বিয়ে পর্ব-১০

0
937

#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০

ধ্রুব চেঁচিয়ে ওঠলো,
— আই সী। তুমি আমার থেকে এক টাকাও নেবে না। তাহলে এতগুলো টাকা কে দিচ্ছে তোমাকে? তোমার বাবা নাকি কোনো রিচ বয়ফ্রেন্ড?
অদ্রি কড়া স্বরে বলল,
— এসব আমার মায়ের টাকা। কিছুদিন পর চাকুরী করলে মায়ের টাকারও প্রয়োজন পড়বে না।
এটুকু বলে থামলো। তারপর খুব শান্ত গলায় পলক না ফেলে ধ্রুব’র চোখে চোখ রেখে বলল,
— আমার আসলে কেউ নেই।

ধ্রুব’র দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এলো। অদ্রি কি বলছে এসব? ওর শান্ত গলা আর দু’চোখে টলমল করা জল ধ্রুব’র বুকে তোলপাড় তৈরি করে দিয়েছে ওর যে কি হলো, আচমকা টেনে অদ্রিকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো! ভোরের নির্মল বাতাস, বর্ষার ঝুম বৃষ্টি আর প্রথম শীতের আগমনের ন্যায় শান্তি অনুভব করলো নিজের মনে। নিজেকে পৃথিবীর এক প্রেমিক মানব মনে হচ্ছিলো তার। ততক্ষণে অদ্রির চোখে জমা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়লো ওর গালে, ধ্রুব’র শার্টে। অদ্রি হাত দিয়ে মুছে নিলো সেটা। নিজের কান্না বা দুর্বলতা কারো সামনে প্রকাশ কর‍তে একদম চায় না। ধ্রুব’কে উদ্দেশ্য করে কড়া স্বরে বলল,
— এখানে জড়িয়ে ধরার কি হলো? নিজের পাশে আমি নিজেই আছি, একা নই তো।
ধ্রুব এতক্ষণ অন্য জগৎে বিভোর ছিলো। অদ্রির কথা শুনে ওর ঘোর কাটলো। শিথিল করলো অদ্রির পিঠে থাকা নিজের হাত। তারপর দূরত্ব বজায় রেখে সরে দাঁড়ালো। অদ্রি কিছুক্ষণ ওর দিকে সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিছানার একপাশে বসলো। আস্তেধীরে ব্যাগ থেকে নিজের কাপড় বের করলো। ধ্রুবকে তখনো দাঁড়ানো দেখে স্বাভাবিক স্বরে বলল,
— আপনি যান, আমি তৈরি হয়ে আসছি। বেশি সময় নেবো না।
ধ্রুব কিছু একটা ভাবছিলো। অন্যমনস্ক থাকায় মুখ ফসকে বলে ফেললো,
— আমি থাকলে কি সমস্যা?
অদ্রি বসা থেকে সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। গিয়ে দরজা লক করতে করতে বলল,
— তাহলে থাকুন। আপনার তো আবার মেয়েদের চেঞ্জ করা দেখতে খুব আগ্রহ! প্রথমদিন যেভাবে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন তখনি আমার বুঝে যাওয়া উচিৎ ছিলো।
— রাবিশ!
ধ্রুব অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলো। চেঞ্জ করা দেখতে আগ্রহী মানে? ও তো এসব মিন করে নি। উফ! কেন যে বুঝেশুনে, মেপে কথা বলে না এই মেয়েটার সামনে! ওর সামনে এসব বলা মানে নিজের মানসম্মান নিয়ে নিজেই খেলা করা। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে অন্যকোনো মানে বের করে ফেলবে ভেবে ধ্রুব তড়িঘড়ি করে কাবার্ড থেকে নিজের একসেট কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ও যেতেই অদ্রি মুখ কুঁচকে আনমনে বলল,
— কতকিছু দেখা বাকি আমার!

বলে নিজের কাজে মন দিলো। বেশি সময় লাগলো না ওর রেডি হতে। তারপর, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অফ হোয়াইট টপে অদ্রিকে দেখে ধ্রুব কয়েকটা হার্টবিট মিস করে ফেললো। মুখে নেই কোনো প্রসাধনীর ব্যবহার। চুলগুলো বেশি বড় না হলেও পিঠময় ছড়ানো। কালো প্যান্ট, ছাইরঙা শার্টের ফর্মাল লুকে ধ্রুব’কেও দারুণ দেখাচ্ছিলো। কিন্তু অদ্রিকে লক্ষ্য করে ও নিজে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না। শুধু মনে হচ্ছিলো যেভাবেই হোক এই মুহূর্তটার একটা স্মৃতি ক্যাপচার করা দরকার। তাই ফোন আসার বাহানায় একটু আড়ালে গিয়ে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিলো অদ্রির। কেন, তা জানে না। তারপর এমন একটা ভাব করে ফিরে এলো যেন কোনো এক ইম্পোর্টেন্ট কল এসেছিলো ওর। জরিনা দুজনকে এভাবে দেখে তো মহাখুশি। একসময় তো বলেই ফেললো,
— আফনেরা দুইজন এক্কেবারে মিলছেন গো ভাইজান। কত্ত সুন্দর লাগতাছে যে কেমনে আর বোঝামু!

এদিকে ওদেরকে পাশাপাশি দেখে আশফাক সাহেব আর শায়লার চোখও জুড়িয়ে গেলো। মাশাল্লাহ! একেই বোধহয় পার্ফেক্ট জুটি বলে। তবে দেরি হয়ে যাওয়ায় দুজনকে বেরিয়ে পড়ার তাড়া দিলেন শায়লা। অদ্রি ড্রাইভিং সিটের পাশেরটাতে ওঠে বসলে ধ্রুব গাড়ি স্টার্ট দিলো।

পড়ন্ত বিকেল। রোদ নেই। হিমশীতল নীরবতা চারদিকে। নীল আকাশে মেঘের লুকোচুরি। দলে দলে উড়ছে পাখিদের ঝাঁক। সবুজ গাছগাছালির দল হাওয়ায় দুলছে। তার মাঝে কৃষ্ণচূড়া, সোনালু ফুল ছিটিয়ে আছে পিচঢালা পথে-প্রান্তরে। গোধূলি শুরু হওয়া সেই মুহূর্তটাতে কিছুতেই ধ্রুব ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিতে পারছে না। এতদিন বিয়ে মানি না, বউ মানি না করে যে ধ্রুব মা-বাবাকে বিরক্ত করে তুলছিলো সে ধীরে ধীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে অদ্রির মায়াতে, যাকে ও চায় নি। আসলে মানুষের মন সৃষ্টিকর্তার অতি আশ্চর্য এক সৃষ্টি। বড়ই বিচিত্র এই মনে কখন কিসের ঘনঘাটা চলে তা বুঝে ওঠা খুবই মুশকিল। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর অনেক রহস্য সমাধান করলেও এই মন নামক জগৎের রহস্য উদঘাটন করার কোনো কূলকিনারা পায় নি কেউ। পাওয়া সম্ভবক নয়! ধ্রুব শক্ত হয়ে স্টিয়ারিং ধরে, দম নেয়। পাশে বসে থাকা অদ্রি এতক্ষণ ওকে দেখেছিলো। এবার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
— আপনি এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছেন কেন? কোনো সমস্যা হচ্ছে?
ধ্রুব মাথা নাড়িয়ে বলে,
— না তো।
— সমস্যা তো একটা হচ্ছেই। গাড়িটা একটু সাইড করুন তো!
ধ্রুব অবাক হয়ে বলে,
— কেন?
— এত প্রশ্ন কেন করছেন? যা বলছি তা করুন তো।
ধ্রুব আরকিছু জিজ্ঞেস করলো না। জিজ্ঞেস করে লাভও নেই। অদ্রি ওকে উত্তর দেবে না। ধ্রুব রাস্তার পাশের একটা বড় গাছের নিচে গাড়িটা সাইড করে বিরক্তি নিয়ে অদ্রিকে বলল,
— কি সমস্যা?
অদ্রি উত্তর না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। পেছনের সিটে গিয়ে বসে বলল,
— এবার চলুন!
ধ্রুব বিস্ময় নিয়ে বলে,
— সিরিয়াসলি? আ’ম নট ইওর ড্রাইভার।
অদ্রি কঠোর গলায় বলে ওঠলো,
— ড্রাইভিং আর করছেন কোথায়? আপনি তো মন দিতে পারছেন না। বারবার ঘুরেফিরে আমাকেই দেখছেন। সেটা আমি বুঝতে পারবো না আপনাকে কে বললো?
ধ্রুব’র গলার স্বর দৃঢ় হয়ে এলো,
— মোটেও না।
অদ্রি চেঁচিয়ে বললো,
— চলুন তো!

ধ্রুব সাথে সাথে গাড়ি স্টার্ট দেয়। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হতে থাকে। আচ্ছা, অদ্রি কি খেয়াল করছিলো যে এতক্ষণ ধ্রুব লুকিয়ে লুকিয়ে এতক্ষণ ওকে দেখছিলো? ওকে দেখে যে ধ্রুব’র হার্টবিট রকেটের গতিতে ছুটছিলো এটাও বুঝে গেছে? ধ্রুব চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেয়। উহু! অদ্রির সামনে একদম ভাঙলে চলবে না। অদ্রিকে বুঝতেই দেবে না যে ওকে দেখে ধ্রুব’র হার্টবিট থেমে গেছ। প্রতিনিয়তই যে তা হচ্ছে উহুম! সেটাও বুঝতে দেবে না।

কোচিং সেন্টারটি বেশিদিনের নয়। আশফাক সাহেবের এক বন্ধু একটি পাবলিক ইউভার্সিটির টিচার। সেই ভার্সিটির ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টরাই এটি পরিচালনা করে থাকে। কয়েক বছরেই বেশ নামডাক করে ফেলেছে এই কোচিং সেন্টার। ধ্রুব টিচারদের সাথে অনেকক্ষণ আলোচনা করে, বুঝেশুনেই অদ্রিকে সেখানে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলো। কিন্তু ওখানে অদ্রির ব্যাচমেট সব ছেলেরা যেভাবে অদ্রির দিকে মুগ্ধতা নিয়ে তাকাচ্ছিলো ধ্রুব সেটা নিতে পারছিলো না। এদিকে আবার অদ্রি মোটেও ওর থেকে কোনো টাকাও নিলো না। সাথে করে আনা ব্যাগ থেকে যখন টাকা বের করে দিচ্ছিলো ধ্রুব তখন রেগে নিচু গলায় ওকে বলল,
— মা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলো এ ব্যাপারটাতে। তোমার কাজটা কিন্তু মোটেও ঠিক হচ্ছে না।
অদ্রি বিস্মিত গলায় বলল,
— কেন ঠিক হবে না? আরে বাবা বিষয়টা এত সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? কুল…
ধ্রুব প্রচন্ড রেগে গেলো। তবে এতগুলো মানুষ থাকায় সবার সামনে সিনক্রিয়েট করলো না। সেন্টার থেকে বাইরে বেরিয়ে অদ্রির মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার কাছে এটা সিরিয়াস ম্যাটার নয়?
অদ্রি ভাবলেশহীন হয়ে বলল,
— একদম না।
ধ্রুব কপালে ভাঁজ পড়লো। মেয়েটা সবসময় সোজাসাপটা বলে দেয় সবকিছু, ধ্রুব কেন সেটা নিতে পারে না? ও প্রশ্ন করলো,
— কেন?
অদ্রি কাঠ কাঠ গলায় বলল,
— কারণ আপনি, আমি দু’জনেই দু’জনের নামমাত্র লাইফ পার্টনার। মূলত সেজন্যই আমি আপনার কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চাই না।
ধ্রুব এবার রেগে বলল,
— আর আমার মা-বাবার ভালোবাসা? ওরা তো নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে তোমাকে।
অদ্রি বলল,
— আমি তাঁদেরকে নিঃস্বার্থভাবে সম্মান-শ্রদ্ধা করি। আংকেল-আন্টিকে আমি খুব ভালোবাসি। এই দুটো ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। সেদিন বলেছিলাম তো আপনাকে, আমার কোথাও এডমিশন হয়ে গেলে আমি চলে যাবো আপনাদের ওখান থেকে। আমি আর আপনার ঘরের এক্সট্রা পার্সন হবো না।

এক্সট্রা পার্সন? অদ্রি? আসলে ধ্রুব প্রথম দিকে এগুলোই ভেবেছিলো অদ্রিকে নিয়ে। কিন্তু মুখে তো কোনোদিন বলেনি ওকে। কিন্তু অদ্রি ঠিক ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে। নিজেকে নিয়ে যে মেয়ে এতোটা কনফিডেন্ট সে ধ্রুব’র থেকে টাকা নেবে এটা কি করে ভাবলো ধ্রুব? ও নিজের রাগ সামলাতে ব্যর্থ হলো। গাড়ির ডিকিতে জোরে ঘুষি মারলো। অদ্রি কেঁপে ওঠলো পুরো। ধ্রুব’র হাত কেটে গেছে খানিকটা। অদ্রি ধ্রুব’ হাতটা নিজের মুঠোতে নিলো। তারপর বলল,
— এটা আপনি কি করলেন?
ধ্রুব বলে ওঠলো,
— কিছু না। ছাড়ো দেখি।
অদ্রি চোখ রাঙালো। ধ্রুব সাথে সাথে চুপ করে গেলো।
আশেপাশে অনেকগুলো হসপিটাল, ডিসপেনসারি আছে। অদ্রি ধ্রুব’কে নিয়ে গেলো একটাতে। ফার্মেসি বয় ধ্রুব’র হাতে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো। ধ্রুব’র চেহারা-চুল এলোমেলো হয়ে আছে। ওর মুখ মুছে দেওয়ার জন্য অদ্রি টিস্যু বের করলো নিজের ব্যাগ থেকে। কিন্তু ধ্রুব’র হাইটের কারণে নাগাল পাচ্ছিলো না। অদ্রি ধ্রুবকে কড়া গলায় বসার আদেশ দিলে ধ্রুব সাথে সাথে বসে পড়লো। অদ্রি আলতো হাতে ধ্রুবর মুখ মুছে দিতে দিতে বলল,
— আপনার মনে হচ্ছে না নিজের ইগো ধরে রাখতে এমন করছেন?
ধ্রুব গম্ভীর গলায় বলল,
— তুমি তাহলে কেন এসব করছো?
অদ্রি হতাশ হয়ে বলল,
— আমি শুধু নিজের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছি। সেটা আপনার ইগোতে লাগলে আমার কিছুই করার নেই। সিনক্রিয়েট করবেন না। দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি চলুন।

দু’জনে বাড়ি ফিরলো একসাথে। তবে পুরোটা সময় নিজেদের মধ্যে আর কথা হলো না। ধ্রুব’র কাছে কেমন উলটপালট লাগছিলো সবকিছু। অদ্রির মায়ায় জড়িয়ে গেছে, বেরুতে ইচ্ছে করছে না একদম! ওর মাথা কাজ করছে না। রাতে ঘুমাতে গিয়ে ধ্রুব আজেবাজে চিন্তা কর‍তে লাগলো। আচ্ছা, এডমিশনে চান্স পেলে অদ্রি যখন চলে যাবে তখন ধ্রুব কিভাবে থাকবে ওকে ছাড়া? তাছাড়া কাল থেকে অদ্রি যখন কোচিংয়ে যাবে সেখানে এতগুলো ছেলের সাথে ওকে কিভাবে সহ্য করবে? ধ্রুব তো মোটেও পারবে না। ওর দম বন্ধ হয়ে এলো এসব চিন্তা করে।

[ সবার দিকেই ফোকাস করবো, ওকে?]

চলবে…