#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ১৬)
নুসরাত জাহান লিজা
দুই বাড়ি জুড়ে বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। বেশ আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে বিয়ে দেবার মনোবাসনা দুই পরিবারেরই। বিয়ের কেনাকাটা হবে আজ। হাতে একেবারেই সময় নেই৷ আনোয়ারা কল দিলেন রাত্রিকে,
“মা, তুমি কি আজ সময় বের করতে পারবে? বিয়ের কেনাকাটা করতে হবে।”
“ম্যাম, আপনারা পছন্দ মতো কেনাকাটা করলেই হবে।”
“সে কী কথা, মা! তোমরা আজকালকার পোলাপান। তাছাড়া তুমিই যেহেতু ব্যবহার করবে, পরে পছন্দ না হলে আলমারিতে ফেলে না রেখে, নিজে পছন্দ করে নেয়াটাই তো ভালো। সবার পছন্দ আলাদা। তাই না?”
আকাট্য যুক্তিতে রাত্রি আর অমত করতে পারল না।
“ঠিক আছে ম্যাম। আমি সময় বের করে নেব।”
“বেশ। ইমরোজ আর ইপ্সিতা তোমার বাসা থেকে তোমাকে নিয়ে যাবে৷ তুমি রেডি থেকো। আরেকটা কথা মা, এখন আর ম্যাম বলছ কেন? নতুন সম্পর্ক তৈরি হতে যাচ্ছে। সেখানে এই সম্বোধনটা খুব বেমানান লাগছে।”
‘’আমি চেষ্টা করব।”
আনোয়ারা ভীষণ খোশমেজাজে আছেন, তার ছেলে অবশেষে বৈরাগ্য ভাঙতে যাচ্ছে। এরচাইতে আনন্দের আর কী আছে!
তিনি ইপ্সিতাকে রেডি হতে বলে ইমরোজকে কল করলেন, সে কলেজে চলে গেছে। রিসিভ হলো না। নিশ্চয়ই ক্লাসে আছে। ক্লাসের সময় ফোন সাইলেন্ট মুডে রাখে।
মিনিট দশেক পরে ইমরোজ কল দিল, “মা, ক্লাসে ছিলাম। তুমি ওষুধ খেয়েছ?”
“হ্যাঁ। খেয়েছি। শোন, তোকে যে জন্য কল করলাম। আজ একটু আগে চলে আসিস বাবু।”
“কেন মা?”
“কেন আবার? তোর বিয়ের কেনাকাটা করতে হবে না?”
“তো আমার কাজ কী মা?”
“তোর বিয়ে। তোর আর বউয়ের জন্য কেনাকাটা। সেটা কে করে দেবে?”
“আমার সময় নেই।”
“দেশের প্রাইম মিনিস্টারও যদি বিয়ে করে, তা-ও ছুটি নিতে পারে। আর তুই কোথাকার কোন নবাব পুত্র যে তুই সময় পাচ্ছিস না?”
“মা, তুমি বুঝতে চেষ্টা করো…”
“অনেক বুঝেছি। তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। চিনি বলেই জানি যে তুই একটা বাজে অজুহাত তৈরি করছিস। যার কোনো ভিত্তি নেই। তুই একটার মধ্যে বাসায় আসবি। খেয়েই বেরিয়ে যাবি রাত্রিকে নিতে। ইপ্সিতা যাবে তোদের সাথে।”
ইমরোজ তার নাছোড়বান্দা মাকে চেনে। তাই রাজি হয়ে গেল।
***
ইপ্সিতা আগে থেকেই তৈরি হয়েই ছিল। ইমরোজকে ডাকতে এসে দেখল তার ভাই এখনো ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে,
“ভাইয়া এত্ত মাঞ্জা মারার দরকার নেই। এসো। রাত্রি আপু রেডি হয়ে বসে আছে।”
“ভালোভাবে কথা বল। মাঞ্জা মারা আবার কী জিনিস?”
“সেটা তুমি বুঝবে না। বাংলার শিক্ষকের অভিধানে এসব শব্দ নেই। বন্ধুদের সাথে আড্ডার অভিধানে আছে।”
“কী সব বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিস, যে ভাষার বিকৃতি করে! আর তোর মনে হয় মেয়েরা এত ফাস্ট? ওদের মেকআপ করতেই লাগে এক ঘণ্টা।”
অনুরোধে আস্ত ঢেঁকিটাই মুখে তো পুরে নিয়েছে, গলধঃকরণ হচ্ছে না। ছেলেবেলায় বাঘের গলায় হাড় আটকে যাবার গল্প পড়েছিল, গলা থেকে ঢেঁকি ছোটানোর কোনো মন্ত্র বা কৌশল ওর মাথায় আসছে না।
***
ইমরোজের বাবার একটা গাড়ি ছিল৷ বেশ অনেক বছর আগে সেটা বিক্রি করেছিলেন মা। এক জোড়া কানের দুল, ছোট্ট চেইন আর একজোড়া বালা ছাড়া অন্যসব গহনাও বিক্রি করা হয়ে গেছে ওদের বাবার চিকিৎসার জন্য। বাবার কেনা ফ্ল্যাটটা আছে, যেখানে ওরা থাকে।
ইমরোজ গাড়ি কেনার টাকা জমাচ্ছে। ইপ্সিতার বিয়ের ডামাডোল শুরু হবার পরে মনে হলো, বোনের বিয়েতেও তো খরচ হবে অনেক৷ এখন আবার নিজের বিয়ে। মা অবশ্য বলেছেন ওদের বিয়ের খরচ তিনিই করবেন৷ পেনশনের টাকা পেয়েছিলেন। সেটা সন্তানদের বিয়ের জন্য রেখে দিয়েছেন। টাকাগুলো হাতে আসার পরে তারও মনে হয়েছিল ছেলেমেয়েদের যাতায়াতের জন্য একটা গাড়ি কেনা যেতে পারে। কিন্তু স্বামীর অসুখ, তার চিকিৎসা ব্যয় দেখে মনে হয়েছে, হাতে কিছু থাকুক। ভবিষ্যতে যদি তেমন মুহূর্ত কখনো আসে! তখন টাকাগুলো কাজে লাগবে বলে। তিনি সবসময় বলেন,
“তুই কোনো একটা ভয়ংকর বিপদে পড়বি, তোর কষ্ট সহ্য করতে হবে। কিন্তু তখন তুই মানুষ চিনবি। আমিও চিনেছি, কে বন্ধু আর কে নয়।”
ওরা রাত্রির বাসার সামনে এসে কল দিতেই সে আর উৎপল নেমে এলো। ইপ্সিতার সাথে কুশল বিনিময় শেষ ইমরোজকে বলল,
“প্রায় বিশ মিনিট হলো রেডি হয়ে বসে আছি। এত লেট!”
ইপ্সিতা বলল, “ভাইয়া বলল, তোমার নাকি রেডি হতে দেরি হবে। মেকআপ করতে নাকি এক ঘণ্টা লাগে। তাই ধীরেসুস্থে আসলাম।”
“আমার রেডি হতে কতক্ষণ সময় লাগবে, সেটা আপনি জানেন কী করে?”
“মেয়েরা ঠিক সময়ে আসে নাকি!”
“মেয়েদের সম্পর্কে দেখছি আপনার অগাধ জ্ঞান! তবে জানিয়ে রাখি, আমার কিন্তু বেশিক্ষণ লাগে না।”
“হলেই ভালো।”
***
চরম বিরক্তি নিয়ে রাত্রির খুঁতখুঁতে বাতিক দেখছে ইমরোজ। বিয়ের শাড়ি পছন্দ করতেই দুই ঘন্টা লাগিয়ে দিয়েছে। এরপর বাকি জিনিস কিনতে কিনতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে।
ওর শেরওয়ানির ডিজাইনও পছন্দ করল ওই মেয়েটা! কেন? সে কী নির্বোধ, যে নিজের পোশাক পছন্দ করতে পারবে না! পরবে তো সে, রাত্রির শাড়ি কেনার সময় কী সে নাক গলিয়েছে!
ওর ধারণা মেয়েটা ওকে ভোগান্তিতে ফেলার জন্য এই মেয়ে ইচ্ছে করে এত সময় নিচ্ছে। উৎপল ইমরোজকে উশখুশ করতে দেখে বলল,
“বিয়ের প্রথম শর্ত হলো, বউকে নিজে সাথে থেকে শপিং করানো।”
“আপনার এক্সপেরিয়েন্স আছে নাকি?”
“উপলব্ধি ব্রো, উপলব্ধি।”
“তোমরা কী গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর হচ্ছে? আমাদের হেল্প করার কথা না?”
রাত্রির কথায় উৎপল এগিয়ে গেল৷
“আর কতক্ষণ লাগবে?”
“সেটা কী করে বলব, পছন্দের উপরে ডিপেন্ড করবে। বিয়ে যখন করছি, ভালো মতোই করব।”
“অসহ্য।”
“এটুকু সহ্য না হলে আমার কিছু করার নেই। আপনি ননীর পুতুল জানলে আপনার সাথে আসতামই না।”
রাত্রির কথায় ইমরোজ মনে মনে বলল, “খুব শখ না আমাকে বিয়ে করার! আমিও দেখব, এই শখ কই যায়।”
সামনে উৎপল আর ইপ্সিতা আছে বলে ভদ্রতা বশত কথা বাড়ালো না।
***
শুভক্ষণ উপস্থিত। রাত্রিকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে কণের সাজে৷ কনভেনশন সেন্টারে বসে আছে এখন। বর চাক এসেছে। রাত্রি এই কয়দিন তেমন গা না করলেও আজ শেষ মুহূর্তে এসে কেমন যেন নার্ভাস লাগছে।
একেতো ভারি শাড়ি, তার উপর জমকালো সাজ, তারমধ্যে ভ্যাপসা গরম। এই গরমে কেউ বিয়ে করে! সবমিলিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে।
উৎপল ভীষণ খুশি। ছোট বোনের বিয়ের খুশি তো আছেই। ওদের মিশন বিবাহ আজ পৃথিবীর অন্যতম সফলতম একটা মিশন হিসেবে নাম লেখাতে যাচ্ছে।
শেরওয়ানি পরিহিত ইমরোজের আগমন ঘটল। এসব জাঁকালো আয়োজনের ঘনঘটা ওকে বিষকাঁটার মতো খোচাচ্ছে। কোরবানির আগে গরুকে যেমন আদর করে যত্ন করে খাওয়ায়, সাজিয়ে দেয়। নিজেকে তেমন অবলা মনে হচ্ছে।
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে সহ্য করে নিচ্ছে।
কাজীর উপস্থিতিতে বিবাহ সুসম্পন্ন হলো। দোয়ায় থাকল নববিবাহিত দম্পতির নতুন জীবনের জন্য দোয়া।
কবুল বলার সময় ইমরোজের মনে হলো ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেল।
রাত্রির অস্বস্তি লাগছিল, কত মানুষের সে বিয়ে করিয়েছে, বিয়ে নিয়েই ওর কারবার। অথচ আজকের আগে ওদের অনুভূতিটা বুঝতে পারেনি। মনে হচ্ছে সব কেমন যে হয়ে গেল।
বর-কণের একসাথে ছবি তুলতে বেচারা ফটোগ্রাফারকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এমন আনরোমান্টিক দুটোই যে চোখে প্রেম নিয়ে ঠিকঠাক পরস্পরের দিকে তাকাতেও পারেনি৷ ছবি সুন্দর না হলে সব দোষ পড়বে ফটোগ্রাফারের উপরে। নিজেরা পোজ দিতে পারে না, এক্সপ্রেশন জানবে না তো তার কী করার আছে!
উৎপল জাহিদের কাছ থেকে সিভি থেকে ওই লোকটার কন্টাক্ট নম্বর নিয়ে দাওয়াত দিয়েছিল, ওদের মিশনে অজান্তেই যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মাকে ওই লোকের কথার জন্যই বোঝানো গেছে যে রাত্রি ইমরোজের মধ্যে আগে থেকেই অনুভূতির খেলা চলছিল।
সে উৎপলকে বলল, “ভাইজান, মাশাল্লাহ, আমি খুব খুশি হইসি। কী সুন্দর মানাইসে দুইজনরে। এহন বলেন পান কোন পাশে। এমন খাবার খাইলে পান না চাবাইতে পারলে আত্মা জুড়ায় না।”
ইপ্সিতাকে এমন সাজে উৎপল আগে দেখেনি। সে মেসেজ পাঠাল,
“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। আজই বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে।”
কিছুক্ষণ পরে উত্তর এলো, “বোনের বিয়েতে ফোকাস করো। আমাকে সারাজীবন দেখতে পারবে।”
কণে বিদায়ের সময় হাবিব সাহেব ইমরোজের হাতে রাত্রির হাত ধরিয়ে দিলেন। প্রথম একটা অন্যরকম স্পর্শ। দুজনেই চোখ তুলে পরস্পরের দিকে তাকালো ক্ষণকালের জন্য। এরপর দৃষ্টি অবনত করল দুজনেই।
বললেন, “আমার মেয়েটাকে বুঝতে চেষ্টা কোরো বাবা। আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদকে খুশি রাখার দায়িত্ব আজ থেকে তোমার।”
ইমরোজের মনে যাই থাকুক, ওর সহবত জ্ঞান ওকে তা প্রকাশ করে ঔদ্ধত্য দেখাতে বাঁধা দিল। সে মোলায়েম গলায় বলল,
“আমি চেষ্টা করব।”
………
পরের পর্ব থেকে দুই পাগলের সংসারের গল্প শুরু হবে। আজকে একটু তাড়াহুড়োয় ছিলাম, কিছুটা অগোছালো হয়েছে সেজন্য।