#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ১২)
নুসরাত জাহান লিজা
প্রায় দুই সপ্তাহ নির্বিঘ্নেই কাটল। এরমধ্যে আনোয়ারা আর মায়ার মধ্যে আরও বেশ কয়েকবার মুঠোফোনে কথা হয়েছে। ওদিকে আনোয়ারা রাত্রির পাঠানো বায়োডাটা থেকে দুটো পছন্দ করে ফেলেছেন। শোভার বাড়ি থেকেও উৎপলের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। রাত্রি এটা নিয়ে বেশ খুশি। উৎপলকে এখনো জানানো হয়নি।
আজ সন্ধ্যায় আনোয়ারা সমুচা বানিয়েছেন। বসার ঘরে ছেলেমেয়ের সামনে পরিবেশন করে বললেন,
“বাবু, শোন, আগামীকাল বিকেলে কোনো প্রোগ্রাম রাখিস না।”
“কেন মা?”
“আমাদের সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”
ইমরোজ গরম সমুচায় কামড় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায়?”
“তোর জেরা করা দেখে মনে হচ্ছে তোকে জঙ্গলে বনবাস দিতে নিয়ে যাচ্ছি। আমি যেতে বললাম, আমাকে বিশ্বাস করিস না? আমি তোর মা না?”
“মা, তুমি সবসময় সোজা কথাকে এমন প্যাঁচাও কেন বলো তো? স্বাভাবিক একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম।”
“কারণ আমি জন্মের পর থেকে শুধু জিলাপি খেয়েছি। জিলাপির সব প্যাঁচ আমার মধ্যে ঢুকে গেছে।”
ইমরোজ আর কথা বাড়ায় না, “ঠিক আছে, যাব।”
ইপ্সিতাকে বললেন, “শোন ইপ্সি, তুই এখন অকারণে বাইরে কম যাবি। বিয়ের কণের এত ঘনঘন বাইরে যেতে হয় না। রোদে পুড়ে স্কিন নষ্ট হয়ে যাবে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ছে কেন? রাতে ঘুমাস না?”
ইপ্সিতা আঁতকে উঠে বলল, “কী বলো মা? ডার্ক সার্কেল পড়ে যাচ্ছে?” বিয়ে তো সে উৎপলকেই করবে। তবুও তো সে বিয়ের কণেই। না, না, আজ থেকে উৎপলের সাথে কথা বলা সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে হবে। বিয়ের সময় চোখের নিচে কালি পড়ে গেলে কী হবে!
“হ্যাঁ। শোন কয়দিন একটু যত্ন নে নিজের।”
ইমরোজ এসব মেয়েলী আলাপে পাত্তা দিল না, সে জানেও না, আগামীকাল ওকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
রাত্রির বাড়ি থেকে ওদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেখানে বিয়ের আলোচনাও হবে।
***
রাত্রি উৎপলের ঘরে যাচ্ছিল, ওকে শোভার বাড়ির আগ্রহের খবর দিতে। মা ওকে মাঝপথে থামালেন৷
“আমার রুমে একটু বস। তোর সাথে জরুরি কথা আছে। আমি উৎপলকে চা দিয়ে আসি।”
রাত্রি উৎপলের ঘরে না গিয়ে বাবা-মা’’র ঘরে গেল। বাবা পত্রিকায় মুখ ডুবিয়ে বসে আছেন। ওর পায়ের শব্দ পেয়ে বললেন,
“তুই তো আজকাল অমাবস্যার চাঁদ হয়ে যাচ্ছিস মা।”
“খুব ব্যস্ত থাকি বাবা। মা’র জরুরি কথাটা কী, সেটা কি তুমি জানো বাবা?”
“কিছুটা জানি। তবে বলব না। তোর মা’ই বলবে।”
“তুমি হিন্ট দাও অন্তত!”
এরমধ্যে মায়া এসে বসলেন, “শোন, রাত্রি, কাল বাসায় মেহমান আসবে।”
“কারা?”
“তোর বিয়ের ব্যাপারে বলেছিলাম না? উনারা আসবেন।”
“মা, আমি তো বলেছিলাম এখন না।”
“আরে, এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? দেখা কর, কথা বল। এতে তো কোনো দোষ নেই। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন তোকে কালই কবুল বলতে বলা হচ্ছে!”
“বাবা, তুমি কিছু বলো?”
“এটার ক্ষেত্রে কিছু বলব না। তোর মা এবার একটা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
কটমট করে স্বামীর দিকে তাকাতেই তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে কথা ঘুরিয়ে ফেললেন, “না মানে, তোর মা তো বেশিরভাগ সময়ই ঠিক সিদ্ধান্তই নেয়। এটাও সঠিক সময় বলে মনে হচ্ছে।”
বলে স্ত্রীর কঠিন মুখ সহজ হয়ে এসেছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, যাক, বহুদিন পরে তিনি সঠিক সময়ে নিজের মুখটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন৷ এই মুহূর্তে তার ঝগড়া করার মতো ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই। একটা আর্টিকেল পড়বেন, তার জন্য মনোযোগ লাগবে।
“তোমাদের এটাই শেষ কথা?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে।”
রাত্রি বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “ছেলেও আসবে?”
“হ্যাঁ।”
ছেলের সাথে কথা বলে ঠিকই এটা পণ্ড করা যাবে, ভাবল রাত্রি।
***
আনোয়ারা একটা পাঞ্জাবি ধরিয়ে দিলেন ইমরোজের হাতে,
“এটা পরে রেডি হয়ে নে।”
“এটাই পরতে হবে কেন মা?”
“এই রঙে তোকে ভীষণ মানায়।”
ইমরোজ সন্দিহান দৃষ্টিতে মা’কে নিরীক্ষণ করে বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি বলো তো মা? এত ঘটা করে সাজার মানে কী?”
“গেলেই দেখতে পাবি।”
ইমরোজ অফ হোয়াইট পাঞ্জাবিটা পরে ভীষণ পরিপাটি হয়ে বেড়িয়ে এলো। পোশাকের ক্ষেত্রে সে বরাবরই ভীষণ রুচিশীল। সে খুব ভালো ক্যারি করতে পারে।
আনোয়ারা ছেলেকে চোখ ভরে দেখলেন, “মাশাল্লাহ। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।”
বলেই দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে দিলেন। ইমরোজের মনের সন্দেহ প্রগাঢ় হচ্ছে। ইপ্সিতা শাড়ি পরেছে, ওকেও ভীষণ মিষ্টি লাগছে।
আনোয়ারা ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই শাড়ি পরবি বলিসনি তো?”
ইপ্সিতা অপ্রস্তুত হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। আজ হবু শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে প্রথমবার। একটা ব্যাপার আছে না! যদিও অন্য পরিচয়ে যাচ্ছে৷ তবুও একটা ব্যাপার আছে না!
“বা রে, তোমরা সবাই সেজেগুজে যাচ্ছ, আমি এমনি এমনি যাব না-কি?”
মেয়েকেও ফুঁ দিয়ে দিলেন, ইপ্সিতার গায়ের রঙ একটু চাপা, মুখের আদলে অদ্ভুত মিষ্টতা আছে। বিয়ের কথাবার্তা হলে নাকি মেয়েদের রূপ খোলতাই হয়। আনোয়ারার মেয়েকে দেখে কথাটা সত্যি বলেই মনে হলো।
***
একটা খয়েরি রঙের শাড়ি রাত্রির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মায়া বললেন,
“এটা পর।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে রাত্রি বলল, “আমি এভাবে সেজেগুজে মানুষের সামনে গিয়ে বসব না।”
“তুই নিজে কত মেয়েকে এসব নিয়ে পরামর্শ দিস মনে আছে? নিজের ক্ষেত্রে কেন করবি না? আচ্ছা, আজ পর না, দেখা কর। দরকার হলে তোর গোয়েন্দা লাগিয়ে দিবি ছেলের পেছনে। আমরা না জেনেশুনে তোর বিয়ে দেব নাকি?”
রাত্রি শাড়িটা পরে নিল, এখন আর অমত করল না। ওকে ছেলের সাথে কথা বলতে হবে। সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকল।
মায়া নিজে রাত্রির চুল আঁচড়ে দিলেন।
***
উৎপলও আজ বেশ পরিপাটি হয়ে আছে। আজ প্রথমবার ইপ্সিতা আসছে বাড়িতে। ওর পুরো পরিবার আসছে। কিছুটা নার্ভাস লাগছে।
ওদের মিশন বিবাহের একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দিন। রাত্রি আর ইমরোজ মুখোমুখি হলে কী হবে সেটা ভাবতেই আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হলো। ওরা বাসায় এসে পড়েছে।
***
বাসায় ঢুকার আগে আনোয়ারা ছেলেকে বললেন, “ইমু, আদবের সাথে থাকবি। কোনো হুজ্জতি করবি না। আমার নাক কাটবি না।”
“আমি হুজ্জতি করতে যাব কোন দুঃখে?”
“তোর বিয়ের জন্য কথা বলতে এসেছি, সেই দুঃখে করতেও পারিস।”
বলতেই বলতেই দরজা খুলে গেল, ইমরোজ প্রতিক্রিয়া দেখাবার সময় পেল না। তার আগেই মা ওর হাত ধরে বললেন,
“আয়, ইমরোজ।”
ইমরোজ খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছিল, এমন কিছুই হতে পারে। তবুও বিস্ময়ের ধাক্কাটা ভালোই লেগেছে।
ওরা এসে পরিপাটি বসার ঘরে বসল। উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে। ভেতরে ভেতরে গজগজ করলেও প্রকাশ করতে পারছে না ইমরোজ।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালানোর পরে কণের ডাক পড়ল। ইমরোজ মুঠোফোনে চোখ গুঁজে ফেসবুকের নিউজফিড চেক করছিল, বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয় পোস্ট। তবুও সমস্ত মনোযোগ তাতে নিবন্ধ রাখার চেষ্টা করছে।
রাত্রিও প্রথমে ওকে খেয়াল করেনি। উল্টোদিক থেকে এসেছে সে। ওকে বসানো হয়েছে ইমরোজের মুখোমুখি।
আনোয়ারা সন্তর্পণে ছেলেকে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
“সামনে তাকা হাঁদা।”
এই বয়সে এসে মায়ের কাছে এহেন উপমা পেয়ে নিজের মানসম্মান রক্ষার্থে সামনে তাকিয়ে যা দেখল, এত বড় বিস্ময় ওর এত বছরের জীবনে আবির্ভূত হয়নি কোনোদিন, দুঃস্বপ্নেও।
রাত্রিও একই সময়ে তাকিয়েছে, ওর মনে হলো, আনোয়ারা ম্যামের হয়তো আরেকটা ছেলে আছে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়, ওর স্মৃতিশক্তি বলছে, ইপ্সিতার বায়োডাটায় সে স্পষ্ট পড়েছে, ওর একটামাত্র ভাই আছে! শেষ পর্যন্ত এই পায়ে পা বাঁধিয়ে ঝগড়া বাঁধানো ছেলে! পৃথিবীতে ছেলের এত আকাল পড়েছে নাকি!
“আমার বাসায় আমি থাকব না তো কে থাকবে? আপনি?”
একটা প্রশ্নের উত্তর দেবার ছিরি নেই, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরে মা’য়ের এই মেয়েটাকেই পছন্দ হলো! আল্লাহ, রক্ষা করো!
উৎপল সবে মুগ্ধতা নিয়ে ইপ্সিতার দিকে তাকিয়েছিল, উল্টো দিক থেকে লাজুক দৃষ্টি উপভোগ করছিল, সেই মুহূর্তেই প্রলয়ের পূর্বাভাসে ওরা দুজনেই প্রমাদ গুণল! সব ভালোই ভালোই মিটুক! তৃতীয় বিশ্ব যু দ্ধ না শুরু হয়ে যায়!
……….
(ক্রমশ)
সামনের পর্বে কী হতে যাচ্ছে ভাবুন তো! এরা দুটো কী করতে পারে? কতদূর যেতে পারে? মিশন বিবাহ সফল হবে নাকি ওদের পণ্ডশ্রম হবে সব!
গতকাল পর্বটা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লিখতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, বলে শেষ করতে পারিনি। সেজন্য দুঃখিত।