#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২৭)
নুসরাত জাহান লিজা
রাত্রি আর ইমরোজ ফেরার পরে ওদের হাসিখুশি দেখে ভীষণ ভালো লাগল আনোয়ারার৷ তার মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল।
মনের উপরে জোর দেয়া তার পছন্দ নয় কোনোকালেই। কিন্তু কখনো কখনো সন্তানের ভালোর জন্য একটু শক্ত হওয়াই যায় বলে মনে হলো।
“তোমরা খেয়েছ মা?”
“হ্যাঁ রে।”
“ওষুধ?”
“খেয়েছি। তোর শরীর ঠিক আছে এখন?”
রাত্রি উত্তর দিল, “এখনো পুরোপুরি ঠিক নেই মা। রিকশায়, জ্বর জ্বর লাগছিল বললেন।”
ইমরোজ মুহূর্তেই অপ্রতিভ হয়ে যেতে তিনি বুঝে নিলেন বিষয়টা। বললেন, “কক্সবাজারের ওয়েদার ওর সহ্য হয়নি। সেজন্য মনে হয়। তোর সেবাযত্নে ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠছে।”
রাত্রি কেন জানে না, কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ করল। সে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল,
“মা, ইপ্সিতার বিয়ের বিষয়টা আবার শুরু করব ভাবছিলাম। হাতের কাজ ঝুলিয়ে রেখে তো লাভ নেই।”
“হ্যাঁ, সেই ভালো মা। তুই যখন দায়িত্ব নিয়েছিস, আমি নিশ্চিন্ত। ইমুটা তো কাজেরই না।”
“মা, তুমি কিন্তু আমাকে খোঁচাচ্ছ।”
“সত্যি কথা খোঁচাই লাগে। বউকে দেখে কিছু শেখ। এখন যদি একটু বুদ্ধি হয় ঘটে।”
রাত্রি হেসে ফেলল, ওর হাসি দেখে ইমরোজের পুরোনো রাগের খানিকটা ফিরে এলো,
“উনাকে দেখে শিখতে হবে এখন? কী শিখব? ঘটকালি?”
“করে দেখান পারলে! মুখ দিয়ে বলার সময় অনেককিছু বলা যায়। করতে গেলে দৌড় বোঝা যায়!” আবার লোকটা ওকে ওর প্রফেশন নিয়ে খোঁচা দিয়েছে, সেটা চুপচাপ হজম করার মতো রাত্রি নয়ই।
“আপনি বলতে চাইছেন, এখন যদি আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করতে চাই, তাহলে আমাকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পার্টিসিপেট করে প্রেসিডেন্ট হতে হবে? নইলে সমালোচনা করতে পারব না?”
অকাট্য যুক্তিতে রাত্রি খানিকটা দমে যাচ্ছিল, একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল, “তার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু প্রপার ক্রিটিসাইজ করার জন্য ওই বিষয়ে ন্যুনতম জ্ঞান তো থাকতে হবে মাথায়। নইলে সমালোচনাটা ফাঁপা আর অন্তঃসারশূন্য মনে হবে।”
বলে ভেতরে চলে গেল রাত্রি। এই লোক জীবনেও ভালো হবে না।
অপরদিকে ইমরোজের মনে হলো, সেদিনের পরে আবার যে কেন মেয়েটার দুর্বল জায়গা নিয়ে কথা শোনাতে গেল! একটু আগের মুহূর্তটা এত সুন্দর ছিল, তার রেশটা গড়বড় করে দিল।
আনোয়ারা বললেন, “যা, ঘরে যা। ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না, পুরোনো মুরুব্বীরা বলতেন। ভুল বলেননি কিন্তু।”
“তুমি সবসময় ওর পক্ষ নাও কেন মা? আমি তোমার ছেলে, এখন আমি তোমার পর হয়ে গেছি।”
আনোয়ারা ছেলের মাথায় হাত দিয়ে হেসে বললেন, “রাত্রির কথাটা ভেবেছিস? শুধু রাত্রি না, প্রত্যেকটা মেয়েকে বিয়ের পরে নিজের চেনা জগৎ, কমফোর্ট জোন ছেড়ে চলে আসতে হয় সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা পরিবেশে। এডজাস্ট করতে হাজারটা কম্প্রোমাইজ করতে হয়। তোকে তো নিজের রুমটা ছাড়া আর কিছু এখনো অব্দি কম্প্রোমাইজ করতে হয়নি, তাই বুঝিস না। রাত্রি আমাদের ভরসায় এখানে এসেছে। ওকে পুরোপুরি না পারি, অন্তত নিজেদের জায়গা থেকে কিছুটা হলেও কমফোর্ট জোন দিতে পারব না আমরা? চেষ্টা করা উচিত না?”
ইমরোজ আর কিছু বলল না। মা’র কথাগুলো ওর মাথায় প্রবল আলোড়ন তুলল। সত্যিই তো, সে এভাবে ভেবে দেখেনি৷ ক’দিন পরে ইপ্সিতারও বিয়ে হবে, তখন ওর হাজব্যান্ড যদি ওর মতো আচরণ করে, সে নিজেই তো মেনে নিতে পারবে না!
ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে সে নিজের ঘরে এলো। রাত্রি মুঠোফোনে কথা বলছিল।
“আন্টি, চিন্তা করবেন না। ভাইয়া অমত করবে না। তাছাড়া মা-ও জানিয়েছেন, তার শোভাকে পছন্দ হয়েছে।”
“একেবারে এঙ্গেজমেন্ট?”
অপরপ্রান্তের কথাগুলো ইমরোজ শুনতে পাচ্ছে না, রাত্রি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, এরপর বলল,
“আমি বুঝতে পেরেছি আন্টি। তবুও, পাত্র-পাত্রী একবার সরাসরি কথা বলে নিলে ভালো হতো না?”
“ঠিক আছে, আন্টি। আমি বাসায় কথা বলে আপনাকে জানাব।”
ইমরোজ কথা বলার সুযোগ পেল না, রাত্রি তার মাকে কল দিল,
“মা, শোনো। শোভার মা কল করেছিলেন। আন্টি চাইছেন, দেখতে যাবার দিনই একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা হোক। আসলে দেখে এসে রিজেক্ট করা, বিষয়টা অপমানজনক হয়ে যায়। উনার কথাটাও ফেলে দেবার মতো না। তুমি কী বলো?”
“আমি তোর বাবার সাথে কথা বলে জানাই।”
মায়ের সাথে কথা বলতে মোবাইলটা কান থেকে নামাতেই ইমরোজ বলল, “উৎপলের নিজের মতামত ছাড়াই ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলছেন? ওর তো অন্য পছন্দ থাকতে পারে।”
“নেই। থাকলে সবার আগে আমি জানতাম। তারপরও কনফার্ম হবার জন্য আমি ওকে আজকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। না-ই করেছে।”
“তারপরও…”
“আপনারা ইপ্সিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন? করেননি তো। নিজেরা যা করেননি, সেটা নিয়ে দয়া করে জ্ঞান কপচাবেন না।”
কথার ছিরিছাঁদ নেই এই মেয়ের। ‘জ্ঞান কপচাবেন না’, রুচিশীল মানুষ এভাবে কথা বলে!
“ইপ্সিতা বাচ্চা একটা মেয়ে। ও এসবের সময়ই পায়নি। তাই জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয়নি।”
“বাচ্চা মেয়ে? তাহলে বিয়ের জন্য উতলা হচ্ছেন কেন? আগে বড় হোক। তারপর ভাবেন।”
ইমরোজ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, “আমার ওষুধ নিয়ে যাইনি ওই বাড়িতে। আপনি রেখেছিলেন। দেবেন প্লিজ।”
“দিচ্ছি।”
রাগ চেপে নির্লিপ্ত গলায় কথাটা বলে গ্লাসে পানি ঢেলে ওষুধ বের করে ইমরোজকে দিল সে।
“থ্যাংক ইউ, রাত্রি।” হেসে বলল ইমরোজ।
“গরু মেরে জুতা দান করার দরকার নেই।” অভিমানী গলায় বলল রাত্রি।
“রাগলে আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগে রাত্রি।”
ইমরোজ স্ত্রীর মনোভঞ্জনের উপায় খুঁজে না পেয়ে যা মুখে এলো, বলে ফেলল! আশ্চর্য হয়ে দেখল, মেয়েটা সত্যিই হেসে ফেলল এবার, নিটোল প্রশান্তিদায়ক, স্নিগ্ধ মিষ্টি হাসি!
“আপনি যখন অপ্রস্তুত হয়ে কিঞ্চিৎ বোকা বোকা আচরণ করে ফেলেন, তখন আপনাকে ভীষণ কিউট লাগে ইমরোজ। একদম আদুরে বেড়াল ছানার কিউট।”
বলেই আদর করে ছোট্ট শিশুদের যেমন করে গাল টিপে দেয়, তেমন করে ইমরোজের গাল টেনে দিল রাত্রি!
ইমরোজ একইসাথে লজ্জা পেল কিঞ্চিৎ, রাগ হলো অনেকটা এবং সবচাইতে আশ্চর্যজনক এবং ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ওর ভালোও লাগল!
“আমি মোটেও বোকা বোকা আচরণ করি না। আর বেড়াল ছানা মানে?”
“বেড়াল ছানা মানে বেড়ালের বাচ্চা। আপনি দেখছি বাংলাতেও ভীষণ কাঁচা। পড়ান কীভাবে?” দুষ্ট হাসি রাত্রির চোখে-মুখে!
“আপনি ভীষণ যাচ্ছে তাই।”
“আপনিও।”
ইমরোজকে জ্বালাতে ওর এত ভালো লাগে! সত্যি সত্যি আদুরে লাগে তখন! তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মুখ ফুলিয়ে ইমরোজকে ফুঁসতে দেখে রাত্রি সশব্দে হেসে ফেলল।
ইমরোজ আরও বিরক্ত হলো। কোনো মানে হয়!
“একদম হাসবেন না।”
“এখানে হাসতে বারণ বুঝি? কই, কোথাও নিষেধাজ্ঞার সাইনবোর্ড তো দেখছি না!”
ইমরোজ কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল। রাত্রি তখনও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে।
“ফাজিল মেয়ে!”
কাঁথায় প্যাকেট হয়ে থাকা ইমরোজের অস্ফুটস্বরে বলা কথাটা অবশ্য রাত্রির কান পর্যন্ত এলো না।
***
মায়ের কাছ থেকে বিয়ের কথা পাকাপাকি হবার কথা শুনে মাথায় একসাথে হাজারটা বজ্রপাত হলো উৎপলের। সে ইপ্সিতাকে কল দিয়ে বলল,
“আজই দেখা করো। আর্জেন্ট।”
………….
(ক্রমশ)
#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২৮)
নুসরাত জাহান লিজা
ইপ্সিতার জন্য যে দুইজন পাত্র শর্ট লিস্টেড ছিল আগে, এরমধ্যে একজন ইতোমধ্যে বিয়ে করে ফেলেছে। আরেকজনের সাথে কথা হয়েছে। সাথে নতুন বায়োডাটা আর জাহিদের দেয়া ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট থেকে আরেকজনকে সিলেক্ট করেছে। রাত্রি নতুন ক্লায়েন্টের সাথে আজ একটা মিটিং ফিক্স করেছে রেস্টুরেন্টে। ইমরোজ যাচ্ছে সাথে।
ইমরোজ তাড়া দিয়ে বলল, “আপনাদের তো আবার রেডি হতে কমপক্ষে একঘণ্টা লাগে। এখনই শুরু করে দিন। নইলে দেরি হয়ে যাবে।”
“আমাদের মানে?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল রাত্রি।
“মেয়েদের।”
রাত্রি ইমরোজের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বলল, “তাই নাকি? অনেক এক্সপেরিয়েন্সড মানুষ তো আপনি। মেয়েদের রেডি হবার সময়ের উপরে পিএইচডি করে ফেলেছেন মনে হচ্ছে।”
“নর্মাল কমন সেন্স থাকলেই এটা বোঝা যায়।”
“আজকে দুইজন একসাথে রেডি হতে শুরু করব। দেখি কারটা আগে হয়। ওকে?”
ইমরোজ আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল, “আপনি বলতে চাইছেন আপনি আমার আগে রেডি হতে পারবেন? ইম্পসিবল।”
“চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন?”
“সানন্দে। আমি কখনো চ্যালেঞ্জ হারিনি।”
“দেখা যাক। হারলে কিন্তু প্যানাল্টি আছে।”
“কী প্যানাল্টি?”
“যে জিতবে তার বলা একটা উইশ পূরণ করতে হবে।”
“যেমন?”
“ভাবতে থাকুন। আমি আমারটা ভাবছি।”
“ওকে। শুরু হোক তবে।”
রাত্রি ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে জামাটা পাল্টে নিল। এরপর মুখে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে চুলটা আঁচড়ে নিল। এরপর ড্রেসিং টেবিল দখল করে রাখা ইমরোজ তখন হাতে ঘড়ি পরছিল, চুল আঁচড়ানো, পারফিউম দেয়া বাকি।
“চলুন, চলুন।”
ইমরোজ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। বিস্মিত গলায় বলল,
“আপনি রেডি? কী করে সম্ভব!”
“হ্যাঁ। কেন, আপনার বাকি এখনো?” যেন কিছুই বোঝেনি এমনভাবে বলল রাত্রি।
“হ্যাঁ, ওই আর একটু।”
“তার মানে আপনি হেরে গেছেন।”
“অল্পের জন্য।” হার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে ইমরোজের।
“হার তো হারই হয়। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে যে আগে ফিনিশিং লাইন ক্রস করে সেই জয়ী হয়। এক সেকেন্ড পরে এলেও সে সেকেন্ড। যৌথভাবে জয়ী হয় না। জানেন না?”
দুষ্টু হাসি রাত্রির চোখে-মুখে। ইমরোজ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে এখন কী করতে হবে?”
“সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। এখন চলুন তো। এমনিতেই দেরি করে ফেলেছেন৷ এখন কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় নেই।”
এই মেয়ে ভীষণ বিপজ্জনক। তার একটা ইচ্ছে-পূরণের বাধ্যতার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে হতাশ ইমরোজ বেরিয়ে এলো। রাত্রি মনে মনে হাসছে ভীষণ।
আনোয়ারার ব্যাংকে কাজ আছে। তিনি আগেই বেরিয়ে গেছেন৷
***
উৎপল আর ইপ্সিতা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। ইপ্সিতা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কান্না নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল। ওরা রেস্টুরেন্টে বসেছে আজ।
“এখন কী করব আমরা?”
উৎপল বলল, “সব বলে দেয়া ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো উপায় নেই ইপ্সি।”
“প্রথমেই বলে দিলে ভাইয়া হয়তো খুব রাগ করত। মার-টারও দিতে পারত হয়তো। কিন্তু এখন সব বলতে গেলে ওদের বিয়ের কথাগুলোও বলতে হবে। কী হবে বুঝতে পারছ?” কাঁদো কাঁদো গলায় বলল ইপ্সিতা।
উৎপল ওকে অভয় দেবার চেষ্টা করে বলল, “হ্যাঁ। রাত্রি হয়ত মন খারাপ করত। কিছুদিন কথা বলা বন্ধ রাখত। অভিমান করত। কিন্তু এখন?”
কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলল, “প্রথমে আমাদের ঝোঁকের মাথায় সিদ্ধান্ত নেয়া ভীষণ ভুল হয়েছে। সবদিক তলিয়ে ভাবা উচিত ছিল। সবকিছু এখন প্যাঁচালো হয়ে গেছে।”
“তাহলে আর কী! তুমি ওই শোভা না কী! ওকে বিয়ে করে সংসার করো। আমিও নাচতে নাচতে ওদের ঠিক করা ছেলে বিয়ে করি৷ এটাই বলতে চাও?”
ইপ্সিতা দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে রেগে উঠে দাঁড়াল, উৎপলও উঠে ওর হাতটা ধরেছে মাত্র। সাথে সাথে জায়গায় জমে গেল। ইপ্সিতাও ততক্ষণে সামনে তাকিয়ে প্রস্তরবৎ হয়ে গেল।
ইমরোজ আর রাত্রি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে, দুজনের দৃষ্টিই ওদের হাতের দিকে। ইপ্সিতা ঝট করে সরে গেল।
ইমরোজের চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছিল প্রবল রাগে, আস্তে অথচ শীতল গলায় সে ইপ্সিতার উদ্দেশ্যে বলল, “আমি তোকে বিশ্বাস করতাম৷ তুই…”
ওর গলা চড়ছিল। দুই পা এগিয়েছিল বোনের দিকে, রাত্রি এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে বলল,
“ইমরোজ, এটা পাবলিক প্লেস। এখানে সিনক্রিয়েট করবেন না। আমরা বাসায় গিয়ে বসি।”
এরপর উৎপলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইয়া, আশা করছি এর একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা তোমার কাছ থেকে পাব। বাসায় বাবা-মা আছে। তুমি আমাদের সাথে চলো।”
রাত্রির এই ঠান্ডা গলার সাথে উৎপল পরিচিত। চারজন বাইরে এলো। উৎপলের বাইকের দিকে ইমরোজ বিষদৃষ্টিতে তাকালো।
ইপ্সিতা প্রবল আতঙ্কে জমে গেছে, বড় ভাইকে সে ভীষণ সমীহ করে। ইমরোজের বাইকের পেছনে গিয়ে বসল। রাত্রি বসল উৎপলেরটায়।
***
আনোয়ারা তখনো ফেরেননি দেখে ওরা স্বস্তি পেল। বসার ঘরে চারজন বসল। ইমরোজ গজগজ করছিল,
রাত্রি গলার শীতলতা ধরে রেখে উৎপলকে বলল, “তোমাদের মধ্যে এসব কতদিন থেকে চলছে ভাইয়া? আমাদের বিয়ের সময় থেকে?”
উৎপল সিদ্ধান্ত নিয়েছে একবার যখন সামনে চলে এসেছে, তখন আর নতুন করে কোনো মিথ্যে কথা বলবে না। একটা মিথ্যার পথ ধরে অসংখ্য মিথ্যে সারি বেঁধে আসতে থাকে।
“অনেকদিন থেকে।”
“তোমাকে আমি সেদিনও জিজ্ঞেস করেছিলাম ভাইয়া। তুমি না করেছিলে। আমি শোভাদের পরিবারে কথা বলে এঙ্গেজমেন্ট ফিক্স করলাম৷ ওদের কী জবাব দেব? কেন ছোট করলে আমাকে?”
“ইপ্সিতার বিয়ের জন্য যেদিন তুই ইন্টারভিউতে ডাকলি, সেদিন ও তোকে চিনতে পারে। তোদের ঝগড়া করতে দেখে খুব ভয় পেয়ে যায়। আমরা পরস্পরকে হারানোর ভয়ে তোদের মিলিয়ে দেবার প্ল্যানিং করি।”
আস্তে আস্তে সমস্ত ঘটনার পেছনের ষড়যন্ত্রের জাল উন্মোচিত হতে থাকল উৎপলের কথায়। সব শুনে ইমরোজ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। জীবনে কোনোদিন যা করেনি, তাই করল।
উঠে ইপ্সিতার সামনে গিয়ে ওর গালে চড় মেরে দিল।
আবার হাত তুলতে যাচ্ছিল রাত্রি আর উৎপল এসে থামাল,
“ইমরোজ, ও বড় হয়েছে। গায়ে হাত তোলা কোনো সমাধান নয়।”
“আপনি একটাও কথা বলবেন না। এটা আমার আর আমার বোনের ব্যাপার।”
রাত্রি ইমরোজের হাত ছেড়ে পিছিয়ে এলো সাথে সাথে।
“ও শুধু বিশ্বাসই ভাঙেনি। একটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছে। ওর জন্য আমাকে বিয়ে করে কতটা সাফার করতে হয়েছে। সবকিছু খেলা? আমার জীবনটা শুধুমাত্র ওর জন্য শেষ হয়ে গেল।”
রাত্রির কী হলো জানে না, উৎপলের উপরে ওরও রাগ হচ্ছে৷ কিন্তু সেটাকে ছাপিয়ে একটা অবর্ণনীয় কষ্ট ওকে তাড়িত করল। হ্যাঁ, বিয়ের পরে প্রথম কিছুদিন সে ইমরোজকে ভীষণ বিরক্ত করেছে৷ সে-ও তো করেছে। কিন্তু ওর ধারণা হয়েছিল কক্সবাজার থেকে ফেরার পরে ওদের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছিল। সে হয়তো একটু বেশিই ভেবে ফেলেছিল।
নইলে ইমরোজ এখনো ভাবে এই বিয়ে করে ওর জীবন শেষ হয়ে গেছে। সে এগুতে পারেনি। ছিঃ ছিঃ! লজ্জায় ওর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল।
তাছাড়া আরেকটা কী যেন বলল, ওর আর ওর বোনের মধ্যে সে কেউ নয়। কিছুই নয়। ওর কোনো অধিকার নেই।
“আপনার যেহেতু মনে হচ্ছে, এই বিয়েটা করে আপনার জীবন শেষ হয়ে গেছে। আমি স্বেচ্ছায় আপনার জীবন থেকে চলে যাচ্ছি নাহয়।”
“রাত্রি, কী বলছিস এসব?”
উৎপল এই ভয়টাই পাচ্ছিল সেদিন থেকে। অনুশোচনায় সে শেষ হয়ে যাচ্ছে৷
“আমার ডিসিশন চেঞ্জ হয় না। তুমি তো জানো ভাইয়া।”
ইমরোজও ততক্ষণে সম্বিতে ফিরেছে। কিন্তু একবার কোনো কথা বলে ফেললে ফিরিয়ে নেবার উপায় নেই। সে মাথা নিচু করে বসে পড়ল সোফায়। সব রাগ গিয়ে পড়ল বোনের উপরে।
ইপ্সিতা বসে বসে কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ওদের দুই ভাইবোনের সামনে দিয়ে রাত্রি বেরিয়ে গেল ভাইয়ের সাথে।
ইমরোজ বাঁধা দেবার চেষ্টা করল না৷ ওর রাগের মাথায় বলা একটা কথার জন্য চলে যাচ্ছে যাক। ও কী মানুষ নয়! ওর দিকটা একবার সে ভেবেছে!
সে বোনকে কতটা ভালোবাসে, বিশ্বাস করে এটা তো রাত্রি জানে। বিশ্বাস ভাঙার কষ্টে বোনকে শাসন করে দুটো কথা শুনালে সেই কথা গায়ে মেখে নিতে হয়!
সব বোঝার দায় কি ওর একার! সে আটকাবে কেন! রাগে অভিমানে সে কাঠ হয়ে বসে রইল।
………..
(ক্রমশ)