বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব-১০+১১

0
229

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১০
আরহান ডাক্তারের সাথে কথা বলে রুহানীকে হসপিটালে সাফার কাছে রেখে পু*লিশ স্টেশনে যায়। সেখানে পু*লিশের থেকে সবটা জানতে পেরে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে। তার নিজেরই বেস্ট ফ্রেন্ড তার সাথে এভাবে ধোঁকা করতে পারল! যে কিনা রুহানীর নিখোঁজের সময়টাতেও তাকে ভরসা দিয়ে গেছে, সাহায্য করে গেছে। অথচ কি*ডন্যা*পার কী-না সেই বের হলো! যেই ফ্ল্যাটটাতে রুহানী ও সাফাকে রাখা হয়েছিল সেই ফ্ল্যাটটা পর্যন্ত রাফাতের নামে। আরহান বুঝতে পারছে না রাফাত এসব কেনই বা করবে আর রাফাত লন্ডনে ফ্ল্যাট কবে কিনল তাও তার অজানা। সমস্তটা তার প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে। এর জবাব দিতে পারবে রাফাত। সে এবার হসপিটালের জন্য বের হয়।

আরহান হসপিটালে পৌঁছে রুহানীকে বলে,
“আমরা পরশু ফিরব। সাফার যাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। আমি আঙ্কেল-আন্টিকেও বলেছি।”

রুহানী মাথা নাড়িয়ে আবারও সাফার দিকে মনোনিবেশ করা মাত্রই আরহান ওর হাত চেপে ধরে। বেশ রূঢ়তা স্পষ্ট। রুহানী হকচকিয়ে তাকায়। আরহানের মুখভঙ্গি বেশ শান্ত তবে হাতের ছোঁয়াতে কঠোরতা কেন? রুহানী ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলবে তার আগেই আরহান ওকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। রুহানী বারবার আরহানকে হাত দিয়ে ডাকলেও আরহান শোনে না। সে রুহানীকে নিয়ে সোজা হসপিটালের বাহিরে বুকড করে ক্যাবে উঠে পরে। তারপর ক্যাব ড্রাইভারকে লন্ডন ব্রিজে নিয়ে যেতে বলে। গাড়িতে বসেও আরহান নিরব হয়ে আছে। রুহানী তাকে ডেকে ইশারায় শুধায়,

“কী হয়েছে আপনার?”

আরহান বলে,
“সময় হলে জানতে পারবে।’

এমন জবাবের পিঠে আর কী বলা যায় জানা নেই রুহানীর। সে অপেক্ষা করতে থাকে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের।

________

রাফাত ইন্ডিয়া গিয়ে সেখান থেকে নেপাল চলে গেছে। সম্পূর্ণ নেটওয়ার্কের বাহিরে। রাফাত কোথায় গেছে কেউ জানে না। জাওয়াদ, কবির, অভিক ও আহান রাফাতকে খুঁজছে কিন্তু পায়নি। রাফাত যে পালিয়েছে তা বুঝে গেছে। আহান বলে,

“ভাইয়ার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে এমনটা করল! আনবিলিভেবল! হাই কুড হি।”

অভিক বলে,
“হয়তো রুহানীকে ভালো লেগে গেছে! কিন্তু তাই বলে বেস্টফ্রেন্ডকে বি*ট্রে! রাফাতকে দেখে মনেই হয় না, ও এমন।”

“হুম ঠিক বলেছিস। রুহানী নিখোঁজ হওয়ার পর দেখেছিস? ও কিন্তু আরহানকে এসে খুব সামলেছে। আমাদের থেকেও বেশি। মানে বুঝলাম না। ও চাইছে টা কি?

জাওয়াদের কথা শোনে বাকিরাও চিন্তায় পরে গেল।

_____

আরহান রুহানীর লেখাগুলো পড়ছে। রুহানী তার পাশে বিমূঢ় হয়ে মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার সম্মুখে অম্বরপানে নিশ্চল। আরহান পড়ছে,

“রাফাত ভাইয়া আমাকে কিডন্যাপ করেছে কারণ সাফা কোমাতে তাই। আমার ও আপনার এনগেজমেন্টের কথা শুনে সাফার আজ এই অবস্থা। সে নিজের আবেগ সামলাতে পারেনি। ছুটে যেতে নিয়ে তার অ্যা*ক্সিডেন্ট হয়ে যায়। আর সবটাই ঘটেছে রাফাত ভাইয়ার চোখের সামনে। রাফাত ভাইয়া সাফার এই অবস্থা মেনে নিতে পারেননি। একমাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করে সাফা কোমাতে চলে গিয়েছে। রাফাত ভাইয়া সাফাকে বোন বললেন। নিজের বোনের করুণ পরিণতির দোষী তিনি আমাকে ভাবেন তাই আমাকে আপনার জীবন থেকে সরিয়ে ফেলতে তিনি এই কাজ করেছেন।”

লেখাটুকু পড়ে আরহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর বলে,
“হ্যাঁ, রাফাত সাফাকে বোনের মতো ভালোবাসে। খুব ছোটোবেলায় নাকি রাফাতের ছোট বোন মা*রা গিয়েছে। রাফাতের ছোট বোন ও নাকি সাফার মত এরকম চঞ্চল ও মিষ্টি ছিল। হাসিটাও নাকি মিলে যায়। তাই সে সাফাকে নিজের বোনের জায়গা দিয়েছে। কিন্তু সাফার অ্যা*ক্সিডেন্টের সাথে তোমার তো কোন হাত নেই। ওর নিয়তিতে ছিল এটা। এটা কেন মানতে পারছে না? এজন্য সে আরেকটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিবে! এটা কেমন ন্যায় হলো? আমিও তো তার বেস্টফ্রেন্ড। সে আমার দিকটাও দেখবে না? একজন ভালবাসলে যে বিপরীতে তাকেও ভালবাসতেই হবে এরকম তো সংবিধানে নেই। ভালোবাসা পাখির মত মুক্ত। ভালোবাসা এমন হতে হবে যাতে এর দ্বারা ইচ্ছাকৃত কারো ক্ষতি না হয়। ভালোবাসা কারো কাছে মধুর মতো, তো কারো কাছে বি*ষের মতো। সবটাই নির্ভর করে সঠিক ও ভুল মানুষকে ভালোবাসা নিয়ে। সাফার জন্য আমি ছিলাম ভুল মানুষ।”

রুহানী তাও নির্বিকার। তার কেন যেন নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে। ছোটো থেকে নিজেকে নিয়ে অন্যদের মাঝে মনোমালিন্য দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত। বুঝতে পারেনি যে বড়ো হয়েও এই ধারা অব্যাহত থাকবে। তার মাঝেমাঝে আফসোস হয় যে তার বাবা-মা তাকে কেন তাদের সাথে করে নিয়ে গেল না! রেখে গেল পরনির্ভরশীল করে। আরহান হঠাৎ খেয়াল করল রুহানী তার কথা শুনছে না। তার নেত্র পরিধি অনন্ত। হয়তো কোন ভাবনার সাগরে ডুবে আছে। আররহান রুহানীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিজের দুই হাতের আঁজলায় রুহানীর মুখমণ্ডল আগলে নিল। বলল,

“যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে। ওর ভাগ্যে যা আছে সেটাকে আমরা আটকাতে পারতাম না। তোমাকে খুঁজে পেয়েছি সেটাই অনেক। কিন্তু রাফাতকে এর জবাব দিতেই হবে। বন্ধু হয়ে বন্ধুর সাথে এরকমটা সে কী করে করতে পারলো! তুমি এসব নিয়ে আর ভাববে না। এসব ভুলে যাবে। ঠিক আছে?”

রুহানী চুপ করে রইল। একদৃষ্টিতে আরহানের চোখের দিকে চেয়ে আছে। আরহান আবারও জবাব চাইলে সে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে মাথা নাড়ায়। আরহান মুচকি হেসে ওকে ক্যান্ডিফ্লস যেখানে বিক্রি হচ্ছে সেখানে নিয়ে যায়। তারপর দুটো ক্যান্ডিফ্লস কিনে রুহানীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,

“আকাশের মেঘরাশি তোমার হাতে এনে দিলাম এবার সূর্যের মতো ঝলমলিয়ে উঠো দেখি। তোমার হাসি তো আমার বড্ড প্রিয়।”

রুহানী অজান্তেই হালকা হাসে। তা দেখে আরহান ভীষণ খুশি হয়। দুজনে লন্ডনের রাস্তায় হাতে হাত রেখে হেঁটে চলে।

_______

দুইদিন পর,
আরহান ও রুহানী, সাফাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। রুহানীকে ঘিরে যেমন তার পরিবারের আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি নির্জীব সাফাকে ঘিরেও তার বাবা-মা কাঁদছেন। একটা মাত্র মেয়ে তাদের। সেই মেয়েকে এমন নিস্তেজ হয়ে প্রাণহীনের মতো পড়ে থাকতে দেখা কতোটা যন্ত্রণাদায়ক। আরহান উনাদের কাছে গিয়ে বলেন,

“আঙ্কেল-আন্টি, আপনারা প্লিজ এভাবে কাঁদবেন না। দেখবেন সাফা একদিন ঠিক কোমা থেকে ফিরে আসবে।”

সাফার মা ক্রন্দনরত স্বরে বলল,
“জানিনা কী এমন পাপ করেছি, উপরওয়ালা সন্তান দিয়েও নিয়ে গেল।”

তাকে সাফার বাবা ও তন্নি, রাইদা মিলে সামলাচ্ছে। আরহান সরে আসলো।

এদিকে আমেনা খানম চশমা খুলে চোখ মোছেন। তখন আলো খান কাছে এসে মৃদুস্বরে বলে,
“মা এই মেয়েটাই তাহলে আরহানের হবু বউ?”
“হ্যাঁ।”
“মেয়েটা কথা বলতে পারে না। তাছাড়া এমনটা তো নয় যে এই মেয়ের মতো সুন্দরী আর কেউ নেই! তাও এই মেয়েকে নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে বিবাদ! হাহ্! সত্যি এখানকার মানুষজন এক্সট্রিম আবেগী। এই মেয়ে এতগুলো দিন একটা ছেলের সাথে ছিল কিন্তু মেয়েটার ভাবভঙ্গি কতটা শান্ত, যেন কিছুই হয়নি!”

আমেনা খানম কিছুটা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। তিনি বললেন,
“আরহান ওকে স্বাভাবিক করেছে।”
“এতোটা স্বাভাবিক! এইসব কি*ডন্যা-পিংয়ের ট্রমা অনেকদিন থাকে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এটা কি*ডন্যা*পিং না!”

আমেনা খানম সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন। আলো খান মায়ের এভাবে তাকানো দেখে বলেন,
“আই মিন, আমি জাস্ট বলছি। সত্য মিথ্যা জানি না। প্রায় ২০ দিনের মতো সে নিখোঁজ ছিল। কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। শেষে যখন খোঁজ পাওয়া গেল তখন দেখা গেল তার হবু বরের বেস্টফ্রেন্ড তাকে কি*ডন্যা*প করেছে। হয় মেয়েটার স্বেচ্ছায় গিয়েছে! আর স্বেচ্ছায় না গেলেও এতদিন একটা ছেলের সাথে….! ”

“কী বলতে চাইছ তুমি?”

মায়ের প্রশ্নে আলো খান প্রসঙ্গ বদলানোর ইচ্ছা পোষণ করলেন,
“বাদ দিন মা। আমি জাস্ট আমার সাইট থেকে বললাম। সত্য-মিথ্যা আমিও জানিনা, আপনিও জানেন না। কারণ এখানে শুধু আমরা এক পক্ষের বলাটাই শুনছি, অপরপক্ষের ব্যাপারে জানিনা। আমার কথা আপনি মনে নিবেন না।”

আমেনা খান ও মেঘে আর কিছু বললেন না তিনি চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

জাহানারা শেখ এসে আরহানের হাত ধরে আবেগময় কণ্ঠে বলেন,
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার মেয়েটাকে সুস্থভাবে খুঁজে আনার জন্য। ওকে নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই কিন্তু তোমাকে পেয়ে সেই চিন্তা কিছুটা হলেও কমেছে।”

আরহানও জাহানারা শেখের ধরে বলে,
“আমি ওকে ভালোবাসি আন্টি। নিজের ভালোবাসাকে আগলে রাখতে আমি সবকিছু করতে পারি। ওকে সব শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করাও আমার দায়িত্ব। একবার গাফিলতির কারণে যা হওয়ার হয়েছে। ভবিষ্যতে আর আমি এরকম গাফিলতি করব না। ওকে শীঘ্রই আমি নিজের কাছে নিয়ে আসব।”

রিহা মুচকি হেসে রুহানী গালে হাত দিয়ে আরহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“তা তো নেবেই। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি না। আমি আমার বোনের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে তো নেই। ছোটো থেকে ওকে শুধু নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ও হিং*সার চোখেই দেখে গিয়েছি। এখন আমার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। কিছু কোয়ালিটি টাইম তো নিজের বোনের সাথে কাটাতেই পারি।”

“হ্যাঁ অবশ্যই পারো। একদিক দিয়ে চিন্তা করলে রুহানীকে কিন্তু আজ আমি তোমার কারনেই পেয়েছি। তুমি যদি সেদিন নিজে বিয়েটা না করতে, তাহলে আজ হয়তো আমি ওকে পেতাম না। তাই তোমার এইটুকু আবদার আমি রাখতেই পারি। কিন্তু খুব বেশিদিন সময় কিন্তু দেবো না।”

আরহানের কথা শুনে রিহা সহ বাকিরাও হেসে উঠলো। রহমত শেখ বলেন,
“বেশ লম্বা জার্নি হয়েছে। অনেক ধকল গিয়েছে। এখন বাড়ি গিয়ে রেস্ট করবে। আমরাও তবে রুহানীকে নিয়ে বাড়ি যাই।”

সবাইকে বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠল। আরহান রুহানীর কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আজ থেকে তোমার একা বাহিরে যাওয়া নিষেধ। আমি তোমাকে কলেজের জন্য নিতে আসবো ও বাড়ি পৌঁছে দিব। যেসব দিন আমি কলেজে যাব না সেসব দিন কেউ না কেউ তোমার সাথে যাবে। আমি আর রিস্ক নিব না।”

রুহানী চো*রা দৃষ্টিতে আরহানের চোখের দিকে তাকায়। সেই চোখে যেন তাকে সাবধান করছে, ‘রুহানী আজ থেকে তুমি আমাকে না বলে কোথাও যাবে না।’ রুহানী চুপচাপ মেনে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
“একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারো না! সেই তো রুহানী উড়াল দিয়ে চলে গেল।”
রাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি কি করবো চাচ্চু, আমি তো বুঝতে পারিনি রুহানী এভাবে চালাকি করবে। ওকে তো প্রতিদিন খাবারের সাথে ড্রা***গ দিয়ে বেশিরভাগ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো।”

টেলিফোনের অপর পাশে ঢাকা রাফাতের চাচা রেগে গেলেন। তিনি রাফাতের নির্বুদ্ধিতা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“তুমি বারবার ভুলে যাও, রুহানী কিন্তু মোটেও জন্মগত বোবা নয়। এক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সে তার কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। কিন্তু যেকোনো সময় তার জবান ফিরে আসতে পারে। তুমি ওকে হাত-পা খোলা অবস্থায়, মুক্ত অবস্থায় একটা ঘরের মধ্যে শুধু বন্দী করে রেখেছিলে। ও কার মেয়ে জানো তো? হাসনেয়ারার মেয়ে ও। যার জন্য তোমার বাবা তোমার মাকে দিনের পর দিন অবহেলা করে, কষ্ট দিয়ে দিয়েছে তারপর সেই হাসনেয়ারার জন্য নিজেকে ও তোমার মাকে শেষ করেছে। তোমাদের দুই ভাই-বোনকে এতিম করেছে। এখন সেই হাসনেয়ারার মেয়ে তোমার বোনের জীবনটা!”

পুরনো স্মৃতি মনে করানোতে চোখের পর্দায় ভেসে উঠে সেই ভয়ংকর স্মৃতি। পরক্ষনেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। রাগ ও দুঃখ দুটোই এখন তার মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় ধপ ধপ করছে। রাফাত হিংস্রাত্নক স্বরে বলে,
“কিচ্ছু ভুলিনি আমি। চাইলেও ভুলতে পারবো না। আমার মায়ের প্রতিটা কান্না, কাকুতি-মিনতি কিছুই আমি ভুলতে পারব না। নিজের মাকে বাঁচাতে পারিনি, কারণ তখন ছোটো ছিলাম। বাবা নামক মানুষটার উপর কিছু বলার সাহস ছিল না। কিন্তু নিজের বোনকে রক্ষা করতে, ওকে বোনকে সুখে রাখতে আমি সবকিছু করতে পারব। এতে যদি আমায়ও ওই মানুষটার মতো হতে হয় তো হবো।”

রাফাতের চাচা বাঁকা হাসলেন। তিনি নিজের ভাতিজাকে বাহবা দিয়ে বললেন,
“যা লাগে করো। আমি সব সময় তোমার পাশে আছি। আপাতত কিছুদিন যেখানে আছো সেখানেই থাকো। নিজের ফোন অন করবে না। যোগাযোগ করতে হলে আজ যেভাবে করলে সেভাবেই করবে। ওই দিকটায় আমি খেয়াল রাখব।”

“ঠিক আছে।”

রাফাত টেলিফোন রেখে, বিল মিটিয়ে চাদরে মুখ ঢেকে টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়ে যায়।

________

রাতের নির্জন প্রহরে খোলা টেরেসে একাকী বসে আছে রুহানী। কিছুক্ষণ আগেই আরহানের সাথে মেসেজে বাক্য আদান-প্রদান করে ঘুম পাচ্ছে বলে অফলাইন হয়েছে। কিন্তু তার নেত্রদ্বয় রক্তিম হয়ে জ্বা*লাপো*ড়া করলেও নিদ্রাকন্যারা যে ধরা দিচ্ছে না! তিন-চার দিন যাবত তার সাথে এটাই হচ্ছে। মাথাব্যথার জন্য জোড় করে ঘুমাতে হচ্ছে। আজ তার মোটেও জোড় করতে ইচ্ছে করছে না। বসে বসে আরহানের বলা কথাগুলো ভাবছে। আরহান বলেছে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু রুহানী যে এখনই বিয়েটা করতে চাচ্ছে না। অন্তত সাফা সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত। সাফার সাথে হওয়া সবকিছু নিয়তি হলেও কিছুটা কষ্ট তো তার কারণেও পেয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু সময় বসে থাকার পর হঠাৎ করে মাথাব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে ধরলে উঠে রুমে যায়। তারপর একটা পেইনকি*লার ও হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আরহানের। আজ বেশ বেলা করেই ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে সকাল সাড়ে আটটা বাজে। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে যায় সে। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে রুহানীর নাম্বারে কল করে কিন্তু রিসিভ হয় না। পরপর দুইবার কল করে রিসিভ না হওয়ায় ভাবল, হয়তো ফোনটা সাথে নেই। তাই ফোন রেখে তৈরি হওয়া শুরু করল।
পরিপাটি হয়ে আরহান নিচে নেমে ডাইনিং এ গিয়ে বসে দাদীকে হাঁক ছাড়ে,
“দাদী, জলদি নাস্তা আনতে বলো। নয়তো আমি নাস্তা না খেয়ে চলে যাব।”

তখন আলো খান রান্নাঘর থেকে প্লেট হাতে ডাইনিংয়ের দিকে আসতে আসতে বলেন,
“আজ ব্রেকফাস্ট আমি নিজে বানিয়েছি। সার্ভেন্টদের বলেছি দুপুরের খাবারটা দেখতে।”

আরহান উৎসাহী হয়ে বলে,
“কী বানিয়েছো ফুপি?”

“এগ স্যান্ডউইচ!”

নামটা শোনা মাত্রই আরাহানের মুখটা বিরস হয়ে যায়। এই এগ স্যান্ডউইচ তার মোটেও পছন্দ না। যদি চিকেন স্যান্ডউইচ বলতো তাও মানা যেত। সেদ্ধ ডিমও তার চেয়ে ভালো। আরহান জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে রেখে তার দাদীর দিকে তাকায়। তার দাদী চোখের ইশারায় খেয়ে নিতে বলে। এই বাধ্য হয়ে আরহান একটা এগ স্যান্ডউইচ ও জুস নিয়ে খেতে আরম্ভ করবে তখনি আলো খান বাধা দিয়ে বলেন,

“সবাই আসুক। একসাথে খাই।”
“তোমরা একসাথে খেও। আমার ক্লাস আছে আমায় যেতে হবে।”
“তোমার ক্লাস কি এখন? মা তো বলল তোমার ক্লাস দশটাতে।”
“হ্যাঁ ক্লাস দশটাতেই। আমি এখন রুহানীর বাড়িতে যাব। ওকে পিক করব। তারপর কলেজে যাব।”

রুহানীর নামটা শুনে আলো খানের মুখটা চুপসে গেল। তিনি কৃত্রিম হাসি দিয়ে আর কিছু বললেন না। আরহান দ্রুত খেয়ে উঠে গেলে আলো খান তার মায়ের কাছে এসে বলেন,

“মা, রুহানী মেয়েটার সাথে আরহানের বিয়ের ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখলে ভালো হতো না?”

আমেনা খানম কপাল কুঞ্চন করে মেয়ের পানে চেয়ে তার কথা বোঝার চেষ্টা করলেন। তিনি শুধালেন,
“কী ভেবে দেখব?”

“এটাই যে মেয়েটা কথা বলতে পারে না, তার উপর প্রায় অনেকগুলো দিন মেয়েটা একটা ছেলের সাথে ছিল। সেখানে কী হয়েছে না হয়েছে তা তো আমরা স্বচক্ষে, সরজমিনে দেখিনি। বিয়েটা তো সারা জীবনের ব্যাপার। একটু ভেবেচিন্তে দেখলে ভালো হতো।”

আমেনা খানম মুচকি হেসে মেয়েকে আশ্বস্ত করলেন,
“সেটা আরহান ও রুহানী ওরাই বুঝে নেবে। যেহেতু সারাটাজীবন ওরা দুজনই একসাথে থাকবে। ওরা নিজেদের মধ্যে বুঝ করে যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই আমরা মেনে নেব। আমরা আর কয়দিনের! আজ আছি কাল নেই।”

“এটা ঠিক যে, যারা সারা জীবন একসাথে থাকবে, সিদ্ধান্তটাও তাদের হওয়া উচিত। কিন্তু ভালো-মন্দ দেখার ব্যাপারটাও তো আমাদের। বিষয়টা আমার বলার দরকার ছিল তাই বলেছি।”

আমেনা খানম আর কোন জবাব দিলেন না। ইতোমধ্যে নাস্তার টেবিলে সবাই এসে জড়ো হয়েছে।

________

আরহান রুহানীদের বাড়ির গেইটে গাড়ি থামিয়ে রুহানীকে আরো তিনবার কল করে। কিন্তু তাতেও কোন রেসপন্স আসে না। তাই সে এবার বাধ্য হয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। কলিংবেল চাপলে জাহানারা শেখ দরজা খুলেন। দরজার বাহিরে আরহানকে দেখে জাহানারা শেখ হাস্যজ্জল কণ্ঠে বলেন,

“আরে আরহান, আসো আসো।”

আরহান ভেতরে এসে জিজ্ঞাসা করে,
“আন্টি রুহানী কোথায়? ওকে আমি অনেকবার কল করেছি, কিন্তু ও কল রিসিভ করেনি। কলেজের সময় হয়ে যাচ্ছে তো।”

“রুহানী তো ঘুম থেকেই ওঠেনি!”

“কীহ! এত সময় তো ও ঘুমায় না।”

আরহানের কন্ঠে বিস্ময়ের রেশ। জাহানারা শেখ বলেন,
“হয়তো খুব ক্লান্ত তাই। বুঝোই তো, কত বড়ো ধকল গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। আজ না হয় রেস্ট করুক। কাল থেকে যাবে।”

আরহান ব্যাপারটা ভেবে সায় দেয়। তারপর বলে,
“আচ্ছা আন্টি, তবে ওকে এখন ঘুম থেকে উঠিয়ে নাস্তা করিয়ে নিন। তারপর আবার নাহয় রেস্ট করুক।”

“হ্যাঁ সেই জন্যই যাচ্ছিলাম। তুমি বসো আমি রুহানীকে ডেকে দিচ্ছি।”

“না আন্টি আমার যেতে হবে। আমি কলেজ শেষে দেখা করে যাব।”

“হ্যাঁ তোমার তো ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আচ্ছা যাও তবে। দুপুরে কিন্তু এসো। এখানে খাবে।”

আরহান মাথা দুলিয়ে চলে যায়।

________

সাফার মা মিসেস শাহানা সাফার পাশে বসে আছেন। তিনি এক ধ্যানে মেয়ের পান্ডুর মুখশ্রী দেখে চলেছেন। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে তার ঘোর কাটে। তিনি কাজের মেয়েকে ডেকে বলেন,

“দেখ তো রিতা, কে এসেছে?”

কাজের মেয়ে রিতা দরজা খুলে দেখে এক অপরিচিত লোক। রিতা মিসেস শাহানাকে ডাক দিয়ে বলে,
“আম্মা, কে যেন আইছে? আমি চিনি না।”

রিতার কথা শুনে মিসেস শাহানা ভাবুক হলেন। হঠাৎ অপরিচিত কে আসবে! তিনি উঠে সদর দরজার কাছে গেলেন। অতঃপর বাহিরে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে অবাক হয়ে বলেন,

“রঞ্জু ভাই যে। এত বছর পর? আসেন ভাই ভিতরে আসেন।”

লোকটা ভেতরে এসে সোফায় বসে। তারপর বলে,
“হ্যাঁ ভাবি অনেক বছর পর এলাম। হসপিটালের কাজের জন্য বছরে তিনবার কি চারবার দেশে আসা হয়। কিন্তু এক দিনের জন্য। তারপর আবার ফিরে যাই। আর আপনি তো জানেন আমার হসপিটাল আমি সামলাই না। কিন্তু এইবার হসপিটাল একটা প্রজেক্ট ধরেছে। তাই কিছুদিন দেশে আছি। তা ফয়সাল ভাই কোথায়? আর সাফা?”

সাফার কথা শুনে মিসেস শাহানা বিমর্ষ হয়ে গেলেন। তিনি বললেন,
“আপনার ভাই অফিসে গেছেন। আর সাফা!”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। অতঃপর ওড়নাতে ভিজে উঠা চোখের কোণ মুছলেন। মিস্টার রঞ্জু খন্দকার শুধালেন,
“কী সাফা?”
“সাফা কো*মাতে আছে। একটা অ্যা*ক্সিডেন্টে মেয়েটা আমার কী থেকে কী হয়ে গেল!”

মিস্টার রঞ্জু খন্দকার যেন ভীষণ অবাক হলেন। তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কীভাবে? আমি তো জানিই না।”

এরপর মিসেস শাহানা সবটা খুলে বললেন। এবার রঞ্জু খন্দকার বলেন,
“সাফার চিকিৎসার দায়িত্ব আমি নিতে চাই। ওকে লন্ডনসহ বিশ্বের যেকোন জায়গায় নিতে হয় তো নিব।”

“আপনার ভাই ওকে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার ব্যবস্থা করছে।”

“তাহলে তো ভালোই আমি সেখানকার বেস্ট ডাক্টারের সাথে কনসাল্ট করব। সাফাকে সুস্থ হতেই হবে।”

“তাই যেন হয় ভাই। দোয়া করবেন।”

“আমাকে সাফার কাছে নিয়ে চলুন ভাবী।”

মিসেস শাহানা, মিস্টার রঞ্জু খন্দকারকে নিয়ে সাফার রুমে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,