বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-১৯

0
38

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ১৯)
নুসরাত জাহান লিজা

প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে এসে অপ্যায়নের যন্ত্রণায় কাহিল হয়ে গেছে ইমরোজ। তবে তাদের আন্তরিকতায় সে মুগ্ধ। এমন ভদ্র বাড়িতে ওমন একটা দজ্জাল মেয়ে কীভাবে এলো এটাই সে ভেবে পায় না। জন্মের সময় বদল হয়েছিল কিনা কে জানে! কিন্তু মায়ার সাথে রাত্রির চেহারার মিল প্রকট। তাই এই সম্ভাবণাকে নাকচ করে দিল।

হাবিব খবর দেখছিলেন, ইমরোজ পাশে গিয়ে বসল, তিনি ইমরোজের সাথে গল্প শুরু করলেন, দেশ-বিদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। মায়া এসে বললেন,

“তোমার এই ভাঙা রেডিও আপাতত বন্ধ রাখো তো।”

“বয়সকালে তোমার মাথা একেবারে গেছে মায়া। চলছে টেলিভিশন আর তুমি দেখছ রেডিও, তাও আবার ভাঙা!”

স্ত্রীকে রাগিয়ে দিতে তার ভালো লাগে কেন যেন! বহু বছরের অভ্যাস। এখন অবশ্য মেয়ের জামাই সামনে বসে থাকায় তিনি প্রত্যুত্তর দিলেন না, তবে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন, যেন প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে রাখলেন। শুধু বললেন,

“মাথা যে কার গেছে সে তো দেখছিই।”

ইমরোজের হাসি পেলেও হাসতে পারল না, কারণ এখানে ওর কার পক্ষ নেয়া উচিত সেটা বুঝতে পারল না। ওর নির্দোষ হাসিতে যদি দুজনের একজনও ওকে বিপরীত পক্ষ ভেবে নেয়! তবে এই দুটো মানুষের এমন খুঁনসুটি মাখা কেমিস্ট্রি দেখতে ওর ভালো লাগছে। আসার পর থেকেই দেখছে বিষয়টা, ওর ভালো লাগার কারণ হচ্ছে, খুঁনসুটির পেছনে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাটা, যা খুবই স্পষ্ট! ওর আর রাত্রির মতো জেদ চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতা বিন্দুমাত্র নেই সেখানে!

***
গতকাল নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে ইমরোজ আর রাত্রি। ওদের শোবার ঘরে বড় দুটি বুকশেলফ, তাতে থরে থরে বই সাজানো। রাত্রি নেড়েচেড়ে দেখল৷ নেপথালিনের গন্ধ আসছিল। এই তাক যে নিয়মিত পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখা হয়, তা দেখলেই বোঝা যায়। আলবেয়ার কামু’র ‘দ্য আউটসাইডার’ বইটা নিয়ে বিছানায় বসল সে।

কিছুক্ষণ পড়ার পরে আনোয়ারা ঘরে এলেন। ইমরোজ আজ কলেজে গেছে, রাত্রি পরশু থেকে ওর কাজে নিয়মিত হবে।

“আসব?”

রাত্রি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “প্লিজ মা, আসুন।”

ওর হাতে বই দেখে বললেন, “বই পড়ছিলে বুঝি?”

“জ্বি।”

“ভীষণ বইপাগল ছেলে আমার। নিয়মিত সব রোদে দেয়, আবার ঝেড়ে মুছে গুছিয়ে রাখে। আগে কোনোভাবে বই নষ্ট হলে রেগে যেত।”

“আপনার ছেলের পারমিশন ছাড়া তার কালেকশন থেকে বই নিয়েছি। নির্ঘাৎ রেগে যাবে, তাই না মা?”

রাত্রি সেটাই চায় অবশ্য, ইমরোজকে জ্বালাতে। তবে বই যেহেতু সে নিজেও ভালোবাসে তাই নষ্ট করতে পারবে না!

“কী যে বলো না মা! ও এখন তোমার নিজের মানুষ, ওর সবকিছুও তাই তোমার। নিজের জিনিস নেবে, ও খামাখা কেন রাগ করতে যাবে!”

আনোয়ারার বলার ধরনে রাত্রি হেসে ফেলল। কিছু মানুষ ভীষণ ম্যাজিক্যাল হন। এই মানুষটা তেমন। কেমন ভোজবাজীর মতো মন ভালো করে দেন। রাত্রি হাসিমুখে বলল,

“চলুন মা, আপনার চুলে তেল দিয়ে দেই।”

“তুমি রেস্ট করো।”

“আমার ভালো লাগবে মা। আমি তো মায়ের চুলেও তেল দিয়ে দিতাম। মা বলেন, আমি বিলি কেটে তেল দিয়ে দিলে নাকি ঘুম চলে আসে।”

আনোয়ারা আপত্তি করলেন না, “আচ্ছা, তাই দাও। চলো আমার ঘরে যাই।”

আনোয়ারার আয়েশে ঘুম চলে আসছিল। তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দেবার পরে, তিনিও বললেন, “আয়, তোর চুলগুলো আঁচড়ে দেই।”

রাত্রি তার সামনে বসে পড়ল।

ইমরোজ কলেজ থেকে ফিরে মায়ের ঘরে যায় সবসময়। আজও এসেছিল, কিন্তু দেখল মায়ের চুলে রাত্রি তেল দিয়ে দিচ্ছে, দু’জনে কী নিয়ে কথা বলছিল আর হাসছিল। দৃশ্যটা সুন্দর! রাত্রির প্রতি ওর রাগ থাকলেও কেন যেন ওর ভালো লাগছিল। ওদের স্পেস দিতে সে আর ভেতরে গেল না। নিজের ঘরে ফিরে গেল।

ঘরে এসে নিজের প্রিয় বই এভাবে বিছানায় দেখে একটু আগের মুগ্ধতা কেটে গেল। ফ্রেশ হয়ে সে আবারও মায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল, দেখল রাত্রির চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন মা। এবার আর সুন্দর লাগল না দৃশ্যটা! ওর মনে হলো, ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা হিসেবে দল ভারি করার জন্য মাকে প্রলুব্ধ করার অপচেষ্টা করছে মেয়েটা! ওর ঈর্ষা হলো ভীষণ!

এবারও সে সরে যাচ্ছিল, কিন্তু মা ওর উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন, “বাবু, কখন এলি?”

অগত্যা সে ভেতরে এসে বলল, “আমার দিকে তো এখন তোমার নজরই নেই!”

রাত্রি হেসে জিজ্ঞেস করল, “বাবু কে? উনার ডাক নাম?”

ইমরোজ বুঝল এটা নিয়ে মজা নেবে অসহ্য মেয়েটা, “আদরের ডাক এটা। আপনি বুঝবেন না।”

এবার আনোয়ারা বললেন, “ছিঃ ইমু, এভাবে বলছিস কেন? না বোঝার কী আছে! তবুও কনফিউশান থেকে জিজ্ঞেস করেছে।”

“কীসের কনফিউশন?”

এবার রাত্রি কথা বলল, “আপনার বয়সী একজনকে বাবু ডাকায় কিঞ্চিৎ আবাক হয়েছি। এই যা!”

“দেখলে মা?”

ইমরোজের অভিযোগকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আনোয়ারা বললেন, “কী দেখব? এখানে দেখার কী আছে?”

“কাকে কী বলছি আমি! আমি তো কেউ নই এখন আর তোমাদের। অন্য সব মানুষই তোমার চোখে পড়ছে শুধু কয়েকদিন থেকে। ইপ্সি কই?”

“ইপ্সি বাইরে গেছে। এত হিংসুটে কেন তুই বাবু? নিজের বউকে হিংসা করিস!”

ইমরোজ রেগে মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

আনোয়ারা হেসে ফেললেন, “পাগল ছেলে!”

রাত্রি হেসে ফেলল, আনোয়ারা বললেন, “তোরা এখনো আপনিতেই আছিস?”

তিনি কিছুক্ষণ থেকে রাত্রিকে তুই বলা শুরু করেছেন, বলায় প্রগাঢ় আন্তরিকতার ছাপ আছে বলে ওর ভালো লাগল! তবে প্রশ্নটার উত্তর দিল না।

আনোয়ারা জানেন তার ছেলে রেগে গেলে ভেতরের শিশুটাকে বাইরে বের করে ফেলে। ইমরোজের ভেতরের শিশুটাকে রাত্রি একবার চিনে ফেললে, তবেই না ব্যাপারটা মাখোমাখো হবে! এদের যা রকম-সকম, একটু ধাক্কা না দিলে কেউই নিজের জায়গা ছেড়ে নড়বে না!

***
রাত্রি ঘরে আসতেই ইমরোজ হিসহিসিয়ে বলল, “দল পাকাচ্ছেন? তাও আমার মায়ের সাথে?”

রাত্রি দল পাকানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আনোয়ারার সাথে আন্তরিক হয়নি। বরং মানুষটার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে নিজের ভালো লাগা থেকেই কাজটা করেছে সে। আগে থেকেই আনোয়ারা তার প্রিয় শিক্ষক। শ্রদ্ধাবোধ ছিলই, এখন কাছ থেকে দেখে সেই মুগ্ধতা বেড়েছে। তবে তার ছেলেটা বড্ড বেয়াড়া।

“আপনার নিজের মা সম্পর্কে আপনার দেখছি অনেক উচ্চ ধারণা!”

তাচ্ছিল্য ভরে কথাটা বলে ইমরোজকে পর্যবেক্ষণ করল আবার বলল, “নিজের মা অন্যের সাথে দল পাকাচ্ছে! তাহলে ভাবুন আপনি কতটা যোগ্য!”

“সেটা মা আর আমার ব্যাপার। আপনার নয়!”

“তাই যদি হবে, তাহলে মাঝে আমাকে টেনে কথাটা শোনালেন কেন?”

“আপনি আমার বই নিয়েছেন, ভালো কথা। সেটা এভাবে বিছানায় রেখেছেন কেন? জায়গার জিনিস জায়গায় রাখতে পারেননি?”

“কারণ বইটা আমি পড়ার জন্য নিয়েছি। বের করে বইয়ের প্রচ্ছদ দেখার জন্য নিইনি যে বের করে আবার জায়গায় রাখব।”

“বিছানায় বইপত্র রাখা কিংবা পড়া কোনোটায় আমার পছন্দ নয়! টেবিলে পড়বেন দয়া করে।”

“আপনি টেবিলে পড়ুন, ইচ্ছে হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অথবা পায়চারি করে পড়ুন, সেটা আপনার ইচ্ছে। আমি বিছানা ছাড়া পড়তে পারি না, একাডেমিক পড়াও আমি বিছানায় শুয়ে-বসে পড়তাম। আর গল্পের বই পড়ি আয়েশ করে। সেখানে আপনার এসব নিষেধাজ্ঞা ফলাতে আসবেন না।”

“দিলে কী করবেন?”

“করুন তারপর ফলাফল নিজেই হাতেনাতে পেয়ে যাবেন। কারণ আমি কথায় না, কাজে বিশ্বাসী।”

“আপনি আর আপনার বিশ্বাস!”

রাত্রি বইটা হাতে নিয়ে বারান্দায় যাচ্ছিল, এরমধ্যে ইমরোজের অস্ফুটস্বরে বলা কথাটা শুনতে পেল, ঘুরে এসে বলল,

“কী বলতে চাইছেন?”

“বলতে চাইছি এসব ফাঁকা বুলিতে ইমরোজকে কাবু করা যায় না!”

“আপনি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছেন?”

রাত্রির চাহনিতে ইমরোজ কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলেও ঠাঁট বজায় রাখতে বলল, “হ্যাঁ, করলাম।”

“দেখা যাক! কিন্তু খেলাটার গ্রাউন্ড আমি কিছুটা ধীরেসুস্থে তৈরি করছিলাম৷ আপনার যেহেতু তর সইছে না। তবে তাই হোক।”

ইমরোজের গলাতেও চ্যালেঞ্জের সুর, “হোক। তবে ভুলে যাবেন না, এই খেলায় আপনি একমাত্র খেলোয়াড় না। প্রতিপক্ষকে হালকা ভাবে নিলে বিপদ আপনার!”

“আমি এমনিতেও এই ভুলটা কখনো করি না৷ তবে উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। আমিও একটা ফ্রি এডভাইস দিচ্ছি, নিজের মরিচা পড়া মগজে একটু শান দিন, প্রতিপক্ষ দুর্বল হলে একপেশে খেলায় মজা নেই।”

বলেই রাত্রি বেরিয়ে গেল বীরদর্পে। ইমরোজ মনে মনে রাত্রির প্রথম চাল কী হতে পারে ভাবতে বসল! রাত্রির একটা দুর্বলতা ওকে খুঁজে বের করতে হবে! কারণ সে ইমরোজের দুর্বলতা জানে। সাথে ওর মা আর বোন আছে, জানানোর জন্য!

এই মেয়ে ইনোসেন্ট মুখ করে কিছু জানতে চাইলেই জানিয়ে দেবে! কীভাবে খুঁজবে! শ্বশুরবাড়ির কথা মনে পড়ল! রাত্রির কৌশলে সে-ও চাল দেবে!
…………
(ক্রমশ)
(অনেকদিন পরে লিখলাম, আপনারা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে! এবার যেন হতাশ হয়ে এটা থামিয়ে দিতে না হয়! সেটা আপনাদের উপরে! হাজার হাজার রিয়্যাক্ট পড়ার দরকার নেই, কিছু উৎসাহব্যঞ্জক কমেন্টই পারে এই উৎসাহ ধরে রাখতে। পাশে পাব আপনাদের?