বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-২১+২২

0
29

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২১)
নুসরাত জাহান লিজা

“আমার মনে হয় তোদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া উচিত। নতুন নতুন বিয়ে করেছিস, এটাও আমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে? তোরা আজকালকার ছেলেমেয়ে। কিন্তু আচরণ করছিস আদি যুগের মতো, এসব কী ইমু?”

“বিয়ে করলেই ঘুরতে যেতে হবে কেন মা?”

ছেলের নির্বুদ্ধিতায় আনোয়ারা যারপরনাই হতাশ হয়ে বললেন, “তোকে তো আমি সব ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাইয়ে বড় করেছি। তাও যে এমন ফাঁপা মাথা কই পেয়েছিস বুঝলাম না। হানিমুনে মানুষ কেন যায়? তোদের এরেঞ্জ ম্যারেজ, নিজেদের মতো একটু নিজেদের চিনবি, জানবি। এরজন্যই যাবি।”

হানিমুনে যাবার কোনো ইচ্ছা রাত্রির নেই, তবে এত দামড়া ছেলের মায়ের কাছে ঝাড়ি খাবার এই মনোরম দৃশ্য সে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে। ভীষণ হাসি পাচ্ছে ওর, কিন্তু আনোয়ারা কথাগুলো বলেছেন অত্যন্ত সিরিয়াস ভঙ্গিতে, সেজন্য সে হাসতে পারছে না, প্রাণপণ চেষ্টায় হাসি চেপে রেখেছে।

মা সবসময় ইমরোজের সাথে এভাবেই কথা বলেন, তাই সে গা করে না। কিন্তু এখন সামনে ওর একমাত্র শত্রু উপস্থিত।

“মা, আমি জানি এসব। তুমি যার-তার সামনে আমাকে অপমান করছ, এটা কী ঠিক?”

“অপমান? তুই তো জিজ্ঞেস করলি। আমি উত্তর দিলাম শুধু। আর যার-তার সামনে মানে? ও তোর স্ত্রী, ইমু।”

“শোনো মা, আমি এখন কোথাও যেতে পারব না। বিয়ের জন্য সেদিনই ছুটি নিলাম। বারবার ছুটি নেয়া যায় না।”

“সামনের সপ্তাহে বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটি আছে। কক্সবাজার যা অন্তত। বুধবার যাবি, শনিবার রাতে বাসার জন্য রওনা দিবি। শুধু রবিবার ছুটি নিতে হবে।”

“মা, আমি যাব না। তাছাড়া উনারও কাজ আছে।”

ইমরোজ চাইছিল না যাবার অজুহাত রাত্রির উপরে চাপিয়ে সটকে পড়তে।

“তোমার মতামত কী রাত্রি?”

রাত্রির সরাসরি না বলত, কিন্তু ইমরোজের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সাথে ওকে আরেকটু নাকানিচুবানি খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে বলল,

“মা, আমার একটু ব্যস্ততা আসলেও আছে। কিন্তু আপনি বললে আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব। তবুও থাক মা, উনি যেহেতু যেতে চাইছেন না, পরে কখনো যাওয়া যাবে।”

“দেখলি? তোর বউয়ের আপত্তি নেই। তোর ওসব ভুজুংভাজুং বহুত সহ্য করেছি। বিয়ে করেছিস, এবার রেসপনসেবলিটি নিতে শেখ। আর রাত্রি, পরে আবার কী! এখন তোমাদের জন্য সময়টা অনেক সুন্দর। যত দিন যাবে, তত রেসপনসেবলিটি বাড়বে। একসময় নিজের শখগুলোকে চাইলেও আর প্রায়োরিটি দিতে পারবে না। মানুষের প্রায়োরিটি চেঞ্জ হয়ে যায়। তাই এখনই একটু নিজেদের মতো সময় কাটাও। সময় চলে গেলে আর ফিরে পাবে না।”

“মা, আমি…”

ইমরোজ আবার গোয়ার্তমি করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, আনোয়ারা বললেন, “এটাই ফাইনাল। তবে কোথায় যেতে চাস, সেটা তোরা ঠিক করিস।”

ওরা বেরিয়ে গেলে ইপ্সিতা বলল, “উফ্ মা। দারুণ।”

ইপ্সিতাই কলকাঠি নেড়েছে মায়ের কাছে। ইমরোজের মতিগতি ওর ভালো লাগছে না, নিজে তো সরাসরি কিছু করতে পারবে না। তাই মায়ের শরণাপন্ন হয়ে বলেছিল, “ওদের যে অবস্থা, কিছু একটা না করলে সারাজীবন ঝগড়া করে কাটিয়ে দেবে!”

এরপর বাকিটা আনোয়ারা নিজেই করেছেন৷

***
রুমে এসে দু’জনেই পায়চারি করতে লাগল, “খুব শখ না হানিমুনে যাওয়ার? ‘আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব’ ন্যাকামি! অসহ্য।”

“এত বাজে মিমিক্রি আমি জীবনেও দেখিনি। শুনুন, আপনার সাথে আমি সামনের পার্কেও যেতে চাই না। হানিমুন!”

“তাহলে ঢং করে বললেন কেন?”

“কারণ আমি ভেবেছিলাম আপনি কিছু একটা বলে আটকাতে পারবেন।”

“আর আপনি মায়ের ভালো বউমা হয়ে যাবেন, তাই না?”

“ঘ্যানঘ্যান করবেন না তো! একটা সামান্য বিষয়ে কনভিন্স করার ক্ষমতা নেই, আবার বড় বড় কথা।”

“পারতাম যদি না আপনি বাগড়া দিতেন।”

“শুনুন, আপনি যেভাবেই হোক, যাওয়াটা ক্যান্সেল করুন।”

“কথায় কথায় অর্ডার করবেন না। অসহ্য লাগে৷”

“আর আমার খুব ভালো লাগে, এত ভালো লাগে যে, দুটো পাখা গজিয়েছে।”

ইমরোজ মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়ল।

রাত্রিও ওর পাশে বসেছে, গভীরভাবে কিছু ভাবছে৷ একটা উপার যদি পাওয়া যায়, যাতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।

“কিছু পেলেন?”

ইমরোজের মাথায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা ভাবনা খেলে গেল, এই সুযোগ। জেতার এমন মোক্ষম সুযোগ আর কই পাবে!

সে বালিশে মাথা এলিয়ে দিল আয়েশ করে, এরপর মৃদু হেসে বলল,

“পেয়েছি।”

“বলুন, শুনি, আপনার গোবর ভর্তি মাথা থেকে কী বুদ্ধি বেরুলো?”

ইমরোজ আজ রাগে দাঁতে দাঁত চাপল না, বরং ওর হাসি আরেকটু বিস্তৃত হলো,

“চলুন, ঘুরেই আসি। এরচাইতে বেটার কিছু আর মাথায় এলো না!”

“ফাজলামো করছেন?”

“নাহ্! আমি ভীষণ সিরিয়াস। মধুচন্দ্রিমায় যেতে আমার আপত্তি নেই আর। মধুর প্রতিশোধ মধুচন্দ্রিমায়! আপনি যেমন আমার উপরে শোধ নিতে বিয়ে করেছেন, আমি আবার ঋণ রাখি না! শোধবোধ!”

বলেই গুনগুন করে বেরিয়ে গেল ইমরোজ, রাত্রি ইমরোজের বালিশ মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। প্রবল রাগে ফুঁসছে সে! বদের হাড্ডির পেটে পেটে যে এমন শয়তানি, এটা সে আগেই জানত! আজ নিশ্চিত হলো!

“শোধবোধ? আমিও ঋণ রাখি না ইমরোজ। সুদ সমেত ফেরত নেবার জন্য প্রস্তুত থাকুন। তোর মধুচন্দ্রিমায় যদি আমি করল্লার তেতো না মেশাই তো আমার নামও রাত্রি নয়!”

***
রাত্রি না থাকায় বাড়িটা ভীষণ খালি খালি লাগে। মায়া রাত্রির পছন্দের কিছু খাবার রান্না করেছেন। উৎপলকে ডেকে বললেন,

“এগুলো রাত্রিকে দিয়ে আসবি।”

“আমি? ওদের আসতে বললেই তো হতো মা।”

“সে বলা যেত। আনোয়ারা আপা সবসময় আসেন না। এটা স্বাভাবিক। তুই দিয়ে আয় বরং।”

উৎপল সংকোচ নিয়ে রাজি হলো, ওই বাড়িতে এখন সবাই আছে। সবার সামনে ইপ্সিতার সাথে কথা বলতে গেলে যদি ধরা পড়ে যায়!

উৎপল কল দিল ইপ্সিতাকে, সে ধরল না। আজ দুপুরে ঝগড়া হয়েছে। ওই বাড়ি গিয়ে কলিংবেল চাপতে ইপ্সিতাই দরজা খুলে দিল।

উৎপল কথা বলতেই যাচ্ছিল, ইপ্সিতা ইঙ্গিতে ভেতরে দেখিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,

“আরে ভাইয়া আপনি? আসুন আসুন। কেমন আছেন?”

প্রেমিকার মুখে ভাইয়া ডাক শুনে উৎপল একটা ধাক্কা খেল, মনে হলো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে! এতকিছু থাকতে শেষ পর্যন্ত ভাইয়া!

ইমরোজ এগিয়ে এলো, “আরে, উৎপল! এসো এসো। কেমন আছ?”

“ভালো। তুমি কেমন আছ?”

“ভালো। তুমি তো আসোই না বাসায়!”

ওরা বসার ঘরে এসে বসল।

“আন্টি কেমন আছেন?”

“মা ভালো আছে।”

“রাত্রি কোথায়?”

“ও ভেতরে, তুমি বোসো। আমি ডেকে দিচ্ছি।”

উৎপল খাবারগুলো ইপ্সিতার হাতে দিয়ে বলল, “এগুলো রাখুন। মা পাঠিয়েছে আপনাদের জন্য।”

ইমরোজ উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলল, “ইপ্সিকে আপনি বলছ? ও ছোট মানুষ।”

উৎপল বলল, “ছোট হোক, উনি একজন ভদ্রমহিলা। প্রথমেই তুমি বলাটা…”

ইপ্সিতা কটমট করে ওর দিকে তাকাল, ভদ্রমহিলা! ইমরোজ ভেতরে যেতেই ইপ্সিতা ফিসফিস করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি ভদ্রমহিলা? ফাজলামো হচ্ছে?”

“আমি যদি ভাইয়া হতে পারি, তোমাকে ভদ্রমহিলা বলেছি, আপু বলিনি, এটাই ভাগ্য।”

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এরমধ্যে রাত্রি এসে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “ভাইয়া!”

উৎপল উঠে বোনকে ভালো মতো দেখে ওর মাথায় হাত রেখে বলল, “কেমন আছিস?”

“তুমি কেমন আছ সেটা বলো! আমাকে তাড়ানোর জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিল। এখন তো মনে হয় বিন্দাস আছিস।”

উৎপল আজ আর খুঁনসুটি করল না, “তোকে ছাড়া বাড়িটা ভীষণ খালি খালি লাগে রে!”

রাত্রি উৎপলের কাঁধে মাথা রাখল, চোখে পানি চলে আসছিল, সেটাকে কোনোমতে প্রবোধ দিয়ে বলল, “এখন তো তোমাকে আর আমার জন্য চকলেট আনতে হয় না!”

উৎপল পকেটে থেকে চকলেটের বক্সটা বের করে রাত্রির হাতে দিলো, “প্রতিদিন এনে জমিয়ে রাখি। আজ একেবারে দিলাম। এতদিনের অভ্যাস কি এত সহজে ভোলা যায়?”

“ভাবি, তুমি এখনো চকলেটের বায়না করো?”

“ওর কাছে সারাজীবন করব। কিছু জিনিস বদলাতে ইচ্ছে করে না। ধরে রাখতে ইচ্ছে করে। বড় হয়ে গেলেও ছেলেবেলা গায়ে মেখে রাখতে ভালো লাগে!”

“কী কিউট ব্যাপার!” ইপ্সিতার কথায় রাত্রি হেসে উৎপলকে বসতে বলে নিজেও পাশে বসল।

ইমরোজ রাত্রিকে পাঠিয়ে মায়ের ঘরে যাচ্ছিল তাকে ডাকতে। কিন্তু ভাইবোনের মিষ্টি আদুরে আবদার ভরা খুঁনসুটি দেখে কেন জানে না দাঁড়িয়ে পড়ল! প্রথমে চকলেটের আবদার শুনে বিরক্ত হয়েছিল, পরে কেন যেন ভীষণ ভালো লাগল! রাত্রিকে সবসময় ডাকাবুকো দেখে অভ্যস্ত ইমরোজ৷ ওই ইমেজের ভেতরে যে এমন শিশুসুলভ আরেকটা রাত্রি আছে, এটা ওকে চমৎকৃত করেছে!

সে-ও ইপ্সিতাকে ভীষণ ভালোবাসে, কিন্তু এভাবে সেটা প্রকাশ করতে পারে কী! উৎপলের মতো!

“তুই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছিস?”

আনোয়ারার কথায় সম্বিতে ফিরে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, সবগুলো চোখ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সে বলল,

“তোমাকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম মা।”

ইপ্সিতা আর উৎপল পুরো সময়টা তটস্থ হয়ে রইল, কোনোভাবেই ধরা পড়া যাবে না। উৎপলকে কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়লেন না আনোয়ারা।

খাবার সময় মা উৎপলের প্লেটে মাছ তুলে দিচ্ছিলেন, ইপ্সিতা প্রায় বলেই ফেলতে যাচ্ছিল, উৎপল মাছ খায় না! এই যাত্রায় রাত্রির জন্য বেঁচে গেল। সে-ই বলল কথাটা। উৎপল তো আপনি তুমি গুলির ফেলছিল বারবার।

ইপ্সিতার মাঝেমধ্যে ভাইয়া ডাকটাই যত নষ্টের গোড়া! এত কাঁঠখড় পুড়িয়ে মিশন বিবাহ সাক্সেসফুল করেছে কী ওর মুখে ভাইয়া ডাক শোনার জন্য!

ইপ্সিতাকে মেসেজে বলেছে, “খবরদার ভাইয়া বলবে না।”

“ভদ্রমহিলা বললে কেন? এখন তো শুনতেই হবে।”

ধূর! কোনো মানে হয়! তবে এতকিছুর মধ্যে একটা খবর শুনে ভালো লাগল, রাত্রি আর ইমরোজ মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছে।
…………
(ক্রমশ)

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২২.১)
নুসরাত জাহান লিজা

মধুচন্দ্রিমায় যাবার প্রস্তুতি হিসেবে রাত্রি হাতের জরুরি কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। যেই বিয়েগুলো প্রায় গুছিয়ে এনেছে, সেই ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং সারল। মিটিং প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন ইমরোজ কল করল।

“কতক্ষণ লাগবে আপনার?”

আজ ওরা কেনাকাটা করতে যাবে, ওদের কারোরই ইচ্ছে ছিল না, রাত্রি বলেছিল,

“মা, কিছুদিন আগেই তো কেনাকাটা করলাম।”

কিন্তু আনোয়ারা মানেননি। কড়া গলায় বলেছেন,

“সেটা তো বিয়ের জন্য। এখন কমফোর্টেবল কিছু নিবি।”

ইমরোজ জানে বলে লাভ হবে না, তাই এবার কিছু বলেনি। তাছাড়া এই হানিমুনে সে এখন বেশ আগ্রহের সাথেই যাচ্ছে, শোধবোধ বলে কথা।

“আপনি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করুন। আধাঘণ্টা লাগবে।”

“এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে?”

“কল করে আসলেই পারতেন। কাজ না গুছিয়ে তো যাওয়া যায় না।”

নির্ঘাত এই মেয়ে ইচ্ছে করে দেরি করছে, সারাক্ষণ ওকে ভোগান্তি দিতে এক পা খাড়া করে রাখে। অসহ্য মেয়ে।

রাত্রি কাজ শেষ করে বেরুলো ঘড়ি ধরে বিয়াল্লিশ মিনিট পরে। ইমরোজ মোটরসাইকেল কিনেছে কিছুদিন হয়। পুরোনোটা অনেকদিন থেকেই অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে রাত্রি বলল, “আপনি বাইক এনেছেন কেন? আপনি যান, আমি রিকশা বা সিএনজি দেখছি।”

“দেখুন, সেটা আগে বললেই পারতেন। বিয়াল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে এখন সিনক্রিয়েট করছেন কেন?”

“আপনার সাথে বাইকে চাপতে ভরসা পাচ্ছি না। রিভেঞ্জ ঘুরছে মাথায়, বলা তো যায় না, ইচ্ছে করে ফেলেও দিতে পারেন!”

“ভয় পাচ্ছেন? আপনি ভয় পান জেনে ভালো লাগল।”

রাত্রি চোখে আগুন ঝরিয়ে ইমরোজকে ভস্ম করে দিতে চাইল, “ভয়? ওই জিনিসটা আমার মধ্যে নেই। সরুন, সামনে এগিয়ে বসুন। খবরদার যদি ফেলে দেবার চেষ্টা করেছেন, আমি একা পড়ব না, আপনাকে সাথে নিয়েই পড়ব।”

“আমি এতটাও খারাপ নই যে ইচ্ছে করে কারোর এক্সিডেন্ট করাব। এটুকু ভরসা রাখতেই পারেন।”

রাত্রি উৎপলের সাথে বাইকে উঠেছে অসংখ্যবার। তাই তেমন জড়তা নেই। কিন্তু ইমরোজের সাথে প্রথমবার, কোথাও যেন খানিকটা অস্বস্তি হলো। তবে সেটা কেটে গেল দ্রুত৷ বেশ সাবধানেই চালাচ্ছে ইমরোজ, রাত্রির মনে হলো ছেলেটা ভীষণ ঝগড়াটে, বোকাও মনে হয় মাঝেমধ্যে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে একেবারে খারাপ নয় বোধহয়।

কেনাকাটা করার সময় রাত্রি ইচ্ছে করে সময় নিল, দুই বাসার সবার জন্যও কেনাকাটা করল ওরা। দাম মেটাতে গিয়ে কিছুটা কথা কথা কাটাকাটি লাগছিল৷ কারণ রাত্রি ইমরোজকে টাকা দিতে নিষেধ করেছিল,

“এখন দেবেন, পরে এটা নিয়ে কথা শোনাবেন, সেটা হবে না।”

শেষমেশ দুজন ফিফটি ফিফটি বিল শেয়ার করতে রাজি হয়েছে।

ইমরোজ খেয়াল করল, রাত্রির পোশাক কেনায় খুঁতখুঁতে, তবে শপিংয়ে তারও অনীহা। কোনো মেয়ের শপিংয়ে অনীহা থাকতে পারে, এটা ওর জন্য রীতিমতো বিস্ময়কর।

***
আগামীকাল রাত্রিরা কক্সবাজার চলে যাবে তিনদিনের জন্য, এই উপলক্ষে ওদের বাসায় ইমরোজদের দাওয়াত আজ।

রাত্রি খয়েরি রঙের একটা শাড়ি পরল৷ বিয়ের সময় উৎপল দিয়েছিল শাড়িটা। ভারি সাজে ওর চেহারার মিষ্টতা ঢেকে যায়, মানায় না কেন যেন। মানানসই স্বল্প প্রসাধনী ব্যবহার করেছে সে। তবে লিপস্টিক গাঢ় রঙের পরে। খোলা চুলে ওকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল।

ইপ্সিতা ওকে ডাকতে এসে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “ভাবি, তোমাকে কী যে মিষ্টি লাগছে!”

“তোমার থেকে কম।” মৃদু হেসে উত্তর দিল রাত্রি।

ইমরোজ নীল রঙের পাঞ্জাবি পরেছে, আনোয়ারা বললেন, “তুই খয়েরি পাঞ্জাবিটা পরতে পারলি না?”

“কেন মা, এটাতে কী সমস্যা?”

“এই জেনারেশন পুরোটাই এমন রসকষহীন, নাকি তোরা দুইটাই এমন এক পিস?”

ইমরোজ আর রাত্রি দুজন দুজনের দিকে তাকাল,
ইমরোজ ভাবল, “দেখতে যেমন নিরীহ, কাজেকর্মে সাক্ষাৎ শাকচুন্নী।”

রাত্রির ভাবনা ছিল, “দেখো, কেমন গোবেচারা ভাব, মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। অথচ এর পেটে পেটে শয়তানি। চেহারা আর স্বভাবের এত বৈপরীত্যে কেন!”

রাত্রি মায়াকে বলল, “মা, ভাইয়ার বিয়ের ব্যাপারে এসে তোমাদের ডিটেইলস দেব। খুব ভালো ফ্যামিলি। মেয়েটাও ভালো। ভাইয়াকে বায়োডাটা দিয়েছিলাম, দেখে সিদ্ধান্ত নিও।”

“উৎপল কী বলেছে?”

“কিছুই না। তবে ও যেহেতু কোনো সম্পর্কে ইনভলভ হয়নি, আপত্তি করার তো কিছু দেখছি না।”

“আচ্ছা, সে হবে নাহয়। তোরা ভালোয় ভালোয় ঘুরে আয়।”

মায়া আর হাবীব সাহেব দোয়া করে দিলেন ফেরার সময়।

নির্দিষ্ট দিনে ওরা নির্ধারিত ট্রেনে গিয়ে বসল। দুজনের একসাথে প্রথম যাত্রা। ইমরোজের মনে প্রতিশোধ নিতে পারার আনন্দ, রাত্রির মনে সেই মধুময় আনন্দে চিরতার রস ঢালার বাসনা৷ মধুর সাথে চিরতার রস মেশালে কেমন লাগবে! বিটকেলে স্বাদের কথা মনে পড়তেই কেমন গা গুলিয়ে এলো।
………..
(ক্রমশ)

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২২.২)
নুসরাত জাহান লিজা

চট্টগ্রামে রাত্রির ফুপুর বাসা, সেখানে একবার না গেলে তিনি ভীষণ মন খারাপ করবেন৷ ওরা এসেছে খুব অল্প সময়ের জন্য। চট্টগ্রাম পৌঁছাতে ভোর হবে। বিকেল পর্যন্ত ফুপুর বাসায় বিশ্রাম করে কক্সবাজারে যাবে ওরা। কিছুক্ষণ ভালোই গেল, দু’জনেই পাশাপাশি বসে বই পড়ছিল। কেউ কারোর সাথে কথা বলছিল না। শুধু ট্রেন থামলে ইমরোজ একবার করে দেখতে চেষ্টা করছিল কোন স্টেশন!

হঠাৎ একজন ইমরোজের বয়সী সুদর্শন ছেলে এসে রাত্রিকে ডাকল,

“আপু, আপনার কাছে পানি হবে?”

ইমরোজ এর আগে যখন উঠেছিল, এই ছেলেকে দেখেছে, ওদের থেকে বেশ দূরেই এর সিট। এদিকে উঁকিঝুঁকি মেরে পাশের জনকে কিছু বলছিল। এখন যে আশেপাশে বাদ দিয়ে রাত্রির কাছে পানি নিতে এসেছে, বিষয়টা ওর ভালো লাগেনি। ওর সন্দেহ আছে, এই ছেলের ব্যাগ চেক করলে নিশ্চিত পানির বোতল পাওয়া যাবে।

রাত্রি কিছু বলার আগে সে-ই বলল, “হ্যাঁ, আমি দিচ্ছি।” এরপর ইচ্ছে করেই রাত্রিকে বলল, “পানিটা কোন ব্যাগে যেন?”

রাত্রি ছেলেটার ইনটেনশন বুঝতে পেরেছে, তবে ইমরোজের ওর প্রতি প্রোটেক্টিভ হবার কারণ বোধগম্য হলো না।

রাত্রি ইমরোজের ব্যাকপ্যাক ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলল, “ওইটাতে মনে হয়।”

এবার ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “যদি কিছু মনে না করেন, আপনারা সম্পর্কে…”

দুজন একসাথে উত্তর দিল, “হাজব্যান্ড ওয়াইফ।”

ছেলেটা এই যুগলকে কিছুক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখে বলল, “ও আচ্ছা, আপনাদের দেখে বোঝা যায় না ঠিক।”

ওদের সম্পর্ক যাই থাক, বাইরের মানুষ কেন আঙুল তুলবে, দুজনেরই মেজাজ খারাপ হলো, ইমরোজ বলল, “কেন?”

“না, মানে কাপলরা তো গল্প করে, উচ্ছ্বসিত থাকে। আমি ভেবেছিলাম, আপনারা অপরিচিত। আচ্ছা, স্যরি। কিছু মনে করবেন না। আসি।”

রাত্রি হেসে বলল, “সে কী, পানি লাগবে না?”

“না। আসি।”

ছেলেটা যাবার পরে রাত্রি হেসে ফেলল, ইমরোজ বলল, “হাসছেন কেন? আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছিল এতে হাসির কী আছে? অদ্ভুত মেয়ে তো আপনি।”

“আমি হাসছি আপনার জন্য।”

“আমি কী করেছি?”

“আমাকে বিরক্ত করলে আপনার কিন্তু খুশি হবার কথা ছিল। আপনি বিরক্ত হলেন কেন?”

“আশ্চর্য! আপনার প্রতি আমার একটা রেসপনসেবলিটি আছে না?”

রাত্রি মাথাটা ইমরোজের দিকে একটু এগিয়ে এনে চোখে চোখ রেগে বলল, “সেটা হলেই ভালো। আমার প্রেমে পড়তে যাবেন না যেন! তাহলেই ডুববেন।”

বলেই রাত্রি সরে গিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বইতে মুখ ডুবিয়ে দিল, এমন ভয়ংকর একটা কথা বলেছে মাত্রই কে বলবে দেখে! ইমরোজের কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয়েছিল কেন কে জানে! তবে ধাতস্থ হয়ে নিয়ে সগর্বে ঘোষণা দিল,

“আপনার প্রেমে? আমি? যদি কখনো উন্মাদ টুন্মাদ হয়ে যায়, তাহলে জানি না, কিন্তু সুস্থ থাকতে, ইম্পসিবল।”

“আমি শুধু সতর্ক করলাম।”

রাত্রি খুব ভালো করে জানে, আর যাই হোক, ইমরোজ ওর প্রেমে পড়েনি। ওকে জ্বালানোর জন্য কথাটা বলেছে। প্রতিক্রিয়া দেখে বেশ মজাও লাগছে!

কতক্ষণ পরে খাবার বের করে খেয়ে নিল, আনোয়ারা ওদের জন্য হালকা খাবার দিয়ে দিয়েছেন।

তবে বাকি রাস্তা কেউ আর কোনো কথা বলল না। নির্বিঘ্নেই কাটল।

নামার সময় ইমরোজ নিজের ব্যাগটা নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছে দেখে রাত্রি বলল,

“আমার একটা ব্যাগ ধরুন।”

“আপনি নিজেই নিন। আপনারটা আমি কেন ধরতে যাব।”

“একটু আগে না বললেন আমি আপনার রেসপনসেবলিটি? এখনই ভুলে গেলেন?”

“নিলেই তো বলবেন, আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি। কথা শোনার জন্য কেন নেব?”

“প্রেমে পড়ার ভয় পাচ্ছেন? এত ভীতু আপনি?”

এবার ইমরোজের আঁতে ঘা লাগল, ও মোটেও ভীতু নয়! সেটা প্রমাণ করার জন্য রাত্রির লাগেজটা নিল।

“পুরো একমাস থাকার প্ল্যান না-কি আপনার? এত কী নিয়েছেন ব্যাগে?”

“মেয়েদের অনেককিছু লাগে। ব্যাগ বড় হওয়া স্বাভাবিক। আপনি বুঝবেন না।”

এরমধ্যে ট্রেন থেমে গেছে, নামার আগে ইমরোজ বলল, “আমি মোটেও ভীতু নই।”

“জেনে খুশি হলাম।”

***
“মা আমার কাছে বায়োডাটা চাইছে।”

উৎপল আছে একটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে। ইপ্সিতার সাথে মুঠোফোনে কথা বলছে এখন।

“কার?”

“শোভার।”

“উৎপল, ফাজলামো করছ?”

“সত্যি। রাত্রি নাকি সেদিন যাবার আগে মাকে বলে গেছে আমার কাছ থেকে বায়োডাটা নিতে। মা ওটা চাইছে এখন।”

“এবার মনে হয় আমাদের সব বলে দেয়া উচিত। এভাবে আর কত!”

“এভাবেই যদি বলব, তাহলে এত কাহিনী করে ওদের বিয়ে কেন দিলাম? আমি মাকে বলেছি আমি হারিয়ে ফেলেছি ওটা। ওরা আসুক৷ এরমধ্যে একটা ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলব। একটু ভরসা রাখো ইপ্সি।”

“আমার কিছু ভালো লাগছে না।”

ভালো ওরও লাগছে না। কোনো বুদ্ধি না পেলে সরাসরি বলতেই হবে। ইপ্সিতা ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।

ওর মনে পড়ে ওর বন্ধু পিয়ালের বিয়েতে ইপ্সিতা এসেছিল। সে পিয়ালের ছোটবোনের ফ্রেন্ড। সেখানেই পরিচয়। কথাবার্তা চলতো। বলতে বলতে একসময় ভালোলাগা তৈরি হয়, তারপর হুট করে একদিন সে প্রস্তাব দিয়ে ফেলে। ইপ্সিতাও রাজি হয়ে যায়৷ সেই থেকে ওদের সম্পর্ক। কত শত প্রতিশ্রুতি।

***
কক্সবাজারে আসতে রাত হয়ে গেল। ওরা হোটেলে নিজেদের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে একবার বেরুলো। কলাতলী বীচের এদিকে ভালোই জন সমাগম। তবে আলো নেই সেভাবে। অদূরের স্থানীয় দোকানগুলোর আলো আসছে খানিকটা। আজ অদ্ভুত সুন্দর চাঁদ উঠেছে। জোৎস্নালোকে ভেসে যাচ্ছে জলরাশি, বাতাসে ভেসে আসছে সমুদ্রের কান্না কিংবা আনন্দের সুর!

সেইসাথে বিশাল সমুদ্রের গর্জন কেমন মন খারাপ করা একটা ভালো লাগায় আচ্ছন্ন করে ফেলল রাত্রিকে। মনে হলো সুবিশাল জলরাশির সামনে সে অতি তুচ্ছ একজন মানুষ। ওর আশেপাশে সমস্তই যেন মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হয়ে গেল।

“আমার এই গর্জনটা খুব ভালো লাগে।”

ইমরোজের কথায় ওর ঘোর কাটল, এর আগেও সে দুবার এসেছে এখানে। একবার পরিবারের সাথে, আরেকবার ফ্রেন্ডদের সাথে। এবার যার সাথে এসেছে, তার সাথে ওর অদ্ভুত এক যোগসূত্র! ওর যে জীবনসঙ্গী হবে, তার অবচেতন মনে আঁকা ছবির সাথে কি এই ছেলেটা মিলে! তবুও তো একটা অদৃশ্য সুতো ওদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।

এই অপার্থিব পরিবেশই কি-না, ওদের ভেতরে থাকা প্রতিশোধের খেলা, কিছু মুহূর্তের জন্য যেন কোথায় সরে গেছে! রাত্রির আজ আর রাগ হলো না,

“আমারও।”

ওরা সৈকত ধরে হাঁটল বেশ কিছুক্ষণ। মাঝেমধ্যে অর্থহীন কিছু আলাপ। দুজনেই যদিও স্বীকার করবে না, তবুও ভেতরে ভেতরে জানে, সময়টা মন্দ কাটেনি।

হোটেলে ফিরতেও কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যেই থাকল। তবে ওই পরিবেশে যা স্বাভাবিক, এই আলো ঝলমলে বন্ধ রুমটা সম্পূর্ণই আলাদা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন আবার নিজেদের মধ্যে ফিরে এলো। চমৎকার সময় কাটায় রাত্রি আজ আর ইমরোজের পিছু লাগেনি।

সে জামাটা বদলাবে বলে ওয়াশরুমে যাচ্ছিল, ইমরোজের ঝড়ের বেগে ওকে ক্রস করে ঢুকে পড়ল।

রাত্রির কিছুক্ষণ সময় লাগল বুঝতে৷ এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“অসভ্য, ফাজিল ছেলে।”

সে প্রবল রাগে এই পাশ থেকে ছিটকিনি তুলে দিয়ে জামা বদলে আয়েশ করে বসল। একে ছাড় দেয়াই ভুল হয়েছে, ব্যাটা বদের হাড্ডি, মিচকে হনুমান। আজ ইমরোজের একদিন কী রাত্রির একদিন! যদি জরুরি হতো, ও যেহেতু আগে যাচ্ছিল, ওকে বললে কি যেতে দিত না! এটা কী ধরনের বর্বর আচরণ!
………
(ক্রমশ)