#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ১৮)
নুসরাত জাহান লিজা
নিজের ডেরায় সারাক্ষণ শত্রু বসে আছে, এই অনুভূতি ইমরোজকে বিন্দুমাত্র স্বস্তি দিচ্ছে না। এত বছরের জীবনে নিজের ঘরে একা থেকে অভ্যস্ত। হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা কারোর জন্য যে ওকে এত বড় স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে এটাও অসহ্য লাগছে।
একা থেকে অভ্যস্ত বলে অন্যের বাসায়ও সে গিয়ে থাকে না কখনো। ওর এত বছরের নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে এ কী অনাচার শুরু হলো।
মেয়েটা সকালে খেয়ে আসার পর থেকেই নিজের মুঠোফোন কানে লাগিয়ে ননস্টপ কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। নিজে ওকে বিয়ে করে অশান্তি দিচ্ছে, তাতে হচ্ছে না। আরও কতগুলো মানুষের জীবনে অশান্তির পায়তারা করছে।
ইমরোজ কথা বলে ভীষণ মার্জিতভাবে। গলা চড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস নেই। মা আর ইপ্সিতার মতো এই মেয়ের গলার স্বরও উচ্চগ্রামের। এসব বিরক্তিকর ব্যবসায়িক আলাপে ওর মাথা ধরে যাচ্ছে।
অবশেষে সহ্য করতে না পেরে বলল, “একটু আস্তে কথা বলুন না। ঘরে আরেকজন মানুষ আছে, তাকে বিরক্ত করছেন কেন খামাখা?”
রাত্রি জাহিদের সাথে কথা বলছিল৷ সে তিনদিন বিবাহ ডটকমে যেতে পারবে না। নিজের বিয়ে উপলক্ষে ইমার্জেন্সি কাজগুলো শেষ করলেও অনেকগুলো বিয়ের আলোচনা এখনো পেন্ডিং আছে। সেসব কী করে হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা করছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপে বিরক্ত হলো সে বলল,
“আমি আপনার মতো অকাজে বসে নেই। কাজের কথা বলছি। আপনার সমস্যা হলে কানে তুলো দিয়ে বসে থাকুন। আর নইলে বাইরের আলো-বাতাস গায়ে লাগিয়ে আসুন।”
ইমরোজ এক পৃথিবী অবিশ্বাস নিয়ে রাত্রির দিকে তাকিয়ে আছে, এটা ওর নিজের ঘর। সে কস্মিনকালেও কোনোদিন ভাবেনি, নিজের ঘর থেকে কেউ ওকেই বেরিয়ে যেতে বলবে। এই মেয়ের স্পর্ধা দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
“এক্সকিউজ মি, আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন, ঘরটা আমার।”
“আপনি না বললে জানতেই পারতাম না। কথাটা জানিয়ে বহুত উপকার করলেন।”
ব্যঙ্গ গায়ে মাখল না ইমরোজ, “আমার মাথা ব্যথা করছে। একটু আস্তে কথা বলুন, নইলে বারান্দায় গিয়ে কথা বলে আসুন।”
“এই কথাটা আপনার আগে মনে ছিল না? সকালবেলা ধেড়ে ইঁদুরের মতো ঘরে হুঁটুপুটি করে আমার ঘুম ভাঙালেন, সেই সময় আপনার মানবতা কোথায় ছিল? মাথা ব্যথা আমার এখনো আছে।”
“ধেড়ে ইঁদুর মানে?”
“এমন খাম্বার মতো বেড়ে লাভ কী, যদি একটা সাধারণ ইঁদুর না চেনেন? না চিনলে প্লিজ গুগলের সাহায্য নিন।”
“আমি চিনি না কে বলল? আমাকে কেন ইঁদুর বললেন?”
“এক হাজার একটা কারণ আছে। আমি যদি লেখক হতাম, তাহলে একটা বই লিখতাম এটা নিয়ে। বইয়ের নাম দিতাম ‘মহামান্য ইমরোজকে ধেড়ে ইঁদুর বলার এক হাজার একটা কারণ’। এখন এক্সপ্লেনেশন দেবার মতো সময় আমার নেই। ডিস্টার্ব করবেন না। কাজের সময় ডিস্টার্বেন্স নিতে পারি না আমি।”
বলে একজন ক্লায়েন্টের নম্বর ডায়েল করে কথা বলতে শুরু করল। ঘর নিয়ে কথা শোনানো ওর একেবারেই পছন্দ হয়নি। নেহায়েত এর হাড় কয়লা করার প্ল্যান নিয়ে এসেছে। নইলে এই কথার পরে এই রুমে বসে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর অবশিষ্ট নেই।
ইমরোজ জানে কথায় সে এই মেয়ের সাথে পারবে না। আবার বসে থাকতেও অসহ্য লাগছে। তাই নিজেই আপাতত বেরিয়ে গেল নিজের ঘর থেকে।
***
বউভাত শেষে শ্বশুর বাড়ি এসেছে ইমরোজ। বাড়িটা আত্মীয়স্বজনে গিজগিজ করছে আজও। সবার কথাবার্তায় এটুকু বুঝতে পারল মহাশয়া এদের সকলের ভীষণ আদরের। অতিরিক্ত আদরে বাঁদর হয়েছে তাহলে। এত বড় একটা মেয়েকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা কীসের!
রাত্রির প্রতি সকলের ভালোবাসার অংশীদার ওকেও হতে হলো। ওদিকে খাবার টেবিলে মায়া আর রাত্রির বড় খালামনি যেভাবে ওর যত্নআত্মী করছিল, তাতে ওর রীতিমতো অত্যাচার বলে মনে হচ্ছিল। এত খাবার কী করে খাবে সে! সে মানুষ, রাক্ষস নয়!
উৎপল বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল, “মা, একদিনে সব খাওয়াবে নাকি! আমাদেরকেও দাও, আমরা খাই।”
মায়া বুঝতে পারলেন, খাবার শেষ করে উৎপলের ঘরে এলো ইমরোজ।
“থ্যাংকস।”
“কেন?”
“খাবারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য।”
উৎপল সশব্দে হেসে ফেলল। হঠাৎ করে ওর মনে হলো, এদের বাড়িতে কিছুদিন পরে ওকেই জামাই হিসেবে যেতে হবে। তখন এই উপকারের প্রতিদান পেলেই হয়!
“বসুন না।”
“আপনি আপনি ঠিক পোষাচ্ছে না। বয়সে হয়তো আমি অল্প একটু বড় হবো।”
ইমরোজের কথায় উৎপল ওদের সম্পর্কের সমীকরণ মেলাবার চেষ্টা করল। ইমরোজ ওর বয়সে হয়তো এক দুই বছরের বড় হবে। তবে ওর ছোট বোনের হাজব্যান্ড। সেদিক থেকে ইমরোজকে নাম ধরে বলা সহজ। আবার ওর ছোট বোনের সাথে বিয়ে হলে আবার সম্পর্কে বড় হয়ে যাবে। এত জটিলতায় যাওয়ার প্রয়োজন কী! তাই সে বলল,
“সেই ভালো। বসো।”
ইমরোজ বসল। বিছানার পাশে রাখা গিটার দেখে জিজ্ঞেস করল, “তুমি গান গাও?”
“টুকটাক। তবে বাজাই সুযোগ পেলে।”
“বাহ্!”
“রাত্রিকে কেমন দেখলে?”
ইমরোজের মুখে বিরক্তির ছায়া ঘনালো, উত্তর দিল না। উৎপল বলল,
“ইমরোজ, রাত্রি ভীষণ ভালো একটা মেয়ে। শুধু আমার বোন বলে নয়, তুমি মন দিয়ে যদি ওকে বোঝার চেষ্টা করো, তাহলে বুঝতে পারবে। কারো প্রতি বিদ্বেষ তৈরি হলে ও খুব প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে যায় হয়তো। তবে কারোর ক্ষতি সে কোনোদিন করে না। তবে কাউকে ভালোবেসে ফেললে তার জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করে না। ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। আমার জন্য অসংখ্যবার সে এটা করেছে। বুঝতে পারছো? ওকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের পরিবারের আলো রাত্রি। সেই আলোতে কখনো আঁধার আসতে দিও না।”
ইমরোজ শুনতে শুনতে যেন খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে গয়েছিল, অবচেতনেই বলল, “চেষ্টা করব।”
***
রাত্রি ওর ঘরে এসে দেখল ইমরোজ একমনে কী যেন ভাবছে! নিশ্চয়ই ওকে অপদস্ত করার ফন্দি আঁটছে। এই লোকের মাথায় এটা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
“শুনুন, সকালে নিজের ঘর নিয়ে খোঁটা দিচ্ছিলেন। আমি কিন্তু তেমন নই। আমার মানবিকতা বোধ আছে। নিজের মতো থাকতে পারেন।”
ইমরোজ চোখ তুলে রাত্রির দিকে তাকালো, নিজেকেই বিদ্রুপ করল। একটু আগে উৎপলের কথা শুনে মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যি মেয়েটাকে বুঝতে চেষ্টা করবে কি-না। এখনকার খোঁচায় মনটা আবার বিষিয়ে গেল।
“কী বলতে চাইছেন? আমার মধ্যে মানবতাবোধ নেই?”
“সেটা কখন বললাম? তবে শুনেছে যার মনে যা, সে তেমন অর্থই দাঁড় করায়। আপনার নিজেরই যদি এটা মনে হয়, আমি কেন অমত করতে যাব!”
রাত্রি ওর দিকে একটা এন্টাসিড এগিয়ে দিয়ে বলল, “নিন। প্রয়োজন মনে করলে একটা খেয়ে নেবেন৷”
ওর হাতে ওষুধটা গুঁজে দিয়েই বেরিয়ে গেল রাত্রি। এটা ইমরোজ আশা করেনি৷ ওকে ভোগান্তি দিয়েই তো শান্তি পায়, হঠাৎ মনে দয়া হলো কেন! ওকে নতুন কোনো ভোগান্তিতে ফেলার পায়তারা করছে না তো!
এই মেয়েকে বোঝা ওর জন্য কঠিনই হবে। গতিবিধি না বুঝলে নিজেকে প্রস্তুত করবে কী করে, চালই বা ধরবে কী করে!
……….