বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব-২০

0
250

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ২০
#লেখিকাঃদিশা মনি

❝ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি❞

বর্ণর কন্ঠে এই গানটা শুনে হতবাক হয়ে যায় জোনাকি। অনুভূতি গুলো বড্ড অসহায় হয়ে পড়ছে আজকাল।বর্ণর প্রতি ভালোলাগা থাকার পরেও
জোনাকি এতদিন নিজেকে দূরে রেখেছে তার কাছ থেকে। সে যত দূরে যেতে চাইছে বর্ণ যেন তাকে তত কাছে টানছে। জোনাকি কোম্পানি থেকে বেরোনোর উদ্দ্যেশ্যে যাচ্ছিল তখনই বর্ণর মুখোমুখি হয়। জোনাকিকে দেখে বর্ণর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সাথে তার কন্ঠ দিয়ে নিঃসৃত হয় উক্ত গানটি।

জোনাকি মনে মনে নিজেকে অনেক গালি দেয় বর্ণর প্রতি এরকম দূর্বলতা থাকার জন্য। আর বেশি না ভেবে হাটা ধরে। জোনাকির পেছন পেছন বর্ণও আসছিল।

‘এভাবে একা যাওয়ার কি প্রয়োজন। আমিও তো বাড়িই যাচ্ছি। চলো তোমাকে পৌছে দেই।’

‘আমি একাই যেতে পারব।’

‘আমার সাথে গেলে কি অসুবিধা?’

‘আপনি যথেষ্ট বুঝদার মানুষ। আপনি নিশ্চয়ই জানেন কি সমস্যা। জরিনা মরিনা,,,,না মানে জরিনা আন্টি কিভাবে তিলকে তাল করে উপস্থাপন করে সেটা আমার থেকে বেশি ভালো আপনি জানেন।’

‘আমি তো ছেলেমানুষ। আচ্ছা তুমি জরিনা আন্টিকে ভয় করছো। আমি আছি তো আমি সামলে নেব।’

‘আমি আপনার সাথে যেতে চাইনা প্লিজ আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।’

জোনাকিকে আর আটকায় না বর্ণ। তবে তার মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়। নিজেকে নিজেই প্রেরণা জুগিয়ে বলে,
‘চিন্তা করিস না বর্ণ। এই মেয়েই একদিন তোর সঙ্গ পেতে চাইবে দেখে নিস।’

৩৯.
আলো মন খারাপ করে ক্যান্টিনে বসে ছিল। লতা এসে তার পাশে বসে,
‘কি হয়েছে আলো? তোমাকে এত উদাসীন লাগছে কেন? কোন সমস্যা?’

‘কোন সমস্যা নেই লতা। আমি আর এখন এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভাবি না। তোমার কি খবর?’

‘খবর আর কি সবকিছু ভালোই চলছে।’

‘ও। আচ্ছা রুহি বনানী কোথায়? ওকে দেখেছ তুমি?’

‘হ্যা ঐ তো এদিকেই আসছে।’

রুহি বনানী এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সটান বসে পড়ে। তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এখন কতটা রেগে আছে। আলো প্রশ্ন করে,
‘কি হলো রুহি বনানী? এত রেগে আছো কেন?’

‘তুমি রিলেশনে যাবে আলো?’

‘রিলেশন মানে! এসব কি বলছ।’

‘আমি তোমার জন্য অনেক ভালো একটা ছেলের খোজে আছি। তোমাকে একটা হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ড জোগাড় করে না দিয়ে আমার শান্তি নেই।’

‘আমার বয়ফ্রেন্ড লাগবে না। আমি একাই ঠিক আছি।’

‘তোমার না লাগলেও আমার লাগবে। আমার ভাইটা বড্ড বেশি বার বেড়েছে। ওকে আমি চ্যালেঞ্জ করেছি তোমার জন্য সেরা ছেলে এনে দেব।’

লতা কিছুই বুঝতে পারছিল না। রুহি বনানীর শেষোক্ত প্রশ্নটা শুনে বলে,
‘সেরা ছেলে মানে বর্ষ স্যারের মতো কেউ।’

রুহি বনানী হাতে চাদ পাওয়ার মতো খুশি হয়। লাফিয়ে বলে,
‘হ্যা পেয়ে গেছি। বর্ষ স্যারই তোমার জন্য পারফেক্ট আলো।’

রুহি বনানীর কথা শুনে আলো বিষম খায়। পানি পান করে বলে,
‘তুমি কি বলছ সেটা তুমি নিজেও হয়তো জানোনা। আমি তাও আবার বর্ষ স্যারের সাথে! অসম্ভব কথাবার্তা।’

‘এই পৃথিবীতে কোন কিছুই অসম্ভব নয় আলো। তুমি শুধু দেখো আমি কি করে নিজের মিশনটা পূরণ করি। লতা আমার সাথ দেবে?’

আলো বাকা চোখে লতার দিকে তাকায়। লতার মন দোনোমোনো করছিলো কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রুহি বনানীকে সাহায্য করার। আলোর সাথে বর্ষকে সত্যি খুব ভালো লাগবে। আলোর তার দুই বান্ধবীর উপরেই খুব রাগ হয়। বিড়বিড় করে বলে,
‘কিছুদিন আগে একে অপরকে দেখতেও পেতোনা আর এখন দুজনে মিলে আমার বিরুদ্ধে প্ল্যান সাজাচ্ছে।’

আলো আর সেখানে না থেকে তাড়াহুড়ো করে উঠে আসতে নেয়। যার ফলে আচমকা কারো সাথে ধা’ক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে বর্ষ তাকে আগলে নেয়।

‘দেখে চলতে পারো না? চোখ থাকে কোথায়?’

‘আকাশে।’

আলোর খুব বিরক্ত লাগছিল তাই এক ছুটে দৌড়ে চলে যায়।

বর্ষ বলতে থাকে,
‘মেয়েটা এত অদ্ভুত কেন? আর আমিই বা ওর কথা এত কেন ভাবছি। না বর্ষ মাহমুদ তুমি এরকম সাধারণ বিষয় নিয়ে ভাববে না। এটা তোমার স্বভাব নয়।

৪০.
আলো আজ অনেকদিন পর তার মায়ের ছবি বের করে দেখতে লাগল। ও বাড়ি থেকে আসার সময় ছবিটা নিয়ে এসেছিল। এটা মালেকার ছবি নয় এটা তার জন্মদাত্রী মা জ্যোতির ছবি। মায়ের মুখের সাথে আলোর খুব মিল। আলোর মা জ্যোতি ছিল অপরূপ সুন্দরী। আলো শুনেছিল তার মা শহরের মেয়ে ছিল। আলোর বাবা যখন শহরে পড়াশোনার তাগিদে এসেছিল তখন তার সাথে পরিচয় হয়। নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে জ্যোতি বিয়ে করে আলোর বাবাকে। আলোর জন্মের সময়ই তার মায়ের মৃত্যু হয়। কোনদিন নিজের মাকে চোখের সামনে দেখেনি আলো। জোনাকির কাছে যতদূর শুনেছিল তার মা এক মমতাময়ী নারী ছিল।

‘তুই আবার আম্মুকে দেখছিস আলো?’

জোনাকির কথাটা শুনে আলো হাসে।

‘তুই অনেক সৌভাগ্যবতী আপু। অন্তত আম্মুকে কাছে পেয়েছিল। আমাকে দেখ কোনদিন আম্মুর সান্নিধ্য পাইনি। আম্মু বলে ডাকতে পারি নি, তার কোলে উঠতে পারিনি। মালেকা আম্মু যদিও আমায় মেয়ের মতোই ভালোবেসে বড় করেছে। তাও আমার জীবনের একটা বড় না পাওয়া আম্মু। কেন এমন করল আম্মু আমার সাথে? আমাকে জন্ম দিয়ে কষ্ট পাওয়ার জন্য রেখে গেল।’

জোনাকি আলোর মাথায় হাত রাখে।

‘মন খারাপ করিস না আলো। দেখবি একদিন তুই এই পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ হবি। সেদিন আমি থাকব কিনা জানি না। কিন্তু তোর সুখ দেখে আমিও সুখী হবো।’

‘এরকম কথা বলিস না আপু। আমার খুব খারাপ লাগে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে এখন যা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আয়। এত মনমরা হয়ে থাকিস না সারাদিন।’

জোনাকির কথায় আলো একটু বাইরে হাটতে বের হয়। বাইরে এসে সবার আগে বর্ষর সাথেই দেখা হয়। আলো বর্ষকে পাশ কা’টিয়ে যায়। বর্ষ একবার ফিরে তাকায় আলোর দিকে তারপর নিজের মতো চলে যায়।

আলো বাগানে এসে বিভিন্ন ফুল দেখছিল। ফুলের সৌন্দর্য বরাবরই তার পছন্দ। জরিনা আলোকে একা এভাবে বাগানে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ফেলে। মেয়েটাকে জরিনা পছন্দ করে না কেন জানি। তবুও মাঝে মাঝে মেয়েটাকে বিষন্ন মনে দেখলে খারাপ লাগে। জরিনা নিজেও তো পৃথিবীর অনেক কদর্য রূপ দেখেছে। যার কারণে এখন আর কাউকে ভরসা করে না।

আলো জরিনাকে খেয়াল করে৷ জরিনা আলোর কাছে আসে। আলোকে তার কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল। সবকিছু বলতে না পারলেও এইটুকু বলে,
‘আমরা মেয়েরা অনেক আবেগি হই। আবেগের বশে অনেক ভুল করি যাতে আমাদের পস্তাতে হয়। আমি নিজেও সেসবের সাক্ষী। তাই তোমাকে আর বিশেষ করে তোমার বোনকে বলছি সাবধানে থেকো। এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরে গেছ পৃথিবী কতটা কঠিন। এই পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট কঠিন রূপ আমি দেখেছি। সেসময় সুমনা ম্যামই ছিল আমার ভরসা। আরেকজনের কথা না বললে ভুল হবে সে তো আমার সবথেকে বড় ভরসা ছিল যদিও সে স্বার্থপরের মতো চলে গেছে। সেসব অন্য কথা, আমি যেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছি তার ছিটেফোটাও তোমরা দেখো নি বোধহয়। তাই বলছি সময় থাকতে সতর্ক হও।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨