বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব-২১

0
279

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ২১
#লেখিকাঃদিশা মনি

সুমনা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে ছিল। জরিনা তাকে এভাবে দেখে আশ্চর্য হয়।
‘চা তো ঠান্ডা হয়ে যাবে ম্যাম। খেয়ে নিন।’

সুমনার ঘোর কা’টে না। জরিনার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দেয়।

‘আচ্ছা জরিনা তোমার কি আলোকে দেখে কারো কথা মনে পড়ে?’

জরিনা থতমত খেয়ে বলে,
‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

‘কারণ আছে তাই। আমি মেয়েটাকে প্রথম যেদিন দেখি সেদিনই জ্যোতির মুখটাই আমার সামনে ভাসে। আমার চাচাতো বোন জ্যোতি, আমার বোনের থেকেও বেশি বান্ধবী ছিল। তোমাকেও তো জ্যোতিই এনেছিল এই বাড়িতে।’

জরিনা পুরাতন কথা মনে পড়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে।
‘যে চলে গেছে তার কথা ভেবে কি হবে ম্যাম? তার কাছে নিজের জেদটাই বেশি ছিল। আমাকে ঐ নরক থেকে নিয়ে আসার সময় কথা দিয়েছিল সবসময় আমার পাশে থাকবে। অথচ আপনার চাচার একটা কথার কারণে আমাদের কারো সাথে যোগাযোগ করল না। আজ ২৫ বছর হয়ে গেছে এতদিনেও আমাদের কথা মনে পড়ল না তার। একবারও খোজ নিল না। বেচে আছে নাকি মারা গেছে সেটাও জানি না।’

‘জরিনা! একদম এরকম কথা বলবে না। আমি জানি জ্যোতি আবার ফিরে আসবে। চাচার কত আদরের মেয়ে ছিল। যখন যা চেয়েছে পেয়েছে। শুধুমাত্র তার ভালোবাসার মানুষটাকেই মেনে নেয়নি চাচা। যার কারণে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। যার কারণে চাচা তাকে ত্যায্য করে। বলে আমাদের কারো সাথে যেন আর কখনো যোগাযোগ না করে। ও সেদিন কথা দিয়েছিল বেচে থাকতে আর নিজের মুখ আমাদের কাউকে দেখাবে না। তাই হয়তো এতবছর আমাদের থেকে আলাদা আছে। আমি শুধু এটাই চাই ও যেখানেই আছে ভালো থাকুক।’

৪১.
আলো ভার্সিটিতে এসে যথারীতি একা বসে ছিল। লতা আর রুহি বনানীর সাথে কথা বলবে না ঠিক করে নিয়েছ কি ভেবেছ কি ওরা? জীবন কি রঙ্গমঞ্চ নাকি?

আলোর ভাবনায় ছেদ ঘটে রুহি বনানীর আগমনে। রুহি বনানী আলোর পাশে বসে বলে,
‘তোমার হিরো এসে গেছে। দেখতে যাবে না তাকে?’

আলো ভ্রু কুচকে তাকায়। রুহি বনানীর উপর এখন তার এত রাগ হচ্ছে যা বলা বোঝানো সম্ভব নয়। নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে আলো।

‘আমার কোন হিরোর প্রয়োজন নই। আমি একাই ঠিক আছি।’

রুহি বনানী নাছোড়বান্দা। সে যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে বর্ষর সাথে আলোকে মিলিয়ে দেবে তখন দেবেই। এই ব্যাপারে সে কোন ছাড় দেবে না। আলোকে টেনে নিয়ে যায় রুহি বনানী।

বর্ষ ক্লাসে ঢুকতেই আলোর সাথে ধা’ক্কা খায়। রুহি বনানী খুশিতে মুখ টিপে হাসে। বর্ষ কেন জানিনা আগের মতো বিরক্ত হয়না। আলোর স্পর্শে তার ভালোই লাগছিল আজ। আলো দ্রুত দূরে সরে এসে বলে,
‘সরি।’

আর একমুহূর্ত না দাড়িয়ে নিজের ছিটে এসে বসে। রুহি বনানীর দিকে রাগী চোখে তাকায়। রুহি বনানী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে থাকে।

ক্লাস শেষে আলো কোন কথা না বলে ব্যাগ নিয়ে চলতে শুরু করে। রুহি বনানী বারবার সরি বলছিল কিন্তু আলো আজ অনেক বেশিই রেগে গেছে।

দ্রুত হাটতে গিয়ে পরে যায় আলো। তার মাথা গিয়ে একটা ইটে লাগে যার কারণে মাথা ফে’টে রক্ত বের হয়। বর্ষ পাশ দিয়েই যাচ্ছিল আলোকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসে।

রুহি বনানীকে বলে,
‘তুমি ওকে একটু ধরে রাখো আমি ফাস্ট এইড নিয়ে আসছি।’

বর্ষ যেতেই রুহি বনানী আলোকে বলে,
‘দেখলে তোমার হিরো কত কেয়ারিং?’

আলো এবার রুহি বনানীর থেকে জোরপূর্বক নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।

‘আমার কোন কেয়ারিং হিরোর দরকার নেই। আমি নিজেই নিজেকে সামলাতে পারি।’

আলো চলে যায় নিজের মতো। রুহি বনানী তাকে আটকাতে পারল না। বর্ষ ফাস্ট এইড এনে আলোর খবর জানতে চাইলে রুহি বনানী বলে,
‘চলে গেছে আলো। মেয়েটা এত জেদি যে কি আর বলব।’

বর্ষর এবার খুব রাগ হয়। এত কিসের অহংকার মেয়েটার? নিজে যা মনে করে তাই ঠিক, সবসময় এত জেদ দেখানো বর্ষর মোটেই পছন্দ নয়।

বর্ষর নিজের ভাবনার উপর রাগ হয়। কয়েকদিন থেকে মেয়েটাকে নিয়ে এত ভাবছে কেন সে? আগে তো কাউকে নিয়ে এভাবে ভাবে নি বর্ষ। বরাবরই স্ট্রেট ফরোয়ার্ড সে। নিজের এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না বর্ষ। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আর ভাববে না ঐ মেয়েটার কথা।

৪২.
জোনাকি এখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে বর্ণর ব্যবহারে। হাজারবার বোঝানোর পরেও বর্ণ কিছু বুঝতে চাইছে না। বর্ণর এই ছেলেমানুষী না কোন বিপদ ডেকে আনে।

প্রতি দিনের মতো আজও কোম্পানি যাওয়ার সময় জোনাকি বর্ণর সামনে এসে দাড়ায়। নিজের গাড়ি করে যাওয়ার অফার করে। আজ জোনাকি ভেবে নিয়েছে হয় ইসপার নাহয় উসপার করে তবেই শান্তি।

‘আপনি কেন এমন করেন আমার সাথে? আপনি বুঝতে চান না কেন আমি শুধুমাত্র একজন আশ্রিত এখানে। একজন আশ্রিতর সাথে আশ্রয়দাতার সম্পর্ক কৃতজ্ঞতার। এর থেকে বেশি কিছু নয়। আপনি যদি এমন করেন, কিংবা আমি আপনার ডাকে সাড়া দেই তাহলে আর কেউ কখনো কাউকে আশ্রয় দিতে চাইবে না। আপনার মা অনেক ভালো মানুষ। তাই আমি চাই না তার কোন অপমান হোক। আপনাকে শেষবারের মতো বলছি আমার সামনে আর আসবেন না। যদি আর কখনো আমার সামনে আসেন তাহলে আমি আমার বোনকে নিয়ে চলে যাব। অনেক দূরে চলে যাব। আর থাকবোনা এখানে।’

জোনাকির গলা ভারি হয়ে আসে। বর্ণর চোখেও জল। বর্ণ হাটু গেড়ে বসে পড়ে জোনাকির সামনে। বলে ওঠে,
‘আই লাভ ইউ জোনাকি।’

জোনাকি এবার পুরোই স্তব্ধ। কি বলবে এখন সে?

জোনাকি আর সেখানে দাড়ায় না। দৌড়ে চলে যায় সেখান থেকে। বর্ণ উঠে দাড়ায়। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এই অশ্রু ব্যর্থতার।

দূরে দাড়িয়ে এইসব ঘটনার সাক্ষী হয় বর্ষ। সবকিছু মিলিয়ে তাজ্জব বনে যায় সে। নিজের ভাইয়ের কাধে এসে হাত রাখে।

‘তুই কিভাবে এত সহজে নিজের মনের কথা প্রকাশ করিস বর্ণ? শুধুমাত্র এই একটা কারণে তোর উপর আমার এত হিংসা হয়। কত সহজে তুই নিজের মনের কথা মুখে আনতে পারিস। অথচ আমায় দেখ আমার মনের কথা আজীবন মনেই থেকে যায়।’

‘আজ আমারও আফসোস হচ্ছে বর্ষ। কেন তোর মতো হতে পারলাম না। তাহলে আজ হয়তো এভাবে কষ্ট পেতে হতো না।’

বর্ষ জড়িয়ে ধরে বর্ণকে।
‘না ভাই তুই যেমন আছিস তেমনই ঠিক। অন্তত কাউকে নিজের মনের কথা বলে দিয়ে হালকা হতে পারিস। মনের কথা মনেই চেপে রাখা যে আরো বেশি কষ্টের, আরো বেশি যন্ত্রণার। মাঝে মাঝে মনে হয় দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

বর্ষর চোখেও জল চলে আসে নিজের ভাইকে এভাবে বাচ্চাদের মতো কাদতে দেখে। যদি সে কোনভাবে পারত ভাইয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিতে তাহলে খুব খুশি হতো।

আলো বাড়িতে এসে দেখতে পায় সুমনার হাসিমুখ। আলোকে দেখে সুমনা বলে,
‘জানো এই বাড়িতে খুব শীঘ্রই বড় একটা অনুষ্ঠান হতে চলেছে।’

‘অনুষ্ঠান! কিসের অনুষ্ঠান?’

‘আমার কিউট ছেলে বর্ণর এনগেজমেন্ট।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨