#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ১১)
নুসরাত জাহান লিজা
রাত্রি খাবার পরে শুয়ে শুয়ে ওদের প্রচারণার জন্য একটা বিজ্ঞাপন দেবার পরিকল্পনা করছিল। আগেরবারের বিজ্ঞাপনটা একেবারেই নবিশ লোক দিয়ে করিয়েছিল, ওর নিজেরই খুব একটা পছন্দ হয়নি। এখন যেহেতু ভালো আয় হচ্ছে, বিজ্ঞাপনের জন্য একটা প্রফেশনাল এজেন্সি সে এফোর্ড করতে পারবে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রচারণা বিশাল ভূমিকা পালন করে লোকের আরও কাছাকাছি যেতে। বিবাহ ডটকম ওর অনেক স্বপ্নের একটা জায়গা, এটাকে বহুদূর নিয়ে যেতে চায় সে। এটা থেকে অল্প কিছু মানুষের কর্মসংস্থানও হচ্ছে।
মায়া এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এলেন। গরমটা এবার বড্ড বেশিই পড়েছে। রাত্রি উঠে বসল,
“তুমি আবার এখন এত কষ্ট করতে গেলে কেন মা?”
“আমার কষ্ট যেন কত বুঝিস? জীবনে আমার সাথে কাজে হাত লাগিয়েছিস কয়দিন?”
“মা, সেদিনও ঘর গোছালাম।”
“একদিন করে উদ্ধার করেছিস। এখন এটা নে, ধর।”
রাত্রি হাসল, মা সবসময়ই শাসনের ভঙ্গিতে কথা বলেন। কিন্তু তার মধ্যেও ভালোবাসাটা ঠিকই বোঝা যায়। এই যে বলেন, কাজ করিস না, কিন্তু করতে গেলেই বলেন, “যা তো। কাজের নামে আমার কাজ বাড়াতে হবে না।”
“তোর সাথে একটা কথা ছিল।”
“বলো না, মা।”
“তোর কোনো পছন্দের ছেলে আছে?”
রাত্রি ভিরমি খেল, “এসব কী বলছ মা?”
“শোন, এত সংকোচ করতে হবে না। খুলে বল, আমরা বসি, কথা বলি। মেঘে মেঘে তো কম বেলা হলো না!”
“আমার পছন্দের কেউ নেই মা।”
মায়ার কাছে মনে হলো, তার মেয়ে লজ্জা পাচ্ছে। এই ধরনের কথা মায়ের সাথে শেয়ার করতে কিছুটা লজ্জা পাওয়া স্বাভাবিক। তাই তিনি অন্যদিকে হাঁটলেন। ভাবলেন, নিজের উদ্যোগে তিনি কথা এগিয়ে নেবেন মেয়ের পছন্দের ছেলের সাথেই।
“আচ্ছা, তাহলে আমরা যদি কাউকে পছন্দ করি তোর আপত্তি আছে?”
বিয়ে করতে রাত্রির আপত্তি নেই, কিন্তু বিয়ে নিয়ে সে ভীষণ খুঁতখুঁতে। অন্যেরটা নিয়েই যতটা কনসার্ন থাকে, নিজের ক্ষেত্রে সেটা হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
“মা, তোমাদের পছন্দ নিয়ে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু আমি আর দুই বছর পরে বিয়ে করব।”
“শোন, শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভালো। আমাদের কাছে খুব ভালো একটা ছেলে আছে। কথা বলে দেখি? তাছাড়া, কথা বললেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। তাই না? সময় এমনিতেই অনেক লাগে এসব ক্ষেত্রে।”
“মা, শোনো আমি…”
“তুই আমার কথা শোন, আমি আর তোদের ধানাইপানাই শুনতে রাজি না। তোদের দুইটার বিয়ে আমি এই বছরেই দেব।”
বলে তিনি উঠে চলে গেলেন, হঠাৎ করে ঘাড়ে এটা কী নতুন আপদ এসে ভর করল! সে অবশ্য এটা নিয়ে এত মাথা ঘামালো না, বিয়ে ভাঙার অনেক টেকনিক ওর জানা আছে।
উৎপলের বায়োডাটা সে নিজে তৈরি করে শোভাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
***
আজ শুক্রবার। ইমরোজ ভেবেছিল ছুটির দিনে একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমাবে। মা ওর সাধের ঘুমের দফারফা করে হাতে বাজারের লিস্ট আর ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছেন৷
“আমাকেই যেতে হবে? চম্পাকে পাঠাও না!”
“ওর আজ ছুটি। বাজার না করলে রান্না হবে না। না খেয়ে থাকতে ইচ্ছে হলে যাস না।”
“আমি খাবার অর্ডার করি তাহলে।”
“আমার বাইরের খাবার পেটে সয় না। এ্যাসিডিটি প্রবলেম আছে, জানিস না?”
মুখ গোমড়া করে ইমরোজ বলল, “আচ্ছা, যাচ্ছি।”
আনোয়ারা ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন, “শোন, যা চাইবে, তাই দিয়ে কিনবি না কিন্তু। দরদাম করে কিনবি।”
ইমরোজ দরদামে খুব কাঁচা, দোকানী যে দাম চায়, সে তাই দিয়েই কেনে। বাসায় আসার পরে দাম শুনে মা কথা শোনান। ওকে নাকি ঠকিয়েছে।
আনোয়ারা চান ছেলেমেয়েরা আত্মনির্ভরশীল হোক। নিজের কাজগুলো নিজেই করুক৷
মেয়েটা হয়েছে কুঁড়ের রানী, ছেলেটা পরিশ্রমী, কিন্তু খুঁতখুঁতে বাতিক আছে কিছুটা৷ ঘরের কোথাও এলোমেলো থাকলে নিজেই পরিষ্কার করে, তিনি অসুস্থ থাকলে কখনো কখনো রান্নাও করে। ইমরোজের এই দিকটা ভীষণ ভালো। ইপ্সিতা কখনো রান্নাঘরে গেলেও সে সরিয়ে দেয়। বোনকে ভীষণ ভালোবাসে বলে। তবে বাজার করতে ভয় পায়।
আজ বাসায় রাত্রির মা আর বাবা আসবেন। তিনিই কল দিয়েছিলেন৷ ইপ্সিতা কোত্থেকে যেন নম্বর যোগাড় করেছে৷ তিনিও বসে থাকতে চান না৷ তার এক বান্ধবী তাকে খুব করে ধরেছে, ইমরোজকে তার মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে। কিন্তু মেয়েটাকে তার পছন্দ নয়। বড্ড নাক সিঁটকানো অভ্যাস মেয়ের। ওদিকে রাত্রিকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে৷
তাছাড়া আগে থেকেই চেনেন৷ ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হতো না মেয়েটা, তবে বিভিন্ন কার্যক্রমে সবার আগে এগিয়ে আসত। সেন্সিবল ছিল, আবার স্পষ্টভাষী। সেদিনও কথা বলার সময় এটা বুঝতে পেরেছেন। তাছাড়া তার ছেলেটা যেমন স্বভাবের, একটু শক্ত ধাতের কেউ না হলে হবে না।
সবকিছু বিবেচনা করে রাত্রিকেই সঠিক মনে হয়েছে। তারাও আসতে রাজি হয়েছেন। জুম্মার নামাজের পরে পরেই তারা রওনা দেবেন৷ দুপুরে এখানে খাবেন৷
***
বাজারের ঝক্কি সামলে বাসায় আসার পরে পরেই ওর এক বন্ধু কল দিল, তার বাসায় যেতে৷ আরও কিছু বন্ধুরা আসবে। অনেকদিন সবার সাথে দেখা হয় না। সে মসজিদে যাবার সময় একেবারে প্রস্তুতি নিয়েই বেরিয়েছে৷
সে জানতেও পারল না, এত কষ্ট করে কাদের জন্য বাজার করল!
***
আনোয়ারার সাথে কথা বলে মায়ার মনে হলো, ভদ্রমহিলা ভীষণ প্রাণখোলা মানুষ, খুব আন্তরিক। ছেলের বোনও বেশ লক্ষ্মী একটা মেয়ে। কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাদের চিনতে খুব বেশি সময় লাগে না। ভদ্রমহিলা তেমনই।
এই পরিবারে রাত্রি ভালো থাকবে।
“আপা, আমার ছেলে বলে বলছি না, ছেলে হিসেবে ইমরোজ খুব ভালো মনের মানুষ। তবে একটু দোষত্রুটি নিয়েও বলি, যদি সম্বন্ধ হয়, কিছু না লুকানোই ভালো। আপনারা যাতে সবটা বিবেচনা করতে পারেন। বিয়ের পরে রাত্রি যেখানে থাকবে, যার সাথে থাকবে, সেটা যাতে আপনারা যাচাই করে নিতে পারেন। ইমরোজ একটু রগচটা ধরনের। হুটহাট রেগে যায়, তবে হঠকারী নয়। রাগটা আবার হুটহাট পড়েও যায়।”
“আপা, আমরা তো ছেলে দেখবই। আপনাদের আন্তরিকতা আমাদের খুব ভালো লেগেছে। রাত্রিকে তো আপনি দেখেছেনই, আমি আর কী বলব!”
“আমার মনে হয়, আমাদের জমবে ভালো। কী বলেন ভাই সাহেব?”
হাবিব সাহেব হেসে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।”
ইপ্সিতা পুরো সময়টায় ভীষণ সতর্ক থেকেছে। হবু শ্বশুর শাশুড়িকে প্রথমবার সামনা-সামনি দেখছে। নিজের একটা ভালো ইম্প্রেশন তৈরি না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। উৎপল ইচ্ছে করে আসেনি। দুই মায়েরই দৃষ্টি ভীষণ তীক্ষ্ণ, কখন না জানি ধরা পড়ে যায়! এই ভয়ে আজকের এই সাক্ষাৎ সে অনুপস্থিত।
ইপ্সিতা আনাড়ি হাতে তাদের আপ্যায়নও করার চেষ্টা করেছে। আনোয়ারা মেয়ের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন খেয়াল করেছেন, যে মেয়ে নিজের খাবারই ঠিকঠাক বেড়ে নিয়ে খেতে চায় না, সেই মেয়ের এই আশ্চর্য পরিবর্তনের হেতু তার ঠিক বোধগম্য হলো না।
সামনে বিয়ে হয়ে যাবে বলে এখন থেকেই অভ্যাস করছে! কী জানি!
……….
(ক্রমশ)
গল্পটা মেলোড্রামায় ভরপুর। বিরক্ত হচ্ছেন?
(আগামীকাল আরেক পর্ব দিতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ)