বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-০৩

0
23

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা

রাত্রি যখন ইমরোজকে বলল, “আমাদের স্পেস দরকার। উনাকে কিছু প্রশ্ন করব।”

ইপ্সিতা তখন ভেতরে ভেতরে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিল। ভেবেছিল যাক, উৎপলটা তো বাড়িতে বলার সাহসই পাচ্ছে না, এই সুযোগে রাত্রির সাথে ভাব জমিয়ে নিজেই ওদের বিষয়টা খুলে বলবে। বিয়ের রাস্তা পরিষ্কারে এবার নিজেই মাঠে নামবে। কিন্তু এখান থেকেই যে বিপত্তির সূত্রপাত হবে তা সে জানবে কীভাবে!

“স্পেস দরকার কেন? আমার সামনেই জিজ্ঞেস করুন যা করার। ওকে আপনার সাথে একলা ছাড়ব না।”

“কেন?”

“ও ছোট মানুষ। আপনার ভুলভাল প্রশ্ন ওকে বিভ্রান্ত করতে পারে?”

আঁতে ঘা লাগল রাত্রির, সে ইপ্সিতার দিকে তাকিয়ে ইমরোজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি তো ভেবেছিলাম, উনি প্রাপ্তবয়স্ক। কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য ছাড়তে ভরসা পাচ্ছেন না, আবার বিয়ে দিতে চাইছেন কেন? যেদিন মনে হবে আপনার বোনের বিয়ের বয়স হয়েছে সেদিন আসবেন।”

“বিয়ের বয়স কেন হবে না? প্রাপ্তবয়স্ক হলেও সে যথেষ্ট ভদ্র মেয়ে। বড় ভাই হিসেবে যেকোনো পরিস্থিতিতে ওকে সামলানো আমার কর্তব্য।”

“শুনুন, আপনার বোন বিয়ের আসর থেকে পালানোর প্ল্যান করা কোনো তরুণী নয়, আমিও তাকে সাহায্য করতে আসা কোনো বান্ধবী নই। যে ওকে নিয়ে ভেগে যাব, এরপর ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিয়েতে স্বাক্ষী হিসেবে কাজী অফিসে হাজির থাকব। এখানে আপনার এই অকারণে ইনসিকিউরড হবার কারণ কী?”

ইমরোজ নাছোড়বান্দা, সে বলল, “আপনি এত উদ্ভট উদাহরণ কই পেলেন?”

“আপনি যেভাবে একজন তেইশ বছরের মেয়েকে পনেরো বছরের বাচ্চা মেয়ের মতো ট্রিট করলেন, এমন উদ্ভট আচরণের সাথে খাপ খাওয়ার মতো অতটা উদ্ভট উদাহরণ টানিনি নিশ্চয়ই! এখন কিছুক্ষণের জন্য যান তো। আমি সারাদিনের জন্য সময় নিয়ে আসিনি। আমার আরও কাজ আছে।’’

ইপ্সিতা এবার মৃদু গলায় ইমরোজকে বলল, “ভাইয়া, সমস্যা নেই। আমি উনার সাথে কথা বলতে পারব।”

ইমরোজ এবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ওকে, যেতে পারি, কিন্তু আমি আগে প্রশ্নগুলো দেখতে চাই।”

“কেন?”

“কেন নয়? আমি কোন ভরসায় আপনার সাথে ওকে রেখে যাব? কী না কী প্রশ্ন করে ওর মাথায় আপনার উর্বর সব আইডিয়া ঢুকিয়ে দেবেন কে জানে? নইলে প্রশ্নগুলো দেখাতে সমস্যা কোথায়?”

এই আধা উন্মাদ লোকটার কাজ নেয়াই ভুল হয়েছে, অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে রাত্রি, সে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

“কিছু প্রশ্ন আছে, এর উত্তর ফ্যামিলির বড়দের সামনে দিতে সংকোচ হতে পারে। ও যাতে মন খুলে ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, সেজন্যই আপনার এখানে থেকে যাওয়া জরুরি। আপনার মহা উর্বর মাথায় কথাগুলো ঢুকেছে ঠিকঠাক?”

ইপ্সিতা দেখল পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে, এরা দুজন এমন সাপে-নেউলে আচরণ করছে কেন, তাও ওর বোধগম্য হচ্ছে না।

ইমরোজ ভীষণ জেদি, হয়তো সেদিন কিছু হয়েছিল, এবং ওর ভাই নির্ঘাত খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি, সেজন্য আজ এই আজগুবি কথাবার্তা বলে উস্কাতে চাইছে। ওদিকেও বা রু দ , উৎপলের কাছ থেকে রাত্রির ব্যপারে সে শুনেছে। সলতেয় আগুন যেকোনো মুহূর্তে জ্বলে উঠবে দাউদাউ করে। তাই সে মধ্যস্থতায় নামতে চাইল,

“ভাইয়া, প্লিজ, তুমি কিছুক্ষণের জন্য যাও না।”

কিছু একটা ভাবল ইমরোজ, এরপর বলল, “আমি যাব বললাম তো। তবে প্রশ্নগুলো জানতে চাই।”

রাত্রি এবার একটা ফাইল থেকে একটা কাগজ বের করে এগিয়ে দিল, গজগজ করতে করতে। পরবর্তী ক্লায়েন্ট চলে আসার আগে এই ঝামেলা শেষ করতে চাইল বলে আপাতত আপত্তি করল না।

প্রশ্নগুলো পড়তে পড়তে ইমরোজের কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়ল, দৃষ্টি বিস্ফারিত হলো। এগুলো কেমন প্রশ্ন। কিছু প্রশ্ন পড়ে যত নিচের দিকে যেতে থাকল, তত ওর ভ্রু কুঁচকে যেতে থাকল,

“নিজে নাক ডাকেন? অন্যের নাক ডাকা সহ্য করতে পারেন?” নাক ডাকা কী সহ্য করার মতো জিনিস!

“মশার জন্য মশারি প্রেফার করেন?”

“বার্সেলোনা নাকি রিয়াল মাদ্রিদ? আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল?” বিয়ের সাথে এই প্রশ্নের যোগসূত্র কী সেটা ইমরোজের বোধগম্য হলো না।

“প্রেম করেন? কয়টা প্রেম করেছেন? আপনার বেটার হাফের পূর্ব প্রেম কীভাবে এক্সেপ্ট করবেন?” ফালতু প্রশ্ন।

“তরকারিতে ঝাল বেশি খান না কম?”

“শুটকি ভর্তা পছন্দ?”

“শপিং করতে পছন্দ করেন? শাড়ি গহনার প্রতি আকর্ষণ আছে? (মেয়েদের জন্য)

প্রিয় ফুল, প্রিয় খেলা, প্রিয় পারফিউম, প্রিয় পোষাক, প্রিয় লেখক সহ অসংখ্য অর্থহীন প্রশ্ন দিয়ে ভর্তি। আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। আরও কী আজব গজব প্রশ্ন আছে সেটা জানতে ইচ্ছে করল না।

বরং ইমরোজ বিরস গলায় বলল, “এসব কোনো প্রশ্ন হলো? এই ধরনের প্রশ্নের আইডিয়া যার মাথা থেকে বেরিয়েছে সে নির্ঘাৎ মূর্খ।”

রাত্রি একবার শ্বাস টেনে নিয়ে এরপর নিঃশ্বাস ছেড়ে, ইমরোজের দিকে তাকিয়ে সেই গা জ্বালানো হাসি হাসল, এরপর বলল,

“সবগুলো রিয়েল লাইফে কাজে লাগার মতো প্রশ্ন। আপনার সারাজীবন কেটেছে বিসিএস গাইডের অকেজো প্রশ্ন পড়ে আর একাডেমিক বইয়ের তৈলাক্ত বাঁশে বানরের উঠানামার মতো অবাস্তব ম্যাথের সল্যুশন শিখে। সেজন্য এই কেজো প্রশ্ন আপনার নিরেট মাথায় ঢুকছে না।”

“নিজের মূর্খতার প্রমাণ দিয়ে দিলেন এসব বলে। আপনি যেগুলো বলছেন, সেগুলো মোটেও মূল্যহীন নয়।”

“অবশ্যই মূল্যহীন। আপনি বাংলা পড়ান, আপনি উগান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম জেনে কী করবেন? তার সাথে আপনার কী কাজ? তিনি আপনার কাছ থেকে বাংলা শিখবেন? নাকি নৈশভোজ সারতে সারতে তার সাথে চর্যাপদ আর বৈষ্ণব পদাবলী নিয়ে আলোচনা করবেন?”

এবার এই মেয়ের বিদ্যার দৌড় সে বুঝতে পেরেছে, সেটাই তো স্বাভাবিক। নইলে এতকিছু থাকতে ঘটকালি করছে কেন?

“আপনার মাথায় কিচ্ছু নেই।” যেন রায় শুনিয়ে দিল সে।

রাত্রির গলা শান্ত অথচ চোখে আগ্নেয়গিরি,
“আপনার মাথায় অনেককিছু আছে, গোবর আছে বলে ঘাসও ভালো আছে মাথায়। অন্যকিছু থাকলে তৈলাক্ত বাঁশের বানরের উঠানামার সময় আর দূরত্ব নির্ণয় নিয়ে না মাথা ঘামিয়ে বাঁশের আগায় তেল কে মাখিয়েছিল আর এর প্রয়োজনীয়তাই বা কী ছিল সেটা বের করায় মন দিতেন।”

“আপনি যে চূড়ান্ত অভদ্র, এটা আপনি জানেন?”

“না জানতাম না। এখন জানিয়ে মস্ত বড় উপকার করলেন। এই উপকারের ঋণ আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।” নাটুকে গলায় বলল রাত্রি।

ওর ইচ্ছে করছে এই ছেলের ঘটকালি করতে, এমন একটা দজ্জাল মেয়ে ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিত, যে সারাজীবন মাথার ঘাম, পায়ের ঘাম একসাথে মিলেমিশে যেত। এই লোক বিয়ে করেছে কি-না জানলে উদ্যোগ নেয়া যেত। এ-র চাইতে মধুর প্রতিশোধ আর হতো না। তবে যদি বিয়ে করে ফেলে সে অন্য কথা। পরক্ষণেই মনে হলো, এমন গোবর ভর্তি মাথা, আর নাক ভর্তি ইগো, এই ব্যাটাকে বিয়ে করবে কে? এর কপালে বিয়ে নেই।

“আপনার মতো মেয়ের সাথে কথা বলতে আসাই ভুল হয়েছে। আমার চরম শত্রুরও যেন আপনার সাথে পরিচয় না হয়।”

রাত্রির ইচ্ছে করছিল, নাকে ঘুঁষি মেরে ফাটিয়ে দিতে, সে টেবিল চাপড়ে গলা চড়িয়ে বলল, “আমার মতো মেয়ে মানে?”

ইমরোজের মুখে প্রায় চলেই এসেছিল, “মাথামোটা।”

কিন্তু সে বাংলার শিক্ষক, একটা ভালো বাংলা গালি ব্যবহার করা উচিত বলে হলো। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“সহবত জ্ঞানহীন।”

“গাধারা সবসময় নিজেকে চালাক প্রাণী মনে করে, আপনার মতো। তবে একটা জায়গায় ওরা এগিয়ে আছে আপনার চাইতে। ওদের মাথায় গোবর থাকে না।”

“আপনি আমাকে অপমান করছেন।”

“আপনি আমাকে ফুল দিয়ে বরণ করেছেন বুঝি? নিজের বেলায় ষোলো আনা?”

“আপনি…..”,

“আমি চলে যাচ্ছি। আপনার ফাইল ফেরত নিয়ে যাবেন। আপনার কাজ আমি করব না।”

ইপ্সিতা এবার কথা বলে উঠল, বাড়িতে রাত্রির কথায় বাবা মা গুরুত্ব দেন, একে পটাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এখন যা হচ্ছে,

“ভাইয়া, প্লিজ, কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের মতো করছ কেন? আপু, আপনি বসুন প্লিজ। আমি কথা বলছি।”

কথাটা রাত্রির কানেও গেল, ওর মনে হলো, ভাইয়ের মাথায় গোবর ভর্তি থাকলেও, বোনটা একেবারে নিরেট নয়।

নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে গলায় অবিশ্বাস নিয়ে ইমরোজ বলল, “ইপ্সি,…..”

ওর হাত ধরে ইপ্সিতা বলল, “এমন করছ কেন ভাইয়া?”

“আচ্ছা যাচ্ছি।”

যাবার সময় ইচ্ছে করে গ্লাসের পানির কিছুটা রাত্রির দিকে ঢেলে দেবার প্রচেষ্টা করেছিল, কিন্তু গ্লাস উল্টে পানি গড়িয়ে ওর নিজের দিকেই এলো, ফলে নিজেই ভিজে গেল। যেটা ওকে আরও তাতিয়ে দিল ভেতরে ভেতরে।

ইপ্সিতা সবটাই বুঝল। ভাইকে সে চেনে ভালো করে। রাত্রির প্রতি যে ওর মনে আকাশ প্রমাণ রাগ হয়েছে, এটা স্পষ্ট।

রাত্রির সাথে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেও খুব প্রফেশনাল আচরণ করতে শুরু করেছিল বলে সে আর ওদের কথা বলতে পারেনি। প্রশ্নোত্তর পর্বের মুড তৈরি হয়নি আর। রাত্রি বলেছে,

“আপনার বা আপনার বাসার অন্যকারো নম্বর দিন। আপনার ভাইয়ের সাথে আমি জীবনেও কথা বলতে চাই না। আজকের এপয়েনমেন্ট আমি অন্যদিন ফিক্স করতে চাই।”

ইমরোজের কথা না বললেই নয়, সারা রাস্তা রাত্রির চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতে করতে এসেছে।

***
ইপ্সিতা বাসায় এসে দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকেই উৎপলকে কল দিল। রেস্টুরেন্টের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।

উৎপল প্রায় ধরা গলায় বলল, “এখন কী হবে?”

“কী হবে মানে?”

“রাত্রি নির্ঘাৎ তোমার পেছনে ওর গোয়েন্দা লাগিয়েছে। কী হবে বুঝতে পারছ?”

“ভালোই হবে। অন্তত তোমার তো লজ্জাবতী লতার মতো অবস্থা। বলতে তো কিছুই পারবে না। এভাবেই অন্তত জানুক।”

“জানলে কী হবে বুঝতে পারছ?”

এবার ইপ্সিতার কপালেও চিন্তার ভাঁজ, ইমরোজ একশভাগ বেঁকে বসবে। কী হবে?

সারারাত ধরে চিন্তা করে একটা সমাধান ইপ্সিতার মাথায় এলো।

উৎপলকে বলল, “উৎপল, লাঠি না ভেঙে সাপ মারার বুদ্ধি পেয়েছি।”

“কী?”

“ওদের সেটিং করিয়ে দিতে হবে।”

অফিসের জন্য তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছিল উৎপল, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়, প্রতিদিন দৌড়ের উপরে তৈরি হয়। কাঁধ আর কান দিয়ে মুঠোফোন ব্যালেন্স করে মোজা পরছিল সে কথা বলতে বলতে, ইপ্সিতার কথা শুনে ওর ফোন পড়ে যাচ্ছিল প্রায়,

“ভাইয়া আর রাত্রির প্রেম বা বিয়ে করিয়ে দিতে হবে।”

হাত দিয়ে ধরে আবার কানে রাখল,
“কীহ্!”

“এছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় নেই।”

দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজনবোধ করল দুজনেই।

সমাধান তো একটা পাওয়া গেল, কিন্তু দুটো বড় প্রশ্ন থেকেই গেল।

বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধলেই নিষ্কৃতি মিলবে সেটা তো নিশ্চিত। প্রশ্ন হলো, ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? আরও বড় প্রশ্ন হলো, বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার উপায়টা কী! বহুত কলকাঠি নাড়তে হবে।
…………
(ক্রমশ)