#বিভাবরী
#প্রথম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা
নূপুরের আওয়াজে ঘুমটা ভে ঙে গেল কোয়েলের। জানালা দিয়ে দেখলো এখনও অনেক রাত। চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল। আজ কোয়েলের কালরাত্রি। অর্থাৎ আজ সে সন্দীপের মুখ দেখতে পাবে না। কাল ফুলশয্যা।
কদিনের ঘটনাগুলোতে বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে তার কাছে।
বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছিল আজ থেকে ৩ মাস পর। কিন্তু সন্দীপের বাড়ি থেকে বললো, সন্দীপের ঠাকুমা খুব অসুস্থ, তাই বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়া ভালো। কোয়েলের বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। কিছুদিন আগেই কোয়েলের দিদি নয়নার বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে আবার একটা মেয়ের বিয়ে, আবার সবার ব্যস্ততা। দুই বাড়ি থেকেই আগেই পরিচয় হয়ে ছিল বলে, সহজেই সব কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল। সন্দীপের বাড়ি থেকে কোনো রকম অনুষ্ঠান হয় নি। সবাই জানতো সন্দীপের ঠাকুমা অসুস্থ। তাই কারোর কোনো সন্দেহ হয় নি। কিন্তু আজ যখন কোয়েল এই বাড়িতে নতুন বৌ হয়ে এলো, তখন তার সব থেকে বেশি অবাক লাগলো ঠাকুমাকে দেখে। তিনি তো বেশ ভালোই শক্তপোক্ত মানুষ। তাঁকে দেখে অসুস্থ বলে তো মনে হলো না। কোনো আত্মীয় আসেনি এই বাড়িতে। সন্দীপ, সন্দীপের মা, বাবা আর ঠাকুমা আছেন এই বাড়িতে। তবে আরও একজন আছেন এই বাড়িতে, সন্দীপের দাদা বিভাস। কিন্তু তাঁকে এখনও কোয়েল দেখেনি। বিয়ের আগে কোয়েল অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছিল সন্দীপকে, তার দাদার ব্যাপারে। কিন্তু সন্দীপ বারবার এড়িয়ে গেছে।
নূপুরের আওয়াজটা কি ভুল শুনেছিল কোয়েল? কই আর তো কোনো আওয়াজ পাচ্ছে না সে।
বহু পুরোনো দিনের তিনতলা বাড়ি। নিচের তলায় থাকেন সন্দীপের মা বাবা আর ঠাকুমা। সেখানে প্রায় ৫ টি রুম আছে। দোতলায় থাকে সন্দীপ। যদিও আজ সে বাড়িতে নেই। তাই সন্দীপের রুমে কোয়েল একা। পাশে আরও ৪ টি রুম। সেগুলো সব বন্ধ। দাদা কোথায় থাকেন তা কোয়েল জানে না। একবারও দেখেও নি তাঁকে। তিনতলায় এখনও যায় নি কোয়েল।
নতুন বৌ বলে পাড়া থেকে দেখতে এসেছিল কয়েকজন। শাশুড়ি মা মিষ্টি দিতে ব্যস্ত ছিলেন সবাইকে, কিন্তু ঠাকুমা একদম কোয়েলের কাছ থেকে নড়েন নি। এইবাড়িতে এসে একটা জিনিস কোয়েল বুঝেছে, সব কিছু ঠাকুমার কথা মতো হয়। শ্বশুর শাশুড়ি সকলেই তাঁকে খুব মানেন।
আর ঘুম আসছিল না কোয়েলের। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রাত্রি ২ টো বাজছে।
বিছানা থেকে নামতে গিয়ে বুঝতে পারলো সেও পায়ে নূপুর পরে আছে, তাহলে হয়তো ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে গিয়ে নিজের নূপুরের আওয়াজই সে শুনেছে। দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। হালকা নীল রঙের লাইট জ্বলছে, তাতে দোতলার এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত বুঝতে পারা যাচ্ছে। শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট ঘরের মতো আছে, যেখান থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে তিনতলায়, অর্থাৎ তিনতলায় যাওয়ার পথ সেটি।
এত বড়ো ঘরে এই কয়েকজন মানুষ থাকে কী করে কে জানে? কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল তিনতলা যাওয়ার সিঁড়ি দিয়ে। কারোর অস্তিত্ব অনুভব করছিল সে। তারপর কেমন যেন মনের মধ্যে অস্থিরতা বাড়লো কোয়েলের। সেখান থেকে ফিরে এসে নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল। ঠিক সেই সময় একটা ছায়া সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে গেল যেন।
সকাল হলো,
শাশুড়ি মায়ের ডাকে ঘুম ভা ঙ লো কোয়েলের। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুললো। শাশুড়ি মা হেসে বললেন, রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়েছিল তো?
কোয়েল হ্যাঁ- সূচক মাথা নাড়লো।
শাশুড়ি মা আবার বললেন, আমি তোমার সাথেই রাতে থাকতাম, কিন্তু মা মানে তোমার ঠাকুমার পায়ের ব্য থাটা বেড়েছিল, তাই সেখানেই ছিলাম।
একটু পরেই সন্দীপ চলে আসবে। কাল ব্যবসার কাজে শহরে যেতে হলো। খুব দরকারী কাজ থাকায় যেতে দিলাম, নয়তো বিয়ের পরেই এইভাবে বাইরে বেরোতে দিতাম না। তুমি তৈরি হয়ে নীচে এসো। আমি জলখাবার বানিয়েছি। এত ভালো ব্যবহার পেয়ে কোয়েল বেশ খুশি হলো। কিন্তু পরক্ষণেই কোয়েল যখন বললো, মা আমি একবার তিনতলার ঘর গুলো ঘুরে আসবো?
তখনই তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি একটু গম্ভীর গলায় বললেন, না। তিনতলায় যাওয়ার কোনো দরকার নেই। তুমি নিচের আর দোতলার সব ঘর গুলোতে ঘুরতে পারো। তিনতলায় যাওয়ার দরকার নেই।
কোয়েল বেশ অবাক হয়ে গেল। তারপর আবার কোয়েলের শাশুড়ি হেসে বললেন, তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসো, নয়তো তোমার ঠাকুমা আবার রা গ করবেন।
কোয়েল আর কথা বাড়ালো না। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো। তাকে দেখে ঠাকুমা বললেন, এই যে আমাদের লক্ষ্মী এসেছে, দাও বৌমা তাড়াতাড়ি জলখাবারটা দাও। এই যে নাতবৌ, কাল মুখ দেখে কিছু দেওয়া হয়নি তোমাকে। আজ তোমার শ্বশুর লকার থেকে গয়না গুলো নিয়ে এসেছে। এই সব কিছু তোমার। আজ এই গয়নাগুলো পরে ভালো করে সেজেগুজে নেবে৷ তোমার বাপেরবাড়ি আর আমাদের কিছু আত্মীয় আসবে, ছোটখাটো একটু আয়োজন করেছি। যতই হোক এইবাড়ির নতুন বৌ তুমি, তোমাকে আমাদের আত্মীয়রা দেখবে না নাকি?
কোয়েল গয়নাগুলো দেখে বললো, এই সব কিছু আমার? এ তো অনেক গয়না।
ঠাকুমা বললেন, তুমি তো আমাদের বংশের একমাত্র বৌ, তোমার সব নয়তো কার?
কোয়েল কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। কিন্তু সে তো শুনেছে, সন্দীপের এক দাদা আছে। তাহলে কোয়েল কেন একমাত্র এই বাড়ির বৌ হবে, দাদারও তো বিয়ে হবে। আর তাছাড়া দাদার বিয়ে আগে কেন হলো না?
অনেক প্রশ্ন কোয়েলের মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো।
সন্ধ্যের পর বাড়ি ভর্তি লোক। কোয়েলকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বাপের বাড়ি থেকেও সবাই চলে এসেছে। কোয়েলের দিদি নয়না আর সুজয় বাবুও এসেছেন। সাথে তাদের বন্ধু ঋষভ আর সোমাশ্রীও এসেছে। সন্দীপের বেশ কিছু বন্ধুও এসেছে। সকলের সাথে সন্ধ্যেটা বেশ ভালোই কা’টলো।
সুজয়, নয়না, ঋষভ, সোমাশ্রী এত বড় পুরোনো বাড়ি দেখে বেশ অবাক আর খুশি হলো। চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। দোতলায় এসে তিনতলার দিকে যাওয়ার সময় কোয়েলের শ্বশুর বিক্রম বাবু ডেকে বললেন, তিনতলার দিকে যেয়ো না।
চারজনেই অবাক হলো। বিক্রম বাবু বললেন, আসলে তিনতলার ঘরগুলো ঠিক মতো পরিষ্কার করা হয়নি। সব কিছু এলোমেলো হয়ে আছে। বুঝতেই পারছো, বাড়িতে এই কজন মানুষ। এত বড়ো বাড়ি গুছিয়ে রাখা মুসকিল।
সুজয় বললো, আরে না না কাকু। এত বড়ো বাড়িকে বেশ সুন্দর ভাবে মেইনটেইন করে রেখেছেন আপনারা। কোথাও কোনো ফাটল নেই। আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি, এত বছরের পুরোনো বাড়ি শুনে।
বিক্রম বাবু বললেন, চলো রাত হচ্ছে এবার খাবে চলো, তোমরা তো আবার ফিরে যাবে বলছো।
ঋষভ বললো, হ্যাঁ কাকু আমরা চারজনেই এখান থেকে কলকাতা ফিরে যাবো। তবে ছুটি পেলেই চলে আসবো এখানে ঘুরতে।
বিক্রম বাবু হেসে বললেন, বেশ ঠিক আছে।
কোয়েলের কাছে এসে বসলেন এবার সন্দীপের পিসি, বেণি পিসি। এসেই তিনি কোয়েলের গয়না গুলো দেখতে দেখতে বললেন, এই গুলো কি বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছো?
কোয়েল বললো না না, বাপের বাড়ির গয়না আজ আমি পরিনি, সেইগুলো বিয়ের দিন পরেছিলাম। আজ এইগুলো ঠাকুমা আমায় দিয়েছেন।
বেণি পিসি মুখ বাঁকিয়ে বললেন, ওহ, সব গয়না বুঝি তাঁর একমাত্র নাতবৌকেই দিয়ে দিয়েছেন।
কোয়েল বললো আপাতত এইগুলো আমার। তবে দাদাভাইয়ের বিয়ে হলে আমরা দুই জা মিলেই পরবো। বেণি পিসি মুখ বাঁকিয়ে এবার হেসে বললেন, আর হাসিয়ো না বাপু তোমার ভাশুরের কথা শুনিয়ে।
ঠিক সেইসময় সন্দীপ আর তার ঠাকুমা ঢুকলেন ঘরে। ঠাকুমা বললেন, তোর চিন্তা নেই বেণি, তোর মেয়ের জন্যও আমি গয়না গড়িয়ে রেখেছি। বিয়ের সময় তোকে এক গা গয়না পরিয়ে পাঠিয়ে ছিলাম। তোর মেয়েকে এমন সাজাতে না পারলেও, যতটা করণীয় ঠিক করবো।
পাশ থেকে বেণি পিসির মেয়ে বললো, দিম্মা ওইসব পুরোনো গয়না আমি পরবো না। তুমি এক কাজ করো, ওই গয়না গুলো দিয়ে দাও, আমি নতুন করে গড়িয়ে নেবো।
ঠাকুমা এবার বেণির দিকে তাকিয়ে বললেন, বাহ্ বেশ তো মেয়েকে নিজের মতো গড়েছিস বেণি।
সন্দীপ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বললো, চলো চলো রাত হচ্ছে। কোয়েলের বাড়ির সকলে অপেক্ষা করছে। খেয়ে নিই চলো।
রাত হতেই সবাই ফিরে গেল। যে যার নিজের ঘরে চলে গেল। সন্দীপ আর কোয়েল ফিরে এলো নিজের রুমে। রাত্রি প্রায় অনেক।
কোয়েলের মনে যে প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল তা আর প্রকাশ করলো না সন্দীপের কাছে।
মনে মনে ভাবলো, এইবাড়িতে এসেছি যখন সবকিছু রহস্য আমিই খুঁজে বের করবো।
পরের দিন সকালে ঠাকুমা ডেকে পাঠালেন কোয়েলকে। কোয়েল যেতেই ঠাকুমা বললেন, এইবাড়ি তোমার। সব কিছুর উপর তোমার অধিকার। শুধু একটা কথা মাথায় রেখো, তুমি তিনতলায় যাবে না।
কোয়েল এবার বললো, কেন?
ঠাকুমা বললেন, তিনতলায় তোমার ভাশুর মানে সন্দীপের দাদা বিভাস থাকে। ও কারোর সাথে কথা বলে না।
তোমার শাশুড়ি গিয়ে শুধু খাবার দিয়ে আসে। ও নিচে নামে না। আমরা ওকে ওর মতো থাকতে দিই। আশাকরি তুমিও সেটা করবে। আর কিছু চাওয়ার নেই তোমার থেকে।
কোয়েল বললো, আমি কি একবারও দাদাভাইয়ের সাথে দেখা করবো না?
ঠাকুমা বললেন, যদি সে চায়, তাহলে নিশ্চয় দেখা হবে।
কোয়েলের মনে আরও প্রশ্নের ভীড় জমলো। একটা মানুষ দিনের পর দিন নিজেকে বন্দী করে রেখেছে কেন?
চলবে।