বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব-০৩

0
212

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
১৯
রাতের তমসাকে দূর করে রক্তিম সূর্য তার কিরণে ধরিত্রীকে আলোকময় করেছে। জানালার ফিনকি দিয়ে সূর্যের রশ্নি রুহানীর চোখের উপর পরতেই ঘুম ছুটে যায় তার। বেশ শীত শীত করছে। রাতে ক্লান্ত হওয়াতে কোনোরকম শাল দিয়ে পেঁচিয়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে পরেছিল। দিনের আলোতে ঘরটার চারিদিকে নজর বুলিয়ে বুঝতে পারল এটা কোন গুদাম ঘর বা স্টোর হাউস না। এখানে বেশ কয়েকটা বস্তা ও ভাঙ্গা চেয়ার থাকলেও সেগুলো সংখ্যায় ঘরটার তুলনায় নগণ্য। ঘরটা বিশাল বড়ো তবে জানালা বলতে দেয়ালের সাত ফুট উুঁচুতে একটা ছোটো জানালা আছে। সেখান থেকেই আলো আসছে। গতকাল সে খাবে না বুঝানোতে লোকটাও আর লাইট জ্বা*লায়নি। গতরাতের খাবার যত্রই পরে আছে। এখন দেখতে পেল মেঝেতে ভাঙা কাঁচের বোতল পরে আছে যা দিয়ে তার হাতে কিঞ্চিত ক্ষত হয়েছিল। রুহানী দক্ষিণ দিকে ওয়াশরুম দেখে উঠে গেল। অতঃপর হাত-মুখ ধুঁয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হলো। বের হতেই দেখল একজন লোক পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসে আছেন। লোকটির মুখে একটা কালো মুখোশ লাগানো। পরনেও তার কালো হুডি ও ট্রাউজার। তৎক্ষণাৎ রুহানি ভয় পেয়ে গেল। তার রাতের কথা মনে পড়াতে এক পা দু পা করে পিছিয়ে যেতে ধরলো। তা দেখে লোকটি অট্টস্বরে হেসে বলে ওঠে,

“কি হলো মিস বোবা পাখি? অবাক হলে বুঝি? ভেবেছিলে রাতে যা হয়েছে সব তোমার দুঃস্বপ্ন ছিল? ইশ! যদি দুঃস্বপ্নই হতো তাইনা? তাহলে তুমি এখন তোমার আলিশান বাড়িতে থাকতে। মোলায়েম বিছানায় রাজকন্যার হালে ঘুম ভাঙতো। আহা! কত শান্তি তাই না? কিন্তু তোমার ওই শান্তিটাই আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। তাইতো তোমাকে নিয়ে এলাম। একটু কষ্টও ভোগ করো। কীভাবে পারো অন্যের সুখ, ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে নিজে সুখে থাকতে? জন্ম থেকেই তো তুমি স্বার্থপর তাই না নিজের চাচাতো বোনকে তার বাবা-মায়ের ভালোবাসা থেকে দূরে করেছ। সব সময় তো অন্যের থেকে অন্যের জিনিস কেড়ে নিজের করাই তোমার স্বভাব। তাই না? আর মানুষজন তোমার ভোলা-ভালা চেহারা, ইনোসেন্ট বিহেভিয়ারে এতটাই মজে যায় যে তোমার ধোঁকা, কুৎসিত মানসিকতা বুঝতে পারে না।”

রুহানী হতভম্ব দৃষ্টিতে লোকটির দিকে চেয়ে রইল। লোকটি কী সব বলছে তা রুহানী বুঝতে পারছে না! কেনইবা বলছে? রুহানী নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে অনুরোধ করে করে বলল,

“আমি কারও কিছু কেড়ে নেইনি। আপনার ভুল ধারণা। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।”

রুহানীর নিঃশব্দে বলা কোন কথাই লোকটি বুঝতে পারল না। বরং সে বিরক্ত হয়ে বলে ওঠল,
“তুমি যে বোবা সেটা কি মাঝে মাঝে ভুলে যাও নাকি? বোবারা যেভাবে সাংকেতিক ভাবে নিজের ভাষা বোঝায় সেভাবে বলতে পারো না? সবাইকে কি আরহান ভাব নাকি? যে সবাই তোমার ঠোঁট নাড়িয়ে বলা ভাষা বুঝে যাবে! সবাই লিপ রিডিং জানবে! ভুলে যেও না তুমি একজন বোবা! তুমি কথা বলতে পারো না। তাই নিজেকে অন্যান্য সবার সাথে গুলিয়ে ফেলো না। আরহান কখনো তোমাকে কষ্টে দেখতে চায় না হীনমন্যতায় দেখতে চায় না। কিন্তু তোমার জন্য অন্য কারো হৃদয়ের শত টুকরো করতেও ওর এক সেকেন্ডও লাগে না। যেটার তুমি যোগ্য না, আরহান তোমাকে সেটাই দিতে চেয়েছে! এবং দিচ্ছিলও। ”

লোকটার বলা প্রত্যেকটি বাক্য রুহানীর হৃদয়ে তী*রের মত আ*ঘাত করেছে। সত্যি বলতে আরহানের সাথে থাকলে তার নিজের প্রতিবন্ধকতা অনুভব হয় না। নিজেকে যেন স্বাভাবিক লাগে। হঠাৎ রুহানীর কিছু একটা খটকা লাগে। সে সন্দিহান হয়ে ইশারায় শুধায়,

“আরহান আমার জন্য কার মন ভেঙেছে?”

“হাহ্! ভালোই তো অভিনয় জানো মিস রুহানী শেখ! এখন নিজেকে ইনোসেন্ট প্রমাণ করার চেষ্টায় আছো তাই না? যেন তুমি কিছু জানোই না! অবশ্য তাতে খুব একটা লাভ নেই। তুমি জানো বা না জানো, তুমি একজনের হৃদয় ভাঙ্গার কারণ। তুমি তাকে এমন অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছ যার থেকে সে কখনো ফিরবে কিনা তার কোন গ্যারান্টি নেই। সবকিছু জন্য তুমি দায়ী মিস রুহানী শেখ! আর সেই তোমাকে আমি শান্তিতে থাকতে দেবো? সুখে থাকতে দেবো? কখনোই না! তুমি এই চার দেয়ালের বাহিরে যেতে পারবে না। এখানেই তুমি তোমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। তাও নিজের আপনজন, ভালোবাসার মানুষদের না দেখে কষ্টে ধুকে ধুকে ম*রবে। তোমার সেই কষ্ট আমার হৃদয়ের যন্ত্রনা কমাবে। শান্তি পাবে সে!”

কথাগুলো বলে লোকটি উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে। রুহানী মুখে হাত চেপে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ে। তার অক্ষিপটে ভেসে উঠছে, তার কিছু সুখ স্মৃতি। তার চাচীর সাথে কাটানো অমূল্য মুহূর্তগুলো সেই সাথে আরহান তার জীবনে আসা। প্রতিটা ধাপে ধাপে তাদের দেখা হওয়া, তাদের ভালবাসার দিনগুলো। এতো জলদি যে তার জীবনের রংগুলো ফিকে হয়ে যাবে তা সে কল্পনাও করেনি। নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে আপনমনে দুঃখবিলাস করার মাঝেই হঠাৎ তার কপাল বরাবর কিছু এসে আ*ঘাত করতেই ভয় পেয়ে যায় রুহানী। কণ্ঠ থেকে নির্গত হয় ব্যাথাতুর ধ্বনি। কিন্তু তাতেও লোকটির মনোভাবে সামান্যতম মায়ারও আবির্ভাব হলো না। বরং হিং*স্রতা তার অভিলাষে। লোকটি বলল,

“সামান্য কাঁটা চামচের আঘাতেই এতটা জ*খমি হলে! ভাবো তো, যদি তোমার বা তোমার আপনজনের উপর দিয়ে দ্রুতগতির ট্রা*ক যায় তখন? কতটা ব্যথা লাগবে বলো তো? শরীর থেকে কতোটা র*ক্ত ঝরবে? বলতে পারো? না বলতে পারো না। কারণ তুমি এইসব কখনো ফেস করোনি। কখনো আপন কাউকে দেখনি ট্রা*কের নিচে পড়তে। কিন্তু আমি দেখেছি। আমার র*ক্তের কাউকে নিজের চোখের সামনে ট্রাকের নিচে পড়তে দেখেছি। জানো আমার তখন কেমন লেগেছিল? ওই সময়টা কতটা দিশেহারা ছিলাম আমি? নিজেকে কতটা পা*গল পা*গল লাগছিল? কোন আইডিয়া আছে তোমার? আর এই সব কিছুর মূলে তুমি! তোমার কারনে আমি আমার বোনকে ওই অবস্থায় দেখেছি। আমার নিজের বোন। কী ক্ষতি করেছিল ও তোমার? কেন ওর জীবন থেকে সকল সুখ কেড়ে নিলে তুমি? তুমি আমার বোনের জীবনের সকল সুখ কেড়ে নিয়ে তাকে বিবর্ণ করে দিয়েছ। আর সে তোমার দেওয়া সেই বিবর্ণ রংকে পুঁজি করে দূরে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু কে জানত! সে দূরে চলে যেতে চাওয়ায় তাকে এমন জায়গায় পৌঁছে দেবে যেখান থেকে সে….!”

এতটুকু বলেই লোকটি নিজের কথার লাগাম টানল। এদিকে রুহানূ উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে পরেরটুকু জানতে। লোকটির বোন কোথায় গিয়েছে তা তার জানতে হবে। কী হয়েছে লোকটির বোনের সাথে? আর কেইবা লোকটির বোন? লোকটির বোনকে কি সে কোনোভাবে চিনে?
দীর্ঘক্ষণ লোকটিকে মৌন থাকতে দেখে রুহানি হাত দিয়ে ফ্লোরে শব্দ করল। লোকটির নজর তার দিকে পরতেই ইশারায় শুধালো,
“কী হয়েছে আপনার বোনের?”

রুহানীর উদ্বিগ্ন মুখশ্রী দেখে তাচ্ছিল্য হাসল লোকটি। অতঃপর বলল,
“জানবে জানবে সবকিছুই জানবে। এত জলদি কিসের? এখানে এসেছ, তোমার প্রাণ বায়ু তোমার শরীর ত্যাগ করার আগে সবকিছুই তুমি জানবে। তবে ধীরে ধীরে জানবে।”

এই বলে লোকটি চেয়ার থেকে শব্দ করে উঠে ধপ ধপ পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে রুমটি লক করার আগে বলে গেল,

“চেয়ারের কাছে দেখবে একটা ব্যাগ আছে। সেখানে তোমার দুই-তিন সেট জামাকাপড় আছে। আর সময়মত তিন বেলা খাবারও পাবে। খেলে খাও, না খেলে না খাও। তুমি এখানে সব রকম সুবিধাই পাবে। শুধুমাত্র বাহিরে কারো সাথে যোগাযোগ করা ও বাইরে যাওয়া বাদে।”

লোকটির অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে রুহানি নির্নিমেষ চেয়ে রইল। সে লোকটির ধাঁচ ধরতে পারছে না।

________

ভোরবেলা ফজর ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আরহান রুহানীকে খুঁজতে বেরিয়ে গেছে। শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে দিনের আলোয় তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলেছে। থানা থেকেও পুলিশ এখন পর্যন্ত কোন খবর দিতে পারছে না। সারাদিন খুঁজে ফিরে আরহান ক্লান্ত হয়ে গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। সূর্য এখন ঠিক মাথার উপর। ঘড়ির কাটায় বেলা বারোটা বাজে। গতরাত নির্ঘুম কাটানোর পর শরীর এখন সায় দিচ্ছে না কোন কিছুতে। গতকাল যখন থেকে রুহানী নিখোঁজ হয়েছে তখন থেকে শুধু পানি ছাড়া আর কিছুই দাঁতে কাটেনি সে। চোখের কোণ বেয়ে সূক্ষ্ণ জলধারা বয়ে চলেছে। মনে নানারকম চিন্তা। তার এই হতাশা মিশ্রিত চিন্তার মাঝেই তার ফোন বেজে ওঠল। রুহানীর কোন খবর এসেছে মনে করে দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল রুহানীর চাচা ফোন করেছেন। আরহান ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলীর দ্বারা চোখ মুছে ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেসা করে,

“রুহানীর কোন খোঁজ পেয়েছেন আঙ্কেল? ”

হতাশ হন রহমত শেখ। তিনি ভেবেছিলেন, আরহানের কাছে হয়তো কোন খোঁজ পাবেন। তিনি প্রত্যুত্তর করলেন,
“না বাবা কোন খোঁজ পাইনি। সিলেটের আনাচে কানাচে খোঁজ নিতে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা এখনো পর্যন্ত কোন পজিটিভ কিছু বলতে পারছে না। এদিকে তোমার চাচিকেও সামলানো মুশকিল হয়ে পরেছে। তাকে ঘুমের ইন*জেক-শন দিয়ে থামিয়ে রাখতে হয়েছে। সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই সে আবারো রুহানীকে খুঁজতে শুরু করে বিলাপ করছিল। ভাগ্যিস তখন রিহা এসে তোমার চাচীকে সামলিয়ে ছিল।”

আরহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“রিহাকে আন্টির পাশে রাখুন। আমি খোঁজ জারি রেখেছি। পেলেই জানাব।”

রহমত শেখ তিক্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,
“জানিনা, সবাই রুহানীর পেছনেই কেন পরে! কার কী ক্ষতি করেছে সে!”

“ও কারও ক্ষতি করেনি। ও তো সবাইকে আগলে রাখতে চায়। আঙ্কেল আপনি ধৈর্য্য ধরুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, রুহানীকে আমি খুঁজে বের করবোই। এর জন্য আমাকে যা করা লাগে আমি সব করব।”

“দোয়া করি তুমি সফল হও বাবা।”

কথা বলা শেষে আরহান ফোন রেখে আবারো চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে রইল। তন্মধ্যেই গাড়ির কাঁচে ঠকঠক শব্দ হতে আবারো দৃষ্টি মেলে। চেয়ে দেখে একটা বাচ্চা মেয়ে হাতে কতগুলো বেরঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরহান জানালার গ্লাস নামিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করল,

“কী হয়েছে বাবু?”

মেয়েটি ইশারায় ফুল কিনতে বলল। আরহান মলিন হেসে বলে,
“আমি এখন এই ফুল দিয়ে কি করব বলো? আমার তো এই ফুলের এখন দরকার নেই। ফুল দেওয়ার মানুষটাই যে এখন আমার কাছে নেই। ”

মেয়েটি ইশারায় আবারও একই কথা বলল। আরহান প্রত্যুত্তর একই কথা বললেও মেয়েটি যেন বুঝতেই পারেনি। তৃতীয়বারের মতো একই বুলি বললে আরহানের হুট করে মনে হলো মেয়েটি বোবা! সে ইশারায় জিজ্ঞাসা করে,
“কথা বলতে পারো না? কোনো কথা শোনোও না?”

মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে না বোধক বুঝালো। তা দেখে আরহানের ভীষণ মায়া হলো। সে মলিন হেসে মেয়েটির হাতের সবগুলো ফুল নিয়ে ৫০০ টাকার একটা নোট মেয়েটির হাতে দিয়ে ইশারায় বলল,

“দোয়া করো, আমি যেন আমার এই ফুলগুলোর মালকিনকে জলদি খুঁজে পাই।”

মেয়েটি মুচকি হেসে ইশারায় হাত দিয়ে দোয়া করার মতো করে চলে গেল। মেয়েটি প্রস্থানের পর আরহান জানালার কাচ লাগিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করে,

“প্লিজ রুহানী। কোথায় তুমি? তোমাকে ছাড়া কেমন দমবন্ধকর লাগছে সবকিছুতে। আমার মানসিক শান্তি চাই। ইউ আর মাই মেন্টাল পিস।”

চলবে ইনশাআল্লাহ,