিম আশায় চেয়ে থাকি
সইগো বসন্ত বাতাসে।।

আমি কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে শুনলাম আসিফের গান। তারপর পাশে গিয়ে বললাম,

‘কী? নিজের বোনের বিষয়ে যে বলছি…’

আসিফ এবার উঠে গেলো। আমাকে বললো,

‘আমি দেখছি। বাসায় মেহমান সব চলে গেলে আমি কথা বলছি মায়ের সাথে।

‘কিন্তু ততক্ষণে যদি…’

‘ততক্ষণে যদি কী? যদি কিছু হয়ে যায় তো হয়ে যাক’

আসিফের এই কথাটা শুনে আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না সে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে নিজের বোনকে নিয়ে এমন বলার প্রশ্নই আসে না। আমার ভাবুক মন নিজেকে ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে তুললো।

ঘন্টা দুয়েক পর। আমি রান্নাঘরে ছিলাম। ডায়নিং রুমে চিল্লাচিল্লি শুনে আমি বেরিয়ে এলাম। এসে দেখি মা ছেলের সে কী যুদ্ধ! যেনো এক মহাযুদ্ধ হতে চলেছে। শাশুড়ি সমানে বলছেন,

‘বউ শিখিয়ে দিয়েছে না? এখন এসব বউ করতে বলেছে তাইতো? আমার মেয়ের উপর তুই কোন সাহসে এসব বলছিস? আরে ও তোর বোন না? একটা বাইরের মেয়ে বলে দিলো আর তুই মেনে নিলি এসব?’

আসিফ তার মায়ের কথায় ধরল। বলল,

‘বাইরের মেয়ে মানে? কে বাইরের মেয়ে? ও? নুপুর? নুপুর বাইরের মেয়ে? তাহলে কেন ওকে বিয়ে করিয়ে নিয়ে এসেছিলে আমার সাথে? কেন? জবাব দাও।’

শাশুড়ি চুপ করে গেলেন। আমাকে হাতে ধরে সামনে নিয়ে এলো আসিফ। আবার বলতে লাগলো,

‘কে ও? কে?’

এবার তেড়ে সামনে এলো আমার ননাস। সে বললো,

‘তুই বড় মাতব্বরি করতে এসেছিস এখন! এত জীবন তো এসবে কোন খেয়াল ছিলো না। তাহলে আজ কেন এতো দরদ উতলে উঠছে বোনের জন্য? এতদিন কি বোন ছিলো না?’

ননাস তারপর আমার দিকে তাকালো। আবার বললো,

‘ওই মেয়েটাই তো মাথা খেয়েছে। তাইনা? সব ওই নষ্টের মূলে গরীব ঘরের মেয়েটা।’

আসিফ চিৎকার করে উঠলো। হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে টেবিলের উপরে রাখা গ্লাসের স্ট্যান্ড ফেলে দিলো নিচে। তারপর রুম থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে এসে বললো,

‘কই গিয়েছে তোমার বোন? আমাকে নিয়ে চলো। বান্ধবীর বাসায়? ওকে কোথায় লোকেশন আমাকে বলো আপা।’

ননাস এবার বললো,

‘সব বললো। তবে শুনে রাখ আসিফ, আজ যদি তুই মিথ্যা হোস, তোর বউয়ের লাগানো এই কথাটা মিথ্যা হয় তাহলে এর পরিণাম কী হবে?’

শাশুড়িও জিজ্ঞেস করে বসলেন তার ছেলেকে,

‘কী হবে এর পরিণাম?’

‘পরিণাম?’

‘হ্যাঁ।’

‘যদি নুপুর মিথ্যা হয়, তাহলে আমি নিজে গিয়ে একেবারে আজীবনের জন্য তাকে তার বাড়িতে রেখে আসবো। বলে দিলাম এই আমি। এবার বলো কোন ফ্রেন্ডের বাসায় তোমার তামান্না? আমাকে লোকেশন দাও। আর মা, আপা দুজন আসো আমার সাথে গাড়িতে। আর তোমাকে বলছি নুপুর, যদি আজ তোমার ধারণামতো কিছু না হয়ে থাকে, তাহলে এই পরিণতি তোমার ভালো হবে না। যেই রাস্তা দিয়ে এই ঘরে এসেছিলে, একেবারে সেই রাস্তা দিয়েই নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে।’

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১০
#মিদহাদ_আহমদ

*গ্রুপে যুক্ত না হয়ে যারা গল্প পড়ছেন এবং আমার গ্রুপে পোস্ট করার সাথে সাথেই কপি করে অন্য গ্রুপে গল্প দিচ্ছেন, আপনাদের খুঁজে বের করে গ্রুপ শীঘ্রই প্রাইভেট করে ফেলা হবে। এজন্য গল্প পড়ার আগে গ্রুপে জয়েন হয়ে নিন।

আসিফ বাসা থেকে বের হবার সময় যখন বলে গেলো যে, আজ যদি সে তামান্নাকে ঠিকঠাক দেখে তাহলে এই বাড়িতে এটাই হবে আমার শেষ রাত। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো তখন।

ঘন্টাখানেকের মাথায় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটে গেলো যেনো! আসিফ বাসায় এলো। আসিফের সাথে তামান্নাও এলো। বাসায় ঢুকেই আমার শাশুড়ি অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করলেন। তার সাথেসাথে বলতে লাগলেন,

‘এই ছোটলোকের বাচ্চা শুরু থেকেই আমার মেয়ের পেছনে লেগেছিলো। কই? আমরা কি তামান্নাকে গিয়ে কোন ছেলের সাথে পেয়েছি? সবকিছুর মূলে ওই মেয়েটা।’

আমার ননদ তামান্না নাকি সুরে কান্না করতে করতে বললো,

‘ভাবি তুমি আমাকে এত অবিশ্বাস করো? এতো হিংসা ভেতরে পুষে রাখো আমাকে নিয়ে? আমাকে বলেই দিতে সবকিছু। আমি নাহয় তোমার কথায় কথায় চলতাম। তোমার মন জুগিয়ে চলতাম। তবুও অন্তত আমার চরিত্রে এমন দাগ বসতো না। তুমি কিনা আজ আমার চরিত্র নিয়ে! চিহ! আমার বান্ধবীর বাসায় আমার কতটুকু অপমান হলো তার আন্দাজ করতে পারবা তুমি? পারবা না। আর আমি কখনো তাদের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবো? পারবো না।’

ননাস বললো,

‘কী? এখন কই বড় বড় কথা? খুব তো এসে বলেছিলা আমার বোনের নামে এই সেই। এখন গেলো কই এসব? নাকি সব ভংচং করে আমার ভাইকে নিজের বশে আনার চেষ্টা জারি রেখেছিলা এতদিন?’

‘ব্যাস! সবাই কথা বন্ধ করো। প্লিজ! নুপুর, তোমার যা যা নেয়ার ব্যাগে করে নিয়ে নাও। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে দেরি করতে পারবো না। তোমাকে একেবারে তোমার বাড়িতে রেখে আসবো ‘

আসিফের মুখ থেকে এই কথাটা শোনার পর আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো যেনো! আসিফ তার রুমে চলে গেলো। শাশুড়ি তার বড় মেয়েকে বললেন,

‘কী হচ্ছে এসব তানিয়া? এই মেয়েকে তো এনেছিলাম আমার ছেলের জন্য৷ এখন যে আসিফ পাগলামি শুরু করেছে…’

‘করুক। এই মেয়েটাকে এই ঘরে রাখার জন্য তুমি এখন পক্ষপাত করো না মা। আজ যে মেয়েটা তার ননদের উপর এমন মিথ্যা আরোপ দিতে পারলো, আগামীকাল সেই মেয়েটা তার বড় ননাসের উপর আঙুল তুলতে এক মুহূর্ত ভাববে না। এই মেয়েকে এই ঘরে রাখা মানে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনা৷ একে তার বাপের বাড়িতে বিদায় করে দিলেই মন্দের ভালো ‘

ননদও তার বোনের সাথে যুক্ত হলো। আমার সামনে এসে ফিসফিস করে বললো,

‘সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। কী মনে করেছিলা? আজ আমার বয় ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো আমি? যাইনাই। আমিও দেখতে চেয়েছি যে তুমি কতটুকু যেতে পারো।’

ফিসফিস করে বলা শেষ করে ননদ আবার কান্না জর্জরিত হয়ে বললো,

‘তুমি না আমার ভাবি? তুমি এমন করতে পারলা? এমন বলতে পারলা? এক বারও তোমার মুখে বাধা দিলো না এসব বলার আগে? তুমিও না একজন মেয়ে? একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ের নামে এমন নোংরামো কথা বলার আগে একটাবার ভাবার প্রয়োজন মনে হলো না?’

আমি এবার মুখ খুললাম। জমাট বাধা রক্ত শক্ত হতে গিয়ে যখন ব্লাস্ট করে, তখন যেমন স্ট্রোক হয়ে যায়, আমিও তেমন। নিজের ভেতরের চাপা কথাগুলো এতদিন ধরে যেই ঘরে চাপা দিয়ে আসছিলাম, আজ সেই কথাগুলো আর চাপিয়ে রাখতে পারলাম না। শাশুড়িকে বললাম,

‘মা! আপনিও তো একজন মা তাইনা? একজন মেয়ে তাইনা? আমি মিথ্যা বলে কী লাভ করবো বলেন?’

আর তামান্না, তুমি যে মিথ্যা বলছো এখন, আর এই মিথ্যার ফলে যে আমার সংসার ভাঙ্গছে, আমি এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নই। শুধু আজ আমি এক নারী হয়ে আরেক নারীর সংসার ভাঙ্গার অপরাধে তোমাকে অভিশাপ দিলাম,

‘সংসার নামের শান্তি জীবনে তুমি স্পর্শ করতে পারবা না।’

শাশুড়ি এবার তেড়ে এলেন যেনো। বললেন,

‘কী? কী? ছোটলোকের মেয়ে এসব কী বলছিস তুই…’

‘ছোটলোকের মেয়ে ছিলাম মা। এখন আমি ছোটলোকের মেয়ে নই। আপনার মতো বড়োলোক মানুষের একমাত্র ছেলের বউ আমি।’

ননাস বললো,

‘মা দেখেছো! কী মুখের বাড় বেড়েছে মেয়েটার! এই মেয়ে, শুনেছো তোমাকে কী বলে গিয়েছে আসিফ? একেবারের জন্য তোমার বাড়িতে রেখে আসবে সে তোমাকে। আজই তোমার সবকিছু শেষ এখানে।’

‘শেষ এখনও হয়নি আপা। আমি এখনও আইন এবং ধর্মমতে আপনার ভাইয়ের বিয়ে করা স্ত্রী। আমাদের এখনও ডিভোর্স হয়নি।’

ননদ তার মাকে আর বোনকে বললো,

‘এই মেয়েকে বিদায় করো এখান থেকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করো৷ এখানে এই মেয়েটা দেখছো কত ছোটলোক হয়ে উঠেছে৷ লোভী হয়ে উঠেছে!’

আমি তামান্নার সামনে গেলাম। তামান্নাকে বললাম,

‘বয়সে তুমি আমার চেয়ে দুই বছরের বড় হলেও, সম্পর্কে আমি তোমার চেয়ে বড়, তুমি আমার চেয়ে ছোট। সম্পর্কের তামিজ মেনে অন্তত ভালোভাবে কথা বলবা তামান্না। অনেক সহ্য করেছি আর না। আর না ‘

আমি আমার কান থেকে কানের দুল, হাত থেকে চুড়ি, আঙুল থেকে আংটি আর গলা থেকে চেইন খুলে দিয়ে শাশুড়ির হাতে দিয়ে বললাম,

‘এই রাখুন আপনার সবকিছু। আমি চললাম।’

এক কাপড়ে যখন আমি সদর দরজার দিকে যাচ্ছি, পেছন থেযে আমাকে ডাক দিলো আসিফ। ডাক দিয়ে বললো,

‘দাঁড়াও।’

আমি পেছন ফিরে তাকালাম। ওপরের তলায় সে দাঁড়িয়ে আছে। আসিফ বললো,

‘কোথাও যাওয়া চলবে না তোমার। আর মা, ও আমার বিয়ে করে আনা স্ত্রী৷ সে এখানেই থাকবে। সে কোথাও যাবে না। আর কে কতটুকু সত্য না মিথ্যা বলছে আমি সব জানি, সব বুঝি।’

শাশুড়ি মা আর ননাস, ননদ যেনো চুপটি মেরে মুহূর্তেই। আসিফ আবার বললো,

‘কী হলো? আমার কথা শোনা যাচ্ছে না নাকি? এই ঘর ছেড়ে কোথাও তুমি যেতে পারবে না।’

আমি ভেতরে ঢুকলাম। আসিফকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

‘আজ তিন মাস হলো এই ঘরে বউ হয়ে এসেছি৷ তারপর থেকে প্রতিটা দিন আমি কী পেয়েছি? কী পাচ্ছি? এসব লাঞ্চনা? অপমান? ঘৃণা? কথায় কথায় ছোটলোকের মেয়ে, গরীব ঘরের মেয়ে, গরীবের বাচ্চারা চাল চলন জানে না এই কথাগুলো? নাকি অন্যকিছু? দুইবেলা দুই মুঠো ভাতের জন্য আমি কি এই বাড়িতে এসেছি? নাকি শুধু শুধু কথা শোনার জন্য?
মানুষ বিয়ে করে কত স্বপ্ন নিয়ে৷ মানুষ বিয়ে করে একটা নতুন বাড়ি পায়। শ্বশুর পায়, শাশুড়ি পায়, ননদ, ননাস, জা পায়। আর সবচেয়ে বড় পাওয়া একটা স্বামী, সেই স্বামী পায়। আমি কী পেলাম? শুধু বড়লোক জামাই? তার অনেক টাকা? রুমে এসি? ডিপ্লেক্স বাড়ি? শহরের নামকরা ফ্যামিলি? দামি দামি গাড়ি? আর উৎসব আয়োজন হলে লোক দেখানো সোনার গহনা পরার সামান্য অধিকার? এটুকুই? এজন্য আমি বিয়ে করে এই বাড়িতে এসেছি? না আসিফ না। তুমি এসব ভেবে থাকলো ভুল ভাবছো৷ আমি হতে পারি গরীব ঘরের মেয়ে। হতে পারে কখনো এসির বাতাস খাইনি, ডুপ্লেক্স বাড়িতে থাকিনি, দামি গাড়িতে চড়িনি, তা বলে এই তো নয় যে আমি আমার আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বসবো?’

শাশুড়ি বললেন,

‘তাহলে এত যখন আত্মসম্মান তাহলে সব জেনেশুনে এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলে কেন?’

‘রাজি? আমি রাজি? আমার কোন মত নেয়া হয়েছিলো? আমার লোভী মা তার জীবন স্বাদ আস্বাদন করতে যে আমাকে এই নরকে ঠেলে দিয়েছে, এই পাপের বোঝা আমি এখন আজন্ম নিজের একটা অংশ হিসেবে বয়ে বেড়াচ্ছি। এটাই তো আমার নিয়তি৷ এটাই আমার ভাগ্য।’

কিছুক্ষণ পুরো মহল একেবারে চুপ করে গেলো।

আসিফ এবার নিচে নেমে এলো। আমার হাত ধরলো। হাত ধরে আমাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর আসিফ একটা সিগারেট ধরালো বারান্দায় গিয়ে। আমিও বারান্দায় গেলাম। আসিফকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আমাকে আটকিয়ে রেখেছো কেন? আমি যেতে চাচ্ছি। আমাকে যেতে দাও।’

আসিফ এবারও কোন জবাব দিলো না। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম। এবারও সে নিশ্চুপ। আবার জিজ্ঞেস করায় আসিফ তার পাশে থাকা সিগারেটের স্ট্রে টা ছুড়ে মারলো নিচে। এইটাও যেনো তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে৷ সিগারেট ও ফেলে দিলো। তারপর চিৎকার করে বললো,

‘তুমি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছো নুপুর। তুমি আমার অভ্যাস। আমি অভ্যাস ছাড়তে পারবো না।’

ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো এমন সময়ে। আকাশ থেকে যেনো সুখের ঝর্ণাধারা বইতে লাগলো পৃথিবী জুড়ে। অন্যদিকে তানিয়ার স্বামীর মামাতো বোন এসেছে লন্ডন থেকে। বিয়ের তিন বছর হয়ে যাওয়ার পরও তানিয়ার কোন সন্তান না হওয়ায় তানিয়ার শাশুড়ি চিন্তা করছেন, ছেলের আরেক বিয়ে দেওয়াবেন৷

(চলবে)