#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২০)
নুসরাত জাহান লিজা
ঝড় আসার আগে প্রকৃতি যেমন একেবারে শান্ত হয়ে যায়, গত তিনদিন রাত্রি আর ইমরোজের তেমন নির্বিঘ্নেই কাটল, ঠোকাঠুকি তেমন লাগল না। দুজনেই শক্তি সংরক্ষণ করছে আসন্ন সম্মুখ স ম রে র প্রস্তুতি হিসেবে।
ইমরোজ উৎপলকে যখন কল দিল, বেচারা তখন ছিল ইপ্সিতার সাথে।
“তোমার ভাই কিছু জেনে গেল না-কি?”
ইপ্সিতা আশেপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভাইয়ের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে চেষ্টা করল, “আগে কলটা ধরো। আমার ভাই ছাড়াও ওর আরেকটা সম্পর্ক আছে তোমার সাথে।”
“সে তো আছে। ওরা গতকাল বাসায় এসে ঘুরেও গেল। দাঁড়াও, দেখি কী বলে!”
“উৎপল, কেমন আছ?”
“ভালো, তুমি কেমন আছ?”
“ভালো। আসলে তোমার সাথে একটু কথা ছিল, খুব জরুরি। তুমি কোথায়?”
চট করে মিথ্যে কথা মুখে এলো না উৎপলের, সে-ও চারপাশে নিরীক্ষণ করে চিন্তিত ইপ্সিতার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস টেনে উত্তর দিল,
“আমি তো অফিসে। কোনো সমস্যা? রাত্রির কিছু হয়েছে?”
ইমরোজ মনে মনে আওড়ালো, “ওর কিছু হলে তো বেঁচেই যেতাম। যে ভয়ংকর মেয়ে, উল্টো আমার চৌদ্দটা বাজিয়ে দিয়েছে!”
মুখে বলল, “না, না, ও ঠিক আছে। আসলে কেমন পরিস্থিতিতে হুট করে বিয়েটা হয়েছে, তুমি তো জানো উৎপল। কেউ কাউকে তেমন জানার সুযোগ পাইনি। ওর কী করতে ভালো লাগে, কোনটা অপছন্দ, তুমি তো খুব ভালো মতো জানো। যদি আমাকে একটু হেল্প করো, এই আরকি!”
উৎপল খুশি হয়ে বলল, “জেনে ভালো লাগল যে তুমি রাত্রির পছন্দ অপছন্দ জানতে চাইছ। আমি অবশ্যই তোমার সাথে আছি।”
ইমরোজের ভেতরে একটা অপরাধবোধ এসে ভর করল, কিন্তু উপায় নেই। ওই মেয়ে একটা মূর্তিমান গোলকধাঁধা। তাকে আবিষ্কার নিজে নিজে পড়ে ফেলা ওর কর্ম নয়! ‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার’ আপাতত এই মন্ত্রে সে নিজেকে সান্ত্বনা দিল। এটা তো যেন তেন ও য়া র নয়, থার্ড ওয়ার্ল্ড ও য়া র!
“তাহলে তুমি ফ্রি থাকলে বিকেলে সময় দিতে পারবে!”
“সন্ধ্যার পরে বাসায় চলে এসো তাহলে!”
ইমরোজ সাথে সাথে নাকচ করে দিল, “না, বাসায় না। কোনো রেস্টুরেন্টে বসি?”
মায়া আর হাবীবের সামনা-সামনি ছলনা করতে সে পারবে না! সে তো রাত্রির মতো কূটনীতিক নয়, সে অত্যন্ত ভদ্রলোক। ছলাকলা সে জানে না!
“ঠিক আছে।”
কথা শেষ হলে ইপ্সিতাকে উৎপল বলল, “ওরা একজন আরেকজনকে বুঝতে চেষ্টা করছে বলে মনে হলো।”
বিস্তারিত শুনে ইপ্সিতা ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারল না। সে ইমরোজকে চেনে, এত দ্রুত যে তার ভাই বিয়ের শকটা হজম করতে পারবে না, এটা সে খুব ভালো করে জানে! এর পেছনে কোনো অভিসন্ধি না থেকেই পারে না!
তবে উৎপলকে কিছু বলে চিন্তায় ফেলতে চাইল না, সে নিজেই বরং চোখে চোখে রাখবে। রাত্রিকেও সে যতটুকু চিনেছে, সে-ও ছেড়ে কথা বলবে না। তাই এটুকু অন্তত স্বস্তির, তবুও রাত্রির খারাপ লাগতে পারে, এমন কিছু সে হতে দিতে পারে না! তাহলে মরমে মরে যাবে সে! এই বিয়ের আইডিয়াটা ওর মাথা থেকেই তো প্রথম বেরিয়েছিল! বিয়ের পরের ভাব হবার জন্যও মনে হচ্ছে আরেকটা মিশন শুরু করতে হবে!
***
রাত্রি বিবাহ ডটকমের কার্যক্রম আবারও পুরোদমে শুরু করেছে। সে কাজের মানুষ। ঘরে বসে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠে।
জাহিদের দেয়া রিপোর্ট দেখতে দেখতে ও হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। যে অন্যের বিয়ে নিয়ে এত খুঁতখুঁতে সে-ই কেমন ধাম করে জেদের বশে বিয়ে করে ফেলল! ছেলেবেলা থেকে মায়ের মুখে একটা কথা সে প্রায়ই শুনেছে, যত ভালো রাঁধুনিই হোক, নিজের রান্না করা খাবার সে ততটা উপভোগ করতে পারে না! এটার সত্যতা কতটুকু সে জানে না, পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।
তবে এই বিয়ের ঘটনার সাথে মিলে গেছে!
***
“ভাবি, কী করছ?”
“আরে ইপ্সিতা, এসো।” ইপ্সিতাকে দেখে মনে পড়ল, ওর বিয়েটা পেন্ডিং আছে।
রাত্রি সারাদিনের ধকল শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিল, ইপ্সিতার হাতের ট্রেতে দুই কাপ চা।
“নাও।”
রাত্রি চা নিয়ে বলল, “এটা করতে গেলে কেন?”
“চা’টাই মাঝেমধ্যে করি৷ আর কিছু করা হয় না। আমি খাবো, ভাবলাম তোমার জন্যও করি।”
“মা?”
“মা সকালের পরে আর চা খায় না।”
সহসা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ইপ্সিতা জিজ্ঞেস করল, “তোমার এখানে কেমন লাগছে ভাবি?”
ক্ষণকালের জন্য মৌনতা নেমে এলো ঘরে, এরপর মুখ খুলল রাত্রি, “ভালো। মা এত চমৎকার মানুষ। তুমিও খুব মিষ্টি একটা মেয়ে।”
“আর ভাইয়া?”
চা বেশ উপভোগ করছিল রাত্রি, এই বিষ মুখো লোকটার নাম নিতেই কেমন বিস্বাদ লাগল। মনে মনে বলল, “জঘন্য।”
মুখে বলল, “একটু অদ্ভুত ধরনের লোক তোমার ভাই।”
“কেমন অদ্ভুত?”
“কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চারা যেমন ছোট্ট বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে, সেটা ওদের সাথে যায়! কিন্তু এই বয়সে ওমন আচরণ করলে কেমন লাগে!”
ইপ্সিতা রাত্রির বলার ধরনে হেসে ফেলল, বলল, “বুড়ো বাচ্চা?”
এবার রাত্রিও হেসে ফেলল।
ইপ্সিতা হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, “তুমি ভাইয়ারর ভেতরে বাস করা শিশুকে এত দ্রুত দেখে ফেলেছ, খুব শীঘ্রই সরলতাটুকুও দেখতে পাবে।”
রাত্রি মনে মনে বলল, “ব্যাটার আবার সরলতা, ব্যাটার পেটে পেটে জিলাপির প্যাঁচ। আমার বয়েই গেছে ধেড়ে খোকার সরলতা আবিষ্কার করতে! দুনিয়ায় অনেক অনাবিষ্কৃত জিনিস আছে। সময় নষ্ট করতে হলে সেসবের পেছনেই করব। জিলাপির প্যাঁচ ছাড়াবার পেছনে নয়!”
***
ইমরোজকে নিয়ে রাত্রির বলা অবজারভেশন সে শুনেছে, নিজের ছোট বোনের ওকে নিয়ে মজা কুড়ানোও কানে এসেছে। তখনই সে নিজের ঘরে ঢুকছিল কি-না! নিজের ঘরটা তো এখন আর নিজের নেই! নিজের এত আদরের বোনটাও কি-না ওই মেয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে!
ওর বোনটা ছোট মানুষ, তার মাথা নষ্ট করছে এসব আজেবাজে জিনিস ঢুকিয়ে। এসব কাহাতক সহ্য হয়! বোনকে মাফ করে দিল, শেষে ওর স্তুতি গাইবার জন্য। কিন্তু রাত্রি! অসম্ভব!
না, এভাবে ছাড় দিলে মাথায় চড়ে বসে কাঁঠাল ভেঙে খাবে! আজই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে! ওকে দেখে ইপ্সিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া, তোমার আজ এত দেরি হলো যে!”
সে জানে উৎপলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল ইমরোজ। তবুও প্রশ্ন করল।
“তাতে কার কী! আমার কথা ভাবার সময় আছে তোদের?”
ইপ্সিতা বেরিয়ে গেলে ইমরোজ বলল, “বাচ্চা মেয়েটার মাথায় এসব কী ঢুকাচ্ছেন!”
রাত্রি ইচ্ছে করে পুরো ঘরে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছু একটা যেন খুঁজল, এরপর বলল, “বাচ্চা মেয়ে কে?”
“ইপ্সি।”
রাত্রি বিদ্রুপাত্মক হেসে বলল, “আপনি বুড়ো বাচ্চা বলে সবাইকে তেমন ভাবেন না-কি। একজন তেইশ বছরের তরুণীকে বাচ্চা মনে হয় আপনার? সমস্যাটা আপনার চোখে না মাথায়?”
“আমার কোথাও কোনো সমস্যা নেই। আপনি ইঁচড়েপাকা বলে সবাই তো আর তা নয়!”
রাত্রি যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে ইমরোজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “শুনেছি আপনি নাকি বাংলার শিক্ষক, ভুল শুনেছিলাম নিশ্চিয়ই। ইঁচড়েপাকা মানে জানেন?”
“খুব ভালো করে জানি। এখন বড় হয়েছেন, কিন্তু পিচ্চি বেলা থেকেই আপনি এমন।”
রাত্রির চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল, “এমন মানে কেমন?”
“সেটা আপনিই জানেন।”
“না, জানি না। বলুন।”
“পাগল, উন্মাদ।”
“শুনেছি মানুষ নিজে যেমন, অন্যের প্রতি ঠিক তেমন ধারণা পোষণ করে। আজ প্রমাণ পেলাম।”
ইমরোজও আজ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে, “এবং আমি জানি আমি ঠিক ধারণাই পোষণ করেছি আপনার সম্পর্কে।”
“তা এই পর্যবেক্ষণের ফলাফল নির্ণয় করেছেন কোন পদ্ধতিতে? রিসার্চ শুরু করেছেন নাকি? রিসার্চের বিষয় কী? মানুষকে চেনার একশো একটা উপায়?”
“যেই পদ্ধতিতেই করি, আপনাকে কেন জানাব?”
“এসব শোনার মতো আজাইরা সময়ও আমার নেই।”
“তাহলে জিজ্ঞেস করলেন কেন?”
“আমার ইচ্ছে।”
ইমরোজ কিছু বলতে যাচ্ছিল, ইপ্সিতা বাইরে থেকে ডাকল, “ভাইয়া, মা তোমাদের ডেকেছে।”
ওরা গিয়ে শুনল মা ওদের মধুচন্দ্রিমার ব্যবস্থা করছেন। দু’জনেই মনে মনে বলল,
“অসম্ভব।”
বিয়েটা ইমরোজের জন্য ছিল বজ্রপাত, ওমন একটা বিধ্বংসী মেয়ের সাথে ঘুরতে যাওয়াটা নির্ঘাত সুনামি!
………..
(ক্রমশ)