বিভাবরী পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
3

#বিভাবরী
#অন্তিম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

আজ আমি স্কুল যাবো না অরুন্ধতী, সবাই স্কুলে আমাকে দেখে হাসে। আমার ভালো লাগে না। মা আজ আবার আমাকে বকেছে, লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের শাড়ি পরেছিলাম। বাবাকে সেদিন পাড়ার এক কাকু বললো, বিভাসকে একটু চোখে চোখে রাখো বিক্রম দা। বাবা বললো, কেন?
তখন ওই কাকু বললো, নজরে রাখলেই বুঝতে পারবে দাদা। বিভাস বাকি ছেলেদের মতো নয়।
আমি জানি আমাকে মেনে নিতে সবার ক ষ্ট হচ্ছে। আমি তো নিজেই নিজেকে মেনে নিতে পারি না।
ঠাকুমা জোর করে কাল চুল কা টিয়ে দিল। আমার অত সুন্দর চুলগুলো ছিল, ছোট করে দিল।
আমি লুকিয়ে লুকিয়ে খুব কেঁ’দেছি।
ভাই আমাকে কাল চকলেট এনে দিয়েছে। ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, আমাকে বোঝে। আমাকে কেউ বকলে ও আমাকে আগলে রাখে। আমি কাঁদলে ও ক ষ্ট পায়।

অরুন্ধতী আর বিভাস দুজনে পুকুর পাড়ে বসে আছে। বিভাস কথাগুলো বলতে বলতে পুকুরের জলে ঢিল ছুঁড়ছে। আর অরুন্ধতী চুপ করে শুনছে।
এবার অরুন্ধতী বললো, সবই শুনলাম। স্কুল বন্ধ করে দিলেই সব সমস্যা মিটে যাবে তোর?
বিভাস তাকালো অরুন্ধতীর দিকে, তারপর আবার পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
অরুন্ধতী আবার বললো, স্কুল বন্ধ করে দিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে তুই তোর পড়াশোনার দিকে মন দে। এত ভালো স্টুডেন্ট তুই। আমি আর তোর ভাই সন্দীপ তো আছি তোর সাথে। কাল আমি তোকে ডাকতে যাবো স্কুল যাওয়ার আগে। তুই রেডি থাকিস। আর হ্যাঁ তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি।
কথাটা বলেই অরুন্ধতী টিপের পাতাটা বের করে বললো, তুই বলেছিলি তোর রংবেরঙের টিপ ভালো লাগে তাই নিয়ে এসেছি।
বিভাস টিপের পাতাটা নিয়ে ভুলে গেল সব কিছু। হাসি মুখে বললো, চল সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে। কাল স্কুল যাওয়ার আগে আমাকে ডাকতে আসবি।

“ওই হাফ লেডিজ”….
স্কুলের মধ্যে কথাটা শুনেই চমকে গেল বিভাস। ওর সাথে আছে সন্দীপ আর অরুন্ধতী। বিভাস কেমন যেন চুপসে গেল ভ য়ে।
অরুন্ধতী পিছন ফিরে বললো, কথাটা কে বললি? সাহস থাকলে সামনে আয়।
একটা ছেলে সামনে এসে বললো, আমি বলেছি। কী করবি রে?
ঠিক তখনই সন্দীপ আচমকা ছেলেটাকে ঘুষি মা রলো। বিভাস আরও ভ য় পেয়ে ভাইকে আটকে নিল।
অরুন্ধতীও ছেলেটাকে এক চড় মা’রলো।
ছেলেটা ছুটে পালালো, যাওয়ার সময় বলতে বলতে গেল, হাফ লেডিজ দুটো বডিগার্ড রেখেছে নিজের সঙ্গে।

বিভাসের মনটা খা’রাপ হয়ে গেল। অরুন্ধতী আর সন্দীপ সেটা বুঝতে পেরে বললো, আজ সন্ধ্যেবেলা আমরা তিনজনে ফুচকা খেতে যাবো। কদিন পরেই সরস্বতী পুজো। আজ একটা মিটিং করতে হবে পাড়ার সরস্বতী পুজোর জন্য। বিভাসের মন আবার ভালো হয়ে গেল।

কোয়েল এতক্ষণ ধরে তার বিভাবরীর গল্প শুনছিল। কোয়েল এবার জিজ্ঞাসা করলো, অরুন্ধতীর সাথে তো তোমার ভালো বন্ধুত্ব ছিল, তাহলে কী এমন হলো?
বিভাবরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার বলা শুরু করলো।

কলেজে গেল একসাথে। বিভাস আর অরুন্ধতীর মাঝে আরও একজন এলো, সুদর্শন। বিভাসকে বোঝার মতো আরও একজন এলো। বিভাসের জীবনটা কেমন পালটে গিয়েছিল। সমাজ, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন আর কারোর কোনো কথাতে কান দিত না সে। সুদর্শন এসেছিল চির বসন্ত হয়ে। বিভাস নিজেকে বারবার আয়নায় দেখে বলেছিল, কেন তার মনের মতো শরীরও হলো না?
সুদর্শন একটু একটু করে নিজেকে ভালোবাসতে শিখিয়ে ছিল বিভাসকে। সাথে ছিল অরুন্ধতী আর সন্দীপ। এই তিনজনই বিভাসকে কোনোদিন জাজ করে নি। বরং সবসময় ওকে ফিল করিয়েছে যে, সবকিছু স্বাভাবিক।
কলেজের প্রোগ্রামে যেদিন নাচ করেছিল বিভাস। সেদিন সকলে মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল।
ধীরে ধীরে সকলের সাথে মিশে গিয়েছিল বিভাস।

কোয়েল বললো, তারপর কী হয়েছিল বিভাবরী? তুমি সুদর্শনকে বলে ছিলে কোনোদিন কিছু?
বিভাবরীর চোখে জল। মাথা নাড়িয়ে বললো, না বলিনি। কারণ আমি জানতে পেরেছিলাম অরুন্ধতী আর সুদর্শনের মধ্যে সম্পর্ক শুরু হয়েছে। আমি আমার ছোট বেলার বান্ধবীর জীবন ন ষ্ট করতে চাই নি। আমি সবসময় ওদের ভালো চেয়েছিলাম।

কোয়েল আবার বললো, তাহলে কী হয়েছিল তোমাদের মধ্যে? আর অরুন্ধতী, সুদর্শন এখন কোথায়?

বিভাবরী বললো, কলেজ শেষ করে আমি আবার নাচে মন দিলাম। ভেবেছিলাম নাচ নিয়ে কিছু করবো। মাঝেমধ্যে সুদর্শন আমার বাড়ি আসতো। আমরা কথা বলতাম। ছাদে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো আমাদের। আমাদের কথাতে কোনো বিষয় ছিল না, আমাদের ভাবতে হতো না, আমরা কী নিয়ে কথা বলবো। আমরা বলতাম। অনেক কথার মাথামুণ্ডু থাকতো না। এত বড়ো ছাদে বিকেল থেকে কখন যে সন্ধ্যে নেমে আসতো। আমাদের সাথে মাঝেমাঝে অরুন্ধতীও থাকতো। ওরা দুজনে কখনো আমার সামনে আলাদা ভাবে কথা বলতো না। আমি ভীষণ খুশি ছিলাম ওদের জন্য। তারও কিছু বছর পর ওদের বিয়ে হলো। আমি ছিলাম ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানে।
কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে বুঝতে পারলাম, সব বোধহয় হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। সেদিন অরুন্ধতীকে কত সুন্দর লাগছিল লাল শাড়িতে। এমন একটা শাড়ি আমার নেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। আমি ওদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। ফোন করতো, এখানে এলে আমার বাড়িতে আসতো। কিন্তু আমি বাড়ির লোকদের বলেছিলাম, ওরা এলে বলবে আমি নেই।
এক সময় ওরা শহরে চলে গেল। আমার কাছ থেকে সব হারিয়ে গেল।

কোয়েল বিভাবরীর চোখের জল মুছিয়ে বললো, তারপর কী হলো?
বিভাবরী বললো, তারপর দুইবছর পর হঠাৎ একদিন অরুন্ধতী আমার বাড়ি এলো, আমি তখন নিচে ছিলাম। হঠাৎ আমরা সামনাসামনি হলাম।
ওর শরীরে তখন বাড়তি মেদ জমেছে। চোখে মুখে সুখের ছাপ। চোখ গেল পেটের দিকে। অরুন্ধতী ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল।
আমার কাছে এসে, আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকদিন পর আমাদের দেখা হলো।
তারপর ও ওর সুখের জীবনের কথা বলছিল। সেদিন সুদর্শন আসেনি। আমি একসময় ওদের সুখের কথা শুনতে শুনতে বলে ফেলেছিলাম, এই সুখ আমারও হতে পারতো। যদি আমি একজন শরীরের দিক দিয়েও নারী হতাম। তাহলে কখনো সুদর্শনকে আমি অরুন্ধতীর হতে দিতাম না।
তার পর অরুন্ধতী কেমন চুপ হয়ে গেল। কিছু না বলেই চলে গেল। আমি সেদিন ওকে আর আটকাই নি।

ঠিক তার পরের দিন শুনলাম, সুদর্শন মা রা গেছে, ঘুমের মধ্যে।
আমি ছুটে গেলাম অরুন্ধতীর কাছে।

কথাটা বলেই কান্নায় ভে ঙে পড়লো বিভাবরী। কোয়েল বিভাবরীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো, তারপর?
বিভাবরী নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, অরুন্ধতী সেদিন অসহায় ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর চোখ যেন বলছিল, আমার সুখে এইভাবে নজর দিলি?
বিভাবরী কাঁ’দতে কাঁ’দতে বললো, ওর সুখে আমি নজর দিয়েছি কুহু। আমার নজর খা’রাপ।

কোয়েল কিছুক্ষণ পর বললো, তুমি ওদের কোনো খবর জানো?
কেমন আছে অরুন্ধতী?
বিভাবরী বললো, আমি আর ওদের কোনো খবর জানি না। তারপর থেকেই আমি নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছি। আজ ৫ বছর হয়ে গেল।
আমি জানি না, অরুন্ধতীর সেই গর্ভের সন্তান কেমন আছে এখন!

কোয়েল বললো, তোমাকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে বিভাবরী। তোমার এখন অনেক কাজ। তোমাকে অরুন্ধতীর সামনাসামনি হতে হবে। এটা কোনো নজর দেওয়া নয়। সুদর্শনের মৃ*ত্যুর জন্য তুমি দায়ী নও। এটা হবার ছিল।
কিন্তু অরুন্ধতীর সাথে তোমাকে কথা বলতে হবে। ও তোমার ছোটবেলার সাথী। তোমার খা’রাপ সময়ে ও তোমাকে সাথ দিয়েছে।

বিভাবরী কান্না থামিয়ে বললো, কিন্তু ওকে এখন খুঁজবো কোথায়?
কোয়েল বললো, সেইসব ব্যাপার আমার উপর ছেড়ে দাও। তার আগে আরও একটা কাজ আছে।
বিভাবরী অবাক হয়ে বললো, কী কাজ কুহু?

কোয়েল বললো, আমার দিদিভাই নয়না আর ওর হাজব্যান্ড সুজয়দা কলকাতায় থাকে, সেখানে একটা আমি নাচের স্কুল খুলবো ঠিক করেছি, ওরা আমাকে সবরকম সাহায্য করবে বলেছে। ওদের দুজন বন্ধু আছে ঋষভ আর সোমাশ্রী। ওরা অলরেডি সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। এবার তোমাকে বেরিয়ে আসতে হবে। অনেক অনেক বাচ্চা আছে যাদের নাচ শেখাতে হবে। আমিও থাকবো সাথে। সপ্তাহে ৩ দিন ক্লাস রাখবো। তুমি আর আমি যাবো।

বিভাবরী বললো, আমি পারবো না রে কুহু।
কোয়েল বললো, ঠিক পারবে, আমি থাকবো তোমার সাথে। উঠে এসো, দেখো নিজেকে আয়নায়।
বিভাবরী নিজেকে দেখছে আয়নায়। কোয়েল বললো, এটাই তুমি, নিজেকে একবার মেনে নাও, তুমি আলাদা নও। তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তোমার নজর খা’রাপ নয়। তোমারও বাকি মানুষের মতো অভিমান হয় ক ষ্ট হয়। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে তুমি অরুন্ধতীকে কথাটা সেদিন বলেছিলে। ওর সামনাসামনি হতে হবে তোমাকে। ওকে তোমাকেই বোঝাতে হবে।

বাড়ির সকলে তখন এসে বললো, অনেক হয়েছে, এবার তোকে বেরোতে হবে। এতদিন বিনা দো ষে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছিস। যে যা খুশি বলুক। যে জীবনটা পেয়েছিস, সেটা নিয়েই তোকে চলতে হবে, সেটাকে সুন্দর তোকেই বানাতে হবে।

ছয় মাস পর…

আজ নাচের স্কুল খুলছে। বিভাবরী, কোয়েল, সন্দীপ, পরিবারের সকলেই উপস্থিত সেখানে।
ঋষভ, সোমাশ্রী, নয়না, সুজয়ের আজ ভীষণ ব্যস্ততা। সব কিছু ওরা দেখাশোনা করছে। বিভাবরীকে সামনে পেয়ে আজ ওরা ভীষণ খুশি।

বিভাবরীর সাথে কোয়েলেরও আজ স্বপ্ন সত্যি হলো। এবার থেকে এই নাচের স্কুল চালাবে বিভাবরী আর কোয়েল। পায়ের ঘুঙুরের আওয়াজ ভুলিয়ে দেবে অতীতের সমস্ত তাচ্ছিল্য আর উপহাস।

এই গল্প এখানেই সমাপ্ত হলো,।