বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-৩৫+৩৬

0
37

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৩৫)
নুসরাত জাহান লিজা

ইমরোজ চোখ খুলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল শিয়রের কাছে বসে থাকা রাত্রিকে দেখে। মুহূর্তকাল লাগল রাত্রির অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে। সমগ্র পৃথিবী যেন নিমিষেই বিস্মৃত হয়ে গেল ওর সমস্ত চেতনা থেকে! সে জ্বরক্লিষ্ট চোখেই নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। এও সম্ভব! নিজেকে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করল, যে মেয়ে কিছুক্ষণ আগেই ফিরে আসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে সে এখন ওর ঘরে, ওর এত কাছে বসে আছে। ওর কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছে পরম যত্নে! এটা বিশ্বাস করা কম দুস্তর নয়!

“নিজের উপরে এই অত্যাচার করার খুব দরকার ছিল?”

এবার বিশ্বাস হলো এটা রাত্রি, একজন অসুস্থ মানুষের কাছে কেমন জবাবদিহিতা চাইছে! নিষ্ঠুর একটা মেয়ে। কেন জানে না, প্রবল অভিমান উথলে উঠল ইমরোজের হৃদয় সমুদ্রে।

“কেন এসেছ? দয়া দেখাতে?”

রাত্রির চোখে-মুখে হতাশা ফুঁটে উঠল, “দয়া দেখাতে বুঝি কেউ এই রাত-দুপুরে ছুটে আসে?”

“তখন বলেছিলে ফিরবে না।” অভিমান জড়ানো গলা ইমরোজের।

“আমি আসায় তোমার প্রবলেম হলো বুঝি?” ইমরোজের কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে বলল রাত্রি।

ইমরোজ ডান হাতটা তুলে ওর কপালে রাখা রাত্রির হাতটা আলতো করে স্পর্শ করল, এরপর ওর মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হলো, এই মেয়েকে বোঝা সহজ কর্ম নয়। এখন অসুস্থতায় কাউকে পড়তে চাওয়া ভীষণ ক্লান্তিকর বলে মনে হলো।

“আমি চাইছিলাম তুমি ফিরে আসো। তোমার সমস্যা ছিল আসতে। প্রবলেম থাকা সত্ত্বেও কেন এলে?” অভিমানী ইমরোজ শুনতে চাইছে রাত্রি ওর সাথে জীবনের বাকি পথ চলার জন্য ফিরে এসেছে। কিন্তু তেমন কিছুই বলছে না, অযথা ওর প্রশ্নের বিপরীতে পাল্টা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ইমরোজ শিক্ষক মানুষ, প্রশ্ন করে উত্তর পেয়ে অভ্যস্ত। এতে বিরক্ত হলো মনে মনে।

“ইমরোজ, আমি কখনো আমার মনকে ইগনোর করে কাউকে খুশি করার চেষ্টা করতে পারি না। আমার মন আজ এখানে আসতে সায় দিয়েছে। তাই চলে এসেছি। এখন এত কথা বলো না তো। চুপচাপ ঘুমাতে চেষ্টা করো।”

প্রথমবার খেয়াল না করলেও এবার সে উপলব্ধি করল, রাত্রি ওকে তুমি বলে সম্বোধন করছে। জ্বর আর রাতের অভিমানী শহর ভ্রমণে ওর শরীর মন দুটোই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। রাত্রির কথার পুরো মানেটা সে ধরতে পারল না। আকারে-ইঙ্গিতে কথাবার্তা বুঝতে সবসময়ই সে অপারগ। কেউ ওর সামনে ঘুরিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বললেও সে ধরতে পারে না। অনেকক্ষণ পরে যখন বুঝতে পারে, তখন আসলে পাল্টা উত্তর দেবার মতো পরিস্থিতি থাকে না। সে সবসময় সরাসরি কথা বলে।

এখন বুঝতে চেষ্টাও করল না, তবে রাত্রির মুখে তুমি শুনতে বড্ড ভালো লাগল। হঠাৎ করে কথাটার আংশিক অর্থ ধরতে পারল। রাত্রি নিজের মনের কথা শুনে ফিরে এসেছে। ওর জন্য ফিরে এসেছে এটা যদি বলত! তবুও কেন যেন ভালো লাগল।

রাত্রি এবার বলল, “অনেক শোধবোধের খেলা হলো। এবার এটা শেষ হোক নাহয়।”

“শোধবোধের খেলা শেষ হবার পরে কী হবে?”

“বন্ধুত্ব। অবশ্য তোমার আপত্তি না থাকলে।”

ইমরোজ অবসন্ন চোখে আরেকবার স্ত্রীর দিকে তাকাল। বুঝতে চেষ্টা করল রাত্রির মনে আবার কোনো দুষ্টু বুদ্ধি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কি-না! না, আগের মতো যুদ্ধংদেহী মুখাবয়ব নয়, বরং অত্যন্ত মায়া নিয়ে ব্যথাতুর আপন মানুষের দিকে কেউ যেভাবে তাকায় তেমন দৃষ্টি। রাত্রির অভিব্যাক্তিতে এই দৃষ্টি সে আগে কখনো দেখেনি। চেনা রাত্রির অচেনা মুখ দেখতে ওর ভালো লাগছে। অবচেতনেই সে বলল,

“আপত্তি কেন থাকবে?”

“আমি তোমার স্টুডেন্ট নই, এত প্রশ্ন করছ কেন? উত্তর চাই আমার।” এবারের বলায় কাঠিন্য থাকলেও সেটুকু ছাপিয়ে গেল মায়ার আড়ালে।

“তোমার সাথে বন্ধুত্ব হলে আমারও ভালো লাগবে।”

“এবার সুবোধ ছেলের মতো ঘুমানোর চেষ্টা করো দেখি। এখন সেটা জরুরি।”

ইমরোজ চোখ বন্ধ করল না সহসা, রাত্রি বলল, “মা কত চিন্তা করেন, তুমি জানো? এভাবে রাগ করে এমন কিছু করা ঠিক নয়, যাতে তোমার সাথে সাথে তারও কষ্ট হয়। তুমি কলেজের লেকচারার হয়েও কিচ্ছু বোঝো না, তোমার চাইতে স্কুলে পড়া বাচ্চাদেরও মাথা ভালো।”

রাত্রি কথার মধ্যে বোঝাতে চেষ্টা করল এই রগচটা গাধাটার জন্য ফিরে এসেছে। অথচ কিছুই বুঝল না। বন্ধুত্বেই তিনি খুশি৷ কেন, সে বলতে পারল না, “বন্ধুত্ব তো চাই, তবে বন্ধুত্বের সাথে সাথে তোমাকেও চাই।”

এটা এর মুখ থেকে বের করতে কত অপেক্ষা করতে হয় কে জানে!

ওদিকে তার মুখে আবারও অভিমানের ছাপ পড়েছে, “আমি মাথা খারাপ মানুষ। তাহলে বন্ধুত্ব করলে কেন?”

রাত্রি এবার বিরক্ত হতে হতেও হেসে ফেলল, ওর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “সাধে বলিনি। আগে সুস্থ হোন আপনি। তারপর আপনাকে পড়ার বইয়ের বাইরের অ আ ক খ থেকে শুরু করে ব্যকরণ পর্যন্ত শিখিয়ে দিতে হবে।”

“বন্ধুত্ব করেও আবার আক্রমণাত্মক হচ্ছো তুমি।”

রাত্রি নিজের মুখটা কিঞ্চিৎ নামিয়ে আনলো, এরপর ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে ভীষণ ইনোসেন্ট দেখাচ্ছে এখন। আমাদের পাশের বাসায় একটা কিউট বাচ্চা আছে৷ রাগলে ওরকম লাগে তোমাকে।”

বলে ইমরোজের নাক টেনে দিল রাত্রি। এরপর সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, “তোমার আজকের কাণ্ডে রাগ হয়েছে আমার। এমন কাজ আর কখনো করবে না। এখন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছো। এটা ছেলেমানুষি নয়? কী লাভ হয়েছে তাতে?”

ইমরোজ অবচেতনেই বলে ফেলল, “লোকসান কিছু হয়নি।”

এরপর মনে মনে বলল, “এই যে তুমি আমার পাশে আছ। আমার শূন্যতা নেমে আসা ঘর পূর্ণ করেছ। এটা তো লাভ-ই।”

রাত্রি দেখল ইমরোজের জ্বর আবার বাড়ছে, কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হচ্ছে। সে উঠে নরম কাপড় ভিজিয়ে এনে ওর মাথায় দিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ইমরোজ ঘুমিয়ে পড়ল। রাত্রি পাশে বসে রইল ঘুমন্ত ইমরোজের দিকে তাকিয়ে।

হঠাৎ করে উপলব্ধি করল, সে ডুবে যাচ্ছে অতলান্তিক সমুদ্রে, যে সমুদ্র ভর্তি ভালোবাসার জলে। অন্য আরেক সমুদ্রের জল এসে এই জলে মিশে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ভালোবাসার মহাসমুদ্র।
……….
(ক্রমশ)

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৩৬)
নুসরাত জাহান লিজা

আনোয়ারা রাত্রির বাসার সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন আজ৷ উৎপল আর ইপ্সিতার ব্যাপারটা ঝুলে আছে। সেটার একটা সমাধান প্রয়োজন। তিনি মায়ার সাথে কথা বলে একমত হয়েছে, সবাই একসাথে বসে এটা নিয়ে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। একসাথে আলোচনা করলে অনেক বড় সমস্যাও সহজ হয়ে যায়।

ইমরোজ এখন সুস্থ। আজ শুক্রবার। সবাই বাসায়। রাত্রিও হাতে হাতে আনোয়ারাকে সাহায্য করছিল। ইপ্সিতা আর ইমরোজও এসেছে। সবাই মিলে রান্না করছে৷ রান্নাটা পারিবারিক বৈঠকখানার আড্ডাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

রাত্রি লক্ষ্য করল ইমরোজ রান্নায় ভীষণ পারদর্শী। সে তুলনায় ইপ্সিতার অবস্থা ওর মতোই আনাড়ি। ইপ্সিতা ছুতো খুঁজছে চম্পট দেবার, মায়ের জন্য পারছে না।

“নাচতে নাচতে বিয়ে করতে এত বড় প্ল্যান করলি, এখন ফাঁকিবাজির পায়তারা করলে হবে?”

আনোয়ারা মেয়েকে বেশ শাসনের সুরে বললেন কথাটা। ইপ্সিতার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে ইমরোজ বললেন,

“মা, থাক না। ও ছোট মানুষ।”

ছোট মানুষ বলেই একবার রাত্রির দিকে তাকাল, এরপর সংশোধন করার জন্য বলল, “মানে আগে কখনো সেভাবে করেনি তো। এখন এভাবে…”

আনোয়ারা বললেন, “ইমু, তুই ওকে আস্কারা দিয়েছিস সবসময়। ওর কাজগুলো তুই করে করে ওকে ঘরের কাজ শিখতে দিসনি। কিছু নিত্য নৈমিত্তিক কাজ সবার শেখা উচিত। এতে অন্যের উপরে নির্ভর করতে হয় না। বুঝলি?”

আনোয়ারাকে রাত্রির সবসময়ই ভালো লাগে, আজ আবারও সেই ভালোলাগা বাড়ল। রাত্রি এক্সপার্ট না হলেও টুকিটাকি কাজ চালানোর মতো রান্না জানে। তবে ওকে সব কেটে ধুয়ে তৈরি করে দিতে হয়। এখানে আনোয়ারার সাথে থাকতে থাকতে অল্পস্বল্প উন্নতি হচ্ছে রান্নায়।

রান্না প্রায় শেষের দিকে তখনই কলিংবেল বেজে উঠল।

***
রাত্রির শ্বশুরবাড়ি দাওয়াত শুনে উৎপল খানিকক্ষণ কাচুমাচু করছিল। ওই বাড়ি যেতে এখন ওর অস্বস্তি হয় খুব। মায়া ধমক দিয়ে বললেন,

“ঢং করিস না। তোর এই বোধ আগে থাকলে ভালো হতো। রেডি হয়ে আয়।”

উপায়ন্তর না দেখে তৈরি হলো উৎপল। কাল মা যখন আনোয়ারার সাথে কথা বলেছেন, তখন সে কিছুটা শুনে মনে হয়েছে আজ ওদের বিচার বসবে। রকম-সকম দেখে মনে হচ্ছে আসামীকে ধরে বেঁধে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রায় শোনার জন্য। এজন্যই যেতে চাইছিল না।

আশঙ্কা হচ্ছে, সবাই কী সিদ্ধান্ত নেবে না ভেবে। এখন মনে হচ্ছে যাওয়াই ভালো। যদি ওদের আলাদা হয়ে যাবার ফয়সালা দেয় সকলে মিলে, ইপ্সিতা একা সামলাতে পারবে না। ওকে থাকতে হবে। দুজনেই যেহেতু দায়ী, ইপ্সিতাকে একা একা এমন রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে সে ঠেলে দিতে পারে না।

***
সবাই বসার ঘরে এসে বসল। খোশগল্প হলো বেশ কিছুক্ষণ। এরপর খাওয়া পর্ব শেষ হতেই সবাই আবারও আগের জায়গায় এসে বসল। এবার পরিস্থিতি মুহূর্তেই গোমট হয়ে উঠল।

রাত্রি উৎপল আর ইমরোজের সাথে বসেছে। ইপ্সিতা মায়ের সাথে। অন্যদিকে মায়া আর হাবিব সাহেব।

প্রথম কথাটা বললেন মায়া, “আপা, আমরা আজকে যেজন্য একত্রিত হয়েছি সেটা আপনি শুরু করেন।”

আনোয়ারা বললেন, “ইপ্সিতা আর উৎপল যদি প্রথমেই আমাদের সব খুলে বলত, তাহলে মাঝে যে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেটা হতো না। হয়তো এতদিনে ওদের বিয়েটাও আমরা করিয়ে দিতাম। কিন্তু ওরা দুই জনেই খুবই অপরিপক্ক আচরণ করেছে। যেটার ফল অনেক খারাপও হতে পারত। সেদিকেই যাচ্ছিল। রাত্রি আর ইমরোজ যদি কখনো এডজাস্ট না করতে পারত? এখনো ওরা এডজাস্ট করতে স্ট্রাগল করছে৷ এখন ভাই সাহেব আর আপা, আপনারা কী সিদ্ধান্ত নেবেন ওদের জন্য?”

হাবিব সাহেব বললেন, “যা হয়েছে তা তো আর বদলানো যাবে না। একটা সহজ সমাধান হওয়াই ভালো মনে করি।”

এবার মায়া বললেন, “সহজ সমাধানের সাথে ওদের এটাও বোঝা উচিত যে বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা না। এতে অনেকগুলো মানুষ জড়িত থাকে। সমাধানের সাথে সাথে ওদের উপলব্ধি হওয়াটাও জরুরি।”

এবার আনোয়ারা উৎপল আর ইপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হলো। কিছু বলতে চাও উৎপল? তুই, ইপ্সিতা?”

দুটো’তে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, এরপর উৎপল নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি আরেকবার ব্যাখ্যা করল। এরপর বলল,

“আমরা বুঝতে পেরেছি আমরা যা করেছি সেটা ভুল। তবুও আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসি। উপলব্ধির করানোর জন্য যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন, শুধু ইপ্সির মানে ইপ্সিতার থেকে আমাকে আলাদা করবেন না প্লিজ।”

ইপ্সিতা মাথা নিচু করে বসে থাকলেও শ্রবণশক্তি সজাগ, সেও এবার নিচু গলায় বলল, “আমারও এটাই মত।”

আনোয়ারা রাত্রি আর ইমরোজের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোদের কী মতামত?”

তিনি হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, প্রচুর নালিশ আসতো তার কাছে, সেসব সংবেদনশীলতার সাথে তাকে বিচার করতে হতো। তাই এই বিষয়ে তিনি পারদর্শী।

দু’জনেই সমস্বরে বলল, “তোমরা যা ডিসিশন নাও।”

আনোয়ারা, মায়া আর হাবিব সাহেব কিছুক্ষণ আলাপ করলেন, এরপর আনোয়ারা বললেন,

“ইপ্সিতা আর উৎপলের বিয়েটা হবে। তবে এখন নয়, ওরা অস্থির চিত্তের মানুষ। ইপ্সিতার মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হবে সামনেই৷ সেটা শেষ হোক। ওরা দু’জনেই নিজেরা আরেকটু রেসপন্সিবল হয়ে উঠুক। ইপ্সিতার মাস্টার্স শেষ হলেই ওদের বিয়ে হবে।”

ইপ্সিতা আর উৎপলের একইসাথে স্বস্তি এবং আশাভঙ্গ হলো। স্বস্তি হলো এই ভেবে যে, ওদের আলাদা হতে হবে না। আশাভঙ্গের কারণ হলো, ওরা ভেবেছিল এবার বিয়েটা হবে। একসাথে থাকতে পারবে। লুকিয়ে দেখা আর ফোনে কথা বলার পালা শেষ হবে এবার। কিন্তু এখন সেই এক-দেড় বছরের অপেক্ষা!

ওদের মনোভাব বুঝে মায়া বললেন, “বিয়ে মানে শুধু দুজন মানুষ এক ছাদের নিচে থাকা না। দায়িত্ব নিতে জানতে হয়৷ পারিপার্শ্বিকতা অনুযায়ী মানিয়ে নিতে জানতে হয়। বোঝাপড়া থাকতে হয়। যথেষ্ট পরিপক্কতার প্রয়োজন হয়। বয়সে না হলেও চিন্তা ভাবনায় এখনো দু’জনেই যথেষ্ট অপরিপক্ক। এই সময়টুকু নিজেদের চিন্তাশক্তি বাড়াতে কাজে লাগুক।”

মায়া দেখেছেন উৎপলের জন্য রাত্রিকে খুব খারাপ একটা সিচুয়েশনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। শোভার ভাই সোস্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার। অনেক ফলোয়ার। সে বিবাহ এক সপ্তাহ আগে ডটকম নিয়ে, তাদের প্রোফেশনালিজম নিয়ে প্রশ্ন তুলে স্ট্যাটাস দিয়েছে তার অনেক ফলোয়ার সমৃদ্ধ পেইজ থেকে। এটাও বলেছে, রাত্রি স্বজনপ্রীতি করে। এতে ওর রেপুটেশনে প্রভাব পড়েছে। কী করে সামলায় সেটা নিয়ে ভেবেই তিনি চিন্তিত।

আনোয়ারা হেসে বললেন, “ঠিক। তবে এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।”

***
শোভার ভাইয়ের পোস্টের জন্য খানিকটা প্রভাব পড়লেও বিবাহ ডটকমের ওয়ার্ড অফ মাউথ খুব ভালো হওয়ায় যতটা ক্ষতির আশঙ্কা করা হয়েছিল ততটা এখনো অব্দি হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। যেটুকু হয়েছে সেটুকু আবারও পরিশ্রম আর একাগ্রতা দিয়ে সে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে বলেই মনে হচ্ছে।

ইমরোজ দেখছে মেয়েটা আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কাজের প্রতি এতটা ডেডিকেটেড, নিজেকে নিংড়ে পরিশ্রম করার বিন্দুমাত্র ক্লান্তি ওর মধ্যে নেই। এই জিনিসটা ওর ভীষণ ভালো লাগে।

ইমরোজ উপলব্ধি করতে পারে রাত্রির অনুভূতিটা। নানা কাজে সেটা বোঝা যায়৷ সে অপেক্ষা করছে রাত্রি কবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবে। শনিবার সকালে রাত্রি ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল।

“উঠো উঠো।”

“কেন?”

“এটা নাও।”

একটা ভাঁজ করা কাগজ ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে রাত্রি বেরিয়ে গেল। ইমরোজ কাগজটা হাতে নিয়ে ভীষণ খুশি হয়ে গেল৷ এতে নিশ্চয়ই ওর মনের কথা লেখা আছে। নইলে এভাবে কাগজ দেয়ার তো কথা না। সে ভীষণ উৎসাহ নিয়ে কাগজটা খুলল মৃদু হেসে পড়তে শুরু করতেই ধাক্কা খেল,

“আলু- এক কেজি
পেঁয়াজ -এক কেজি

..”

নিচে আরও সবজির নাম৷ বাজারের লিস্ট। এমন গুছিয়ে বাজারের লিস্ট কে দেয়! নিজেকে ভীষণ বোকা বোকা মনে হলো। বউয়ের প্রেমে পড়ে ওর মাথা কি এতটাই খারাপ হয়ে গেল যে শেষ পর্যন্ত কিনা বাজারের লিস্টকে প্রেমের চিরকুট ভেবে নিয়েছে! কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করল ওর!
…………
(ক্রমশ)