#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৩৭)
নুসরাত জাহান লিজা
এই সপ্তাহেই ইপ্সিতার জন্মদিন বলে ইমরোজ শপিংমলে এসেছে উপহার কিনতে। ভেবেছিল রাত্রিকে বলবে সাথে আসতে। পরে মনে হলো ওর জন্যও একটা উপহার কিনবে৷ উপহার দেবার সময় নিজের অনুভূতির কথা জানাতে সহজ হবে।
ইপ্সিতার জন্য সালোয়ার কামিজ আর একটা ঘড়ি নিয়ে শাড়ি দেখছিল, একটা শাড়ি মা’য়ের জন্য পছন্দ হলো। এরপর ঘুরতে ঘুরতে লাল রঙের একটা শাড়িতে চোখ আটকে গেল। মনে হলো এই শাড়িতে রাত্রিকে খুব মানাবে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে ভেবেছে আজই শাড়িটা রাত্রিকে দেবে। কিন্তু যদি পছন্দ না করে! এত ঘুরে ঘুরে কিনেছে, পছন্দ না হলে ওর খারাপ লাগবে।
পরক্ষণেই এই ভাবনা বাতিল করে দিল। আগে হলে মুখের উপরে বলত, এখন অন্তত তা করবে না। ইমরোজ বুঝতে পারে ওর হৃদয়ের ঢেউ অপর প্রান্তেও লেগেছে। নইলে ওর পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়াত না। কিন্তু কেউ বলছে না। এতকিছু বলতে পারে, কিচ্ছু মুখে আটকায় না, অথচ ভালোবাসার কথা বলতেই মহারানী বোবা!
কিন্তু নিজে থেকে বলতে ইমরোজেরও সংকোচ হচ্ছে। যদি আগের মতো উল্টাপাল্টা কথা শুনতে হয়! যদি বিদ্রুপের হাসি হাসে! সে নিতে পারবে না। থাক, এখন বলার দরকার নেই। আরেকটু অপেক্ষা করে দেখা যাক বরং। তাতে রাত্রি বললে ভালো আর না বললেও সে আরেকটু বুঝে নিতে পারবে বাতাসটা ঠিক কোন দিকে বইছে!
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে এলো। এই সময় রাত্রি থাকে না। এটা বরং ভালো হয়েছে। ইমরোক ওয়ার্ডরোবে রাখল শাড়িটা। এটায় রাত্রি হাত দেয় না জানে সে।
***
রাত্রির আজ ভীষণ ব্যস্ত একটা দিন কাটল, দম ফেলার ফুরসৎ নেই। নতুন করে প্রচারণা বাড়িয়েছে। বিবাহ ডটকমের নতুন বিজ্ঞাপনটার শ্যুটিং হলো আজ সারাদিন। অফিস সামলে শ্যুটিং ফ্লোরে গিয়েছিল।
শোভার সাথে যা হয়েছে সেটা একদমই ঠিক হয়নি। কিন্তু সে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। তা সত্ত্বেও কাজটা করেছে। কিন্তু সে তো বসে থাকতে পারে না। যেটুকু ক্ষতি হয়েছে, সেটুকু পুষিয়ে নিতেই হবে।
উৎপল এই ঘটনায় একেবারে গুম হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছিল ওর একটা বোকামির জন্য বোনের ক্যারিয়ারে একটা দাগ লেগে গেল। রাত্রি আজ একবার বাড়ি এলো উৎপলের সাথে কথা বলতে। যা হয়ে গেছে তা তো আর বদলানো যাবে না। শুধু শুধু এটা নিয়ে মন খারাপ করে থাকার কিছু নেই। অনুশোচনার আত্মদহন বাড়ায়। আত্মদহন আত্মশুদ্ধির পথ সম্প্রসারিত করে। সেটাই বড় বিষয়।
উৎপল শুয়ে ছিল৷ রাত্রি এসে ডাকতে উঠে বসল৷ মৃয়মান গলায় বলল,
“আমার জন্য তোর ক্ষতি হয়ে গেল।”
“ভাইয়া, এই যে এটা বুঝতে পেরেছ, এটাই সবকিছু। ভবিষ্যতে আর এমন কিছু করবে না সেটা আমি জানি। আমি তোমাকে চিনি তো। শোভার বিষয়ে যখন কথা হচ্ছিল, তখনও যদি তুমি আমাকে বলতে বিষয়টা! যাই হোক। এখন এটার জন্য মন খারাপ করে থেকো না। তোমার মন খারাপ থাকলে আমার ভালো লাগে না জানো তো!”
উৎপলের মুখে এবার হাসি ফুটল। সব জানাজানি হবার পরে এই প্রথম রাত্রি ওর সাথে ভালো করে কথা বলল। রাত্রি শুধু ওর ছোট বোন নয়, ওর প্রিয় বন্ধু, ওর ঢাল, মেন্টরও বলা যায়। এই দূরত্ব ওকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে মারছিল। এখন ভালো লাগছে।
“তুই আমার উপরে আর রেগে নেই তো?”
রাত্রি মৃদু হেসে বলল, “আমি আরেকবার তোমায় বিশ্বাস করছি ভাইয়া। এবার বিশ্বাস রেখো কিন্তু।”
উৎপল হেসে রাত্রির মাথায় হাত রেখে বলল, “তুই আমার কাছে কী এটা তুই জানিস?”
“জানি, এখন চকলেট দাও।”
উৎপল হেসে ড্রয়ার খুলে চকলেট বের করে রাত্রিকে দিল, “পাগল।”
মা বাবা থাকতে বললেও সে থাকল না। ইমরোজ ওকে মিস করে সে জানে। এখন ওকে কিছুটা সময় দিতে চায় রাত্রি। ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যামে বসে বসে ইমরোজের মুখটা মনে পড়ল। সেদিন ইমরোজ বাজার করে আনার আগে সে আনোয়ারার কাছে গিয়ে বলেছিল,
“মা, তোমার ছেলের পছন্দের খাবার কোনটা?”
“আমার হাতের বিরিয়ানি খুব পছন্দ করে, গরুর মাংস দিয়ে ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ, চিংড়ি, পায়েস এগুলোই পছন্দ করে।”
“তোমার হাতের রান্নার কিছু একটা আমাকে শিখিয়ে দেবে?”
“তুই রান্না করবি নাকি?”
“হ্যাঁ মা।”
“আচ্ছা, তুই ওকে বাজার করে আনতে বল। কিছু জিনিস লাগবে।”
রাত্রি ইচ্ছে করেই গুছিয়ে বাজারের লিস্টটা দিয়েছিল, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ রেখেছিল, ইমরোজের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা দেখতে মজা লেগেছে। নিজে বলতে পারছে না, আশা করছে সে বলবে! সবসময় ছেলেরা বলে এসব, বুদ্ধুটা তাও জানে না!
সে খিচুড়ি, বিরিয়ানি মোটামুটি পারে, কিন্তু ততটা মজা হয় না। আনোয়ারার কাছ থেকে শিখে নিয়ে রান্না করেছিল। ইমরোজ যখন শুনল রাত্রি ওর জন্য রান্না করেছে, তখনকার অভিব্যক্তিটা কী যে ভালো লেগেছে ওর। মনে হচ্ছিল কষ্টটা স্বার্থক।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাত্রি একটু শুবে ভাবছিল, কিন্তু ইমরোজ ভেতরে এলো। রাত্রি জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বলবে?”
ইমরোজ ইতস্তত করে বলল, “একবার বারান্দায় আসবে? আজকের আকাশটা সুন্দর। অনেক তারা দেখা যাচ্ছে।”
রাত্রির শরীর অবসন্ন, ইচ্ছে করছিল না উঠতে, কিন্তু ওর মনে হলো, এটাই বোধহয় কাঙ্ক্ষিত দিন। তাই সে উঠে এলো।
“একটু বসো, আমি ভেতর থেকে আসছি।”
রাত্রি মনে মনে উদগ্রীব হয়ে আছে আকাঙ্ক্ষিত কথা শুনতে। বিশাল আকাশে ফুটে থাকা অসংখ্য তারাদের ভীষণ আপন বলে মনে হচ্ছিল।
ইমরোজ এসে বলল, “তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনেছি।”
বলে বাড়িয়ে দিল রাত্রির দিকে।
“লাইটটা অন করে দিচ্ছি, দেখো তো পছন্দ হয় কিনা!”
লাইট জ্বালানোর কথা শুনে রাত্রির আশা ভঙ্গ হলো। তারমানে এটা দেবার জন্য!
“এটার কী দরকার ছিল?”
“না, পছন্দ হলো। মনে হলো তোমাকে খুব মানাবে তাই..”
“আমাকে কীসে মানাবে এটা নিয়ে ভাবছ কেন?”
ইমরোজ লাইট জ্বালাতে গিয়েও থেমে গেল, কী উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে বলল,
“বন্ধুর জন্য ভেবেছি।”
রাত্রির গা জ্বলে গেল! এই নিরামিষ ব্যাটার জন্য অপেক্ষা করতে করতে চুলে পাক ধরে যাবে, তবুও তিনি মুখ ফুটে বলতে পারবেন না। রাত্রি সহসা বলল,
“আমি একজনের প্রেমে পড়েছি।”
“কার?” প্রশ্নটা করেই বুঝল ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে, সে এই প্রশ্ন করতেও চায়নি। মুখ থেকে নিজে নিজেই বেরিয়ে গেছে।
রাত্রি কঠিন চোখে ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে নিমিষেই দূরত্ব কমিয়ে ইমরোজের কাছে চলে এলো। এরপর ওর কলার ধরে নিজের কাছাকাছি নিয়ে এলো। রাত্রি ওর মুখটা ইমরোজের কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“একটা গাধার। যাকে সবকিছু গুলে খাইয়ে না দেয়া পর্যন্ত তিনি কিচ্ছু বুঝতে পারেন না।”
বলে ইমরোজের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে প্রায় ছুটে চলে গেল ভেতরে।
হতবিহ্বল ইমরোজ দাঁড়িয়ে রইল গালে হাত দিয়ে। কথাটা মাথায় প্রসেস হতে সময় লাগল খানিকটা। ওকে গাধা বলেছে বলে ভীষণ রাগ হলো প্রথমে। ঝগড়া করার প্রস্তুতি নিয়ে হাঁটতে শুরু করতেই আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। রাত্রি ওর প্রেমে পড়েছে, এটাই বলল না! তাই তো! নিমিষেই মৃদু হাসি ফুটল ইমরোজের মুখে, সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল মনে, মস্তিষ্কে।
বুঝতে দেরি হয়েছে, কিন্তু ওর কী দোষ। এভাবে হুমকি দিয়ে কেউ এমন মিষ্টি কথা বলে! আজ অব্দি কেউ এমন তেতো স্বরে ভালোবাসার কথা বলেছে! সে কথাটা হজম করে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে এলো।
রাত্রি ভেতরে এসে কতক্ষণ দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। সে কখনো লজ্জা পায় না। লজ্জাবতী, লাজুকলতা সে কখনোই নয়। তবুও প্রথমবার কারো এতটা কাছে এসে সেই অচেনা লজ্জার সাথে প্রথমবার পরিচিত হলো।
ইমরোজকে ভেতরে এসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেটা বাড়ল আরও। ইমরোজ এগিয়ে আসতেই রাত্রি উঠে বলল,
“তোমার শাড়িটা দেখব, লাইট জ্বালাই।”
ইমরোজ ওর হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল, “সেটা পরেও দেখা যাবে। এই সুন্দর মুহূর্তটা আর আসবে না। আজকের রাতে নতুন করে শুরু করবে সব?”
রাত্রি মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা যেন নেমে এলো পৃথিবীর এই ছোট্ট ঘরটায়!
…….
(ক্রমশ)
#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৩৮)
নুসরাত জাহান লিজা
রাত্রি আর ইমরোজের মধ্যে এখন দারুণ একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। পরস্পরের জন্য শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে। একজন অপরজনের মতামতকে ভীষণভাবে গুরুত্ব দেয়। তবে খুঁনসুটিটা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
ইমরোজ তার আগের প্রেমের কথাও খুলে বলেছে। যেটার এখন কোনো গুরুত্ব নেই ওদের কারোর জীবনেই, সেটা নিয়ে রাত্রির মাথাব্যথা নেই। তবে ওদের এখন কথা কাটাকাটি হয় অন্য বিষয়ে নিয়ে। যেমন ইপ্সিতার জন্মদিনে রাত্রি ইমরোজের সেদিনের দেয়া শাড়িটা পরে সুন্দর করে সেজে এলো। ইমরোজ তখন পরেরদিনের ক্লাসের লেকচার তৈরি করছিল।
রাত্রি এসে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কেমন লাগছে?”
ইমরোজ মুখ না তুলেই উত্তর দিল, “সুন্দর লাগছে।”
রাত্রি ভীষণ রেগে গেল, “তুমি আমাকে না দেখেই কী করে বললে সুন্দর লাগছে? দায়সারা উত্তর দেবে না কখনো।”
ইমরোজ আবহাওয়া যে প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে তা বুঝে রাত্রির দিকে তাকালো, সত্যিই ভীষণ সুন্দর লাগছে রাত্রিকে। মেয়েটা তখন রেগে চলে যাচ্ছিল, সে পেছন থেকে ওর হাতটা ধরে বলল,
“তোমাকে সবসময়ই সুন্দর লাগে আমার কাছে। তাই না দেখেই বলে দিয়েছি।”
“এসব কিশোরী মেয়েদের পটানো টাইপ কথাবার্তা আমার সাথে বলবে না, খবরদার। আমি কিশোরী নই।”
রাত্রি ইমরোজের জন্য সেজেছিল, যার জন্য এত সাজ, সে এমন কিছু করলে অভিমান তো হবেই।”
“আরে আমি সত্যি কথা বলছি।” এবার ইমরোজ রাত্রির মুখটা নিজের দুই হাতে ধরে ওর চোখের দিকে বলল,
“এটাই সত্যি। সত্যি কথা যদি মেয়ে পটানো টাইপ হয় তো হোক, আমি তবুও বলব।”
রাত্রি ওর হাত নামিয়ে দিয়ে বলল, “থাক, এখন আর ঢং করতে হবে না। তুমি যে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলে সেটা করো।”
“এখন তোমাকে ভালো করে দেখার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমার কাছে আর কিচ্ছু নেই। ওই কাজ একটু পরেও করা যাবে।”
রাত্রি হেসে ফেলল, “খুবই চিজি ডায়লগ।”
“উহু, বলো রোমান্টিক ডায়লগ।”
রাত্রি ইমরোজের নাক টিপে দিয়ে বলল, “আমার আনরোমান্টিক বরটা রোমান্টিক হচ্ছে তাহলে!”
ইমরোজ এবার আর অপ্রতিভ হলো না, সেও পাল্টা হেসে স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বলল,
“রোমান্টিসিজম জিনিসটা বোধহয় ছোঁয়াচে, তোমার কাছ থেকে আমার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে।”
রাত্রির অভিমান গলে গেল, প্রেম পর্ব চলল কিছুক্ষণ।
***
ইপ্সিতা বসে আছে গোমড়া মুখে। আজ ওর জন্মদিন। ঘরোয়া আয়োজনে হলেও রাত্রির পরিবারকে জানানো হয়েছে। সে ভেবেছিল আজ উৎপলের সাথে সামনা-সামনি কথা বলতে পারবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। কেউ না কেউ হয় ওর সাথে নয়তো উৎপলের সাথে বসে থাকছে।
সে একা কথা বলার সুযোগই পেল না। সবাই যেহেতু সব জানে, তাই সবার সামনে কথা বলার চেষ্টা কেউই করল না।
ওদের কথা হলো হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজে। উৎপল লিখল, “তোমার জন্য গিফট এনেছি। সেটা কী করে দেব?”
“তুমি সুযোগ পেলে কোথাও রেখে যেও। আমাকে জানিয়ে দিও। আমি নিয়ে নেব।”
উৎপল তক্কে তক্কে ছিল কোথায় রাখা যায়। ভেবেচিন্তে রান্নাঘরের পাশে যে কমন ওয়াসরুমে আছে, সেখানে রেখে এলো।
সেটা ইপ্সিতাকে জানিয়ে দিল। সে একটা ব্রেসলেট কিনেছে। আগে কখনো দামী উপহার দেয়া হয়নি, ইপ্সিতা নিষেধ করত। এখন যেহেতু বিয়ে ঠিক হয়েই গেছে আর এটা খুব পছন্দ হয়েছিল, তাই কিনে ফেলেছে।
উৎপলরা চলে যাবার পরে নূরী ওয়াশরুমে গিয়েছিল। সে র্যাপিং করা ছোট্ট বক্সটা দেখে কৌতূহলী হয়ে নিয়ে এলো। আনোয়ারা, রাত্রি আর ইমরোজ তখন অতিথি বিদায় করে বসার ঘরে বসেছিল। ইপ্সিতা অপেক্ষা করছিল সবাই যার যার ঘরে গেলেই সে জিনিসটা উদ্ধার করবে। এখন ওর মুখের রঙ উড়ে গেল।
নূরী আনোয়ারার কাছে এসে বলল, “খালাম্মা, এইডা বাথরুমে আছিল। আপার মনে হয়।”
সে এই বাড়িতে দুই মাস ধরে কাজ করছে। আনোয়ারা হাতে নিলেন, ইমরোজ তার কাছ থেকে সেটা নিয়ে বলল,
“গিফট বক্স বাথরুমে কী করে যাবে? তারমানে কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে লুকিয়ে রেখে গেছে। এতে যদি এমন কিছু থাকে যে আমাদের ক্ষতি হয়! আমি বরং ফেলে দিয়ে আসি বাইরে নিরাপদ কোথাও।”
রাত্রি ইপ্সিতার ফ্যাকাসে অভিব্যক্তি দেখে যা বোঝার বুঝে গেল। সে বলল,
“তোমার কী ধারণা এইটুকু বক্সে বো*মা লুকানো আছে?”
“তা না থাকুক, কেউ ফাসানোর চেষ্টা করতে পারে।”
রাত্রি মাথায় হাত দিয়ে ইমরোজকে ফিসফিস করে বলল, “আরে, বাড়িতে বাইরের কেউ এসেছিল নাকি? বুঝতে পারছ না?”
ইমরোজও ফিসফিস করে বলল, “নূরী তো বাইরের। এখন কত উদ্দেশ্য নিয়ে লোকে বাড়িতে ঢুকে কত ক্ষতি করে দিয়ে যায়।”
রাত্রি ইঙ্গিতে উৎপলের কথা বোঝাতে চেয়েছিল, এই লোক কী বুঝল!
আনোয়ারাও ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন ঘটনাটা কী। তিনি বললেন,
“ইমু, আমাদের কারো সাথে অত শত্রুতা নেই বোধহয় যে মে রে ফেলার চেষ্টা করবে। তবে… আচ্ছা, অনেক রাত হয়ে গেল, চল ঘুমাতে যাই।”
“কিন্তু মা, অন্তত একবার খুলে দেখি! এভাবে…..”
রাত্রি ইমরোজের হাত ধরে টেনে বলল, “খুলতে হবে না। চলো তো। কথা আছে।”
“আরে, কী আছে…”
বাকিটা বলতে পারল না, রাত্রি ওকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো।
“আরে, তুমি বুঝতে পারছ না? ওটা ইপ্সিতার জন্য ভাইয়া এনেছে।”
“আনলে সেটা তখন দিত না?”
“সবার সামনে দিতে লজ্জা পেয়েছে হয়তো। তুমি এমন প্রেম কখনো করোনি তাই জানো না বোধহয়।”
“তুমি কয়টা করেছ? এত এক্সপেরিয়েন্স বলছ!”
“এক্সপেরিয়েন্স লাগে না। চোখ কান খোলা রাখলেই দেখা যায়।”
ইমরোজ হঠাৎ করে গুম হয়ে গেল, রাগ হয়েছে ওর। নিজের উপরে।
“কী হলো তোমার?”
রাত্রির প্রশ্নে ইমরোজ বলল, “তুমি বোধহয় ঠিকই বলো। আমার বাস্তব বুদ্ধি কিছুটা কম।”
রাত্রির আচমকা মন খারাপ হয়ে গেল। ইমরোজের মুখে মেঘের আভাস দেখলে ওর মনেও মেঘের আনাগোনা শুরু হয়। ভালোবাসা সত্যিই বোধহয় একটা সংক্রামক রোগ। প্রিয় রোগ। যে রোগ থেকে কেউ পরিত্রাণ চায় না।
“ইমরোজ, এভাবে ভাবছ কেন? তুমি পিওর হার্টেড মানুষ। পৃথিবীর অনেক জটিলতা থেকে বহু দূরে কয়জন থাকতে পারে! তুমি পেরেছ। আমি তোমাকে নিয়ে গর্বিত।”
“সান্ত্বনা দিচ্ছ?”
রাত্রি ইমরোজের পাশে বসে ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল, “না। সত্যি কথা বলছি। তোমার মধ্যে কিছু না থাকলে কি আমি তোমার প্রেমে পড়তাম? অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় চিন্তা করা বাদ দাও। নিজের ভালোকে আবিষ্কার করো। সেটাকে নার্চার করো। তাহলেই হবে। আমি যেমন তোমার ভেতরের ভালোকে আবিষ্কার করেছি সেভাবে। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু অপূর্ণতা থাকে। কোনো মানুষই শতভাগ পারফেক্ট হয় না। তোমার ভেতরের সৌন্দর্য তোমার শক্তি। তাই নিয়ে আলো ছড়াচ্ছ। মিছেমিছি অন্ধকারকে আমন্ত্রণ জানাবার দরকার কী! কিপ গ্লোয়িং।”
ইমরোজের মুখে এবার হাসি ফুটল। রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি রাত্রি। এভাবেই আমার পাশে থেকো সবসময়।”
রাত্রিও হেসে বলল, “যতদিন বেঁচে আছি, তোমার হাত ধরে বাঁচতে চাই।”
ইমরোজ মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইল, এভাবেই ভালোবাসা আর ভরসায় যেনো বহুদিন ওর পাশাপাশি চলতে পারে একই পথে।
***
সবাই যাবার পরে ইপ্সিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ছোট্ট বক্সটা নিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে এলো। খুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, উৎপলকে কল করল।
“আমি এখন রেখে দিলাম এটা। তোমার হাতে পরব। বলে। আমাদের যেদিন বিয়ে হবে সেদিন এটা তুমি আমার হাতে পরিয়ে দেবে।”
সময়টা ওদের কাছে এত লম্বা বলে মনে হচ্ছে! সুতীব্র অপেক্ষার সময়টা এত দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর! এই সময়টায় ওরা স্বপ্ন জমাচ্ছে। সুন্দর একটা ভবিতব্যের স্বপ্ন।
ইপ্সিতা ভাবল, আগে তো মা আর ভাইয়া বিয়ে বিয়ে করে অস্থির করে তুলছিল। আর এখন কেউ বিয়ের নাম মুখেও নেয় না। অবশ্য যা করেছে, তারপরও যে বিয়েটা দিতে তারা রাজি হয়েছে, এটাই বড্ড স্বস্তির।
***
ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে নয় মাসে পা দিয়েছে রাত্রি আর ইমরোজের দাম্পত্য। এমনই এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে রাত্রি ইমরোজকে একটা সুখবর দিল। নতুন অতিথির আগমনী বার্তা।
ইমরোজ শিশুর মতোই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। ওর চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু গড়াচ্ছিল। রাত্রিও।
আনোয়ারা ভীষণ খুশি, তার ছেলেটা একসময় বিয়ে করতে চায়নি। এখন তার সন্তানের ঘর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। তিনি দোয়া করলেন, নাতি বা নাতনি যে-ই আসুক, তার ঘর আলোকিত করুক শিশুটি।
সামনেই ইপ্সিতার বিয়ের আয়োজন করতে হবে। সেটা নিয়ে সবাই পরিকল্পনায় মত্ত হয়ে উঠল। আজ ইমরোজ আনোয়ারা আর রাত্রি, রাত্রিদের বাড়ি যাচ্ছে।
মেয়ের এমন খুশির দিনে মায়া আর হাবিব তাদের দাওয়াত দিয়েছেন। সাথে উৎপল ইপ্সিতার বিয়ে নিয়েও আলোচনা হবে।
………
(ক্রমশ)