বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-০৭

0
29

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা

ইমরোজ ওর এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে রেস্টুরেন্টে এসেছিল। সৌম্য দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল, কিছুদিন হলো ফিরেছে। ইউনিভার্সিটি লাইফের নানান স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে একসময় সৌম্য বলল,

“আমি থাকতে থাকতে বিয়ে করে ফেল। তাহলে তোর বিয়ে খেতে পারব।”

সেদিন মা রাত্রির সাথে ওর বিয়ের কথা বলার পর থেকেই সে বিয়ে শব্দটা শুনলেই আতঙ্ক অনুভব করছে। ওর রথি নামের একজন মেয়ের সাথে প্রায় দেড় বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। প্রথমদিকে সব ভালোই মনে হচ্ছিল, এক পর্যায়ে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিল।

অনেক রাতে যখন সে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ দেখত, তখন কল দিয়ে কথা বলতে চাইত। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথাও নয় সেসব। নতুন কী কসমেটিকস কিনেছে, সকালে, দুপুরে রাতে কী খেয়েছে, আগামীকালের প্ল্যান কী, কোন বলিউড নায়িকার কোন নায়কের সাথে এ্যাফেয়ার, কার ডিভোর্স হলো এসব অর্থহীন আলাপ।

ওর দিকে কোন মেয়ে কতবার তাকিয়েছে সেটা নিয়েও ঝগড়া করেছে, অন্য কেউ যদি ওর দিকে তাকায় এতে তার দোষ কোথায়! সে কী কারোর চোখে পট্টি বেঁধে রেখে দিয়ে আসবে না-কি!

শপিং করতে গেলে ওকে সাথে নিয়ে যেত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত একটা জিনিস পছন্দ করতে।

ওদের দেখা করার কথা থাকলে অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যেত, কিছু বললে শুনত, “মেয়েদের রেডি হতে একটু সময় লাগেই।”

অথচ নিজের অপেক্ষা করতে হলে সেদিন ঠিকই জবাবদিহিতার মধ্যে যেতে হতো।

ইমরোজের মেজাজও ঠিক থাকত না, শেষের দিকে খুঁটিনাটি জিনিস নিয়েও বনিবনা হচ্ছিল না। ব্রেকআপ করল।

ইমরোজ যখন টেনে পড়ে তখন ওর বাবা চলে যান, ইপ্সিতা তখন আরও অনেক ছোট। ওর মা নানান ঝড়-ঝাপটা সামলে ওদের দুই ভাইবোনকে বড় করেছেন, ওদের সমস্ত চাহিদা মিটিয়েছেন। স্বামীকে অকালে হারিয়ে তিনি ভীষণ একা হয়ে পড়েছিলেন। ছেলে-মেয়েকে আঁকড়ে ধরেছেন। সেজন্য কিছুটা ওভারপ্রোটেক্টিভ আচরণ করেন তাদের প্রতি।

ইমরোজ সেজন্য মায়ের সমস্ত আবদার মেনে নেয় হাসিমুখে। নিজের অনিচ্ছা থাকলেও সে মাকে নিষেধ করতে পারে না। ছেলেবেলায় মা যেমন ওর সমস্ত দুষ্টুমি হাসিমুখে সামলেছেন, সে-ও তাই করে। তখন তো মা’য়েরও কষ্ট হতো। কিন্তু তিনি তো ছোট্ট ইমরোজকে এড়িয়ে যাননি। পরম মমতার ছায়া দিয়ে বটবৃক্ষের মতো আগলে রেখেছেন।

মা বেশিরভাগ সময়ই ভীষণ মেলোড্রামা করেন, আবার ইপ্সিতার মধ্যেও ছেলেমানুষি আছে প্রচুর। মা আর বোনকে সে ভীষণ ভালোবাসে বলে সবটা সহ্য করে নেয়। সে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছে মেয়ে মানেই নাটুকে, মেলোড্রামাটিক স্বভাবের হয়। ছোট বিষয়ে অকারণ হুলস্থূল বাঁধায়, অবাস্তব বুদ্ধির হয়। সেই ভয়ে সে মহিলা কলিগদের সাথে পর্যন্ত সৌজন্য ব্যাতিত অন্য কথা বলে না৷

আরেকজন মেয়েকে জীবনে এনে নিজেকে বরবাদ করার কোনো মানেই হয় না৷

“বিয়ে? তুই তো সব জানিস। তবুও কেন বলিস?”

“তুই কয়জন মেয়েকে চিনিস?”

“যতজন চিনেছি, এনাফ।”

“চোখ কান বন্ধ রেখে চললে এমনই হয়।”

“হলে হোক। বিয়ে করে পস্তাতে পারব না।”

বন্ধুর সাথে কথা শেষ করে বেরিয়ে এসেছিল, হঠাৎ রাত্রিকে দেখল শশব্যস্ত ভাবে এদিকেই আসছে। ওর স্বপ্নের কথা মনে পড়ল, অবচেতনেই গলায় হাত চলে গেল। এরপর পাশ কাটাতেই চাইছিল, কিন্তু রাত্রি ওকে দেখে ফেলেছে,

“আরে, আপনি?”

“হ্যাঁ। এত অবাক হবার কী আছে?”

রাত্রি এবার সরাসরি ইমরোজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে কী ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য ডিক্লেয়ার করেছে নাকি? এতকিছু থাকতে আপনাকে দেখে আশ্চর্য হতে যাব কোন দুঃখে?”

এই মেয়ের সাথে কথা বলাই ভুল হয়েছে, “আপনি সবসময় এভাবে কথা বলেন কেন?”

“কীভাবে কথা বলি?”

“আপনি ভীষণ ঝগড়াটে।”

“আমি কার সাথে কীভাবে কথা বলি সেটা ডিপেন্ড করে সামনের মানুষটার উপরে। টিট ফর ট্যাট নীতিতে বিশ্বাসী আমি।”

“আপনি তো নীতির ট্যাবলেট গুলে খেয়েছেন। কথায় কথায় সেসব চুয়ে চুয়ে পড়ে। নিউটনের থার্ড ল’, এখন আবার এটা।”

রাত্রি ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে হেসে বলল, “আপনাকে আরও কিছু নীতি শেখাতাম, বুকিশ নয়, বাস্তব জীবনের। কিন্তু আজ সময় নেই।”

“অসহ্য।”

রাত্রি হাঁটা শুরু করে আবার ঘুরে তাকিয়ে এগিয়ে এসে বলল, “একটা ফ্রি উপদেশ দিই, উপদেশটা বিনামূল্যের হলেও উপাদেয়। এত দাঁতে দাঁত চাপবেন না। বেচারা দাঁতের কী দোষ বলুন! এত প্রেসার নিতে না পেরে একটা দুটো টপাক করে খুলে পড়তে পারে, বেচারা ছোট্ট দাঁতকে এত প্রেসার দেবেন না, ফোকলা হয়ে যাবেন, তখন বিয়ে হবে না।”

ইমরোজের মনে হলো এই মেয়েকে খু ন করতে পারলে শান্তি পেত, “বিয়ে করার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না। আমার বিয়ে নিয়ে আপনাকে নাক গলাতে হবে না। অন্যের পার্সোনাল ব্যাপারে কথা বলা অভদ্রতা, সেটা শেখেননি?”

“কী করব বলুন, আমার কাজটাই বিয়ে নিয়ে। মানুষ যদি আপনার মতো বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তো আমার ব্যবসা লাটে উঠব। ভেতরে ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করছে। আসি। উপকারের জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে না। আমার দয়ার শরীর।”

বলেই ভেতরে চলে গেল রাত্রি, ইমরোজ রাগে গজগজ করছে। এই মেয়ের সাথে সে কেন কথায় পারে না! এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না সে।

প্রবল রাগে আবারও দাঁতে দাঁত চেপে সাথে সাথে স্বাভাবিক করে নিল নিজেকে। রিস্ক নেবার দরকার নেই, এই বয়সে দাঁত যদি সত্যি সত্যি পড়ে যায়, কেমন দেখাবে ওকে!

***
উৎপল এসেছে জাহিদের কাছে। জাহিদ বলল, “শোন দোস্ত, তোকে একটা খবর দিই।”

“বল।”

“রাত্রি আমাকে তোর উপরে চোখ রাখতে বলেছে।”

“কীহ্!” নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না উৎপল।

“হ্যাঁ। আমি ঠিক করেছি এবারের দায়িত্বটা পালন করব ঠিকঠাক।”

“তোকে সেদিনই ওয়ারফেজের কনসার্টের টিকিট কিনে দিলাম। নাচতে নাচতে গেলি। এখন বিট্রে করতে চাইছিস?”

“ওটা তো ইপ্সিতার ইনফরমেশন হেড অফিসে না দেবার জন্য। এটা আলাদা কেস দোস্ত।”

“শালা বেঈমান, তুই বন্ধু নামের শত্রু। তোর মতো একটা বন্ধু থাকলে শত্রুর দরকার পড়ে না।”

“ভাবছি সিনেমা ব্যবসায় নামব। বাহারি একটা নাম পেয়েছি, বাংলা সিনেমার একটা ফ্লেভার আছে, ‘বন্ধু যখন বেঈমান’। এই নামের কোনো মুভি কী হয়েছে, উতু?”

“আমি মরি আমার জ্বালায়, তুই আছিস সিনেমা নিয়ে? আর উতু কী?”

“ওটা ভালোবাসার ডাক।”

জাহিদের পিঠে একটা রদ্দা পড়ল, জাহিদ কঁকিয়ে উঠে পাল্টা একটা বসিয়ে দিল।

“শোন, একটা ট্রিট দে। দেখি এটা ম্যানেজ করা যায় না-কি।”

“পারব না।”

“একটা বুদ্ধি দিতাম, সেটাও বাদ তাহলে।”

“আচ্ছা, বল, ট্রিট হবে।”

“এই না হলে দোস্ত।”

“এবার কিন্তু নাক বরাবর পড়বে।” হাত উঁচিয়ে বলল উৎপল।

“শোন, আমি রাত্রিকে বলব, তোর ভাইয়ের বিয়ে তোর ক্লায়েন্টদের মধ্যে একজনের সাথে সেটিং করে দে। ইপ্সিতার ফরমে তোর পছন্দ ম্যাচ হলে রাজি হতেও পারে।”

উৎপলের মুখে হাসি ফুটে আবার মিলিয়ে গেল, ও জানে রাত্রির উত্তর কী হবে! বলবে,

“আমাদের একটা গুডউইল আছে, সেটা হ্যাম্পার করতে পারব না!”

তাছাড়া ইপ্সিতার সাথে ওর পছন্দ অপছন্দ তেমন মেলে না। তাই ইপ্সিতা না হয়ে যদি অন্যকারো সাথে ওর পছন্দের মিল পায়, আর তাকেই যদি গছিয়ে দিতে চায়!

অসংখ্য বৈপরীত্য সত্ত্বেও ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসে। ইপ্সিতাকে সে কোনোভাবেই হারাতে পারবে না।

ইমরোজের অগ্রগতি জানলে সে মাকে আরেকটু উস্কে দেবে। মিশন বিবাহ সফল হতেই হবে। নইলে ওদের বিয়ে হবে কী করে!

তবে উৎপল জাহিদকে নিষেধ করেনি। এভাবে যদি হয়!

তবে পৃথিবীর অনেক ভালো কাজের প্ল্যানই হিতে বিপরীত হয়ে যায়।
…………
(ক্রমশ)