#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৩৯)
নুসরাত জাহান লিজা
পারিবারিক বৈঠকে উৎপল আর ইপ্সিতার বিয়েটা একমাস এগিয়ে আনা হলো, রাত্রির প্রেগন্যান্সির দিক বিবেচনা করে। বিয়ের তিন মাস পরে ইপ্সিতার মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা হবে। তবে ইপ্সিতার পরীক্ষায় ব্যাঘাত যেন না ঘটে, তার নিশ্চয়তা দুই পরিবারই দিল।
বিয়ের ডেট এগিয়ে আনায় দুইজন খুশিই হলো।
উৎপলের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে গত কয়েক মাসে। দায়িত্ব নিতে শিখেছে এখন। আগে বাসার অনেককিছুর তদারকি রাত্রি করত, এখন সেসব উৎপল করে। মায়া ঠেলে ঠেলে আগে বাজারে পাঠাতেন উৎপলকে, সেটাও এখন নিজেই আগ্রহ নিয়ে করে। বাবা মায়ের ছোট ছোট বিষয়গুলোর খেয়াল রাখে।
ইপ্সিতাও এখন আগের চাইতে কিছুটা পরিণত হয়েছে। কিছু করার আগে এখন ভেবেচিন্তে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়। একটা ভুল পদক্ষেপ থেকে সে শিখেছে যথেষ্ট। ভুল-ভ্রান্তি নিয়েই মানুষ, তবে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে শুধরে নিতে পারাই আসল, এই উপলব্ধি ওকে পরিণত হতে সাহায্য করছে।
এখনও অনেকরকম ঝোঁক মাথায় চাপে, আগে হলে সাথে সাথে করে ফেলত। কিন্তু এখন করার আগে বসে ঠান্ডা মাথায় ভাবে যে কাজটা ঠিক হচ্ছে কি-না।
দুই বাসার অভিভাবক দুইজনের এই পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করে খুশি হয়েছেন। তারা চিরদিন থাকবেন না ওদের সাথে। সামনের জীবনে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেদেরকেই নিতে হবে। দুজন মানুষ শুধুমাত্র ভালোবাসা দিয়ে সংসার করতে পারে না, সেখানে দায়িত্বশীলতা লাগে, বোঝাপড়া লাগে। সংসার জীবনে পা দিলে ধীরে ধীরে আপনা-আপনিই আরও শিখবে ওরা।
“শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়েটা হচ্ছে।”
উৎপলের কথার উত্তরে ইপ্সিতা উদ্ভাসিত হেসে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ।”
***
আজ ইমরোজ কলেজ থেকে ফিরে দেখল রাত্রি বাসায়। কাজের চাপ ধীরে ধীরে কমাচ্ছে। কয়েকমাস পরে বড় একটা ব্রেক নিতে হবে ওকে, তাই বিশ্বস্ত দুইজনকে তৈরি করছে। সাথে জাহিদ তো আছেই।
রাত্রি ইমরোজকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আমাদের বাবু দেখতে কেমন হবে?”
ইমরোজ রাত্রির দিকে তাকাল, এখন এই মেয়ের সমস্ত চিন্তা এটাতেই কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। সেদিন বলল নাম ঠিক করতে।
ইমরোজ বলল, “ছেলে না মেয়ে হবে সেটা তো জানা নেই। নাম কী করে ঠিক করব?”
“তাহলে দুটো নাম ঠিক করে রাখি। একটা মেয়ে আর একটা ছেলের নাম ঠিক করলেই সমাধান হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, তুমিও ভাবো, আমিও ভাবি।”
এরপর আজ আবার এই প্রশ্ন। ওকে উত্তর না দিতে দেখে রাত্রি বলল, “আমার মনে হচ্ছে এমন হবে।”
ইমরোজ দেখল রাত্রির হাতে একটা ছবি। সেটা ওর দিকে ঘোরাতেই মেজাজ বিগড়ে গেল। এটা ওর একেবারে চার বছর বয়সের ছবি। কোনো কিছু নিয়ে খুব রাগ হয়েছিল। রেগে ছিল সাথে আবার কাঁদছিলও। ছবিটা ওর বাবার তোলা।
কান্নার জন্য এই ছবি সে কাউকে দেখায় না। একবার স্কুলে পড়ার সময় ওর কিছু বন্ধুবান্ধবকে বাসায় এনেছিল। তারা এই ছবি নিয়ে খুব হাসাহাসি করেছিল। তারপর থেকে এই ছবিটা তারজন্য লজ্জার। ছবিটা মা রাত্রিকে কেন দিয়েছেন!
“রাত, ছবিটা দাও আমাকে।”
“একদম না। এটা দেয়া যাবে না। আমাদের বাচ্চাদের তাদের কিউট বাবাকে দেখাতে হবে না? এটা এখন আমার জিম্মায় থাকবে। তোমার ভরসা নেই ছিঁড়েটিড়ে ফেললে কী হবে?”
ইমরোজ জানে রাত্রির সাথে কথা বলা বৃথা, মা না বললে এই ছবি সে ফেরত দেবে না। তাই ছবি উদ্ধারের উদ্দেশ্য নিয়ে মায়ের কাছে গেল।
“মা, তুমি ওই ছবি রাত্রিকে কেন দিয়েছ?”
“কেন দিয়েছি মানে? ও দেখতে চাইল তুই ছোটবেলায় কেমন ছিলি। তাই এ্যালবাম বের করে দিলাম।”
“ওই ছবি দিয়ে এখন সারাক্ষণ আমার পিছে লেগে থাকবে।”
রাত্রি ভেতরে এসে বলল, “তোমার ছেলে আমার নামে নালিশ করছে মা?”
আনোয়ারা বললেন, “দেখি কোন ছবিটা?”
রাত্রি এগিয়ে দিল, তিনি মৃদু হেসে ছবিটা দেখলেন। এরপর ছেলের দিকে তাকালেন। এখনকার অভিব্যক্তি পুরোপুরি ওই ছবিটার মতোই। শুধু বয়স বেড়েছে, আকারে বেড়েছে, কিন্তু দেখতে সে-ই একইরকম আছে যেন। মন থেকেও যেন অনেকটা তেমনই।
“ছবিটা কিউট না মা? এজন্যই নিয়েছিলাম।”
আনোয়ারা বললেন, “ইমু, তুই তো কয়দিন পরে বাবা হবি, তখন কি বাচ্চার সাথে সাথে তুইও কান্নাকাটি করবি?”
রাত্রি দুষ্টুমি করে বলল, “আমার কপাল।”
ইমরোজ অবিশ্বাস নিয়ে মা আর স্ত্রীকে দেখে মুখ ততোধিক গম্ভীর করে বেরিয়ে গেল।
রাত্রি বলল, “মা তোমার ছেলেকে তো রাগিয়ে দিলে!”
“তুই ভাঙা।”
“এটা কেমন কথা হলো?”
“শোন, ইমু যে এভাবে হুটহাট রেগে যায়, রেগে গেলে ওর ভেতরে বাস করা শিশুটা বেরিয়ে আসে। দেখতে ভালো লাগে। মনে হয় ও আবার আমার সেই ছোট্ট ইমু হয়ে গেছে। তাই কাজটা করি মাঝেমধ্যে। আবার ভুল করলে কড়া ভাষাও বলি। ও কিন্তু বোঝে কোনটা রাগের কথা, আমি যখন সত্যিই রেগে কথা বলি, তখন কিন্তু ও রাগে না। কিন্তু যখন এভাবে বলি, তখন অভিমান করে বসে থাকে।”
রাত্রি নিজেদের রুমে এসে দেখল ইমরোজ বিছানায় বসে আছে। ছবির বাচ্চা ইমরোজের মতোই লাগছে এখন, ইনোসেন্ট, আদুরে।
রাত্রি আরেকটু দুষ্টুমি করতে ছবিটা ইমরোজের মুখের ডানপাশে দেখে জরিপ করছিল যেন দুই বয়সী ইমরোজের মধ্যে। ইমরোজ উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
রাত্রির মনে হলো যথেষ্ট রাগানো হয়েছে, এবার একটু মা ভাঙানো যাক। সে এগিয়ে গিয়ে কাঁধের পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরে কানের কাছে বলল,
“এত্ত কিউট একটা ছবির জন্য এত রাগ করতে হয়! তোমাকে এভাবে দেখতে অবশ্য আরও কিউট লাগছে।”
ইমরোজ উত্তর দিল না, রাত্রি এবার ডাকল,
“এই রোজ..”
ওদের মধ্যে ভাব হবার পরে কখনো কখনো রাত্রি ওর নাম সংক্ষেপ করে রোজ ডাকে। প্রথম যেদিন ডেকেছিল, সেদিন ইমরোজ বলেছিল,
“রোজ বলছ কেন?”
“সবাই ইমু ডাকে। আমি ভালোবেসে রোজ-ই ডাকব। তুমি আমার কাছে গোলাপের মতোই। আমার কাছে লাল গোলাপ সার্বজনীন ভালোবাসার প্রতীক । তুমি আমার ভালোবাসা। তাই তুমিই আমার গোলাপ। নাকি গোলাপ ডাকব?”
ইমরোজ আঁতকে উঠে বলেছিল, “রোজ ঠিক আছে।”
কেউ যদি গোলাপ কোনোভাবে শুনে ফেলে আর রক্ষা থাকবে না!
“এবার এভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকলে কিন্তু আমি রেগে যাব। কোথায় এখন আমাকে একটু প্যাম্পার করবে, তা না, আমাকেই করতে হচ্ছে।”
বলে রাত্রি সরে আসছিল, ইমরোজ ঘুরে রাত্রিকে জড়িয়ে ধরল। এরপর আচ্ছন্ন গলায় বলল,
“বিয়ের প্রথম রাতে অশুভ রাত্রি বলেছিলাম। আজ বলছি তুমি আমার জীবনে শুভ হয়ে এসেছ। শুভরাত্রি, রাত।”
“তোমাকেও শুভরাত্রি, কিউট রোজ।”
ইমরোজ আবার মুখ গোমড়া করতে করতে হেসে ফেলল। জানে এই মেয়ে এমনই।
ওকে এভাবেই জ্বালিয়ে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে। আপত্তি করে লাভ নেই! বরং ভালোবাসাটুকু গ্রহণ করে নিয়ে পূর্ণ হওয়াই শ্রেয়।
***
বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে, আর মাত্র সাতদিন বাকি। রাত্রি ইপ্সিতার রুমে এলো।
“কী এত চিন্তা করছ বিয়ের কণে?”
“আরে ভাবি, এসো।”
রাত্রি ইপ্সিতার পাশে বসতেই ইপ্সিতা বলল, “বিয়ের দিন যত কাছে আসছে, তত টেনশন হচ্ছে ভাবি।”
রাত্রি ছেলেবেলা থেকেই ভীষণ ডানপিটে ধরনের। নিজে কী করছে তা সম্পর্কে ওর ধারণা স্পষ্ট ছিল। ইপ্সিতা ইমরোজের আগলে আগলে রাখার প্রচেষ্টায় নিজের সিদ্ধান্ত সেভাবে নিজে নিতে পারেনি। বয়সে পরিণত হলেও চিন্তায় তাই কিছুটা অপরিপক্কতা এখনো মেয়েটার মধ্যে রয়ে গেছে। তাই চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ভালোবেসে একটা ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ডে বিচরণ করেছে। এখন যখন বাস্তবেই বিয়েটা হচ্ছে, তখন চিন্তা হচ্ছে, দায়িত্ব নিতে পারবে কি-না, মানিয়ে নিতে পারবে কি-না! এসব সব মেয়েরই হয় হয়তো বিয়ের আগে। রাত্রিরও হয়তো হতো, কিন্তু তখন সময় পায়নি। সে অভয় দিয়ে বলল,
“কীসের টেনশন? ভাইয়াকে তো এতদিনে চিনেই গেছ। মা আর বাবা দু’জনেই ভীষণ ফ্রেন্ডলি। তুমি একবার ওই বাড়িতে যাও। নিজেই বুঝতে পারবে।”
“ভাবি, আমি পারব তো?”
“পারবে ইনশাআল্লাহ। আর শোনো, তোমাকেও তো এখন আমার ভাবি বলা উচিত, তাই না?”
ইপ্সিতা লজ্জা পেয়ে বলল, “ধূর! কী যে বলো না!”
***
ইমরোজের মনে হলো রাত্রি কিছু একটা নিয়ে যেন চিন্তায় মগ্ন।
“কী হয়েছে?”
রাত্রি বলল, “কই! কিছু না তো?”
ইমরোজ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল কী হয়েছে৷ রাত্রিকে এভাবে সে কখনো দেখেনি, সদা অকপট মেয়েটার কী হলো হঠাৎ। ইমরোজ ঠিক করল এই সময়টা আরও বেশি করে সময় দিতে হবে স্ত্রীকে।
রাত্রি কখনো কোনোকিছু নিয়ে সংকোচ করেনি, সেটা ওর ধাতে নেই। কিন্তু এই প্রথমবার সে দ্বিধায় ভুগছে।
উৎপলের বিয়ের উদযাপন নিয়ে ওর কত স্বপ্ন ছিল! কিন্তু ইপ্সিতারও তো বিয়ে। আনোয়ারা একা একা সব সামলাতে পারবেন না। দুই জায়গাতেই ওর দায়িত্ব, মনের টান। ওদিকে যেতে মন উদগ্রীব হয়ে আছে। কোনদিকে যাবে, বুঝতে পারছে না।
মা-বাবা, উৎপল গতকাল ওকে বলার পরেই যেতে ইচ্ছে করছিল, তারা ইমরোজ আর আনোয়ারার সাথে কথা বলতে চাইলে রাত্রি বলেছে,
“আমি ভেবে জানাই তোমাদের, আগেই কথা বলার দরকার নেই।”
বিষয়টা কারোর সাথে শেয়ারও করতে পারছে না। এখানে কেউ জানলে ওকে যেতেই বলবে। কিন্তু নিজের দায়িত্ব সে এড়িয়ে যেতে পারে না। দুই দিক ব্যালেন্স করা যায় কীভাবে সেটাই ভাবছে সে।
………….
(ক্রমশ)