বিভাবরী পর্ব-০২

0
1

#বিভাবরী
#দ্বিতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

সকালে কোয়েলের ঘুম থেকে ওঠার আগেই শাশুড়ি মায়ের জলখাবার বানানো হয়ে যায়। কোয়েল তাড়াতাড়ি কাজ করার জন্য এগিয়ে এলেই শাশুড়ি মা হাতটা ধরে বলেন, এই তো সবে কদিন এসেছো, এখনই কাজ করার কী দরকার? এই সব তো একদিন তোমাকে সামলাতে হবে। কোয়েলকে জলখাবার দিয়ে একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে শাশুড়ি মা চলে যান। কোয়েল জানে এই খাবার কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই তার।

সন্দীপের সাথেও কথা বলে কোনো লাভ হয় নি। বারবার এড়িয়ে গেছে। শুধু বলেছে, সবাই যা বলছে তাই শোনো। দাদা পছন্দ করে না বাইরের কারোর সাথে কথা বলতে।
কোয়েল সেটা শুনেই বলেছিল, আমি তো বাইরের কেউ নই। আমি তো তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী।
সন্দীপ বলেছিল, একটু ধৈর্য ধরো। ঠিক একদিন তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে।

একমাস পেরিয়ে গেল। এর মাঝে দুবার কোয়েল বাপেরবাড়ি গেছে। এই গ্রাম থেকে বাপেরবাড়ি বেশ দূরে। কিন্তু সেখানে এই বিষয়ে কোনো কথা বলেনি কোয়েল। তার মনে হয়েছে এই সব রহস্যের সমাধান সে নিজেই করবে। আর সত্যি বলতে, শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে ভীষণ ভালোবাসে।
শুধু একটা ব্যাপার তার অবাক লাগে। একমাস হয়ে গেল অথচ একটা মানুষ এই বাড়িতে থাকলেও তাকে দেখেনি কোয়েল। একবারের জন্যও নিচে নেমে আসেনি। এই বাড়িতে দুজন পরিচারিকা থাকে। একজন নিচের ঘরের জন্য, আর একজন দোতলার ঘরের জন্য। তাঁরা কেউই বেশি কথা বলে না। কাজ করে চলে যায়। কোয়েল কতবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাঁরা হ্যাঁ বা না দিয়ে চুপ করে যায়। সব থেকে আরও অবাক লাগে ঠাকুমাকে দেখে। তাঁর যেন সব দিকে নজর। কোথায় কার সাথে কোয়েল কথা বলে, সেখানে গিয়েই উপস্থিত হন। যেন কোনো সত্যকে কোয়েলের থেকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কতদিন? একদিন না একদিন তো সব সত্যি বেরিয়ে আসবে।

আজ আবার সন্দীপ শহরে যাবে। কোয়েল রাতে একা থাকবে। শাশুড়ি মা বলেছিলেন, নিচের কোনো ঘরে থাকার জন্য। কিন্তু কোয়েল নিজের ঘরেই থাকবে বললো।
হঠাৎ করেই সুজয় দার কথা মনে পড়লো। সুজয়দা তার দিদির হাজব্যান্ড। পেশায় পুলিশ। ফোনটা বের করে সুজয়দাকে ফোন করলো কোয়েল,

… আরে কোয়েল ম্যাডাম। মনে পড়লো সুজয়দাকে? খুব সংসারী হয়েছো মনে হচ্ছে।

… না না। এখানে আমাকে কিছুই কাজ করতে হয় না।

… তাহলে কোনো ফোন নেই কেন? আর কেমন আছো? সন্দীপ কেমন আছে? তোমার শ্বশুর বাড়ির সকলে কেমন আছেন?

… সবাই ভালো আছে।

… গলার স্বর এমন লাগছে কেন? কোনো চি’ন্তায় আছো?

… তোমার সাথে একটা কথা শেয়ার করতে চাই, কিন্তু তার আগে তুমি কথা দাও, তুমি দিদিভাইকে কিছু বলবে না!

… আচ্ছা বলবো না কথা দিলাম। তুমি আমাকে সব বলতে পারো।

… এই বাড়িতে আসার পর, একটা বিষয় নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়ে গেছি। আমাকে বলা হয়েছে তিনতলার ঘরে না যাওয়ার জন্য। দোতলা আর নিচের ঘরে আমি যখন খুশি যেতে পারি। কিন্তু তিনতলায় যাওয়া চলবে না। তিনতলা থেকে ছাদে যাওয়া যায়। তাই ছাদে অব্দি যেতে পারি না। আমাকে তাঁরা যথেষ্ট ভালোবাসে, কিন্তু এই বিষয়টা আমার বেশ অবাক লাগে।

… তোমার এই কথাটা শুনেই মনে পড়লো আমার। আমরা যেদিন তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমি, তোমার দিদি, ঋষভ আর সোমাশ্রীও তিনতলায় উঠতে গিয়েছিলাম, সেই সময় তোমার শ্বশুর মশাই আমাদের বারণ করলেন যেতে। তখন বলেছিলেন, তিনতলার রুম গুলো পরিষ্কার করা হয়নি, সব এলোমেলো হয়ে আছে। আমরা তাই আর যাই নি।

… কিন্তু আসল ব্যাপার হলো। ওখানে সন্দীপের দাদা থাকেন। আমি এখনও তাঁকে দেখিনি। তিনি নিজেকে ওখানেই বন্দী করে রেখেছেন যেন। একবার নিচে নেমে আসেন নি।

… সে কি? এটা তো বেশ অদ্ভুত কথা।

… হ্যাঁ সুজয় দা। আমাকে বলা হয়েছে, উনি কারোর সাথে দেখা করতে চান না। তাই আমার সেখানে যাওয়া বারণ।

… আচ্ছা কোয়েল, তুমি বলতে পারবে? উনি মানসিক দিক থেকে সুস্থ তো? মানে আমি কী বলতে চাইছি তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো।

… উনি যদি মানসিক ভারসাম্যহীন হতেন, তাহলে বাড়ির কারোর কাছে ঠিকই জানতে পারতাম। নয়তো সন্দীপের কাছেও জানা যেত। সেরকম কিছু তো শুনি নি।

… আচ্ছা সন্দীপ কিছু বলে নি তোমাকে এই ব্যাপারে?

… না সুজয়দা, ও বিয়ের আগেও এই বিষয়টা নিয়ে এড়িয়ে যেত। এখনো তাই করে।

… সন্দীপের দাদা কোনো অ’পরাধ কিছু করেনি তো? যার জন্য নিজেকে আড়াল করে রেখেছে?

… এই যে, পুলিশের মন শুধু সন্দেহবাতিক।

… বাহবা শ্বশুর বাড়ির লোকের ব্যাপারে বলছি বলে খুব গায়ে লাগছে। আচ্ছা আমি মজা করছি। তুমি এক কাজ করো, কোনো রকম সন্দেহজনক কিছু বুঝলে আমাকে জানাবে। দরকার হলে যখনই ফ্রি থাকবে আমাকে একবার করে ফোন করবে।

… করবো। তুমি শুধু দিদিভাইকে কিছু বলো না।

… বলবো না। তুমি বিশ্বাস রাখতে পারো। কিন্তু তুমি আমার থেকে কিছু লুকাবে না।

… ঠিক আছে। আজ রাতে আমি একা। সন্দীপ শহরে যাবে। ভাবছি সবাই ঘুমিয়ে গেলে তিনতলায় যাবো।

… না না। থাক। এত সাহসের দরকার নেই। তারপর তুমি একা। কেউ সাথে থাকলে তবু ঠিক ছিল।

… কিছু হবে না সুজয় দা। আমি খুব সাহসী। তুমি ভেবো না। আমি তোমাকে কাল ফোন করে সব জানাবো।

… যা করবে, সাবধানে করবে। যখন ইচ্ছে আমাকে ফোন করতে পারো।

… ঠিক আছে সুজয় দা।

কিছুক্ষণ পর ঠাকুমা কোয়েলের রুমের বাইরে থেকে বললেন, ঘুমিয়ে গেছো নাতবৌ?
কোয়েল সাথে সাথে বেরিয়ে এসে বললো, না না ঠাকুমা, আমি জেগে আছি। আপনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমার কাছে কেন এলেন? কোনো দরকার হলে আপনার কাছেই যেতাম আমি।
ঠাকুমা বললেন, ও আমার অভ্যেস আছে। আজ রাতে আমি তোমার কাছেই শোবো। তুমি একা আছো। ভ য় লাগতে পারে তোমার।
কোয়েলের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল এটা শোনার পর। কোনোভাবে ঠাকুমা শুনতে পান নি তো যখন সুজয়দার সাথে কথা হচ্ছিল?
এইঘরের যেন দেওয়ালেও কান আছে।
কোয়েল মাথা নেড়ে বললো ঠিক আছে, আপনি এখানেই থাকুন।
তারপর ঠাকুমা বললেন, এসো নাতবৌ তোমার চুলটা একটু বেঁধে দিই। আগে আমি নিজের চুল বাঁধতে পারতাম না বলে আমার শাশুড়ি মা বেঁধে দিতেন। তাঁর কাছ থেকেই শিখেছিলাম।
তোমার শাশুড়ি মায়ের চুলও আমি বেঁধে দিতাম।
কোয়েল বারণ করলো না। চুপচাপ চিরুনিটা ঠাকুমার হাতে দিয়ে বসে পড়লো। ঠাকুমা চুল বাঁধতে বাঁধতে বললেন, যখন তোমার দাদাশ্বশুর মা রা গেলেন, তখন আমার মেয়ের বয়স ৮ বছর আর ছেলের মানে তোমার শ্বশুরের বয়স ৫ বছর। দুটো ছেলেকে বড়ো করেছি আমি। অনেক নিয়ম বারণ সব কিছু শুনেছি। কোনোদিন প্রতি’বাদ করতে পারিনি। মেয়ের বিয়ে দিলাম। ছেলেরও দিলাম। তারা আমার কথা শোনে। কারণ ছোট থেকেই তারা আমাকে দেখে বড়ো হয়েছে। তোমার শাশুড়ি মাও খুব ভালো। আমাকে নিজের মায়ের মতোই ভালোবাসে, আমিও তাকে খুব স্নেহ করি। তুমি আমাদের বাড়ির বৌ, তোমার প্রতি সব দায়িত্ব কর্তব্য আমাদের। কিছু জিনিস একটা পর্দার মধ্যে থাকে, তা একসময় ঠিকই প্রকাশ পাবে, অপেক্ষা শুধু এক হাওয়ার কিংবা ঝড়ের। যা পর্দাকে সরিয়ে দেবে।
তোমার অনেক কৌতূহল আমি জানি। থাকাটাও স্বাভাবিক। একমাস পেরিয়ে গেল তিনতলার ঘরে যে আছে, তাকে তুমি চোখে দেখোনি। এমনকি তার কোনো ছবিও এইবাড়িতে দেখো নি তুমি। আসলে সে চায় না, তাকে কেউ দেখুক। কিন্তু সে জানে তুমি এইবাড়িতে এসেছো। একদিন না একদিন এই রহস্যের থেকে পর্দা সরে যাবে।

ঠাকুমার কথা শুনে কোয়েল বেশ অবাক হলো। কি সুন্দর! করে কথা বলেন তিনি। ওনার কথা শুনে মনে হলো, অনেক ঝড়ঝাপটা তাঁর উপর দিয়ে বয়ে গেছে।
রাত হলো, দুজনেই ঘুমিয়ে গেল।

একটু বেলা বাড়তেই সন্দীপ ঘরে ফিরলো। নিজের ব্যাগটা ঘরে এসে রাখলো সে। কোয়েলকে বললো, তোমার জন্য কিছু জিনিস এসেছি। কথাটা বলেই ওয়াশরুম গেল সন্দীপ।
এদিকে কোয়েল ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে, ব্যাগটা খুলে দুটো প্যাকেট দেখতে পেল। প্রথম প্যাকেটটা খুলতেই দুটো ঘুঙুর পেল। নাচের সময় পায়ে এইরকম ঘুঙুর ব্যবহার করতো কোয়েল। সন্দীপ মনে করে নিয়ে এসেছে। কথাটা ভাবতেই কোয়েল খুশি হয়ে গেল।
শাশুড়ি মায়ের গলার আওয়াজ পেতেই কোয়েল ঘুঙুর গুলো প্যাকেটে রেখে দিল।

সন্দীপও রুমে এলো। শাশুড়ি মা বললেন, তুই এনেছিস? যা আনতে বলা হয়েছিল তোকে?
সন্দীপ প্যাকেটগুলো বের করে দেখে নিয়ে প্রথমের প্যাকেটটাই তার মায়ের হাতে দিয়ে বললো, এই যে সব নিয়ে এসেছি। কথাটা বলে মায়ের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ ভাবে হাসলো।
তারপর মা প্যাকেটটা নিয়ে চলে গেলেন।

কোয়েল বেশ অবাক হলো। ওই প্যাকেটে তো ঘুঙুর আছে, তাহলে কি সন্দীপ ভুল করে শাশুড়ি মায়ের হাতে দিল?
সন্দীপ বললো,
… কী ভাবছো তুমি?

… কই কিছু না তো। কী এনেছো দাও আমাকে?

… দ্বিতীয় প্যাকেটটা ব্যাগ থেকে বের করে বললো, তোমার মেক আপের সমস্ত জিনিস আছে এতে। তুমি সাজতে ভালোবাসো। তাই তুমি যে প্রোডাক্টের মেক আপ ইউজ করো, সেগুলো দেখে আমি নিয়ে এসেছি। একবার দেখো তো সব কিছু ঠিক আছে কিনা।

অন্য সময় হলে এইগুলো হাতে পেয়ে কোয়েল ভীষণ খুশি হতো। কিন্তু ঘুঙুরগুলো কার জন্য এনেছে সন্দীপ? ওকে জিজ্ঞাসা করাটা কি ঠিক হবে? নাকি ঠাকুমার কথা মতো অপেক্ষা করাটাই ঠিক হবে?

রাত্রি প্রায় ১ টা…

ঘুমের মধ্যে কোয়েল একটা আওয়াজ পেল। সন্দীপ ঘুমোচ্ছে। ধীরে ধীরে নামলো কোয়েল বিছানা থেকে।
বারান্দায় আসতে আবারও আওয়াজ পেল। ঘুঙুরের আওয়াজ। কোয়েল ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
তার বুকের ভেতরের ধুকপুক আওয়াজ সে এখন যেন নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল তিনতলার দিকে।

এই প্রথম সে তিনতলায় গেল। এখানে চারটি রুম। তিনটি রুম বন্ধ। একটা রুম খোলা। ধীরে ধীরে ভ য় আর কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল কোয়েল। সেই খোলা রুমে ঢুকেই চমকে গেল সে। কি সুন্দর করে সাজানো। নানারকম ছবি। তবে অবাক হলো দেওয়ালে টাঙানো কোয়েলের নিজের ছবি দেখে। এই ছবিটা তো বিয়ের আগে সন্দীপ তুলে দিয়েছিল। সেটা এত বড়ো করে বাঁধিয়ে এই রুমের দেওয়ালে টাঙানো কেন?
বহু প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছে। ঘরের মধ্যে কেউ কোথাও নেই। এই রুমটা বেশ অনেক বড়ো। একটা দেওয়াল জুড়ে বড়ো আয়না লাগানো আছে। দরজা দিকে কেউ এলে আয়নাতে দেখা যাবে। তাতে নিজেকে কোয়েল দেখছে। হঠাৎ আয়নার মধ্যে সন্দীপকে দেখে চমকে গেল কোয়েল। সাথে সাথে পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো সন্দীপ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে ভ য়ের ছাপ স্পষ্ট।

চলবে…
ভুল ত্রুটি মার্জনীয় 🙏