#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২৩+২৪)
নুসরাত জাহান লিজা
ওয়াশরুমের দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা পড়ছে। রাত্রির তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে কানে এয়ারফোন গুঁজে প্রিয় গানের মূর্ছনায় ডুব দিয়েছে। ওই বর্বর ছেলে কিছুক্ষণ শাস্তি ভোগ করুক, নিজের আচরণের জন্য।
প্রায় দশ মিনিট অতিবাহিত হবার পরে রাত্রি সাড়া দিল, “এত শব্দ করছেন কেন?”
“আপনি দরজা বন্ধ করে রেখেছেন কেন? এটা কী ধরনের আচরণ? এক্ষুণি খুলুন।”
ইমরোজের ক্রুদ্ধ গলা ভেসে এলো। রাত্রি গলা কিছুটা উঁচিয়ে বলল, “আপনি যেভাবে ঢুকলেন, মনে হলো ওটা আপনার ভীষণ পছন্দের জায়গা। ভাবলাম প্রিয় জায়গায় কিছুক্ষণ বন্ধ থাকতে পারলে আপনি খুশিই হবেন।”
“রাত্রি, এই মুহূর্তে যদি ছিটকিনি না খুলেন, তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
“হুমকি দিচ্ছেন? অনেক ভয় পাচ্ছি, ভয়ে কাঁপছি থরথর করে। শুনি, কী করবেন আপনি?”
“ফজলামোর একটা সীমা আছে। খুলুন।”
রীতিমতো ফুঁসছে ইমরোজ, সম্ভব হলে দরজা ভেঙে ফেলত সে, তারপর বেরিয়ে এই দরজার ভাঙা অংশ দিয়ে ওই অভব্য মেয়ের মাথায় সেটা প্রয়োগ করতে পারলে ওর শান্তি হতো।
“খুলব না। আপনার শাস্তি এটা। এক ঘণ্টা পরে খুলব।”
“কীসের শাস্তি?”
“জানে না? আপনি একদিন আমার সহবত জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। একটা মেয়ে ওয়াশরুমে যাচ্ছিল, তার অনেকরম আর্জেন্সি থাকতে পারে। তাকে জিজ্ঞেস না করে প্রায় ধাক্কা দিয়ে আপনি ভেতরে গেলেন৷ সহবত জ্ঞানের আপনার বড্ড অভাব, অভদ্র আচরণের শাস্তি এটা।”
ইমরোজ জানে কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু ওই মেয়েকে বললে অবশ্যই ওকে সুযোগ করে দিত না, এটা সে নিশ্চিত। তাই তাৎক্ষণিকভাবে যা মাথায় এসেছে তাই করেছে। কিন্তু এই মেয়ে যে বিচ্ছু প্রজাতির, সেটা ওর মনে রাখা উচিত ছিল। দেখতে নিরীহ, কিন্তু বিষধর! এক ঘণ্টা অনিচ্ছাকৃতভাবে বাথরুমে বন্দী, জিনিসটা ইমরোজের হজম হচ্ছে না একেবারেই।
“এক্ষুণি খুলুন।”
“আপনি আপাতত বন্দী মিস্টার লেকচারার। এসব হুকুম এখানে চলবে না। এক ঘণ্টার আগে বেরুতে চাইলে নিজের দোষ নিজের মুখে স্বীকার করুন। অনুতপ্ত হলে শাস্তি মওকুফ করা হবে কিনা ভেবে দেখা যাবে! আরেকটা কথা, এমন অভদ্র আচরণ করলে শাস্তি বেড়েও যেতে পারে।”
আমুদে গলায় বলল রাত্রি। ইমরোজ মরে গেলেও এই মেয়ের কাছে নতি স্বীকার করবে না। অসম্ভব। তবে আর রিস্ক নিল না, হুমকি দেয়া থেকে বিরত থাকল।
এরপর আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রাত্রি ওর কাজে মন দিল। বিছানা ঠিকঠাক করল, মাত্র বদলে ফেলা পোশাক ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। ফেলে রাখলে যাবার সময় মনে করে তুলতে ভুলে যাবে। বাসায় গিয়ে পরিষ্কার করে নেবে।
কিছুক্ষণ পরে আবার মৃদু ধাক্কা পড়ল, রাত্রির নিজের কাছেও মনে হলো, কাজটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। ছাব্বিশ মিনিটের মাথায় সে দরজাটা খুলে দিল।
ইমরোজ বেরিয়ে ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো, সম্ভব হলে চোখের আগুনে সে রাত্রিকে ভস্ম করে দিত।
“আমার ভীষণ দয়া, তাই শাস্তি কমিয়ে দিলাম।”
ইমরোজ খপ করে রাত্রির একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল, “আপনি এত নীতির ফুলঝুরি ছুটান, এখন যে অমানবিক আচরণ করলেন তার বেলায় সেই নীতি কোথায় ছিল?”
রাত্রি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল, বল প্রয়োগে না পেরে সর্বোচ্চ শক্তিতে ইমরোজের হাতে চিমটি খাটল। ইমরোজ ছোট্ট একটা আর্তনাদ করে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল।
বিস্ফারিত চোখে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে দুই নখের প্রবল চাপে দাগ বসে গেছে। কিছুটা রক্তও জমেছে ভেতরে।
বিষধর বিচ্ছু, একটু আগেই এই মেয়ের নাম দিয়েছিল, এত দ্রুত নামের স্বার্থকতা প্রমাণ করেছে। এটার দাগ যদি থেকে যায়! সে সর্বদা শুদ্ধতা পছন্দ করে। এই মেয়ে কিনা ওর হাতে এমন দাগ করে দিয়েছে!
“আপনি একটা বিষাক্ত বিচ্ছু।”
রাত্রি হেসে বলল, “মৌমাছি বলতে পারেন। এমনিতে শান্ত, কিন্তু চাকে ঢিল ছুঁড়লে মজা বুঝিয়ে দিই।”
“নখ কাটেন না আপনি?”
“সেটা আপনার জানার বিষয় নয়। একজন মেয়ের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয়, তার প্রাথমিক শিক্ষা কিছুটা হয়েছে নিশ্চয়ই!’”
ইমরোজের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল, সে কখনো গলা উঁচিয়ে কথা বলে না, আজও পরিমিত আওয়াজ বজায় রাখল, কিন্তু হিসহিসিয়ে বলল,
“আপনি নিজেকে কী মনে করেন রাত্রি? মহারানী ভিক্টোরিয়া? সকলেই আপনার প্রজা? কাউকে শাস্তি দেবার আপনি কে? করেন তো ঘটকালি। আমার পড়াশোনা নিয়ে কথা শোনান আবার! লজ্জা করে না? আপনার যোগ্যতা থাকলে একটা ভালো প্রফেশনেই কাজ করতেন। নেই তো সেটা! তাই এসব করে কিছু টাকা কামিয়ে ধরাকে সড়া জ্ঞান করেন। আপনার দৌড় আমার জানা আছে।”
রাত্রির সদা উৎফুল্ল হাসি এক লহমায় মিলিয়ে গেল। মুখ থমথমে হয়ে গেল, চোখে একরাশ হতাশা এসে ভীড়ল। আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল,
“আপনার প্রত্যেকটা কথার উত্তর আমার কাছে আছে। কিন্তু যার মেন্টালিটি এমন, তার কাছে সেসব ব্যাখ্যা করব না৷ এত দুর্দিন আমার আসেনি।”
বলে সে ওয়াশরুম গেল। ইমরোজও যদি ছিটকিনি তুলে দেয়, সেটাও ভাবল না। সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। ওর প্রফেশনকে, ওকে এতটা ছোট করে আজ পর্যন্ত কেউ কথা বলেনি কোনোদিন।
ওরা একজন আরেকজনের পিছু লেগে থাকে, টম এন্ড জেরির মতো এটা ঠিক। কিন্তু সেখানে এতটা নিষ্ঠুর আক্রমণ থাকে না।
তখন রাত্রি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, ওদের এক বন্ধুর ক্যান্সায় হয়েছিল। ওই বন্ধুর পরিবারের সামর্থ্য ছিল না চিকিৎসা ব্যয় বহন করার। তখন ওরা ফান্ড রেইজ করত। ওই সময় ওদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র একজন ভাইয়া ওদেরই এক বান্ধবীকে পছন্দ করত। কিন্তু বলতে পারে না। ওদের সাথে শেয়ার করে। তখন রাত্রির মাথায় আইডিয়াটা আসে। সে প্রফেশনাল ওয়েতে ওদের স্যাটিং করিয়ে দেয়, কিছু পারিশ্রমিক নেয়। ওদের সামর্থ্যের সাথে ওই টাকাটাও সে ওই ফান্ডে দিয়ে দেয়। প্রথমে বান্ধবীদের সাথে নিয়ে বিবাহ ডটকম শুরু করে। প্রথমদিকে তেমন ক্লায়েন্ট আসত না। ওরা টাকা জমিয়ে লিফলেট ছাপায়, সেটা বিভিন্ন দোকানে দোকানে বিলি করে। দুই একজন করে আসতে থাকে ক্লায়েন্ট।
পারিশ্রমিকের টাকার পুরোটাই ওই বন্ধুর চিকিৎসায় দিয়ে দিত। দেড় বছরের মাথায় সে মারা যায়! ওর বাকি বন্ধুরাও বিবাহ ডটকমে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু রাত্রি অটল থাকে। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে প্রতিষ্ঠানটাকে একটু বড় করে। এরপর ওর একাগ্রতা, পরিশ্রম, সততা, আর ইনোভেটিভ ইন্টেলিজেন্স প্রয়োগ করে আজ একটা ভরসা যোগ্য জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, বিবাহ ডটকম।
এটা ওর তিলে তিলে গড়া, হৃদয়ের একটা অংশ। নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়েছে। ওর ফ্যামিলি ক্রাইসিস ছিল না, কিন্তু ওর অধীনে যারা কাজ করে, প্রত্যেকেরই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে সে। হয়তো অল্প কিছু মানুষ, কিন্তু ওই মানুষগুলোর উপরে তাদের পরিবার নির্ভরশীল। প্রতিমাসে দাতব্য সংস্থায়, পথশিশুদের জন্য ডোনেশন দেয়! বিবাহ ডটকমকে আরও বড় করার স্বপ্ন ওর। তখন হয়তো আরও কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বিয়ে দেয়াটা বাজে প্রফেশন যারা মনে করে তাদের মানসিকতা নিয়ে ও সন্দিহান।
ওয়াশরুমের বন্ধ দরজায় মাথা এলিয়ে দিয়ে বড় করে শ্বাস টানল। সে দুর্বল নয়, তাই কাঁদল না। তবে ভেতরে ঠিকই তোলপাড় হচ্ছিল!
ইমরোজ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। উৎপলের কাছে সে শুনেছিল, নিজের পরিবার আর বিবাহ ডটকম এই দুটো রাত্রির সবচাইতে বেশি পছন্দের। উৎপল বলেছিল, কারণ ওর মনে হয়েছিল ইমরোজ রাত্রিকে বুঝতে চায় বলে জানতে চাইছে।
তবে ইমরোজ সেদিন ওর দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছিল। আজ প্রচণ্ড রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ব্রম্মাস্ত্র প্রয়োগ করেছিল। ভেবেছিল, সব সময়ের মতো রাত্রি তেড়েফুঁড়ে ওর সাথে ঝগড়া করবে! কিন্তু এতটা ঠান্ডা আচরণ আশা করেনি।
সে তো রাত্রিকে কষ্টই দিতে চেয়েছিল, তবুও এত খারাপ লাগছে কেন! অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিল ভেতরটা। ভুল হয়ে গেছে।
রাত্রি বেরিয়ে দেখল ইমরোজ একই জায়গায় একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিজের মতো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
ইমরোজ বুঝতে পারছিল না কী করব। ওর মনে পড়ল রাত্রি আলোতে ঘুমাতে পারে না। আলো জ্বেলে রাখা নিয়েও ওদের ঝগড়া হয়েছে কয়েকবার। আজ ওই প্রান্ত থেকে কিছু না বলা সত্বেও ইমরোজ আলো নিভিয়ে দিল।
কয়েকবার মনে হলো রাত্রিকে ডেকে একবার স্যরি বলে নেয়। কিন্তু কোথায় যেন বাঁধল। কিছুক্ষণ পায়চারি করে সেও শুয়ে পড়ল রাত্রির পাশে, তবে ঘুম এলো না সহসা। ওই প্রান্তেও যে নির্ঘুম একজন, তাও উপলব্ধি করল।
সকালের নাস্তা সেড়ে ইমরোজ রাত্রিকে বলল, “আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরব।’’
রাত্রি নিরুত্তর। ইমরোজ জানে না, কেন কৈফিয়ত দিল। সে বেরিয়ে এসে মুক্ত বাতাসে খানিকটা প্রশান্তি পেল, ভীষণ হাঁসফাঁস লাগছিল ভেতরে। সৈকত প্রচুর ট্যুরিস্টের আনাগোনায় মুখরিত।
ইমরোজ মাথায় চিন্তার পাহাড় নিয়ে হাঁটছিল। সে মোটেও ছোট মনের নয়! কারো প্রফেশনকেই সে তুচ্ছ করে দেখে না। জেতার জন্য বলেছিল কথাগুলো। কখনো বলে না বলেই হয়তো অপরাধবোধ কাঁটার মতো খোঁচাচ্ছে ভেতরে।
একবার ক্ষমা চাইতে হবে রাত্রির কাছে। নইলে নিজেকেই ক্ষমা করতে পারবে না। কিন্তু কীভাবে বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না।
একবার মনে হলো কোনো বন্ধুকে কল দেয়, ওর বেশিরভাগ বন্ধুরাই বিবাহিত। পরে নাকচ করে দিল। নিজের এই একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বন্ধুদের হাসিঠাট্টার খোরাক জোগায় এটা সে চায় না৷
উৎপলকে একবার কল দেবে কী! না, ঠিক হবে না। ওর কাছ থেকে জেনে ওর আদরের বোনকে কষ্ট দিয়েছে, এটা জানলে নিশ্চয়ই ওকে সাহায্য করবে না। শেষমেশ গুগলের দ্বারস্থ হলো। সার্চ করল,
‘কাউকে স্যরি বলার বেস্ট ওয়ে’।
রেজাল্ট দেখে সে আশেপাশে হাঁটতে লাগল।
কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে একটা ফুলের দোকান পেয়ে গেল। সেখানে কার্ড ও পাওয়া গেল।
রাত্রির প্রিয় ফুল কী সে জানে না, অনেক ভেবেচিন্তে দশটা গোলপ কিনল। লাল নয়, সাদা গোলাপ। কার্ডে নিজের কিছু কথা লিখল৷ যা মনে এলো, ভেতরের অনুশোচনা থেকে। এরপর ফিরে গেল।
***
রাত্রি রুমে ফিরে এসে মায়ার সাথে কথা বলল। এরমধ্যে আনোয়ারা কল দিলেন।
“কী খবর তোদের?”
“ভালো মা। আপনি কেমন আছেন? ইপ্সি?”
“আমরা ভালো আছি।”
“খেয়েছিস?”
“হ্যাঁ মা।”
“এখন কী করিস?”
“হোটেলেই আছি মা।”
“ইমু কই?”
ইতস্তত করে রাত্রি বলল, “ঘণ্টাখানেকের জন্য বাইরে গেছে।”
“ও আর বুঝতে শিখল না। একসাথে গেছিস। বউকে একলা রুমে ফেলে কেউ বাইরে যায়! দাঁড়া ওকে বলছি আমি।”
“মা, থাকুক না। উনি দরকারেই গেছেন। চলে আসবেন।”
“আচ্ছা, এবার কিছু বললাম না। কিছু উল্টাপাল্টা করলে আমাকে বলবি, কেমন?”
রাত্রি হেসে তাকে আশ্বস্ত করল, “আপনি চিন্তা করবেন না মা। বলব।”
“এই সময়টা সুন্দর, মা। আনন্দ কর, হুল্লোড় কর। পরে আর এই সময়টা ফিরে আসবে না।”
কথা শেষ করে রাত্রির মন কিছুটা হালকা হলো। চাইলেই সব কথা সবাইকে বলা যায়! নিজের ছেলের এহেন আচরণের কথা তাকে বললে তিনি কষ্ট পাবেন। এমন উচ্ছল একজন মানুষকে কষ্ট দেবার কী দরকার! তাও একটা ঠুনকো বিষয়ে!
আসলেই কি ঠুনকো! তাহলে এত কষ্ট হচ্ছে কেন!
***
ইমরোজ ফিরল প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে, ভেতরে এসে ইতস্তত করে রাত্রির সামনে দাঁড়িয়ে থাকল ক্ষণকাল। নিজেকে ধাতস্থ করে নিচ্ছে। এভাবে কোনো মেয়েকে কখনো স্যরি বলা হয়নি। অনভ্যাসের জড়তায় বিমুঢ় হয়ে আছে সে৷ বুক ঢিপঢিপ করছে৷ কী আশ্চর্য!
প্রেম নিবেদন তো করছে না, একটা সাধারণ ক্ষমা প্রার্থনা। তাতেও এমন ওঠাপড়া কেন হচ্ছে। রাত্রি যে ধরনের মেয়ে, ওর স্যরি এক্সেপ্ট করবে তো! তবুও সে চেষ্টা করতে চায়।
রাত্রি তখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে তাকিয়ে। এই রুম থেকে সি বিচে একটা অংশ স্পষ্ট দেখা যায়৷
ইমরোজ পায়ে পায়ে রাত্রির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়৷ এরপর খুব মৃয়মান গলায় ডাকল,
“রাত্রি, একটু শুনবেন?”
রাত্রির দৃষ্টি উদাস, সে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, “হুম।”
“এগুলো আপনার জন্য।”
এবার রাত্রি ঘুরে তাকাল, ইমরোজের হাতে এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ। আর একটা লাল রঙের কার্ড। ওর দিকে বাড়িয়ে ধরা।
“আসলে কালকে আমি… মানে, আসলে.. স্যরি রাত্রি।”
আমতা আমতা করে কোনো রকমে বলল ইমরোজ, ওর চোখ দুটো রাত্রির চোখে স্থির। রাত্রির প্রায় নির্বিকার চোখ দুটো সহসাই ধ্বক করে জ্বলে উঠল,
“স্যরি? কীসের জন্য ইমরোজ? একজন ফালতু ঘটকের কাছে স্যরি বলছেন, আপনার মতো একজন ব্রিলিয়ান্ট লেকচারার। তুচ্ছ একজন মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে লজ্জা করছে না আপনার?”
ইমরোজ এবার সত্যিকার অর্থে অপ্রতিভ বোধ করল, “আমি ওভাবে বলতে চাইনি৷ রাগের মাথায়..”
ওকে থামিয়ে দিয়ে রাত্রি ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল, “স্যরি বললেই কী আপনার বলা কথাগুলো বদলে যাবে? ফিরিয়ে নিতে পারবেন? আমার প্রফেশনটা আমার খুব কাছের। আমার সমস্ত প্যাশন দিয়ে তৈরি করা প্রতিষ্ঠান। কতটা স্ট্রাগল, হাড় জল করা পরিশ্রম করে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে এর মূল্য বোঝেন আপনি? মুখে বলা খুব সহজ। শায়লা, রিসিপশনিস্ট, ওর মা আর ছোটবোনকে নিয়ে থাকে। আমার এসিস্ট্যান্ট ছেলেটা, ওর বাবা অসুস্থ। ইন্টারমিডিয়েটের পরে আর পড়াশোনা করতে পারেনি আর্থিক কারণে। রিতু, শান্তা ওরাও নিজেদের জীবনকে একটু ভালো করে ধারণ করতে পারছে বিবাহ ডটকমের জন্য। প্রতিষ্ঠানটা কেবল আমার নয়, এই সমস্ত মানুষগুলোর পরিশ্রমেরও। আপনি কত সহজে সমস্তকিছুকে তাচ্ছিল্য ভরে ছুঁড়ে ফেললেন। একটা স্যরির এত শক্তি!”
ইমরোজ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চোখের পাতা বারকয়েক বন্ধ করে আবার খুলল।
“আমি এতকিছু ভেবে বলিনি রাত্রি। কিন্তু বলার পরে গিল্টি ফিলিং কাজ করছিল ভীষণ। তাই মন থেকে…..”
“আপনার স্যরির আমার কোনো প্রয়োজন নেই৷ নিজের এরোগ্যান্সি নিয়ে ভালো থাকুন। আমাকে বিরক্ত করবেন না প্লিজ।”
ইমরোজ আজ আর কথা খুঁজে পেল না, কী বলা উচিত তাও বুঝল না। রীতিমতো দিশেহারা বোধ করল।
ফুল আর কার্ডটা বেডসাইড টেবিলে রেখে বলল, “এগুলো এখানে রেখে গেলাম। আবারও স্যরি, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। আর বিরক্ত করছি না।”
বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল ইমরোজ। রাত্রির কেন যেন হঠাৎ করে মন কেমন করে উঠল। ইমরোজ সেই যে বেরিয়ে গেছে, আর ফেরেনি। রাত্রিও আর দুপুরে খেল না। বিকেলেও যখন ইমরোজ ফিরল না, তখন ওর চিন্তা হতে শুরু করল। উঠে বসে ফুলগুলো হাতে নিল। কার্ডটা খুলে লেখাগুলো পড়ল,
“রাত্রি, আপনি আমাকে যতটা খারাপ ভাবেন, আমি ততটা খারাপ নই। আপনার সাথে হেরে যাওয়াটা মানতে পারিনি৷ তাই জিততে চেয়েছিলাম, যেকোনো মূল্যে। আমি যা বলেছি, কিছুই মন থেকে বলিনি, একবার বিশ্বাস করতে পারেন আমাকে। আপনার কাজের প্রতি ডেডিকেশন, প্যাশনকে আমি রেসপেক্ট করি। শুধু জিততে চেয়েছিলাম। কিন্তু জিততে গিয়ে কোথাও হেরে গেছি। আপনি ক্ষমা না করলে এই গিল্ট সরবে না। স্যরি, রাত্রি।”
কখনো যা হয়নি তাই ঘটল, কয়েক ফোঁটা জল, রাত্রির চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল গালে।
ইমরোজের অনুশোচনা ওর মধ্যে ফিরে এলো। সে কী এতটা হৃদয়হীন! কারো আন্তরিকভাবে বলা স্যরি এক্সেপ্ট করতে পারল না!
রাগ পরে যেতে সব মনে করে দেখল রাত্রি, আজ ইমরোজকে সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক মনে হচ্ছিল। কেন এমন বাড়াবাড়ি করল সে! সে নিজেও তো কত কথা বলেছে! দোষ তো ওরও আছে! কেবল একপাক্ষিক দোষারোপ সে তো কোনোদিন করে না! এখন কেন হঠাৎ করে এতটা অবিবেচক হয়ে গেল!
নিজের ভুল বুঝতে পারলে, স্যরি বলতে ওর কোনো দ্বিধা কাজ করে না। ইমরোজ ফিরুক। সে মিটিয়ে নেবে সবটা।
কিন্তু তার দেখা নেই। রাত্রি কল দিয়েছিল, মুঠোফোনটা রুমেই ফেলে গেছে ছেলেটা। সে সারাদিন হোটেল রুম থেকে বেরুলো না। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে, তবুও যখন ফিরল না, তখন চিন্তা প্রগাঢ় হলো।
ভয় হলো, কোথায় গেল মানুষটা! কোথায় খুঁজবে সে এই রাতে, অচেনা জায়গায়, একা একা!
……….
(ক্রমশ)