#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২৯)
নুসরাত জাহান লিজা
প্রকৃতির ঋতুচক্রের মতো মানুষের জীবনেও ঋতু পরিবর্তন ঘটে। পার্থক্য শুধু জীবনের ঋতুচক্রের পরিবর্তন ক্যালেন্ডারের নিয়ম মেনে হয় না, ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল সেটা। হুটহাট এই বর্ষা, আবার নিমিষেই গ্রীষ্মের খরতাপ, কখনো আকস্মিকভাবেই বইতে থাকে বসন্তের মাতাল হাওয়া। দুই পরিবারের চারজন মানুষের জীবনে বসন্ত আসি আসি করেও অসময়ে নেমে এসেছে বর্ষা মৌসুম।
রাত্রি গতকাল নিজের বাসায় চলে এসেছে উৎপলের সাথে। নিজের ঘর থেকে বের হয়নি। রাতে একবার বেরিয়ে খেয়ে আবার দরজা বন্ধ করেছে। অনেকদিন কাজে ফোকাস করা হয়নি। এবার সব ঝেড়ে আবার শতভাগ মনোযোগ বিবাহ ডটকমে দিতে হবে! ওই ঝগড়াটে গাধাটার কথা সে জীবনেও ভাববে না, মরে গেলেও ভাববে না। নিজের স্বাধীনতা নিয়ে থাকুক। আজীবন স্বাধীনতা উপভোগ করুক৷ সে ফিরেও তাকাবে না৷
রাত্রির থমথমে মুখ দেখে মায়া উৎপলকে ধরেছিলেন। ছেলের মুখে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে তার ইচ্ছে করেছে ছেলেকে কয়েকটা চড় মারতে। রাত্রি ইমরোজের বিয়ে নিয়ে তিনি কিছু বললেন না।
“আমি কি সাধে বলি, বাপের মতো স্থুল বুদ্ধি পেয়েছিস! রাত্রি তোকে কতবার জিজ্ঞেস করল, আমি জিজ্ঞেস করলাম৷ তুই তখনও কিছু বলিসনি। এখন ডেট ঠিক হয়ে গেছে এঙ্গেজমেন্টের। সব ছেলেখেলা তোর কাছে?”
“তোমরা যে বিয়ে চূড়ান্ত করে ফেলবে এটা কি তখন বুঝতে পেরেছিলাম নাকি!”
“কেন বুঝবি না? তোর বিয়ে নিয়ে কতদিন থেকে কথাবার্তা চলছে, এটা জানতি না তুই?”
“ভেবেছিলাম কিছুদিনের মধ্যে একটা বুদ্ধি ঠিক বের করে ফেলব। সব এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে…”
মিনমিন করে বলল উৎপল।
“এবার কি বুদ্ধি বের করতি? শোভার সাথে অন্য ছেলের প্রেম করিয়ে দিতি? তোর কাছ থেকে শুনলাম ইপ্সিতার বিয়ের জন্যই নাকি ইমরোজ রাত্রির কাছে এসেছিল। ওর বিয়ে ঠিক করে ফেললে ওরও সেটিং করিয়ে দিতি?”
উৎপল হতভম্ব হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে, এত ভালো আইডিয়া আগে ওর মাথায় কেন আসেনি! ইপ্সিতার জন্য ঠিক করা পাত্রের সাথে কোনোভাবে শোভার…
“এভাবে কয়টা দিতি? সারাজীবন এসব করতেই চলে যেত। তোদের আর বিয়ে হতো না। এরকম করতে করতে একটা একটা ঠিকই লেগে যেত।”
কিছুটা আশান্বিত হয়েছিল উৎপল, প্রত্যাশার পারদ টুপ করে নেমে গেল।
“মা, তুমি না বুঝলে কে বুঝবে?”
“কী বুঝব? তোর একটা অপরিনামদর্শী কাজের জন্য রাত্রির রেপুটেশন নষ্ট হবে। শোভারা প্রভাবশালী ফ্যামিলি। ওদের কথা দিয়ে সেটা ভেঙে দিলে, অপমানিত হবে। অপমান সহ্য করে চুপচাপ বসে থাকবে? তুই এখন আমার চোখের সামনে থেকে যা। তোকে দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”
উৎপল করুণ মুখ করে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। যাবার আগে রাত্রির রুমের বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়লো। ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে। ওর মাথায় এখন দুইটা গুরুদায়িত্ব। একটা রাত্রি আর ইমরোজকে আবার একসাথে করা, আরেকটা হলো এই সমস্যা সমাধান করে ইপ্সিটাকে বিয়ে করা!
মা রেগে না থাকলে তার কাছ থেকে আইডিয়া নেয়া যেত।
***
আনোয়ারা ব্যাংক থেকে ফিরে দেখলেন, বসার ঘরে দুই ভাইবোন এমনভাবে বসে আছে যেন জোর করে কেউ ওদের সহায় সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে রাস্তায় উদ্বাস্তু হিসেবে ছেড়ে দিয়েছে।
ইপ্সিতা কাঁদছিল, ইমরোজ চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে বসে ছিল। তাকে ভেতরে আসতে দেখে মাথা তুলল।
“তোদের কী হয়েছে? রাত্রি কই?”
“চলে গেছে।”
“কোথায়?”
“বাসায়।”
“আচ্ছা।” মা’য়ের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে ইমরোজ আবার বলল,
“একেবারে চলে গেছে।”
এবার আনোয়ারার টনক নড়ল, “মানে?”
ইপ্সিতার কান্নার গতি কমে আসছিল, এখন নতুন করে জোয়ার এলো।
“কী কাহিনী? ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নাকাটি না করে বল।”
দুই ভাইবোন সমস্তটা সংক্ষেপে বলল। সবটা শুনে সন্দিহান দৃষ্টিতে তিনি নিজের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন৷ তার বিশ্বাসই হচ্ছে এই অকাট গর্দভ দুটো তার পেট থেকে হয়েছে! একজন তার চোখের সামনে প্রেম করে, তাকে পাওয়ার জন্য নীল নকশা তৈরি করে ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছে। আরেকজন সেই রাগ বউয়ের উপরে দেখিয়েছে।
“আমি বাইরে থেকে এলাম। এখন খুব ক্লান্ত। পরে এটা নিয়ে কথা বলব।”
ওদের প্রথম কাজটা ভালোই হয়েছে, নইলে তার ছেলে কোনোদিন বিয়ে করত না। তবে না বলে অবশ্যই অন্যায় করেছে। আরেকজন অকারণে মেল ইগো জেগে উঠেছে, স্ত্রী চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। যাবেই তো! যাওয়াই উচিত।
এদের দুটোরই শিক্ষা হওয়া উচিত। গর্তে পড়েছিস, উঠে দেখা দেখি। তিনি বসে বসে দেখবেন, এদের বোকামি কদ্দুর যেতে পারে। কী কী করে সমাধান করতে।
***
ইমরোজ নিজের ঘরে এসে দেখল রাত্রির জিনিসপত্র যেভাবে রাখা ছিল সেভাবেই আছে। বের হবার আগে বাজি ধরার চক্করে গায়ের ছেড়ে রাখা পোশাকটাও বিছানায় রেখে গেছে। তখন তাড়াহুড়োয় ওর চোখে পড়েনি। ড্রেসিং টেবিলে প্রসাধনী সামগ্রী এলোমেলো রাখা।
ইমরোজ বিছানায় রাখা কাপড়টা সুন্দর করে জায়গা মতো রেখে দিল। বিছানা ঝাড়ু দিল। এরপর ড্রেসিং টেবিল গোছাতে গিয়ে মনে হলো থাকুক। পরে এসে দেখলে এটা নিয়ে ঝগড়া করবে।
“আমার জিনিসে হাত দিয়েছেন কেন?” এমন ধরণের কথা বলবে। পরক্ষণেই মনে হলো, রাত্রি তো রাগ করে বেরিয়ে গেছে। আর কি আসবে এই ঘরে!
এই ভাবনা মনে আসতেই ভেতরে অদ্ভুত এক শূন্যতা তৈরী হলো। আলমারি খুলতেই সেদিনের সেই শালটা বের করল৷ ভাঁজ খুলে সেটা গায়ে জড়ালো, পারফিউমটা নাকে এসে মনে হলো রাত্রি যেন ওর কাছেই আছে, সেদিন রিকশায় যতটা কাছাকাছি এসেছিল ততটা।
হঠাৎ রাগ হলো, কত সহজেই বুক ফুলিয়ে চলে গেল। ও এত কাতর কেন হচ্ছে! রাত্রিরও যদি এমন অনুভূতি হতো, তাহলে কি এত সহজে চলে যেতে পারত! সে তার কথা ভাববে একদম ভাববে না।
রাতে শোবার পরে মনে হলো, যে এই ঘরে থাকলে উৎপাত বলে মনে হতো, সে আজ না থেকেও কতটা জুড়ে আছে! তার উপস্থিতির চাইতে অনুপস্থিতি যেন বেশি দৃশ্যমান মনের চোখে। বেশ কিছুদিন পরে নিজের ঘরটা নিজের মতো পেয়েও কেন মনে হচ্ছে এই ঘর ওর ছিল না! মনে হচ্ছে কেউ উচ্চস্বরে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে মুঠোফোনে, সমস্তই কেজো কথা। ওসবের সাথে ওর কোনো লেনাদেনা নেই৷ তবুও ওর জন্য অর্থহীন কথাগুলোই সে সর্বান্তকরণে মিস করছে!
সবশেষে ইমরোজ একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, “এই মেয়েটার জম্ম আমাকে জ্বালিয়ে মারার জন্যই হয়েছে। পাশে থেকেও জ্বালাবে, দূরে থেকেও পোড়াবে।”
***
আনোয়ারা আর মায়া বাইরে বসেছেন একসাথে। হাজার হোক, তাদের সন্তান ওরা। রাগ হলেও মুখ ফিরিয়ে তো রাখা যায় না। তবে ওদের সামনে আলোচনা করতে রাজি নন তারা। একটা গোপন দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সম্পন্ন হলো তাদের মধ্যে। তাতে ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক হলো। অনেক বিষয়ে দ্বিমত শেষে তারা ঐকমত্যে পৌঁছালেন। এরপর যার যার গন্তব্যে ফিরে গেলেন।
***
এক সপ্তাহ চলে গেল এরমধ্যে। ইমরোজ অস্থির হয়ে উঠেছে ভেতরে ভেতরে। সে ভেবেছিল মা অন্তত রাত্রিকে এভাবে যেতে দেবেন না। ঠিকই ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু সাত দিন চলে গেলেও তার কোনো লক্ষণ মায়ের মধ্যে না দেখে ভীষণ হতাশ হলো সে৷
বিয়ে বিয়ে জপ করে ওর বিয়ে করিয়ে এখন কিনা আদরের ছেলের বউকে ভুলে গেলেন৷ পেটে পেটে কত খাতির ছিল এখানে থাকতে, অথচ সাত দিনে রাত্রির প্রসঙ্গ পর্যন্ত তুলছেন না মা। তাহলে বিয়েটা কেন করিয়েছলেন ধরে বেঁধে! নিজে নিজে বলা যায় নাকি! উফ্! মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে একেবারে!
রাতে খাবার সময় ইমরোজ আমতা আমতা করে বলল, “মা, ইপ্সির বিয়ে নিয়ে আর কথা হয়েছিল?”
“আপাতত পড়াশোনা শেষ করবে, এরপর ভাবা যাবে৷”
ইমরোজ ভেবেছিল ইপ্সিতার বিয়ের প্রসঙ্গ তুললে রাত্রির প্রসঙ্গ আসবে।
“ও, সে তো ভালো কথা।”
আনোয়ারা আর কিছু বলছেন না, ইমরোজ আবার বলল, “মা, বলছিলাম কি, আমার ঘরে ইয়ের কিছু অফিসিয়াল ডকুমেন্টস আছে।”
“ইয়ে কী?”
ইমরোজ হতাশ হয়ে বলল, “রাত্রি।”
“তো?”
অফিসিয়াল ডকুমেন্টগুলোর গুরুত্ব মা বুঝতে পারলেন না বলে আরেক দফা হতাশ হলো ইমরোজ।
“এগুলো তো ইম্পর্ট্যান্ট। উনার দরকার হতে পারে।”
“যার দরকার সেই ভাবুক। তোর এত ভাবনা কীসের?”
“না মানে, বলছিলাম, তুমি বললে উনি এসে এগুলো নিয়ে যেতে পারেন।”
আনোয়ারা এবার ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে, কঠিন গলায় বললেন, “শোন ইমরোজ, কানের মধ্যে ম্যাঁও ম্যাঁও করবি না। তুই বেড়াল না। এত চিন্তা হলে নিজে গিয়ে দিয়ে আয়। তুই যদি ভেবে থাকিস, তোর জন্য আমি ওর সাথে গিয়ে কথা বলব, তাহলে তুই বোকার স্বর্গে বাস করছিস। তোরা এ্যাডাল্ট মানুষ, স্বামী-স্ত্রী। তোদের ভেতরের ব্যাপার তোদের। তোর সাথে রাগ করে তোর বউ চলে গেছে। আমার সাথে না। আমাকে পুশ না করে নিজের গরজে নিজের কাজ কর।”
ইমরোজের মুখ পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করল। ধূর, ভাল্লাগে না! মা হঠাৎ এমন নিষ্ঠুর হয়ে গেছেন কেন! তার ছেলের প্রতি তার একবিন্দু মায়া নেই কেন!
“ঠিক আছে। কিছু করতে হবে না তোমাকে। নেহায়েত আমাকে কেউ ভুল বুঝে রাগ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না। সেজন্যই যাব স্যরি বলতে। আর কিছু না।”
“আমি কি বলেছি আর কিছু?”
“ভাবতে পারো যে বউ ছাড়া থাকতে পারি না। যাতে ভুলভাল না ভাবো, তাই আগে থেকেই বলে দিলাম।”
আনোয়ারা বহু কষ্টে হাসি চেপে রেখেছেন। ভীষণ আদুরে লাগছে ছেলেকে দেখতে। কিন্তু তিনি হাসলেন না। পাগল ছেলে! মনে মনে বললেন শুধু!
………
(ক্রমশ)