বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-০৫

0
24

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৫)
নুসরাত জাহান লিজা

বিছানায় শুয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তায় ডুবে ছিল উৎপল। দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে সম্বিৎ ফিরল ওর,

“ভাইয়া, আসব?”

উৎপল উঠে বসতে বসতে বলল, “আরে, আয় আয়।”

রাত্রি এসে আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “অসময়ে শুয়ে আছো যে?”

“এমনি, মাথাটা একটু ধরেছে রে।”

“তুমি শোও, আমি বিলি কেটে দিই।”

উৎপল বালিশে মাথা রাখল, রাত্রি ভীষণ যত্ন করে চুলে বিলি কাটতে শুরু করল, চোখ বুঁজে আসছিল ওর।

“হ্যাঁ রে, তোর বিবাহ ডটকম কেমন চলছে? এখন তোকে বাসায় তেমন পাওয়াই যায় না।”

“চলছে বেশ। হাজারটা ঝামেলা সামলাতে হয়। খাটতে হচ্ছে বেশি। তবে আমি এনজয় করছি ভীষণ।”

“শুধু অন্যের বিয়ে দিচ্ছিস, ঘরে যে আমরা দুজন আছি, তাদের গতি কী হবে?”

রাত্রির হাত থেমে গেল, সে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মেলে ভাইকে দেখল, যেন ওর ভেতরের কথা পড়ে নিচ্ছে।

“কী ব্যাপার ভাইয়া? কাহিনী কী ঝেড়ে কাশো তো?”

“কী ঝেড়ে কাশব?”

“হঠাৎ বিয়ের জন্য উতলা হয়েছ?”

“শুধু আমার কথা বললাম নাকি? তুই বিয়ে করবি না?”

“কথা ঘুরাবে না তো। বলো…”

“সত্যি তোর কথা বলছিলাম। বড় ভাই হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না!”

উঠে বসে বলল উৎপল, উত্তরে রাত্রি বলল, “বড়রা যখন নিজের বিয়ের কথা বলতে সংকোচ বোধ করে, তখন ছোটদের বিয়ের কথা বলে মনে করিয়ে দিতে চায় যে তার এখন বিয়ে করা দরকার।”

“তুই সবজান্তা সমশের?”

রাত্রি হেসে বলল, “উহু, সবজান্তা রাত্রি। আমার চকলেট কই?”

উৎপল বলল, “তোর মান্থলি ইনকাম আমার স্যালারির চাইতে কয়েকগুণ বেশি। তাও আমার কাছে প্রতিদিন চকলেটের আবদার করিস।”

“অভ্যাস হয়ে গেছে। কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করতে ইচ্ছে করে না। বড় হয়ে গেলেও ছেলেবেলা গায়ে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে।”

উৎপলের মুখে হাসি ফুটল, তার বোনটা বদলায়নি, একটু জেদি, কিন্তু ভেতরে এখনো একটা শিশু বাস করে। সে রাত্রির মাথায় হাত রেখে বলল,

“টেবিলে আছে।”

“তোমার কাউকে পছন্দ হলে প্রপোজ করার আগে তাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার কথা ছিল তোমার। মনে আছে তো?”

উৎপলের হাসি মুখে একটা চিন্তার ছায়া পড়ল, ইপ্সিতার সাথে ওর সম্পর্কটা হয়েছে আচমকা। ওরা কেউ কাউকে প্রপোজও করেনি। কীভাবে কীভাবে যেন দুজনেই বুঝতে পেরেছে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের দুর্বলতা। যখন অনুধাবন করেছে, ততদিনে ইপ্সিতাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। তখন রাত্রির সাথে দেখা করালে ওদিক থেকে যদি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসে, সে সহ্য করতে পারত না। সেজন্য রাত্রিকে বলার সুযোগ পায়নি।

উৎপল কোনোরকমে বলল, “হুম।”

রাত্রি চকলেট নিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে আরেকবার উৎপলের দিকে তাকিয়ে যেন ওকে পড়তে চেষ্টা করল, এরপর বেরিয়ে গেল।

মা সত্যি সত্যিই বড় খালামনির সাথে চলে গেছেন, তবে রাগ করে নয়, উৎপলের জন্য মেয়ে দেখতে। বড় খালামনির দুঃসম্পর্কের ননদের মেয়ে।

সে জাহিদকে কল দিল, “জাহিদ ভাই, কী খবর?”

“ভালো। তোর কী খবর?”

“আমার আর খবর। শোনো, ইপ্সিতা নামের যে ক্লায়েন্টের ফাইল আছে, ওখানে ওর ভাইয়ের ভিজিটিং কার্ড আছে। উনার খোঁজখবর নিও তো?”

“পাত্রী রেখে ওর ভাই নিয়ে পড়লি যে হঠাৎ?”

“দরকার আছে। উনাকে আমার সুবিধার মানুষ মনে হয় না। কাজ গুছিয়ে নেবার পরে বাগড়া দিতে পারে। তাই নজর রাখা দরকার। ভেজাল লাগানোর ওস্তাদ ব্যাটা।”

“ঠিক আছে।”

“আরেকজনের বিষয়ে জানতে হবে।”

“কে?”

“ভাইয়া।”

“কীহ্! কেন?”

“ওর আচার আচরণে ঘাপলা আছে মনে হচ্ছে। আর শোনো, একদম বন্ধু বন্ধু করে আমার কাছে গোপন করবে না কিন্তু।”

জাহিদ ভাবছে, এটা জানলে উৎপলের মুখটা কেমন হবে! মজাই লাগছে ভাবতে। সে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

“তুই উৎপলকে সন্দেহ করিস?”

“ভালোর জন্য করতে হয়। বুঝলে?”

***
আজ ইপ্সিতা রাত্রির সাথে দেখা করতে এসেছে মাকে নিয়ে। সেদিন ওর নিজের নম্বরটাই দিয়ে গিয়েছিল।

মা প্রথমে আসতে চাইছিলেন না, ইমরোজকে নিয়ে যেতে বলছিলেন। অগত্যা সেদিনে রেস্টুরেন্টের ঘটনা খুলে বলতে হয়েছে। সব শুনে মা হতাশ গলায় বললেন,

“ইমুকে নিয়ে আর পারি না। এর গতি কী হবে সেটাই ভাবি।”

ইপ্সিতা কিছু একটা ভাবছে এমন একটা ভঙ্গি করে বলল, “মা, আমার কিন্তু মেয়েটাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”

ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তিনি বললেন, “তাই নাকি? তাহলে তো যেতেই হয়।”

রাত্রী আনোয়ারাকে দেখে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল।

“কেমন আছো?”

“ভালো। আপনি কেমন আছেন ম্যাম?”

“ওমা, আন্টি ডেকো আমাকে।”

“আপনি আমাকে বোধহয় চিনতে পারেননি ম্যাম, আমি আপনার স্কুলে পড়তাম।”

তিনি একটা বেসরকারি হাই স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। দুই বছর ধরে অবসর নিয়েছেন। এবার ভালোমতো তাকিয়ে চিনতে পারলেন। অনেক স্টুডেন্ট ছিল তার। সবাইকে মনেও থাকে না। তবে রাত্রির মুখটা মনে আছে, ভীষণ দুষ্টু আর বুদ্ধিমতী ছিল। কিছু শিক্ষার্থী থাকে যারা পুরো ক্লাস মাতিয়ে রাখে, রাত্রি তেমনই ছিল। এক দেখায় ছেলের জন্য ওকে পছন্দ হয়ে গেল আনোয়ারার।

“তোমার মুখটা মনে আছে। তুমি বুঝি বিবাহ ডটকম চালাও? বেশ ইউনিক আইডিয়া।”

ওদিকে রাত্রি ভাবছে, এমন হাসিখুশি একজন মজার মানুষের ছেলে কী করে ওমন রামগরুড়ের ছানা হতে পারে। রসকষহীন, কাঠখোট্টা, মাথামোটা!

“ধন্যবাদ ম্যাম। দোয়া করবেন।”

“অবশ্যই মা।”

সেদিন রাত্রি ইপ্সিতাকে একটা ফরম দিয়ে দিয়েছিল প্রশ্নের। সেখানে ওর উত্তর লিখে এনেছে। কিছু মিথ্যে কথা লিখতে হয়েছে ওকে নিজেদের ভালোর জন্য।

আনোয়ারা ভাবছেন রাত্রিকে কিছু প্রশ্ন করবেন, কিন্তু প্রথম দিনই এসব প্রশ্ন করা ঠিক হবে না ভেবে আপাতত অন্য প্রসঙ্গে কথা বললেন।

“তোমার বাসায় কে কে আছে?”

“মা, বাবা আর ভাইয়া।”

“বাহ্! তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?”

“ভালো আছে।”

“রাত্রি, আমার ছেলের কথায় কিছু মনে কোরো না। ও কিন্তু খুব ভালো মানুষ। একবার যারা ওর সাথে মিশে যায়, তারা বুঝতে পারে।”

“প্লিজ ম্যাম, আপনি একদম এসব বলবেন না। উনার জন্য আপনি এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না। যেটা হয়েছে সেটা একেবারেই উনার আর আমার মধ্যে হয়েছে। এরজন্য আপনি বা ইপ্সিতা চিন্তিত হবেন না।”

“তবুও মা তো। চিন্তা হয়। ওদিকে গো ধরেছে, এখনই বিয়ে করবে না। বুড়ো হলে বিয়ে করবে বলো তো? যেখানে যাই, বলে ইমরোজ বিয়ে করেছে? এত ভালো ভালো প্রস্তাব আসত, ও রাজিই হতো না। এখন নিজেকে পুত্র দায়গ্রস্ত মা মনে হয়।”

ইপ্সিতা দেখল, মা ওদের টোপ গিলে খেলতে শুরু করেছেন ওদের হয়ে। বেশ নাটুকে একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এটাই সে চায়। তুলনামূলকভাবে রাত্রি আজ অনেক শান্ত। হয়তো শিক্ষক সামনে বলে।

রাত্রির মনে হচ্ছে, এই সুযোগ। ওই ছেলের ঘাড়ে যদি একটা ক্ষ্যাপা মোষ ঝুলিয়ে দেয়া যায়!

“ম্যাম, আপনি একদম ভাবনে না। বিবাহ ডটকম আছে তো! আপনি কেমন মেয়ে চান বলবেন। আমরা থাকতে কোনো পুত্র দায় কন্যা দায় গ্রস্ততা কিচ্ছু থাকবে না। এটা আমাদের প্রতিষ্ঠানের মটো।”

“হ্যাঁ মা। এখন এটাই ভরসা। আগে ইপ্সির বিয়েটা দিয়ে দাও। পরে ওর ব্যবস্থাও করব।”

***
বাসায় ফিরে আনোয়ারা ইপ্সিতাকে বললেন, “ইমুর সাথে ওকে খুব মানাবে। কিন্তু আমার কেমন যেন লাগছে। ইমু কথায় কথায় রেগে যায়। সেদিনের ঘটনা শুনে মনে হলো, রাত্রিও ছেড়ে কথা বলবে না। ওরা কি একজন আরেকজনের জন্য ঠিক হবে?”

মা টোপ গিলেছেন ঠিকই, আবার দ্বিধাও আছে। সে আরেকটু ধাক্কা দেবার জন্য বলল, “মা, এটাই তো ভালো। শান্ত নিরীহ ধরনের মেয়ে ভাইয়ার রাগের কাছে পাত্তাই পাবে না। তোমাকে ছাড়া তো কাউকে ভয় টয় পায় না। এরকম কাউকেই দরকার। যেমন রোগ তেমন ওঝা দরকার, তাই না? নইলে রোগ সারবে কীভাবে?”

“এটা ঠিক বলেছিস।”

“ভাইয়াকে রাজি করাও মা। এমন পারফেক্ট ম্যাচ আর কই পাবে? সারাজীবনের জন্য পুত্র দায়গ্রস্ত মা হয়ে থাকতে চাও? এই সুযোগ এটা কাটানোর।”

“কিন্তু রাত্রি, ওর পরিবার? ওরা রাজি হবে কেন?”

“ও তোমার স্টুডেন্ট ছিল মা। এখন তো তোমার জন্য সহজ হবে ওদের এপ্রোচ করা। আমরা একটা উপায় বের করে ফেলব।”

এবার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, “ইমু রাজি হবে না ওর ঘাড় রাজি হবে। ছ্যাঁকা না খেয়েও দেবদাস হবার ভূত ওর মাথা থেকে হটাচ্ছি।”

ইপ্সিতা আশান্বিত হয়ে নিজের ঘরে এসে উৎপলকে লিখল, “মিশন বিবাহ- প্রথম ধাপ- সাক্সেসফুল”

ওদিকে ইমরোজের পেছনে যে ষড়যন্ত্রের জাল রচিত হচ্ছে, তার সবথেকে আপন মানুষরাই তাতে জড়িত, এটা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। সে আছে আপন জগতে, নিজের খেয়ালে।
………
ক্রমশ