বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব-০১ (২য় পরিচ্ছেদ)

0
212

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব

মাথায় হাত দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে রুহানী। হঠাৎ মাথার পেছন দিকে সূক্ষ্ণ চিলিক দিয়ে উঠতেই সেখানে হাত দিতেই মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। তৎক্ষণাৎ নিজের মাথা ও কপালে ব্যান্ডেজের উপস্থিতি অনুভব করে হতবাক হয়ে যায়। নিজের স্থান বুঝতে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে আশেপাশে নজর বুলিয়ে প্রথম দফায় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নজরে এলো না তার। অতঃপর চোখ কচলে নিয়ে আরও গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে অদূরে ভাঙা কিছু চেয়ার ও বস্তা নজরে আসে। এবার ঘাবড়ে উঠে রুহানী। সে কোথায় আছে? সে এখানে কীভাবে এলো তাও বুঝতে পারছে না। তার সাথে কী হয়েছে মনে করতে নিজের মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে। অতঃপর,,
১৭
ফ্ল্যাশব্যাক,
“রুহানী, হলো তোর? আমাদের বেরোতে হবে তো। আরহানের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।”

কথাগুলো বলতে বলতে জাহানারা শেখ রুহানীর ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনি দেখলেন, রুহানী আয়নার সামনে বসে চোখে কাজল লাগাচ্ছে। আয়নায় চাচির প্রতিবিম্ব দেখে রুহানী ঠোঁট প্রসারিত করে মিষ্টি হাসে। জাহানারা শেখ কদম বাড়িয়ে এগিয়ে এসে রুহানীর পেছনে দাঁড়ালেন। কালো ডিজাইনার ফুল স্লিভস ও ফুল নেক ব্লাউজের সাথে গাড়ো পিত রঙের সিল্ক শাড়ি ও একই রঙের ডিজাইনার শাল নিয়েছে। সাথে খোলা চুল ও কালো পাথরের বড়ো ঝুমকো। ওর সাজটাও খুব বেশি গাড়ো না, ন্যাচারাল। তাতেই ভীষণ নজরকারা লাগছে রুহানীকে। অতঃপর জাহানারা শেখ সবসময়ের মতো নিজের চোখের কাজল রুহানীর কানের পিঠে লাগিয়ে বললেন,

“মাশাআল্লাহ। কারও খারাপ নজর না লাগুক।”

রুহানী কাজলটা রেখে পেছন থেকে চাচির হাত টেনে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি হাসে। জাহানারা শেখ বলেন,
“তোর চাচার মোটেও পছন্দ না, আমার এই কানের পিঠে কাজল লাগানো। সে এখন দেখলে সবসময়কার মতো বলতো, ‘আমাদের রুহানী মাশাআল্লাহ সুন্দর। তোমাকে ওর কানের পিঠে কাজল লাগাতে হবে না।’ কিন্তু আমার যে ভালো লাগে। আমার দাদী এই কাজটা করতেন। আমাকে ও তোর মাকে সবসময় এভাবে কাজল লাগাতেন।”

জাহানারা শেখের চোখের কোণে অশ্রুবিন্দুর চিলিক দেখা যায়। তিনি অতি সন্তপর্ণে তা আড়াল করে নিলেন। রুহানী হালকা হেসে উঠে দাঁড়িয়ে ইশারায় বুঝালো,
“চাচ্চু কোথায়?”

“তোর চাচা অফিসের কাজে আটকে পরেছে। আমাদের বলেছে ড্রাইভার নিয়ে অনুষ্ঠান স্থলে যেতে। সে অফিস থেকে সরাসরি সেখানে যাবে। চল এবার। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। আরহান অপেক্ষা করছে তো।”

রুহানীও তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিয়ে ডান হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে যেতে থাকে। গার্ডেনে এসে গাড়িতে বসতেই অচেনা ড্রাইভার দেখে জাহানারা শেখ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে শুধালেন,
“তুমি কে? শফিক কোথায়?”

ড্রাইভার পেছনে ঘুরে ভরাট কণ্ঠে জবাব দেয়,
“আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম। আমি জামাল। শফিক ভাইয়ের মা অসুস্থ হয়ে গেছে বলে আমাকে দুইদিনের জন্য ঠিক করে গেছেন।”

“শফিকের মা অসুস্থ? কই শফিক তো বলেনি।”

জাহানারা শেখের কণ্ঠে সন্দেহের সুর। ড্রাইভার জামাল উত্তর দেয়।
“সকালে স্যারের কাছে চিঠি দিয়ে গেছিল। খুব জলদিতে ছিল বলে আপনাকে বলতে পারে নাই। আমাকে যাওয়ার পথে ফোন করে বলে গেল, আমি যেন দুইদিন তার বদলে ডিউটি করি। ইদানীং বেকার, কাজ পাচ্ছি না তো। তাই আরকি।”

“আচ্ছা চলো। এমসি কলেজে যাবে। যেখানে মেয়র আজমল খান ও তার ছেলের সভা অনুষ্ঠান।”

“জি ম্যাডাম।”

গাড়ি চলতে শুরু করে। রুহানী আরহানকে মেসেজ করে দেয়, সে আসছে। আরহান আজকে অনেক ব্যস্ত। তাও সময় করে রুহানীর সাথে দেখা করতে চেয়েছে।
জাহানারা শেখ তার স্বামীকে ফোন করেন। ফোন রিসিভ হলে সালাম দিয়ে বলেন,

“তুমি কি বের হয়েছ? আমরা তবে পৌঁছে গেইটে অপেক্ষা করব?”

“না। তার দরকার নেই। তোমরা ভেতরে চলে যেও। আমি একটু পরেই অফিস থেকে বের হবো।”

“আচ্ছা। আর শফিকের বদলে আরেকজন নতুন ড্রাইভার আজ এসেছে?”

“ওহ হ্যাঁ। সকালবেলা অফিসের ঠিকানায় শফিকের চিঠি এলো। পিয়ন দিয়ে গেল। ওর নাকি মা অসুস্থ। নতুন ড্রাইভার শফিকের পরিচিত তাই বলল।”

“ওহ আচ্ছা। জলদি চলে এসো। রাখছি।”

কথা বলা শেষ হলে জাহানারা শেখ ফোন ডিসকানেক্ট করে রুহানীকে বলেন,
“শোন, আরহান হয়তো কাজে খুব ব্যস্ত থাকবে। আমরা গিয়ে স্টেজের সামনের সিটে বসে থাকব। তোর চাচার একটু দেরি হবে। তোর চাচা এলেই আরহানের সাথে দেখা করতে যাস। আমি আর তুই কি এতো মানুষজন চিনি নাকি!”

রুহানী ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি প্রদান করে। আচমকা গাড়ি বেশ জোড়ালো শব্দ করে থেমে যায়! হঠাৎ এমন হওয়াতে রুহানী ও তার চাচি দুজনেই কিয়ৎ আঁতকে ওঠে। জাহানারা শেখ উৎকন্ঠা নিয়ে ড্রাইভারকে প্রশ্ন করেন,

“কী হলো?”

ড্রাইভার জবাবে বলে,
“ম্যাডাম, গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেছে।”

“এখনই এসব হওয়ার ছিল! আচ্ছা জলদি ঠিক করো।”

জাহানারা শেখের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। তিনি রুহানীকে বলেন,
“চল আমরা নেমে দাঁড়াই। তোর চাচাকে বলে দেই। ”

রুহানী ও তার চাচি গাড়ি থেকে নেমে বুঝতে পারেন, জায়গাটা বেশ নিরব এবং এটা সচরাচর রাস্তা না। জাহানারা শেখ ড্রাইভারকে সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,

“এটা কোন রাস্তা? কোথায় নিয়ে এসেছ?”

“ম্যাডাম এটা একটু ঘুরানো রাস্তা। সোজা রাস্তাতে আজ ট্রাফিক অনেক। তাই এখান দিয়ে এসেছি। আপনি চাইলে ম্যাপে দেখতে পারেন।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। জলদি টায়ার লাগাও।”

জাহানারা শেখ এরপর রহমত শেখকে ফোন করে ব্যাপারটা অবগত করান। রুহানী চুপচাপ চাচির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তখন ওর ফোনে আরহানের মেসেজ আসে।

“কোথায় তোমরা?”

রুহানী জবাবে লিখে,
“গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। একটু সময় লাগবে। সরি।”

“আচ্ছা আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। লোকেশন বলো।”

“আরে তা লাগবে না। ড্রাইভার টায়ার ঠিক করছেন। আপনি অনুষ্ঠানে মনোযোগ দিন। আজ আপনার জন্য কতো বড়ো একটা দিন। এখন সেটাতে কনসানট্রেট করেন। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি ঠিক আছি।”

“সাবধানে এসো তবে।”

“হুম।”

রুহানী মেসেজটা সেন্ড করে মুচকি হাসল। কীভাবে সময় পেরিয়ে এখন ওরা দুজন দুজনকে ছায়ার মতো ভালোবাসে। পারিবারিক ভাবে ওদের দুইজনের বিয়ে ঠিক হয়েছে পাঁচ মাস হয়েছে। এই পাঁচটা মাস যেন রুহানী নিজেকে স্বপ্নপুরীর রাজকন্যা রূপে দেখেছে। রুহানী কখোনো কল্পনাও করেনি সে এতোটা কাউকে ভালোবাসবে। আরহানের আগমনেই বুঝতে পেরেছে ভালোবাসা কতোটা সুন্দর।

রুহানীর ভাবনা-চিন্তার মাঝেই হঠাৎ মাথার পেছনে বেশ ভারী আঘাত অনুভব করল। তীব্র পীড়ায় মূহুর্তেই অক্ষিপল্লব বুজে আসতে লাগল। কর্ণকুহরে চাচির আর্ত চিৎকারে এক ঝলক চাচির ভীত, বিস্মিত, অশ্রুসিক্ত ও উৎকণ্ঠিত মুখশ্রীটা দেখে জ্ঞান হারাল।

ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড,,

সবটা অক্ষিপটে ফুটে উঠতেই ভয়ে সিটিয়ে গেল রুহানী। জড়োসড়ো হয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসতে নিতেই মাথার পেছনে তীক্ষ্ম ব্যাথা যেন ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে বাড়তে লাগল। তার চোখ দিয়ে কপোল গড়িয়ে অজস্র অশ্রুধারা বইছে। মুখে বোবা চিৎকারে গোঙানির স্বরে সাহায্য পার্থনা করছে। কিন্তু আফসোস, এই বদ্ধ ঘরে তাকে সাহায্য করার মতো কোনো মানুষ বা প্রা*ণী মজুদ নেই। তার সাথে কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? কিছুই সে ভাবতে পারছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে নানান উদ্ভট চিন্তায় আরও ব্যাকুল হচ্ছে। টিকটিকির শব্দও যেন লোমকূপ পর্যন্ত কাঁপন ধরাচ্ছে তার। অনবরত কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে চলেছে।

হঠাৎ খট করে শব্দ হওয়াতে রুহানী হকচকিয়ে পিছিয়ে যেতে নিলে হাত ধা*রালো কিছুর সংস্পর্শে এসে ‘আহ!’ করে আর্তনাদ করে উঠল সে। তখন আচানক আলোকরশ্নির উপস্থিতি চোখে এসে পরতেই আরেক হাতের দ্বারা চোখ ঢেকে নেয়।
ধীর ক্ষণে ক্ষণে কারও পদধ্বনি শুনে পাচ্ছে। তখনি কারও ভরাট কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছায়।

“হাই মিস বোবাপাখি! হোয়াটসআপ?”

চলবে ইনশাআল্লাহ,