#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৩২)
নুসরাত জাহান লিজা
আগে নানান অজুহাতে উৎপলের সাথে দেখা করতে বাইরে যেতে পারত ইপ্সিতা। সব জানাজানি হয়ে যাবার পরে সেটা সম্ভব হচ্ছে না৷ মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে ইমরোজ ওর মোবাইলটা নিয়ে নিজের কাছে রেখেছে। ফলে গত দশ-বারো দিনে উৎপলের সাথে একবারই শুধু আনোয়ারার মোবাইল দিয়ে যোগাযোগ করতে পেরেছিল। এরপর সেটাও সম্ভব হয়নি। ভেতরে ভেতরে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে সে।
ইপ্সিতার একটা পুরোনো নষ্ট মোবাইল আছে, কিন্তু তাতে সিমকার্ড নেই। সে তক্কে তক্কে থাকে যদি কোনো সুযোগ পাওয়া যায়। আজ বসার ঘরে বসে ইমরোজ খবর দেখছিল, ইপ্সিতা উঠে লুকিয়ে ইমরোজের ঘরে গিয়ে দেখল টেবিলে তার মোবাইল।
দ্রুতহাতে সেটা নিয়ে সে উৎপলের নম্বরে ডায়াল করল। প্রথমবার কেউ রিসিভ করল না বলে আরেকবার কল করল৷ এবার কেটে দিল।
উৎপল ইমরোজের কল কাটল কেন? ভয়ে? কিন্তু ওর কাছে ফোন নেই সেটা তো জানে সে। অবশ্যই রিসিভ করা উচিত ছিল। ইপ্সিতা ছাড়া এখন এই বাড়ি থেকে আর কে কল করবে! রাগ হলো ওর। বেরুচ্ছিল এরমধ্যে দরজায় ইমরোজের সাথে দেখা হয়ে গেল,
“তুই কী করছিলি এখানে?”
“কী করব? তোমার ঘরে আসতে পারি না আমি?”
“পারিস। কিন্তু যখন দেখলি আমি রুমে নেই, তখন চোরের মতো আসাটা অবশ্যই সন্দেহজনক।”
“চোরের মতো কেন আসব?”
ইমরোজ ওর মোবাইলটা নিয়ে হিস্ট্রি চেক করল, ইপ্সিতা উৎপলের নম্বর ডায়াল লিস্ট থেকে ভাগ্যিস ডিলিট করে দিয়েছিল।
এবার কিছুটা সাহস নিয়ে বলল, “সবসময় আমাকে সন্দেহ করা বন্ধ করো।”
“অনেক বিশ্বাসের কাজ করেছিস যে।”
ইপ্সিতা মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল। ওর কান্না পাচ্ছিল৷ সবাই ওকে কত বিশ্বাস করত। আর এখন!
***
রাত্রির সাথে উৎপলের সম্পর্কে উন্নতি হয়নি খুব একটা, তবে চা বানিয়েছিল, তাই দিতে এসেছিল রুমে। উৎপল রুমে নেই৷ সম্ভবত ছাদে গেছে। বেরুচ্ছিল এরমধ্যে বিছানায় থাকে মুঠোফোন বেজে উঠল। রাত্রি ভাবল ছাদে গিয়ে ভাইকে চায়ের সাথে মোবাইলটাও দিয়ে দেবে।
হাতে নিতেই দেখল ইমরোজের কল৷ সে ধরল না। ভাবতে চেষ্টা করল উৎপলকে ইমরোজ কেন কল দিচ্ছে। ভাবতে ভাবতে আরেকবার কল এলো। গতকাল ইমরোজ ওর অফিসে এসেছিল।
নিজের ভাই তো ষড়যন্ত্র বিশেষজ্ঞ। দুটো মিলে নিশ্চিত কোনো ঘোঁট পাকাচ্ছে। পরের দুইবারই কেটে দিয়ে বেরিয়ে গেল নিজের ঘরে। কোনো ষড়যন্ত্রকারীকে সে নিজের হাতে বানানো চা খাওয়াবে না।
ওই বাড়িতে থাকা নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো আনতে হবে ভাবল রাত্রি। কী মনে করে নিজেকে লোকটা! যখন যা খুশি তাই বলে অপমান করা যায়! সে এত সস্তা না।
যতই মিষ্টি মিষ্টি ইনোসেন্ট মার্কা কথা বলুক, সে গলবে না। বলা তো যায় না আগে যেভাবে মা’য়ের কথায় বিয়ে করেছে এবারও হয়তো মা’র কথা রাখার জন্যই ওকে নিতে এসেছিল। যার কাছে ওর গুরুত্ব নেই, তার কাছে সে কেন যাবে!
তবুও কোথাও যেন একটা ক্ষীণ মন কেমন করা ব্যথা হচ্ছে। যার উপরে অসম্ভব রাগ, তার জন্যই মনে এমন বিরহ কীসের লক্ষ্মণ! মাঝের ওই অল্প কিছুদিন বাদ দিলে তো সে আগের মতোই আছে। শুধু কয়েকদিনের একটা সম্পর্কের জন্য হৃদয়ে এমন ওঠাপড়া কেন হয়!
***
উৎপল রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে ইপ্সিতার ফোন খুলেছে কি-না দেখার জন্য কল দিতে যাচ্ছিল। দেখল ইমরোজ কল করেছিল। কিন্তু কল নোটিফিকেশন নেই কেন! বুঝে নিল যা বোঝার৷ কিন্তু ইমরোজ ওকে কেন কল দিল! রাত্রির সাথে মিটমাট করতে চাইছে! সে আর কোনোকিছু না ভেবেই কল দিল।
ইমরোজ ফোন ধরতেই উৎপল বলল, “ইমরোজ, কল দিয়েছিলে কেন? কোনো দরকার?”
“আমি কল দিইনি তো!”
উৎপলের মনে হলো আরেকটা ব্লান্ডার করে ফেলেছে, ইপ্সিতা হয়তো ওর সাথে কথা বলতে চাইছিল লুকিয়ে। কী হবে এবার!
“ওহ! আসলে তোমাকে কল দিয়েছিলাম আমি। কীভাবে কথা শুরু করব বুঝতে পারছিলাম না। সেজন্য।”
উৎপলকে থামিয়ে দিয়ে ইমরোজ বলল, “অনেক বোকা বানিয়েছ তোমরা দুইজন আমাদের। এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করো না।” কড়া গলায় বলল ইমরোজ।
উৎপলও রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সুযোগ পেল না, তার আগেই ওপাশ থেকে কল কেটে গিয়েছে। ইপ্সিতার জন্য চিন্তা হলো। বেচারি এমনিতেই ফ্যামিলি প্রেসারে আছে। সে কোথায় কোনো উপায় ভেবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবে। তা না করে মেয়েটার জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলল।
ইমরোজের উপরে রাগও হলো, এই যুগে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের উপরে এত নজরদারি কেন করতে হবে!
এরমধ্যে কলিংবেলের শব্দে উৎপল এসে দরজা খুলতেই থমকে গেল। বাইরে আনোয়ারা দাঁড়িয়ে আছেন হাসিমুখে। উৎপলের ভীষণ নার্ভাস লাগছিল। আগে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে কথা বলেছে, কিন্তু এখন ইপ্সিতার মা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভেবেই ভয় পাচ্ছে।
“কেমন আছ?”
“ভালো, আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো থাকতে দিচ্ছ কই তোমরা? যা করছ সবাই মিলে।”
“আন্টি, আমি আসলে.. মানে.. ওই… আসলে…”
ওকে এভাবে কসরত করতে দেখে আনোয়ারা বললেন, “থাক বাবা। রাত্রি আছে বাসায়? তোমার মা-বাবা?”
“আন্টি, আপনি বসুন। আমি রাত্রিকে ডেকে দিচ্ছি। মা বাবা একটু বাইরে গেছেন।”
আনোয়ারা বসলেন, উৎপল গিয়ে রাত্রিকে ডেকে দিল।
রাত্রি এসে বলল, “মা, আপনি? কেমন আছেন?”
“এত চমকে যাচ্ছিস কেন? তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করল তাই এলাম। আগেই বলে নেই, কারো হয়ে কিন্তু আমি আসিনি। তাই রিল্যাক্স।”
তার বলার ভঙ্গিতে রাত্রি হেসে ফেলল।
“আমিও আপনাকে ভীষণ মিস করছিলাম। আজ এসেছেন, আমি খুব খুশি হয়েছি।”
“মুখে মুখেই। একদিনও মনে করলি না তো!”
“আমি ভেবেছিলাম। কিন্তু…” এটুকু বলে থেমে গেল রাত্রি। ওর মুখ ম্লান হলো।
আনোয়ারা ওর গালে সস্নেহে হাত রেখে বললেন, “শোন, গাধাটা কী করল না করল, সেটা ওই গাধাটার বিষয়। আমি এরমধ্যে নেই। তোর সাথে আমার সম্পর্ক কিন্তু আলাদা। তাই না?”
রাত্রি আবার হেসে ফেলল, “ছেলেকে আমার সামনে গাধা বলছ, শুনলে কী হবে বুঝতে পারছ?”
আনোয়ারা এত আন্তরিক রাত্রি তুমিতে নেমে এলো।
“কী আর করবে! আহাজারি করবে একটু। কিন্তু ওরও তো বোঝা উচিত স্ত্রী অমূল্য। টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নয়। তাই না?”
রাত্রি শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরল, শুধু যদি ইমরোজের ঘটে রাগ কম আর একটু বুদ্ধি বেশি থাকত, তবে নিজেকে সে সেরা ভাগ্যবতী মেয়ে বলে ভাবত! এমন ভালো শাশুড়ি ভাগ্য কয়জনের হয়!
***
ইমরোজের মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হচ্ছে৷ ইপ্সিতা এতটা পেঁকে গেছে, এটা ভেবেই রাগ হচ্ছে। এতকিছুর পরেও সাহস আর স্পর্ধা দেখিয়েছে উৎপলের সাথে আবার যোগাযোগ করার। এখন আরও সিরিয়াস হতে হবে ওকে৷ সে রেগে-মেগে ইপ্সিতার রুমে গেল।
……..
(ক্রমশ)
#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৩৩)
নুসরাত জাহান লিজা
ইমরোজ তেড়েফুঁড়ে ইপ্সিতার রুমে এলো আজ হয় এসপার নয় ওসপার করে ফেলতে। ভেতরে এসে বোনকে কাঁদতে দেখে ওর মাথায় জ্বলতে থাকা আগ্নেয়গিরি দপ করে নিভে গেল। যাই কিছু হয়ে যাক, বোনকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। সবসময় প্রকাশ করতে পারে না, কিন্তু মিথ্যে তো নয়। এত আদরের ছোট্ট বোনকে এভাবে ফুঁপিয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসল।
এই কয়দিন সে ইপ্সিতার সাথে পারতপক্ষে কথাই বলেনি। যেটুকু বলেছে, সবসময় রূঢ় আচরণই করেছে। ইপ্সিতা কিছু বলতে চাইলেও সুযোগ দেয়নি। ইমরোজ গলা যথাসম্ভব নমনীয় রেখে সস্নেহে ডাকল,
“ইপ্সি..”
ইপ্সিতা মুখ তুলে ইমরোজের দিকে তাকিয়ে খানিকটা সিঁটিয়ে গেল, “কাঁদছিস কেন এভাবে?”
ইপ্সিতার কান্নার বেগ বেড়ে গেল, ওকে ভয় পাচ্ছে। ইমরোজের খারাপ লাগল। উৎপল আর রাত্রির সম্পর্কটা কত সহজ! সে বোধহয় একটু বেশিই শাসন করে ফেলেছে বোনকে। ওকে এখন এতটাই দূরের মানুষ ভাবছে যে মন খুলে কথাও বলতে পারছে না।
ইমরোজ ইপ্সিতার মাথায় হাত রেখে বলল, “ইপ্সি, কথা বল।”
“আমার খুব খারাপ লাগছে ভাইয়া। আমার জন্য তোমার জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে গেল।”
ইমরোজ ভাবছিল, আসলেই কি ওর জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে! যদি এলোমেলোই হতো, তাহলে রাত্রিকে এতটা মিস করছে কেন! মনে হচ্ছে ঝগড়া করার জন্য হলেও মেয়েটা ওর পাশে থাকুক। পৃথিবীর বুকে রাত নামলেই অদ্ভুত এক শূন্যতা নেমে আসে ওর পুরো ঘর জুড়ে, মন জুড়ে।
এটা ঠিক রাত্রির সাথে ওর খটমট ছিল৷ কিন্তু তারপর তো সব বলাচ্ছিল ধীরে ধীরে। সেদিন রিকশায় রাত্রির প্রশ্রয়ের কথা মনে পড়ল। রাত্রি ভীষণ বুদ্ধিমতী, সে যখন দেখেছে ওর জ্বর নেই, তখন কি সে ওর সুপ্ত ইচ্ছেটা ধরতে পারেনি! তবুও এক শাল গায়ে জড়িয়ে কাঁধে হাত রাখতে দিয়েছিল। রাত্রিও চাচ্ছিল সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে।
“ভাইয়া, আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমি জানতাম তুমি মেনে নেবে না। তারমধ্য তোমাদের ঝগড়া দেখে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম৷ উৎপলকে আমিই ইনসিস্ট করেছিলাম। তখন ভেবেছিলাম তোমাদের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে আমাদেরও সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তখন এতটা ভাবিনি। জানি ক্ষমা চাইবার মুখ আমার নেই। তবুও পারলে ক্ষমা কোরো।”
এই পর্যন্ত বলে আবারও ফুঁপিয়ে উঠল ইপ্সিতা, “কয়েকদিন থেকেই কথাগুলো তোমাকে বলতে চাইছিলাম। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না।”
ইমরোজ ইপ্সিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “তোরা যেটা করেছিস সেটা ভুল না, অন্যায়। আমাদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল সেটা তো দেখেছিস। যদি এরচাইতেও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যেত!”
“মা ভাবিকে আগে থেকেই চেনে। তোমাকে আমরা চিনি। আমি জানতাম তোমরা কেউই হার্মফুল নও পরস্পরের জন্য। সবদিক ভেবেই এগিয়েছিলাম। কিন্তু এখনকার মতো একটা পরিস্থিতি আসতে পারে সেটা ভাবিনি। অন্যের জীবনকে প্রভাবিত করার অধিকার আমরা কেউই রাখি না। এটা বুঝতে একটু দেরি হয়ে গেছে।”
ইমরোজের ভেতরের রাগ থিতিয়ে এলো, “যা হয়ে গেছে তা তো বদলে যাবে না। কাঁদিস না। সামনে এমন সব না ভেবে কিছু করিস না, তাহলেই হবে।”
এরপর উঠে বেরিয়ে আসছিল, এরমধ্যে একটা কথা মনে পড়ায় বলল, “তুই তখন উৎপলকে কল দিয়েছিলি আমার ফোন থেকে। এটা আর করিস না।”
বলে বেরিয়ে গেল। নিজের ঘরে এসে বসল। বিছানা কুঁচকে আছে, দেখেও আগের মতো লাফিয়ে টানটান করতে উদ্যত হলো না। অদ্ভুত এক আলস্য নেমেছে মন জুড়ে। কিছুই ভালো লাগছে না। ভাবনারা ঘুরেফিরে একজনেই গিয়ে থেমে যাচ্ছে বারবার। ঘরের পাশাপাশি ওর মনটাও যেন ওর নেই। সেখানে সর্বদা অন্যের আনাগোনা। যে অভিমানে চলে গেছে ওকে একা ফেলে।
“ইমু, কী করছিস? ঘর অন্ধকার কেন?”
চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে চোখের উপরে দুই হাতের পাতা রেখে অবাধ্য ভাবনার রাশ টানতে চাইছিল। মায়ের কথায় সচকিত হলো।
“মা, তুমি কখন ফিরলে?”
“কিছুক্ষণ আগে। ইপ্সির সাথে কথা বলে তোর ঘরে এলাম।”
“ওহ্! বসো মা।”
আনোয়ারা বিছানায় বসে বললেন, “এদিকে এসে বোস ইমু। তোর সাথে কিছু কথা বলি।”
ইমরোজ মায়ের পাশে এসে বসল। মা খুব কম সময়ই এতটা সিরিয়াস থাকেন। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন।
আনোয়ারা ছেলের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদু গলায় বললেন, “ইমু, ইপ্সি কিন্তু যথেষ্ট বড় হয়েছে। শাসন করলেও কখনো কখনো রাশ ছাড়তে হয়। নইলে ছিঁড়ে একেবারে হাত থেকে বেরিয়ে যায়। ও যেটা করেছে সেটা অন্যায়। ওর উচিত ছিল নিজের কথাটা আমাদের জানানো। কোনো কারণে সাহস পায়নি। ওকে যা বলার আমি সেদিনই বলেছি। একটা কথা ভেবে দেখেছিস, ওরা কিন্তু সাহস না পেয়ে নিজেরা নিজেরা অনেককিছু করতে পারত। পালিয়ে গেলে বা না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললে তখন কী হতো? কেন কাজটা করেনি জানিস? কোথাও আমাদের সম্মতির জন্য অপেক্ষা করছিল। পথটা ভুল অবশ্যই।”
এটুকু বলে হাতে সস্নেহে চাপ দিয়ে বললেন, “এই যে তুই ওর উপরে নজরদারি করছিস, ফোন কেড়ে নিয়েছিস৷ এটা কি ঠিক হয়েছে? এই বয়সী মেয়েকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবি? এখন যদি ভুল কোনো স্টেপ নেয়, কেমন হবে সেটা? ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে ও ভুল করেছে, ভুলটা কোথায় সেটা ধরিয়ে দিতে হবে বুঝিয়ে শুনিয়ে। প্রেসার দিতে গেলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবণাই বেশি। তাই না?’’
ইমরোজ মায়ের কোলে মাথা রাখল, “আমি ওর ফোন দিয়ে আসব।”
“শুধু দিয়ে আসলে হবে না। তুই ওর বড় ভাই। ওকে বুঝিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দিবি। পারবি না?”
“পারব মা।”
কোলে রাখা মাথায় তিনি হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “দেখ, যা হয়েছে, তাতে তোর সাথে যেমন অন্যায় হয়েছে, রাত্রিও কিন্তু তোর মতোই ভিক্টিম। তুই তবুও নিজের বাড়িতেই ছিলি। রাত্রিকে কিন্তু নিজের কমফোর্ট জোন ছেড়ে আসতে হয়েছে। এখন ইপ্সি আর উৎপল মিলে যা করেছে, তার জন্য যদি তুই মেয়েটাকে ব্লেম করিস, জিনিসটা কি ঠিক? ও কিন্তু তোকে ব্লেইম দেয়নি। এখন এটা ভাব, রাত্রি যদি তোকে বলত, তোকে বিয়ে করে ওর জীবনটা শেষ হয়ে গেছে, তোর কেমন লাগত? যখন তুই ওকে মিস করছিস তখন?”
ইমরোজ বলল, “আমি রাগের মাথায় কী বলেছি, সেটা ধরে ও চলে গেল।”
আনোয়ারা হেসে বললেন, “মানুষ অভিমান কার উপরে করে জানিস? যাকে সে কাছের মানুষ ভাবে, আপন মনে করে। দেখ, বিয়ের পরে কতবার তোরা পরস্পরের দিকে কাদা ছুঁড়েছিস। কই তখন কিন্তু কেউ মান অভিমান করে বসে থাকিসনি। কারণ তখন তোরা কেউ কাউকে আপন ভাবিসনি। কারোর উপরে ভরসা করিসনি। এখন করতে শুরু করেছিস বলেই দু’জনেই কষ্ট পাচ্ছিস।”
“ও কষ্ট পাচ্ছে না মা।”
ইমরোজের মুখে হাত বুলিয়ে বললেন, “সেটা তুই এখানে বসে তো বুঝবি না বাবু। খোলাখুলি কথা বল। আরেকটা কথা সংসার করতে গেলে দোষ যার, বুঝতে পারার সাথে সাথে তাকেই স্যরি বলতে হয়। স্যরি বললে কেউ খাটো হয় না। বরং অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় কেবল নিজের ভুলটা এক্সেপ্ট করতে না পারায়। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটা খুবই প্রথাগত নিয়ম সেট করা আছে। পুরুষ হলে এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না। তাতে নাকি পৌরুষে আঘাত লাগে। বিশ্বাস কর, এসবের কোনো ভিত্তি নেই। ইগো আর ব্যক্তিত্ব আমরা গুলিয়ে ফেলি বেশিরভাগ সময়। এটাও একটা বড় সমস্যা আমাদের। মানুষ সকলেই, ভুল সবার হয়। আবেগ সবার আছে। কষ্ট পেলে কাঁদার অধিকার, ভুল করলে স্যরি বলার সাহস দুই পক্ষেরই থাকতে হয়। সংসারটা দুজনের। দুইজনকেই স্যাক্রিফাইস করতে জানতে হয়। দুই পক্ষ থেকেই স্যরি বলার প্র্যাকটিস থাকতে হয়। তাহলে দেখবি, সম্পর্কটা খুব সুন্দর হয়।”
ইমরোজ এই জন্যই মাকে এতটা ভালোবাসে। মা ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু। সে মৃদু হেসে বলল, “মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। সেটা কি তুমি জানো?”
হাসলে ইমরোজকে এত সুন্দর দেখায়, তিনি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন। তার ছেলে-মেয়েকে কোনোদিন তিনি প্রথাগত নিয়মে বড় করেননি। সময়ে সময়ে শাসন করেছেন, সময়ে সময়ে নিজেদের বিবেচনার উপরে ছেড়ে দিয়েছেন যেন নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে। এই যে এবারের এত গোলমেলে বিষয়, তিনি চাইলেই রাত্রিকে বুঝিয়ে বলে নিয়ে আসতে পারতেন। মায়া রাত্রিকে বোঝাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তারা আলোচনা করে বিরত থাকলেন।
দূরত্ব অনেক সময় কাছে আনে। অপর প্রান্তের মানুষটা তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা অনুধাবন করতে সুবিধা হয়। কাছে থেকে লড়াই করেই হয়তো আরও অনেকটা সময় কেটে যেত, নিজেদেরকেই উপলব্ধি করতে।
এখন দূরে থেকে এই যে মিস করছে একজন আরেকজনকে, এটাই তারা চেয়েছিলেন। নিজের ছেলেকে তো অবলোকন করেছেন, আজ রাত্রির কাছে গিয়েছিলেন ওর মনোভাব বুঝতে। দেখলেন, দুই পক্ষেই ঘন মেঘ, একটু ঝোড়ো বাতাসেই বৃষ্টি নামবে ঝুমঝুমিয়ে।
যেটুকু বোঝানো প্রয়োজন বুঝিয়েছেন। এখন দেখা যাক কী হয়।
ইপ্সিতা আর উৎপলকে নিয়েও দুই মা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথম কথা তারা বড় একটা ভুল করেছে, এটা তাদের বুঝাতে হবে। বাকিটা সময়ে ঠিক হয়ে যাবে।
……….
(ক্রমশ)
#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৩৪)
নুসরাত জাহান লিজা
ইমরোজের মনে যেটুকু সংকোচ ছিল, মায়ের কথায় তা কেটে গেছে। রাত্রিকে যে ভালোবেসে ফেলেছে এটা আগেই বুঝতে পেরেছে। ক্ষমা সে চাইতে পারবে নিঃশঙ্ক চিত্তে। কিন্তু ভালোবাসার কথা জানাতে সময় লাগবে। আগে নিজের সাথে যুঝতে হবে। সে ক্লাসে গুছিয়ে লেকচার দিতে পারে, কিন্তু নিজের একান্ত অনুভূতি প্রকাশে সে বরাবরই অজ্ঞ। দেখা যাবে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে এমন কিছু বলে ফেলবে, পরে সব গুবলেট পেঁকে যাবে। নাহ্! এই রিস্ক নেয়া যায় না। আগে বরং নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়া যাক।
তবে রাত্রিকে ফিরিয়ে আনতে হবে আগে। শনিবার সন্ধ্যার পরে সে রাত্রিদের বাসায় গেল। রাত্রি তখন বাইরে। মায়া ওকে যত্ন করে বসালো। হাবিব সাহেব টেলিভিশনে খবর দেখছিলেন, আবার পত্রিকাও পড়ছিলেন একসাথে। পত্রিকা থেকে চোখ তুলে তিনি বললেন,
“কেমন আছ বাবা?”
“জ্বি ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
মায়া এলেন চা নিয়ে। তিনি ফোঁড়ন কেটে বললেন, “ডাবল নিউজের ডোজ নিলে সে ভালোই থাকে। নাও, চা নাও। যা ঠাণ্ডা পড়েছে এবার।”
“তোমার দেয়া চিনি ছাড়া চা খেয়ে ভালো থাকার উপায় আছে? নিজেকে নিজের ভালো রাখার উপায় বের করে নিতে হয়।”
“এই কথাটা শরীরে সুগার বাড়ানোর আগে মনে ছিল না?”
ইমরোজ উত্তর দিল না, মৃদু হাসল শুধু। তাদের খুঁনসুটির মধ্যে সে ঢুকে কী বলবে, পরে দেখা যাবে অপরপক্ষ নাখোশ হয়ে বসে আছে৷ এই মুহূর্তে এই দু’জনের সাপোর্টই ওর জন্য জরুরি। মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ভালো। তাই নীরবতা পালন করা শ্রেয়।
চা শেষ করতে করতে শ্বশুরের সাথে ইমরোজের দেশ বিদেশের সাম্প্রতিক নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হলো। কিছুক্ষণ পরে পায়েস নিয়ে এলেন মায়া। ঘন দুধের পায়েস খাবার মাঝপথে রাত্রি চলে এলো। উৎপল তখনো বাইরে। ইমরোজকে দেখে ওর পা থমকে গেল।
“আপনি?”
“এটা কী ধরণের প্রশ্ন হলো? যা রুমে যা, ফ্রেশ হ। তুমিও পায়েস শেষ করে ভেতরে যাও বাবা।”
মায়া ওদের দুজনকে একসাথে কথা বলার সুযোগ করে দিতে চাইছেন দ্রুত৷ হাবিব সাহেব বললেন, “তা বাবা, এই যে ইন্টারনেশনাল ইকোনমি..”
মায়া কঠিন চোখে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা দিতেই তিনি বললেন, “পরে কখনো আমরা সার্বিক আলোচনা করব ক্ষণ।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার আলোচনা অনুষ্ঠানের উপরে তো বিশ্বের সব সেক্টরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।”
“তুমি তো পৃথিবীতে কী চলছে কিছুই জানো না। পৃথিবীর একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজের মতামত থাকবে না?”
“যত ইচ্ছা মতামত দাও, আমার সমস্যা নেই। কিন্তু ঘর নিয়েই যে এত উদাসীন, সে বিশ্ব নিয়ে কী চিন্তা করে আমার জানা হয়ে গেছে।”
তাদের কথার যু দ্ধের মাঝেই ইমরোজ ইতস্তত করছিল দেখে মায়া বললেন, “যাও বাবা, ভেতরে যাও।”
ইমরোজ উঠে রাত্রির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নক করল, রাত্রি বলল, “আসুন, দরজা খোলা আছে।”
ইমরোজ ভেতরে এলো। রাত্রি উঠে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল, “বলুন, যা বলতে চান।”
“রাত্রি, আমি সেদিন তোমাকে যা বলেছি, সেটা একদমই ঠিক হয়নি। আমি কিছু ভেবে বলিনি। ইপ্সিকে আমি কেমন করে টেক কেয়ার করি, এটা তো তুমি শুরু থেকেই জানো৷ আমি আসলে ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলাম। তারপর ওদের প্ল্যান জেনে রাগ হয়েছিল ভীষণ। রাগের মাথায় ওকে বকছিলাম, তুমি মাঝে এসে কথা বলছিলে বলে, ওভাবে বলে ফেলেছিলাম। ইনটেশনালি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। স্যরি।”
“আপনাকে মা স্যরি বলার জন্য বুঝিয়েছে, তাই না?”
“হ্যাঁ, কাল মা বলল…”
এটুকু শুনে রাত্রির মুখে মেঘের ছায়া নেমে এলো, “তাই এতদিন পরে স্যরি বলতে চলে এলেন। তাই না?”
“তুমি ফিরে চলো, রাত্রি।”
“যেদিন আপনি নিজে নিতে আসবেন সেদিন যাব। তার আগে নয়।”
ইমরোজ বলতে পারল না সে নিজের গরজে ওকে নিতে এসেছে। খুব কষ্ট হলো ওর। রাত্রির ইঙ্গিতটাও ধরতে পারল না।
“ফিরবে না তাহলে?”
“আপনার প্রশ্নের উত্তর আগেই দিয়েছি।”
ইমরোজ আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। শুধু রাত্রির ঘর থেকে নয়, বাড়ি থেকেই। মায়া রান্নাঘরে ছিলেন, দরজা খোলার শব্দে যতক্ষণে এই পর্যন্ত এলেন, ততক্ষণে ইমরোজ চলে গেছে। তিনি জামাইয়ের আপ্যায়নের জন্য রান্না করছিলেন।
রাত্রিকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ইমরোজ কোথায় গেল?”
“আমি কী করে বলব মা? উনি কি আমাকে বলে গেছেন?”
“যা খুশি কর তোরা। ছেলেটা এভাবে না খেয়ে বেরিয়ে গেল।”
মায়া রাত্রির মুখের দিকে তাকালেন এবার। মেয়ের মুখ দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন, এই মাত্র যেন কোনো প্রবল ঝড় রাত্রির উপর দিয়ে বয়ে গেছে। তিনি রাত্রির হাত ধরে বললেন,
“এত কষ্টই পাবি, তাহলে ধরে রাখলি না কেন?”
“পুরোটাই এক তরফা মা। আমি কেন আটকাতে যাব?”
রাত্রির ঝাপসা চোখ তার নজর এড়ায়নি। তার মেয়েটা বড্ড শক্ত ধাতের। সহজে ভাঙা যায় না, এখন ভেঙে পড়েছে ভেতর থেকে, তবুও টলতে চাইছে না। তিনি সস্নেহে বললেন,
“এক তরফা কিনা, তুই কীভাবে জানিস? খোলাখুলি কথা বলেছিস?”
রাত্রি উত্তর দিল না, সে তো ইঙ্গিত দিল, বলতে পারত না যে নিজের জন্য ওকে চায়। সেজন্যই ফেরাতে এসেছিল! কেন বুঝল না! কেন বলবে! সে না ফিরলেই তো ইমরোজ ভালো থাকে। স্বাধীনতা অক্ষত থাকে।
কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “রাত্রি, শোন, সব মানুষ একরকম হয় না৷ সবাই সব প্রকাশ করতে পারে না। তোর উচিত ছিল ওকে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়া। যাই হোক, যথেষ্ট বড় হয়েছিস। সব বুঝিস। এই যে তোর চোখে জল, এটা ওকে দেখতে দিলেও হয়তো বুঝত৷ নিজেকে প্রকাশ করতে পারত। ভেবে দেখিস।”
***
ইমরোজ রাত্রিদের বাসা থেকে বেরিয়ে বাইক নিয়ে উদ্দেশ্যহীন চক্কর দিল শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে। স্থিরতা এলো না মনে।
ঠান্ডা জাঁকিয়ে বসেছে এবার। হাড় হিম ঠান্ডায় গায়ে কাঁপন ধরে যাচ্ছে, তবুও ঘরে ফিরল না। ওই শূন্য ঘরে ফিরতে ওর ভালো লাগে না এখন আর। এটা কেন মেয়েটা বোঝে না।
***
রাত্রি বসেছিল নিজের ঘরে। হাবিব সাহেব এসে বললেন, “এভাবে গুম হয়ে বসে আছিস কেন মা?”
“এমনি বাবা। তুমি বসো না।”
হাবিব সাহেব বসে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, মেয়েকে তিনি বোধহয় একটু হলেও বেশি ভালোবাসেন। রাত্রি ভীষণ বাবা ন্যাওটা ছিল ছেলেবেলায়। ওইটুকু বয়স থেকে তার সমস্ত খেয়াল রাখত। কাছে কাছে থেকেছে বলেই হয়তো।
“তোর মন খারাপ?”
“না তো?”
“তোকে একটা কথা বলি, দেখ, তোর মায়ের সাথে আমার ঝগড়া দেখেছিস তো সবসময়। তোর একবারও কখনো মনে হয়েছে আমাদের মধ্যে মনের টান নেই? মা একটা কথা বলতেন৷ একটা খুব প্রচলিত উদাহরণ দিতেন, দুটো হাড়ি পাশাপাশি থাকলে ঠোকাঠুকি হবেই। তাই বলে লোকে বাসনপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয়? দাম্পত্য হচ্ছে তেমনই, তারা এত বেশি প্রকাশ্য পরস্পরের কাছে, তাই একটু খটমট লাগেই। পরিস্থিতির জন্য অনেক কথা মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, যার সত্যিকারের ভিত্তি নেই। পরে গিয়ে অনুশোচনা হয়। কেউ যদি নিজের ভুল বুঝতে পারে, দুঃখ প্রকাশ করে, তাকে একবার সুযোগ দিতে হয়। আমি কিন্তু এটা বলছি না যে অসম্মান মেনে নিতে। শুধু পরিস্থিতি বিবেচনা করতে বলেছি। বাকিটা তোর মর্জি।”
রাত্রি বাবার কাঁধে মাথা রাখল, “বাবা, তুমি ওষুধ খেয়েছ?”
“হ্যাঁ, তোর মা সব ভুললেও এটা কখনো ভুলে না।” হেসে বললেন তিনি।
রাত্রি মৃদু হেসে বলল, “মাকে খুব ভালোবাসো, তাই না বাবা?”
“তা তো বাসিই। নইলে এতদূর এলাম কী করে?”
“আচ্ছা বাবা, তোমাদের প্রায় বত্রিশ বছরের সংসার। এখনো এভাবে ভালোবাসা যায়? কখনো একঘেয়েমি আসে না?”
“ভালোবাসলে বরং মনে হয়, শুধু বত্রিশ বছর কেন? আরও কয়েকগুণ সময়ও অল্প মনে হয়। একদিন বুঝতে পারবি। যেদিন বুঝবি, সেদিন তোরও এটাই মনে হবে।”
রাত্রি সহসা আনমনা হয়ে গেল, ইমরোজের সাথে তার এমন একটা সংসার কখনো হবে! সে ঠিক করল ইমরোজ যদি আরেকবার আসে, সে নিশ্চিত হবে একই অনুভূতি ওই প্রান্তেও আছে কি-না। যদি থাকে তবে আর ফেরাবে না।
***
ইমরোজ রাতে বাসায় ফিরল বারোটার আগে আগে, গায়ে ধুম জ্বর। ঠান্ডা লেগে একাকার। ঠান্ডার ধাত আছে ইমরোজের। শীতের সময় তা প্রকট হয়।
“কোথায় ছিলি ইমু?”
আনোয়ারা অস্থির হয়ে উঠলেন। ইমরোজ আর ইপ্সিতার কিছু হলে তার সমস্ত স্থিরতা টলে যায়। ইপ্সিতাকে সাথে নিয়ে কোনোমতে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন। কয়দিন আগেই জ্বর থেকে উঠল। আবার জ্বর। খুব ভালো লক্ষ্মণ নয়।
তিনি বালতিতে পানি আনতে গেলেন, ইপ্সিতা পাশে বসেছিল। ইমরোজ কী কী যেন বিরবির করছিল। সব বুঝতে পারছিল না, মাথা ম্যাসেজ করে দিচ্ছিল। ইমরোজ রাত্রি ফিরেছে কিনা এমন কিছু বলছিল বলে মনে হলো।
ইপ্সিতার মোবাইল গতকাল রাতেই একগাদা উপদেশ শুনিয়ে ফেরত দিয়েছিল ইমরোজ। সে রাত্রিকে কল দিয়ে ইমরোজের অবস্থার কথা জানালো।
***
ইপ্সিতার কল পাওয়ার পরেই রাত্রি ভীষণ চিন্তিত হয়ে উঠল। কক্সবাজারের কথা মনে পড়ল। এই লোকটা ভীষণ খারাপ। অন্যের উপরে রেগে নিজেকে কষ্ট দিতে ওস্তাদ। এত কষ্টই যদি পেয়েছে, কষ্টে এত অলিগলি ঘোরা সহজ মনে হয়েছে, ওকে ফিরিয়ে নিতে নিজের মনের কথা বলার চাইতে! সুস্থ হোক এবার শুধু, সে মনের কথা টেনে বের করবে। এসব সে একেবারে সহ্য করবে না।
কিন্তু মনকে প্রবোধ দিতে পারছে না কিছুতেই। মনে হচ্ছে ইমরোজের এই দুর্ভোগের জন্য কোথাও না কোথাও সে দায়ী।
রাত্রি পুরোনো জামাও পরিবর্তন করল না, কোনোমতে চোখেমুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে মায়ের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল। মায়া হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছেন।
“মা, আমার ওই বাসায় যেতে হবে। ইমরোজ নাকি খুব অসুস্থ।”
“অসুস্থ? এই না সন্ধ্যায় সুস্থ মানুষ এলো। কী হয়েছে?”
“অনেক জ্বর। সেদিনই জ্বর থেকে উঠল। আমাকে যেতে হবে মা।”
ততক্ষণে উৎপল বেরিয়ে এসেছে, “রাত বারোটার বেশি বাজে। এখন?”
“তুমি চলো তাহলে আমার সাথে। যাবে?”
মায়া বললেন, “সাবধানে যা।” মেয়েকে বাধা দিলেন না। সাথে যেহেতু উৎপল যাচ্ছে।
***
রাত্রি এসে সরাসরি ওদের ঘরে এলো। আনোয়ারা মাথায় পানি ঢালছিলেন। ইপ্সিতা পাশে বসেছিল।
প্রায় আধাঘণ্টা পরে রাত্রি বলল, “মা, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমি দেখছি।”
আনোয়ারা বললেন, “আচ্ছা, তুই দেখ তাহলে। আমি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ি।”
আনোয়ারা বেরিয়ে গেলে, ইপ্সিতাকেও বলল, “তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। যাও৷ ঘুমিয়ে পড়ো।”
ইপ্সিতারও মনে হলো, দু’জন থাকুক। তাই সে চলে গেল, যাবার আগে বলল, “কোনো সমস্যা হলে ডেকো ভাবি।’’
উৎপল ওকে দিয়েই চলে গেছে। থাকতে রাজি হয়নি। ওকে আর ইপ্সিতাকে নিয়ে কোনো ভুল বোঝাবুঝি আবার হোক সে চায় না।
রাত্রি ইমরোজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, কিছুক্ষণ পরে ইমরোজ রাত্রির হাতের উপরে হাত রাখল, অস্ফুটস্বরে বলল,
“রাত্রি?”
চোখ এখনো নীমিলিত। স্পর্শেই চিনে ফেলল!
“হুম।”
ইমরোজ ঘোরগ্রস্ত গলায় বিরবির করে বলে চলেছে, “স্বপ্ন দেখছি বোধহয়। যদি স্বপ্ন হয়, আমি চাই না আমার ঘুমটা ভাঙুক। অসুখ থাকুক সবসময়। অসুখ হলেই কেবল তুমি এভাবে পাশে থাকো।”
তবুও রাত্রি স্পষ্ট বুঝতে পারল কথাগুলো। ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু ইমরোজের কপালে পড়তেই ঝট করে চোখ তুলে তাকালো ইমরোজ। চোখ দুটো টকটকে লাল, মুখ মলিন, তবুও যেন একটা বিচিত্র হাসি ফুটে আছে সুন্দর মুখটায়। রাত্রি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সেই মুখের দিকে।
…………
(ক্রমশ)