বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-২৫+২৬

0
36

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২৫)
নুসরাত জাহান লিজা

নয়টার পরে ইন্টারকমে জানানো হলো ইমরোজ ফিরেছে, কর্তৃপক্ষ পৌঁছে দিতে চাইলেও রাত্রি নিজে নেমে এলো। সারাদিন টেনশনে বিধ্বস্ত অবয়বেই এলো।

ইমরোজের অবস্থা তথৈবচ, বসে আছে মাথা এলিয়ে, সে ডাকল,

“ইমরোজ”

ইমরোজ একবার কোনোমতে চোখ খুলে তাকাল, চোখ দুটো টকটকে লাল। একজনের সহায়তায় ওকে ধরতেই বুঝতে পারল প্রবল জ্বরে এই ছেলের গা পুড়ে যাচ্ছে। কাঁপছে ঠকঠক করে। এই শীতে গরম কাপড় না পরেই বেরিয়ে গিয়েছিল। তারই ফল, বুঝল রাত্রি।

হোটেল স্টাফের কাছ থেকে থার্মোমিটার নিয়ে তাপমাত্রা পরিমাপ করে দেখল, একশো তিন ডিগ্রি।

“খেয়েছেন দুপুরে?”

ইমরোজ মাথা দু’দিকে নাড়ল। এত দুর্বলতার কারণটা বোঝা গেল।

রাত্রি ইমরোজকে ধরে বসিয়ে দিল, সে মুখ গুঁজে বসেই আছে। রাত্রির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

“হা করুন।”

“খাব না।”

“কেন?”

“ইচ্ছে করছে না।”

“সারাদিন জ্বালিয়ে হয়নি? কতটা টেনশন করেছি জানেন আপনি? এখন মুখ খুলুন।”

“আপনাকে টেনশন করতে হবে না।”

মহাশয়ের রাগের কথা এটা, রাত্রি মুখে কাঠিন্য এনে বলল, “মা যদি আপনাকে সকাল বিকাল দুই বেলা করে ঠাঁটিয়ে কয়েকটা চড় দিত নিয়মিত, তবে আপনার এই ঘাড়ত্যাড়ামি দূর হতো।”

রাত্রির কথা শুনে ইমরোজ আবার শোবার উদ্যোগ নিতেই ভয়ংকর কথাটা শুনল,

“যদি না খান, সারারাত আপনাকে ওয়াশরুমে বন্ধ করে রাখব। এমনিতেই শরীরের যে অবস্থা আপনার, প্রতিরোধ করতে পারবেন বলে মনে হয় না৷ আমি এক কথার মানুষ।”

ইমরোজ সাথে সাথে মুখ খুলল, রাত্রি হেসে ফেলল। ইমরোজ মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,

“ভাববেন না আপনার হুমকিতে ভয় পেয়ে খাচ্ছি৷ নিজের শরীরের কথা ভেবে…”
এটুকু বলতেই হাঁপিয়ে গেল।

পুরুষ নির্যাতনের কোনো মামলা করা যায় না, গেলে এই মেয়ের নামে সে অবশ্যই মামলা ঠুকে দিত।

রাত্রি এখনো হাসছে, মানুষটার অবস্থা সত্যিকার অর্থেই নাজুক। তাই রাত্রি আর বাগড়ায় গেল না। শুধু বলল,

“অন্তত সারাদিন পরে নিজের ভালোটা যে বুঝতে পেরেছেন, তাতেই আমি কৃতার্থ হয়ে গেছি।”

কেমন ছোট্ট জেদি শিশুর মতো জেদ করছিল! এরজন্যই কি আনোয়ারা আর ইপ্সিতা বলত, এই ছেলের মধ্যে এখনো একটা শিশুর বাস!

খুব বেশি খেতে পারল না ইমরোজ, কয়েক গ্রাস মুখে তুলতে গা গুলিয়ে উঠল। রাত্রি আর জোর করল না। ও সবসময় কোথাও যাওয়ার আগে জ্বর, ঠান্ডা, এ্যাসিডিটি, পেটের প্রবলেমের ওষুধ সাথে রাখে৷

ওষুধ খাওয়াতে এসে আবার বাগড়া দিচ্ছিল ছেলেটা, রাত্রি আবারও তার বিখ্যাত হুমকিটা দিতেই সুবোধ বালকের মতো খেয়ে নিল।

ইমরোজকে ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে মাথায় পানি দিয়ে দিল। ভেতরে এনে বিছানায় বসিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিল। এরপর তোয়ালেটা ভিজিয়ে এনে ওর হাতে দিয়ে বলল,

“গা মুছে নিন।”

গা মোছা হলে ইমরোজ শুয়ে পড়ল। গা ঢেকে দিয়ে মাথার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল রাত্রি।

“যা করেছেন, তারজন্য যদিও বলা উচিত নয়, তবুও বলছি, স্যরি।”

ইমরোজ চোখ বন্ধ করেছিল, রাত্রির কথা শুনে ঝট করে চোখ খুলল। ভীষণ অপ্রত্যাশিত একটা কথা। খুব কাঠখোট্টাভাবে বলা, তবুও যেন এক অদ্ভুত দ্যোতনা তৈরি করল কানে, মনে। মনে মনে আওড়াল,

“স্যরি বলছে কীভাবে দেখো। যেন দয়া করে বলছে।”

“এত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন কেন?”

“আনএক্সপেক্টেড ছিল। তবে এভাবে রেগে রেগে স্যরি হতে কাউকে দেখিনি।”

“ভালো ভাবে বলতাম। সারাদিন যা টেনশন দিয়েছেন তাতে উত্তম মধ্যম জমে আছে। তবুও যে স্যরি বললাম, এটা আপনার ভাগ্য।”

“তাহলে বললেন কেন?”

“আপনার আক্কেল জ্ঞান ভীষণ কম। একটা মেয়েকে এভাবে একা ফেলে সারাদিন কাটিয়ে এলেন। ফিরলেন কীভাবে? হোটেল পর্যন্ত ফিরতে না পারলে কী হতো ভেবেছেন? আমি বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম৷”

ইমরোজ এতটা ভেবে দেখেনি। সকালবেলা রাগের মাথায় বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর একরাশ অভিমান এসে ভীড় করেছে। যার প্রতি পরোয়া থাকে, তার উপরেই মানুষ কেবল অভিমান করে! সে কেন রাত্রির উপরে অভিমান করল! তাও যখন জানে ওর দুঃখ প্রকাশের বিপরীতে ওই মেয়ের কেমন প্রতিক্রিয়া হবে! তবুও কি সে অন্যকিছু এক্সপেক্ট করেছিল! কেন করেছিল! উত্তর জানা নেই।

সারাদিন হেঁটেছে, দিনের বেলা প্রচণ্ড রোদ ছিল বিচে, তাই সমস্যা হয়নি। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে হিমশীতল বাতাস ওকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। তবুও জেদ করে দাঁড়িয়ে ছিল। নিজেকে কষ্ট দিতে চাইছিল যেন। একসময় শরীর আর নিতে পারছিল না। হোটেলে ফিরতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কোনোমতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে হোটেল পর্যন্ত এসেছিল। লবিতে এসে পড়ে যায়! ও শুধু রুম নম্বরটা বলতে পেরেছিল স্টাফকে।

মাথায় আরামদায়ক স্পর্শটা ভালো লাগছিল ওর। ঘুম পাচ্ছিল। শুধু একবার মৃদু গলায় বলল,

“জ্বরের কথাটা মাকে জানাবেন না প্লিজ।”

“কেন?”

“আমাদের অসুখ করলে মা প্যানিক করে। সারারাত জেগে বসে থাকে। এখন তো দূরে আছি, আরও চিন্তা করবে।”

“আচ্ছা, বলব না। আপনি একটু ঘুমাতে চেষ্টা করুন।”

রাতের দিকে জ্বর আবার বাড়লে রাত্রি জলপট্টি দিয়ে দিল। আগে সে খেয়াল করেনি, আজ দেখল, ইমরোজের চেহারায় আশ্চর্য এক শিশুসুলভ সরলতা আছে। ছেলেটা সুদর্শন, ওই সরলতার জন্য বাড়তি মাত্রা পেয়েছে।

রাত্রি আশ্চর্য হয়ে ভাবল, সে এখানে এসেছিল এই ছেলেকে জ্বালাতে। ভোগান্তি দিতে। এখন জ্বরে কাতরাচ্ছে দেখে ওর প্রশান্তি পাবার কথা ছিল! উল্টো একগাদা আশঙ্কা নিয়ে বসে আছে! সেটা বোধহয় ওর ভেতরে মনুষ্যত্ব আছে বলেই!

প্রায় সারারাত ইমরোজের শিয়রের কাছে রাত্রি জেগে বসে রইল। জ্বর উঠানামা করছে ভীষণ! ভোরের দিকে ফজরের আযান শুনে নামাজটা পড়ে নিল। এরপর জ্বর অনেকটা নেমে গেছে দেখে ভালো করে শুলো। সারাদিনের চিন্তা, তারপর এই ধকল, দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ল।

***
সকালে ইমরোজের ঘুম ভাঙতে পাশে রাত্রিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখল। ওকে বিরক্ত করল না। ঘুমিয়ে পড়লেও, জ্বরের জন্য ওর ঘুমটা হয়েছে ছাড়া ছাড়া। তাই প্রায় সারারাত জুড়ে মেয়েটার ওর জন্য চিন্তা, যত্ন মনে আছে৷

কৃতজ্ঞতায় ওর মনটা আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। সে রাত্রির মুখের দিকে কতক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল জানে না! মেয়েটা প্রচণ্ড একরোখা, রাগী, ঠোঁটকাটা, পৃথিবীর সব ঝগড়াটে একসাথে করে একটা কম্পিটিশন হলে এই মেয়ে নির্ঘাৎ প্রথম স্থান অধিকার করবে। তবুও কোথাও যেন একটা সংবেদনশীল মন আছে! নইলে অসুস্থ ইমরোজের জন্য সারারাত জেগে থাকবে কেন, ওর শুশ্রূষা করার জন্য!

আজ সারাদিনও রাত্রি কাটিয়ে দিল ইমরোজের শুশ্রূষায়। আগামীকাল ফিরে যাবে।

যাবার আগে মেয়েটা ওর ব্যাগটাও গুছিয়ে দিল। অবশ্য মাঝেমধ্যেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কড়া কথা শুনাচ্ছিল। কিন্তু ইমরোজের আজ কেন যেন রাগ হলো না।

“আপনি এত লম্বা জার্নি করতে পারবেন? নাকি ফুপুর বাসায় একদিন থেকে তারপর যাব?”

“পারব। এখন অনেকটা ভালো লাগছে।”

রাত্রি কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর নেই আজ। আশ্বস্ত হলো।

ইমরোজ হেসে বলল, “থ্যাংক ইউ, রাত্রি।”

রাত্রি উত্তরে কিছু বলল না, মৃদু হাসল।

“আমার জন্য আপনার এবারের ট্রিপের আনন্দ মাটি হয়ে গেল।”

“সমস্যা নেই। আমি আগেও এসেছি এখানে। আবার আসা যাবে।”

“আবার? হানিমুনে?”

রাত্রি ক্ষণকালের জন্য মৌন হয়ে গেল, ক্লান্তিতে ওর মাথা গেছে! কী বলতে কী বলেছে!

“আমি কথার কথা বলেছি। এবার যে ভোগান্তি দিয়েছেন, আপনার সাথে আমি পাড়ার দোকানেও যেতে রাজি নই।”

বলে সামলে নিয়ে হঠাৎ হেসে ফেলল, ইমরোজ জিজ্ঞেস করল,

“হাসছেন কেন?”

“সবাই মিলে আমাদের পাঠিয়েছে মধুচন্দ্রিমায়। না ছিল মধু আর না ছিল চন্দ্রিমা! ওদের প্ল্যানটা ডাহা ফ্লপ মেরেছে।”

ইমরোজ অস্ফুটস্বরে বলল, “কে বলল ছিল না!”

রাত্রি শুনতে পায়নি, ইমরোজের ব্যাগ গুছিয়ে নিজেরটা গোছাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করল,

“কী বললেন?”

“কই কিছু না তো!”

ভাগ্যিস শুনতে পায়নি, নইলে এখনই ওকে লজ্জায় ফেলত।

ওরা এসেছিল পরস্পরকে জ্বালাতন করতে, কিন্তু কেমন করে একজন সর্বোচ্চ শক্তিতে যত্ন করে গেল! আরেকজন ভাবছিল, অপরপক্ষের কতটা কষ্ট হচ্ছে! একটা চাপা অনুশোচনা হচ্ছিল ইমরোজের সেদিন রাগের মাথায় বেরিয়ে যাবার মতো অপরিনামদর্শী আচরণের জন্য। মধু চন্দ্রিমায় মধু বা চন্দ্রিমা না থাকুক, কোথাও যেন একটা নির্ভরতা এসেছে!

নিজের ভাবনায় চমকে উঠল ইমরোজ। অসুস্থতা ওর মনকেও দুর্বল করে দিচ্ছে নির্ঘাৎ।
(ক্রমশ)

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২৬)
নুসরাত জাহান লিজা

দু’দিন আগে ইমরোজ-রাত্রি একটা অদ্ভুতুড়ে মধুচন্দ্রিমা শেষ করে ঢাকায় ফিরেছে। ইমরোজ এখন অনেকটাই সুস্থ। রাত্রিও পুরোদমে ফিরে গেছে তার কর্মব্যস্ত জীবনে।

কক্সবাজার থেকে বাস ধরার আগে সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করেছে। আজ ওরা দু’জন রাত্রির বাড়িতে এসেছে সেগুলো দিতে। ফেরার আগে মায়া রাত্রিকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“উৎপলের বিয়ের বিষয়ে কী যেন বলছিলি যাওয়ার আগে। ও তো কিছুই বলল না। তুই বল তো দেখি।”

রাত্রি ব্যাগে শোভার বায়োডাটা আর ছবি নিয়েই এসেছিল। সেটা মাকে দিয়ে বলল,

“নাও। তুমি আমাকে জানিও।”

মায়া ছবি দেখে বললেন, “মিষ্টি দেখতে মেয়েটা৷ উৎপলের সাথে মানাবে।”

“এখানে ওর মায়ের নম্বর আছে। চাইলে কথা বলতে পারো মা।”

খাবার পরে উৎপলের ঘরে এলো রাত্রি, “ভাইয়া, তোমার কোনো ব্যাপার স্যাপার নেই তো?”

“কীসের ব্যাপার?”

“অবশ্যই বুঝতে পেরেছ ভাইয়া। কীসের কথা বলেছি।”

উৎপল একটু আগেই ইপ্সিতার সাথে কথা বলছিল। মেয়েটা একটা আশঙ্কার মধ্যে আছে। সে-ও কি নেই! কিন্তু বহুদিন আগে রাত্রিকে কথা দিয়েছিল, প্রেমে পড়লে সবার আগে ওকে জানাবে।

তার বোন বড্ড অভিমানি, তাছাড়া ইমরোজের সাথে রাত্রির তখনকার দ্বন্দ্ব সবমিলিয়ে এত নাটক রচনা করতে হয়েছে। এখন আর বিষয়টা এত সরল নেই। এখন যদি বলে, অনেক প্রশ্নচিহ্ন দাঁড়াবে। ওরা যে কলকাঠি নেড়েছে ওদের বিয়ের, সেটা সামনে চলে আসবে। যার ফলাফল ভালো হবে না।

আজ ইমরোজ আর রাত্রিকে একসাথে দেখে উৎপলের মনে হয়েছে, যেভাবেই বিয়ে হোক, দুজনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরি হচ্ছে মাত্র। এই মুহূর্তে ওদের ব্যাপারটা সামনে চলে বোনের নতুন জীবনে তার কিছু না কিছু প্রভাব পড়বেই, সেই প্রভাবটা যে সুখকর নয়, সেটা জানা কথা।

তখন এত তলিয়ে ভাবেনি, ভেবেছিল, এদের বিয়ে হয়ে গেলে দ্বন্দ্ব মিটে যাবে। তখন নিজেদের রাস্তা পরিষ্কার হবে। কেউ বাগড়া দেবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিষয়টা আরও বেশি ঘোলাটে আর জটিল হয়ে গেছে। আপাতত ম্যানেজ করতে উৎপল ইতস্তত করে বলল,

“আরে না, তেমন কোনো ব্যাপার নেই।”

রাত্রি ভাইয়ের দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, “আজ আসি তবে।”

“চলে যাবি? আজ থেকে যা দু’জন।”

“আজ না ভাইয়া। উনি সবে জ্বর থেকে উঠলেন৷ এখান থেকে কলেজটা একটু দূরে হয়ে যায়। এই শরীরে এত ধকল নেয়া ঠিক হবে না।”

উৎপল মৃদু হেসে বলল, “খুব চিন্তা হচ্ছে ইমরোজের জন্য!”

রাত্রি যেন কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল, মুখ সামান্য আরক্ত হলো কী!

“ওই লোকের জন্য আমার চিন্তা হবে? কী যে বলো না ভাইয়া! ধূর!”

এরপর উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিল, এরপর আবার বলল, “মানবিকতা বলে একটা জিনিস আছে। তুমি আমাকে চেনো না ভাইয়া?”

উৎপল উপলব্ধি করল, মুখে যাই বলুক, মনে সূক্ষ্ম হলেও একটা অনুভূতি জন্মাচ্ছে! সেটা লুকাতে চাইছে বলেই বারবার অজুহাত দিচ্ছে। ওর ভালো লাগল! ভেতরের অপরাধবোধ কিছুটা যেন কমল, যাক ওর প্রিয় একমাত্র ছোট্ট বোনটা ভালো আছে। কিন্তু সব জানলে…

“রাত্রি…”

রাত্রি ঘুরে তাকাল, “কিছু বলবে?”

“ধর, আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি তোর সাথে? তুই কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবি?”

“কী ভুল? আমার সাথে? ভাইয়া, তুমি আমার সাথে ভুল কিছু করবে, এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে!”

বলে এগিয়ে এলো রাত্রি, “কী হয়েছে বলবে? ডিস্টার্বড?”

বিশ্বাসও কখনো কখনো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, আজকের আগে উৎপল সেটা উপলব্ধিই করতে পারেনি। এই বিশ্বাস সে নিজের হাতে ভেঙেছে! প্রবল অনুশোচনায় আবারও মন জুড়ে জাল বিস্তার করল। কোনোমতে বলল,

“কিছু না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। খুব ভালো থাক।”

রাত্রি কয়েক মুহূর্ত উৎপলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল, এরপর ধীরপায়ে বেরিয়ে এলো। ভাইকে সে খোলা বইয়ের মতো পড়তে পারে। আজ মনে হচ্ছে, কিছু একটা যেন ঠিক নেই। ঠিকঠাক পড়তে পারছে না যেন, কিছু অক্ষর আচমকাই দুর্বোধ্য ঠেকছে!

***
ইমরোজকে আজ বাইক নিতে দেয়নি রাত্রি, বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওরা রিকশায় উঠল। শীতের রাত। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে কুয়াশাচ্ছন্ন আলো কেমন মায়া ছড়িয়ে রেখেছে চারদিকে। চাঁদটাও ঘোলাটে।

রিকশায় পাশাপাশি বসেছে ওরা। রাত্রি শাড়ি পরেছে আজ। হাতে কাচের চুড়ির ঝিনঝিন শব্দ কানে যেন মিষ্টি সুরের ঝংকার তুলছে ইমরোজের।

“আপনার শরীর ঠিক আছে এখন?”

“বুঝতে পারছি না, মনে হচ্ছে জ্বর আবার আসছে।”

ত্বরিত বেগে রাত্রি নিজের কাচের চুড়ি পরা হাতটা ইমরোজের কপালে রাখল, জ্বর পরিমাপের জন্য। ইমরোজের ভেতরে হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল! মনে হলো মুহূর্তটা এখানেই থেমে থাক!

“না, জ্বর নেই। খারাপ লাগছে?”

“ভেতরে ভেতরে আছে বোধহয়। বড্ড শীত লাগছে।”

কেন যে ইমরোজ মিথ্যেটা বলল, রাত্রির আলতো স্পর্শ চাইছিল বোধহয়। একটা মিথ্যে আড়াল করতে দ্বিতীয় মিথ্যেটা বলল। তবে ফলাফল যা হলো তা রীতিমতো অপ্রত্যাশিত।

রাত্রি ওর গায়ের শালটা খুলে ইমরোজকে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা গায়ে জড়িয়ে নিন ভালো করে।”

কিছুদিন ধরে যেন অন্য একটা রাত্রিকে আবিষ্কার করছে ইমরোজ। অমন পায়ে পা বাঁধিয়ে ঝগড়া করা রাত্রির ভেতরের অন্য একটা সত্তা। একই মানুষের ভেতরে কতরকম শেড থাকে! দ্বৈত সত্তা ধরনের কোনো মনোব্যাধিতে আক্রান্ত নাকি এই মেয়েটা! সন্দিহান হলো ইমরোজ।

“না, না। আপনি তো সোয়েটার পরেননি। অনেক ঠান্ডা ওয়েদার।”

“আমি আপনার মতো গাধামো করে জ্বর বাধাইনি। অতটাও ঠান্ডা নয়।”

বলল বটে, কিন্তু শাল খোলার পরে মৃদু কাঁপছে রাত্রি। ইমরোজ বুঝল সেটা। ওর কথায় রাগ হলো যদিও, কিন্তু কাজের মধ্যে অদ্ভুত মায়া জড়ানো।

ইমরোজ একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসল, নিজে শাল জড়িয়ে তার অপর অংশটুকুতে রাত্রিকে আবৃত করে নিল। ওর একটা হাত তখন রাত্রির কাঁধে, শাল যাতে পড়ে না যায়! সেটা নিশ্চিত করার জন্য।

রাত্রি কড়া চোখে তাকেতে সে বলল, “আপনি আমাকে গাধামোর সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। গাধামো করলেও এটুকু বোধ আছে যে, নিজের ভালোর জন্য আরেকজন কষ্ট করছে, সেটা দেখেও তার প্রতিকার না করে বসে থাকব।”

“বুঝেছি, অনেক মানবিক মানুষ আপনি!”

কেন জানে না, রাত্রির এই কুয়াশার চাদরে ঘেরা রাত, নির্জীব ল্যাম্পপোস্ট, তার মৃদু স্নিগ্ধ আলো, ঘোলাটে চাঁদের মৃদু জোছনা, হুড খোলা রিকশা, আর পাশে ঘেঁষে বসে ওকে শাল দিয়ে আবৃত করে আলতো হাতে জড়িয়ে থাকা মানুষটা সমস্ত কিছুকে ভালো লাগল। ভীষণ ভীষণ ভালো!

রাত্রির কথার ঈষৎ খোঁচায় ব্যথিত হয়ে ইমরোজ হাত সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, রাত্রি ইমরোজের হাতটা ধরে রাখল। শালটা ছোট, তাই কিছুটা সরে এলো ইমরোজের দিকে। কাজটা কেন করল সে জানে না, শুধু জানে, ভালো লাগছে এই কেয়ার করাটা।

মুখের কাঠিন্য সরিয়ে মৃদু হাসির রেখা ফুটল অবচেতনেই। ইমরোজ আশ্বস্ত হয়ে একবার তাকাল ওর মুখের দিকে। মনে হলো, এই মেয়ে জাঁদরেল হতে পারে, তবে হাসিটা ভীষণ মিষ্টি! কেমন মোহাবিষ্ট হয়ে গেল ইমরোজ, অবচেতনেই৷

ইমরোজের মনে হলো, অব্যাখ্যায় কত কী যে ঘটে যায়। মুহূর্তটা যেন পরাবাস্তব! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সেই প্যারালাল ইউনিভার্সে ঘটা কোনো ঘটনা যেন!

দু’জনে অদ্ভুত নৈঃশব্দের বাঁধনে আটকে গেছে যেন, অথচ নৈঃশব্দের ভিড়েও কত অদৃশ্য, অব্যক্ত কথার আনাগোনা!
………….
(ক্রমশ)