#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪০
অদ্রি ভ্রু কুঁচকালো,
— কি?
ধ্রুব থতমত খেয়ে গেলো। কি খুঁজে পাচ্ছে না সেটা কিছুতেই অদ্রিকে বলা যাবে না। এসব কি বলার জিনিস? সে যে তার কালো রঙের আন্ডার’ওয়্যার খুঁজে পাচ্ছে না এটা অদ্রিকে বললে হয়তো এই মেয়ে ওকে নির্লজ্জ, বেহায়ার তকমা দিয়ে দেবে। ধ্রুব তাই নিজের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করলো। অদ্রি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো, কিন্তু ধ্রুব’র থেকে উত্তর না পেয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
— আচ্ছা মানুষ তো আপনি! না বললে বুঝবো কিভাবে? আমাকে বলুন খুঁজে দিতে সাহায্য করি।
ধ্রুব কতক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে রইলো। সামান্য একটা জিনিস খুঁজতে অদ্রির সাহায্য নিতে হবে? তবুও নেওয়া যেতো যদি জিনিসটা সাধারণ হতো। তাছাড়াও ধ্রুব’র কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু অদ্রিকে বললে ও নিশ্চয়ই ঘাবড়ে যাবে, খারাপ ভাববে। বলা যায় না, মজাও নিতে পারে। উহু! ধ্রুব রিস্ক নেবে না। সে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— প্রয়োজন নেই, আমিই খুঁজে নিতে পারবো…
— শিওর?
অদ্রির সন্দেহী গলা। ধ্রুব’র গায়ে লাগলো ভীষণ। খটোমটো কন্ঠে ঝাঁঝিয়ে ওঠলো,
— সব ব্যাপারে নাক গলাবে না। এটা আমার সিক্রেট ম্যাটার…
— আমি তো শুধু…
ধ্রুব কপট রাগ নিয়েই বলল,
— প্রয়োজন পড়বে না, যাও তুমি!
অদ্রি ওকে সাহায্য করতে চাইছিলো। কিন্তু এভাবে রেগে যাওয়ার মতো কি হলো ও বুঝলো না। ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে উপরন্তু অভিমান জন্মালো ওর মনে। ধ্রুব সচরাচর ওর সাথে গলা উঁচু করে কথা বলে না, তবে যখন বলে তখন ওর মনে একরাশ বিষন্নতা ঘিরে ধরে আজকাল। ও দাঁড়িয়ে না থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে কটমট করে বলল,
— না পেলে খুশি হবো!
ধ্রুব ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। অদ্রি সত্যিই ওকে সাহায্য করতে চেয়েছিলো, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওর ঠোঁটের কোণ চওড়া হয়। শব্দহীন কতক্ষণ হাসে। এরপর আবারও আলমারি, ড্রয়ারে খোঁজ চালায়। কিন্তু ওকে হতাশ হতে হয়। অদ্রির অভিশাপ মতো ধ্রুব খুঁজে পায় না তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি। হতাশ হয়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।পোশাক পরিধান করে চুলে ব্যাকব্রাশ চালিয়ে দ্রুতপায়ে ডাইনিংয়ে চলে আসে। ধ্রুব চেয়ে দেখলো সব ওর পছন্দের পদ। শায়লা ছেলেকে বসতে বললেন। অদ্রি ইতোমধ্যে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে, ধীরগতিতে। পাশের সিটটা খালি। ধ্রুব কিছু না ভেবেই সেখানটায় বসে পড়ে। কড়া পারফিউমের সুবাসে অদ্রি একপলক নজর ঘুরিয়ে তাকায়। আলগোছে ওকে দেখেই আবারও নিজের খাবারের দিকে মনোযোগ দেয়। ধ্রুব হতাশ হয়। মনে জন্মে অদ্ভুত অভিমান, রাগ। নিচু স্বরে বলে,
— ভুলে গেছো নিজের প্রমিজ?
অদ্রি থামে, তবে বিচলিত হয় না৷ বলে,
— একদম না।
ধ্রুব চোয়াল শক্ত করে বলল,
— আমাকে একা রেখে খাবার খাওয়াটা কি প্রমাণ করে তাহলে? আজ তো ছুটির দিন, অন্তত লাঞ্চটা একসাথে করার জন্য অপেক্ষা করতে!
অদ্রি খাওয়া থামিয়ে জবাব দেয়,
— লাঞ্চের টাইম আরও পনেরো মিনিট আগেই শেষ হয়ে গেছে। আপনার সিক্রেট জিনিস খুঁজতে যদি পনেরো মিনিট লেগে যায় তাহলে আমি কি করবো?
ধ্রুব মুখ আঁধার করে বলল,
— প্রতিশোধ নিচ্ছো? তখন না করেছি বলে?
অদ্রি হাসে,
— কি নিবেন বলুন তো। আপনার চক্করে আমার মাছ খাওয়া হলো না…
ধ্রুব শক্ত মুখে বসে থাকে। শায়লা আর আশফাক সাহেব ওদের ব্যাপারে মাথা ঘামান না। দু’জনে মিলেমিশে, সুখী থাকতে পারলেই হলো। এরবেশি আর কি চাইবেন তাঁরা? কিন্তু জরিনা সবই লক্ষ্য করে, দু’জনের ফিসফিসানি দেখে মনে মনে আনন্দ পায়। তার কতদিনের স্বপ্ন অহংকারী, সরল
ধ্রুব আর ঘাড়ত্যাড়া, শান্ত ভাবিজানের মিল দেখা। এদিকে ধ্রুব’র প্লেটে দু’চামচ পোলাও, মাছের কাবাব তুলে দিয়ে অদ্রি জিজ্ঞেস করে,
— এতটুকুতে হয়? নাকি প্রয়োজন পড়লে নিজেই নেবেন…
অদ্রি কি ভেংচালো ওকে? নাকি ধ্রুব ভুল দেখলো? প্লেটে অতি সামান্য খাবার। যেগুলোতে ধ্রুব’র হবে না। তেজদীপ্ত অথচ তাচ্ছিল্য নিয়ে ও বলল,
— আমার বডি দেখে মনে হয় আমি একটা পিঁপড়ে? তোমার মতো দু-চামচ করে খেলে কবেই বাতাসে ওড়ে যেতাম…
গর্ববোধ করে ধ্রুব। অদ্রির চোখ জ্বলে ওঠলো অপমানে৷ ধ্রুব ওর হাত থেকে চামচ নিয়ে নিজেই প্রয়োজন মতো খাবার নিলো। অদ্রি চুপ করে নিজের খাবারে মন দিলো। ধ্রুব’র কথায় ক্ষণে ক্ষণে এরকম অভিমান জন্মানোয় নিজের প্রতি বিরক্ত অদ্রি। প্রিয় মানুষের থেকে সবসময় প্রিয় কথাগুলোই শুনতে চায় মানুষ! অদ্রিও ইদানীং এর ব্যতিক্রমবোধ করে না।
ধ্রুব ওকে জব্দ করতে পেরে বাঁকা হাসে, অদ্রি চোখ পাকিয়ে তাকায়।
রাত্রিবেলা খুব অস্বস্তি নিয়ে অদ্রি ধ্রুব’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ধীরে গলায় রয়েসয়ে বলল,
— আজ মাসের প্রথম দিন।
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকায়,
— তো?
— নিয়ে এসেছি।
ধ্রুব বুঝতে পারে না,
— কি?
অদ্রি ইতস্তত করে খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— ভাড়ার টাকাটা…
ধ্রুব খামটা দেখে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় ওর কথায় মানে বুঝতে। আচমকা ওর চোখমুখে অবিশ্বাস্যতা নেমে আসে। এরপরই চোখমুখ কঠিন করে ফেলে। রাগে লাল হয়ে যায় মুখ। খামটা নিয়ে চেঁচিয়ে জরিনাকে ডাকে। চিৎকার শুনে জরিনা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। ধ্রুব ওর হাতে খামটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— এটা দিয়ে সুস্বাদু স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আয়!
জরিনা জিজ্ঞেস করে,
— কি এইডা?
ধ্রুব কটমট করে তাচ্ছিল্য করে জবাব দিলো,
— তোর ভাবির গাছ থেকে পেড়ে আনা টাকা। টাটকা, সুস্বাদু…
জরিনা বিস্মিত হয়ে যায়। বোকার মতো বলে,
— ট্যাহারও গাছ হয়? আমাগো গেরামে কোনোদিন দেহি নাই, হুনি নাই…
ধ্রুব ধমকে ওঠে,
— এত কথা না বলে যা বলেছি তাই কর। আজ সবাই মিলে টাকার স্যুপ খাবো…
— কি কন এইসব ভাইজান? আফনে পাগল হইসেন নি?
কি হইসে আফনের?
— এত কথা না বলে যা বলেছি বানিয়ে নিয়ে আয়, দ্রুত যা…
জরিনা হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। ধ্রুব ওকে ধমকে ওঠে। অদ্রি বুঝতে পারে ধ্রুব কতোটা রেগে গেছে। সেজন্য দ্রুত খামটা নিয়ে জরিনাকে বিদায় করলো। ধ্রুব তেড়ে এলো ওর দিকে, হাত চেপে ধরতে গিয়েও থেমে গেলো। চোখদুটো বুঁজে দম নিলো। নিজেকে সংযত করে বলল,
— আমি যতদিন বেঁচে আছি এবং আমার মৃত্যুর পরেও তোমার সম্পূর্ণ দায়ভার শুধুমাত্র আমার। তুমি চাওনি বলেই আমি সেপারেশনের পথে হাঁটিনি। সেজন্য আর কোনোদিন এসব টাকাপয়সা নিয়ে আমার সাথে ফাজলামো করবে না। গট ইট, কাপুরুষ নই আমি…
অদ্রির দু-চোখে বিস্ময়। মণিদুটো জ্বলজ্বল করতে থাকে। অবাক ভঙ্গিতে ভড়কে গিয়ে মাথা নাড়িয়ে ধ্রুব’র কথায় সায় জানায়। ধ্রুব শান্ত হয়। অদ্রির গাল ছুঁয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে জাগে। ধ্রুব নিজেকে সংযত রেখে দূরে দাঁড়ায়। ঠোঁট নাড়িয়ে হাসে। অদ্রি সন্দেহজনক ভাবে তাকায়। বিহ্বল গলায় জিজ্ঞেস করে,
— হাসির কি হলো? টাকা নিবেন না বললেই
চলতো। এত…
— বোকা অদ্রি!
বলে হাসতে হাসতে ধ্রুব বেরিয়ে যায়। পেছনে একরাশ বিস্মিত নয়ন মেলে তাকিয়ে থাকা মেয়েটাকে বুঝতে দেয় না এতদিন ওর ভাড়ার টাকার বিন্দুবিসর্গ ধ্রুব ছুঁয়েও দেখেনি। বরংচ ওর কাছেই রয়ে গেছে অন্যরুপে। নাহ! এটুকু মজার স্মৃতি সে নিজের মধ্যেই রাখুক, কাউকে ভাগ না দিক!
এরমধ্যেই মান-অভিমান, ঝগড়া, মনোমালিন্য নিয়ে কেটে গেছে কয়েকদিন। রুখসাৎ জাহান দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে সপরিবারে কানাডা ফিরে গেছেন। তবে যাওয়ার আগে ফ্লোরা, অদ্রি, ধ্রুব, রাদিফ সবাই বেশ একসাথে সময় কাটিয়েছে। এর কিছুদিন পরেই
অদ্রির ভার্সিটির ক্লাসও শুরু হয়ে যায়। সবার জীবন ব্যতিব্যস্ত, গোছানো, পরিপাটি। অদ্রির মনে এখন আর দুঃখবোধ খুব একটা অনুভব হয় না। বাবার কথা ভুলেও বলে না। মায়ের কথা মনে হলে, সেদিনটা ওর কাটে চুপচাপ, বিষন্নতায়। কারো সাথে কথা বলে না। ধ্রুবও ঘাটায় না। থাকুক না অদ্রি নিজের মতো। মাঝেমাঝে দুঃখবিলাসও করতে হয় কষ্ট ভুলে যাওয়ার জন্য। অদ্রি ওর পাশে আছে এটাতেই ওর আজন্ম শান্তি, ওকে দেখেই চোখ জুড়ায় ধ্রুব’র। দু’জনের মাঝের ক্ষুদ্র দূরত্বটা একদিন ঘুচে যাবে এটা ও জানে। সেই বিশ্বাস নিয়েই কেটে যাচ্ছিলো
একেকটা দিন। ওদের বিয়ের তখন বছর হতে চললো…
মানুষের জীবন স্রোতের ন্যায় চলতে থাকে। কেউ পিছিয়ে পড়ে, কেউবা সময়ের সাথেই তাল মিলিয়ে এগিয়ে যায়। হেমন্তের শেষভাগ। এবছর শীত দেরিতেই নেমেছে। আবছা কুয়াশা জড়িয়ে আছে চারদিকে। রোদের উত্তপ্ততা, তেজ কমে আসে। আদুরে কমলা রঙে ছেয়ে যায় চারপাশ। এক সুন্দর গোধূলি বিকেল। মেঘহীন সাদা আকাশে ওড়ে পথ পাড়ি দিচ্ছে কতগুলো পাখির দল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানে কাজ করতে থাকা জরিনার সাথে গল্প করছিলো, হাসছিলো। ধ্রুব সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছে। ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখ। চেঞ্জ করে বিছানায় পিঠ লাগায়। দু-চোখে নেমে আসে ঘুম। অদ্রি বারান্দা থেকে ঘরে এসে দেখে ঘুমন্ত ধ্রুবকে। কখন এসেছে টেরই পায়নি। অদ্রি ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়, এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দেয়। এরপর ধীরপায়ে ধ্রুবর মাথার কাছে বসে। একমনে ওকে দেখতে থাকে।
একজন সুদর্শন পুরুষ। চেহারায় গাম্ভীর্যতা, কঠোরতা, কোমলতা মিশে আছে। মন সরল, অভিমানী। নিজের কথায় অটল, রাগ হলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জানে না৷ কিন্তু অদ্রি জানে, সকলের কাছে রাগী ধ্রুব একমাত্র ওর সামনে আধখোলা বইয়ের মতো। অর্ধেক পড়ে বাকিটা দুর্বিষহ মনে হয় মাঝেমধ্যে। ও পড়তে পারে না।
এই যুবকটির ঘুমন্ত চেহারার নিষ্পাপতা ওর মন ছুঁয়ে দেয়। দেখতে ভালো লাগে অদ্রির। হাত বাড়িয়ে আঙুলের সাহায্যে বিলি কাটতে থাকে ওর চুলে। শুভ্র মুখখানায় লেপ্টে আছে অফিসের ক্লান্তি। অদ্রি আচমকা ঘোরে পড়ে যায়, নিজের ঠোঁট নামিয়ে এনে ছোট্ট স্পর্শ আঁকে ধ্রুব’র কপালে। নরম, উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে তাকায় ধ্রুব। কিছু মুহূর্ত ধাতস্থ হয়ে নেওয়ার পর বিস্মিত হয়। একলাফে ওঠে বসে। অদ্রির হুঁশ ফিরে আসে, হতভম্ব হয়ে যায়। কি করলো এটা সে? ধ্রুব কি টের পেয়ে গেছে? ও আমতাআমতা করে বলে,
— একি! আপনি ওঠে গেলেন যে?
ধ্রুব বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যেতে যেতে চোখমুখ শক্ত করে বলে,
— অফিসের কিছু ফাইল রেডি করতে হবে!
অদ্রির চোখেমুখে বিস্ময়। ধ্রুব কিছুই বললো না
ওকে? কেন?
ধ্রুব সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখলো শায়লা হাসান চিন্তিত মুখে লিভিংরুমে বসে আছেন। তার হাতে ফোন। অন্যমনস্ক থাকায় ধ্রুবকে তিনি খেয়াল করলেন না৷ মায়ের চেহারা দেখেই কিছু একটা আন্দাজ করতে পারে ধ্রুব। কি হয়েছে সেটা জানতে শায়লার পাশে গিয়ে বসলো ধ্রুব। বার কয়েক ডাকার পর শায়লা ঘোর থেকে বেরিয়ে এলেন। ছেলেকে দেখে হাসার চেষ্টা করলেন। ধ্রুব’র খটকা লাগলো। কি এমন হয়েছে যে মায়ের মুখ এমন অন্ধকার আর চিন্তিত?
[ ভুলত্রুটি থাকে, সেগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টও মিস করে ফেলি। চোখে পড়লে ধরিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ।]
চলবে…