বিরহের নাম তুমি পর্ব-৩৪+৩৫

0
465

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
৮৯.
সময়ের বিবর্তনে ব্যস্ততা কাটিয়েও সূচনাকে সময় দিচ্ছে আদিল। তার খুব করে ইচ্ছে করে সারাক্ষণ সূচনার আশেপাশে থাকতে। চোখভরে দেখতে। হাতে হাত রাখতে। কিন্তু অতসব ইচ্ছের এখন মূল্য নেই। আর কয়েক মাস পরেই সূচনার ফাইনাল পরীক্ষা। সেই যে ফার্স্ট ইয়ারে মেয়েটার সাথে পরিচয় হয়েছিল! কীভাবে যে মাঝখানে এতগুলো মাস চোখের পলকেই কেটে গেল তা বোধ করি সে খেয়ালই করেনি। সময়কে কেন বেঁধে রাখা যায় না? সূচনার পরীক্ষা শেষ হলেই ওদের দুজনের বিয়ে। এইযে মাঝখানে আদিল এই কাঙ্ক্ষিত সময়ের জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করত, এ অপেক্ষাটা ছিল মিষ্টি মধুর। তার ভালো লাগে সূচনাকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে। অপরদিকে এতদিনেও সূচনা একটুখানিও স্বাভাবিক হতে পারেনি আদিলের সাথে। এমনটা নয় যে, সে চেষ্টা করেনি। চেষ্টা অবশ্যই করেছে সহজ এবং স্বাভাবিক হওয়ার। কিন্তু কোথায় যেন একটা বাঁধা! দ্বিধা। এতে কিন্তু আদিল একটুও ধৈর্যহারাও হয়নি। উপরন্তু সে সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে সর্বদাই বলে,’এত তাড়াহুড়ার তো কিছু নেই। বিয়ের পর গোটা সংসার জীবন পড়ে রয়েছে। তখন না হয় আবার চেষ্টা করবে।’
সূচনা স্মিত হাসত। মনে মনে তার সংশয়ও লাগত। আসলেই কি মানুষটা এত ভালো? নাকি সেও রাসেলের মতোই? ভয় লাগে। ভীষণ ভয় লাগে এসব ভাবলেই।

পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। দুজনেই নিরব এবং নিশ্চুপ। দুজনের মনের মাঝেই চলছে নানান রকম চিন্তা-ভাবনা এবং কথাবার্তা। সূচনার পরনে কলেজের সাদা ড্রেস। কাঁধে কালো ব্যাগ। আদিল একবার সূচনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,’এই হিজাবটা কি আমার পাঠানো?’
সূচনা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। বিস্মিত হয় আদিলের প্রশ্নে। এমনকি সে ঠিক বুঝতেও পারেনি। আদিল নিজে থেকেই বলল,’পার্সেল গিয়েছিল না তোমার কাছে? এক ডজন সাদা হিজাবের।’
এবার যেন সূচনার সব মনে পড়ে যায়। সে ঐ হিজাবগুলো এখনো তুলে রেখে দিয়েছে। একটাও ব্যবহার করেনি। কিন্তু কথা হচ্ছে হিজাবগুলো তাহলে আদিল পাঠিয়েছিল?
‘কী হলো?’ প্রশ্ন করে আদিল। সূচনা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কোনো উত্তর করে না।
‘তুমি কি হিজাবগুলো পাওনি?’
এবার মাথা নাড়ে সূচনা। হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় এই হিজাবটা তার দেওয়া নয়। আদিল এবার প্রশ্ন করে,’হিজাবগুলো তাহলে কী করেছ?’
সূচনা ব্যাগ থেকে তার ফোন বের করে। আদিলকে টেক্সট করে লিখে,’ঐগুলা এখনো ঐভাবেই রেখে দিয়েছি। একটাও পরিনি।’
ম্যাসেজটি পরে আদিল অবাক হয়ে বলে,’সেকি! কেন?’
সূচনা পূণরায় লিখল,’কোনো আগুন্তুকের পাঠানো কোনো কিছু আমি কেন ব্যবহার করব?’
আদিল এবার হেসে ফেলে। সূচনার মাথায় হাত রেখে বলে,’পাগলি! এখন তো জানলে, সেই আগুন্তুকটা কে? এখন তো আর সমস্যা থাকার কথা নয়।’
প্রত্যুত্তরে সূচনাও স্মিত হাসল।
________
৯০.
সূচনা বাড়িতে ফিরে দেখে চাচা-চাচি এসেছেন। চাচা সূচনাকে দেখতে পেয়েই হেসে বললেন,’এসেছিস তুই! আয় বোস।’
সূচনা চাচার পাশেই বসল। চাচা-চাচি মূলত এসেছেন জারিফের বিয়ের দাওয়াত দিতে। আপাতত বিয়েটা হবে একদমই ঘরোয়াভাবে। দুই পরিবারের অল্প কিছু সদস্যদের নিয়েই আয়োজিত এ বিয়ের অনুষ্ঠান। জারিফ সুস্থ হয়ে ফিরে এলেই জাঁকজমকভাবে পূণরায় বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে।

জারিফ এবং প্রীতির বিয়ে হবে শুনে সূচনা ভীষণ-ই খুশি হয়। অবশেষে দুটি ভালোবাসার মানুষ এক হচ্ছে।
তার উদ্দশ্যে চাচি বললেন,’এবার আর রাগ করে বসে থেকো না। বিয়েতে এসো। নয়তো দেখা যাবে তুমি না গেলে এবারও আমার ছেলে বিয়ে করবে না।’

চাচি কথাটা গম্ভীরভাবেই বললেন। তবে সূচনার খারাপ লাগল না। জারিফের যে প্রীতির সাথে বিয়ে হচ্ছে এতেই সে খুশি। তবে এবার সে সত্যিই বিয়েতে যাবে। চাচা আলাদাভাবে আদিলের পরিবারকেও দাওয়াত করে এসেছেন। বিয়ে কাল রাতে। তাই বিয়ের জন্য উপহার আজ রাতেই কিনে রাখতে হবে। সূচনা ঠিক করেছে ভূমি অফিস থেকে আসলে রাতে গিয়ে কিনে আনবে।
______
৯১.
আদিলের খালা এসেছেন আজ দু’দিন যাবৎ। সংসার সামলিয়ে বেড়াতে আসার খুব একটা সুযোগ হয়ে ওঠে না। আদিলের বিয়ে ঠিক হয়েছে এই সুবাদে অবশেষে সে সময় করে চলেই আসেন। সূচনার সম্পর্কে তিনি সবই শুনেছেন। কিন্তু সামনা-সামনি খোলামেলা কথা বলবেন বলে হঠাৎ করে সময় বের করে চলে আসা।

খালা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন,’দুনিয়াতে মেয়ের অভাব ছিল নাকি বল তো? কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে। ঐ মেয়ে তো আর একাই সুন্দর না। আর্থিক অবস্থাও তো মনে হয় খুব একটা ভালো না। তাহলে সব জেনেশুনে এমন একটা মেয়েকে ছেলের বউ করতেছিস কেন?’

আদিলের মা একটু নড়েচড়ে বসে বললেন,’আপা, একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে আমারও প্রথম সূচনাকে পছন্দ ছিল না। আমারও ইচ্ছে ছিল সবদিক দিয়ে পার্ফেক্ট এমন একটা মেয়ে আসুক। টাকা-পয়সা কোনো ব্যাপার না। আল্লাহ্ আদিলের বাবাকে যতটুকু দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমরা ততটুকুতেই অনেক ভালো আছি। সূচনা বোবা, এটা শুধু সমস্যা না। বিরাট সমস্যা। প্রতিবেশী অনেকেও কানাকানি করে জানি। কিন্তু কী করব বলো? ছেলের সুখের আগে তো আর কিছু নেই। সংসার করবে আমার ছেলে। ওরই যদি সমস্যা না থাকে তাহলে আমাদের আর কী সমস্যা হবে?’
‘তাই বলে তুই বোঝাবি না আদিলকে? মা হিসেবে তোর কোনো দায়িত্ব নাই?’
‘অবশ্যই আছে। ওকে ভালো-মন্দের তফাৎ যা বোঝানোর ছোটোবেলাতেই বুঝিয়ে দিয়েছি। ও এখন প্রাপ্ত বয়স্ক। ওর অধিকারে হস্তক্ষেপ করার মতো সময় আর এখন নেই। জোর করে কোনো সিদ্ধান্তও আমরা এখন আর চাপিয়ে দিতে পারি না। তাছাড়া কথা বলতে পারায়, না পারায় কী আসে যায় বলো তো? একটা সহজ জিনিস সহজভাবে মেনে নিলেই দেখবে সবটা পানির মতো। আসলে, আমরাই সিম্পল একটা বিষয়কে জটিল করে তুলি।’
‘ভালোই! তোর মতো শাশুড়ি পাবে বলেই ঐ মেয়ে শান্তিতে থাকতে পারবে।’
মা মৃদু হেসে বললেন,’আমার ছেলের ভালো থাকা এখন শুধু আমাদের ঘিরেই নয় আপা। আদিলের ভালো থাকার আরেক নাম হচ্ছে সূচনা। আমার দ্বারা যদি মেয়েটা কখনো কষ্ট পায়, তাহলে সেই আঘাত আমার ছেলেও পাবে। আমার প্রতি ওর যেই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান সেটাতে ঘুনে ধরবে তখন। আমি যদি মেয়েটার সাথে অশান্তি করি, তাহলে রেষারেষি ঘরে থাকবেই। সামনা-সামনি হোক বা আগে-পিছে আদিলের চোখে আমি কিছুটা হলেও খারাপ হয়ে যাব। আমি তো সেটা চাই না। আর এমনও তো নয় যে, সূচনা ওকে ফাঁসিয়েছে বা ওদের রিলেশন ছিল। খোঁজ-খবর সব নিয়েছি। মেয়েটা অনেক বেশি সহজ-সরল। কারও সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। এমনকি ও তো নাকি আদিলকেও বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। তাহলে বলো তো, ওর সাথে আমি ঝামেলা করবটা কী নিয়ে? নির্দোষ মেয়েটার সাথে অযথা আমি রেষারেষি করতে যাব কেন? আমি ওকে অনেক বেশি ভালোবাসব। তাহলেই না আমার প্রতি ওর ভালোবাসা জন্ম নেবে। তাছাড়া একটা কথা তো ভুলে না গেলেই নয়। আমার ঘরেও একটা মেয়ে রয়েছে। নুসরাতও একদিন পরের বাড়ি যাবে। আমি যদি পরের মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করি, আল্লাহ্ না করুক একই কাজ যদি আমার মেয়ের সাথে করে ওর শাশুড়ি? তাহলে কি আমি মা হিসেবে সেটা সহ্য করতে পারব? ছেলে-মেয়ে বোবা, কানা ল্যাংড়া, খারাপ যাই হোক না কেন প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছেই অমূল্য রতন। সূচনার মায়ের কাছেও তো ও অনেক দামি। তাহলে পরের মেয়েকে আমি কেন কষ্ট দেবো বলো তো?’

বড়ো খালা এ ব্যাপারে আর বেশি কথা আগাতে পারলেন না। চা শেষ করে বললেন,’যা তোদের ভালো মনে হয় করবি। আমার তো আর সমস্যা নেই।’
‘বাদ দাও তাহলে এসব। এতদিন পরে আসলে বলো আজ রাতে স্পেশাল কী রান্না করব?’
‘গরুর মাংস ভুনা কর। এত চেষ্টা করি তোর মতো করে গরুর মাংস ভুনা করতে! কিন্তু হয়ই না। বাড়িতে গরুর মাংস রান্না করলেই তোর দুলাভাই বলবে, আসমার হাতের গরুর মাংস ভুনার কোনো তুলনাই হয় না। এই হলো কাহিনী বুঝেছিস।’
দু’বোনই হেসে ওঠে এবার।
______
৯২.
শপিংমল ঘুরে ঘুরে সূচনা এবং ভূমিকা দু’বোনের-ই মাথা ঘুরে গেছে। কিন্তু জারিফের জন্য কী গিফ্ট নেবে সেটাই এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি। এ মুহূর্তে ওদের মনে হচ্ছে ছেলেদের উপহার দেওয়াটাও খুবই জটিল এবং দুঃসাধ্য, অভাবনীয়। মেয়েদের তো এক পাতা টিপও উপহার দেওয়া যায়। কিন্তু ছেলেদের? হতাশ হয়ে দুজনে শপিংমলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শপিংমলে এসেছে এক ঘণ্টারও বেশি সময়। এই সময়ে শুধু প্রীতির জন্য শাড়ি আর কিছু ব্র্যান্ডের কসমেটিক্স কিনেছে। অসহায় হয়ে পড়েছে জারিফের বেলাতেই। একবার ভেবেছে ঘড়ি, শার্ট-প্যান্ট এগুলো দেবে। পরক্ষণে মনে হলো এগুলো অনেক কমন হয়ে যায়। অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে রেস্ট নেওয়ারও সময় পায়নি বলে ভূমিকা হাঁপিয়ে পড়েছে। তার মনে হচ্ছে বিছানা তাকে ডাকছে।

সূচনা অসহায় দৃষ্টিতে কতকক্ষণ বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ইশারায় জিজ্ঞেস করে,’আদিলকে জিজ্ঞেস করব, কী গিফট্ করা যায়?’
ভূমিকা কী ভেবে যেন নাকচ করে দেয়। পরক্ষণেই বলে,’শোন, উপহার তো উপহার-ই। জারিফকে যদি আমরা দুই টাকার লজেন্সও দিই তাহলে সেটাও উপহার বুঝেছিস? সূতরাং এত ভাবনা-চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। চল, একটা ঘড়ি আর পাঞ্জাবি কিনে সোজা বাড়িতে যাব। আমার শরীর আর চলছে না।’
সূচনা বোনের কথাতে সায় দেয়। তারপর দুজনে মিলে চলে যায় ঘড়ির দোকানে। আকস্মিকভাবেই সেখানে দেখা হয়ে যায় শোহেব আর শিশিরের সঙ্গে। সাথে সাথে দাঁত কিড়মিড় করে তাকায় ভূমিকা।

অন্যদিকে শিশির খুশি হয়ে যায় দু’বোনকে দেখে। শোহেবকে দেখে অবশ্য কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। শিশির বিস্মিত হয়ে বলল,’তোমরা এখানে!’
ভূমি স্বাভাবিকভাবেই বলল,’জারিফের জন্য কিছু শপিং করতে এসেছি।’
‘কী উপলক্ষে? বিয়ে?’
‘হ্যাঁ।’
‘গ্রেট! তা কী কিনলে?’
‘জারিফের জন্য এখনো কিছুই কিনিনি। ঘড়ি আর পাঞ্জাবি নেব ভাবছি।’
‘ওহ আচ্ছা। আমিও ভাইয়ার সাথে এসেছি। ঘড়ি অবশ্য ভাইয়ার জন্য।’
‘ওহ আচ্ছা।’ বলে ভূমিকা সেলসম্যানকে কিছু নিউ ব্র্যান্ডের ঘড়ি দেখাতে বলে। সূচনা পাশ থেকে ইশারায় ভূমিকে বলে,’আমি শিশির ভাইয়ার সাথে গিয়ে পাঞ্জাবি কিনে আনি? তাহলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যাবে।’

ভূমিকা আড়দৃষ্টিতে একবার শোহেবের দিকে তাকায়। সে গম্ভীর হয়ে ঘড়ি দেখছে। মনে হচ্ছে মন-মেজাজ আজ বিশেষ ভালো নেই। সূতরাং ভূমির সাথেও তার কথা কাটাকাটা কিংবা ঝগড়া হওয়ার সম্ভাবনা একদম শূন্যের কোঠায়। এদিকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাটাও প্রয়োজন। তাই সূচনার প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে যায়। শিশিরকে বলে,’একটা হেল্প করলে খুব খুশি হতাম।’
‘অবশ্যই আপু। বলো কী করতে হবে।’ বলল শিশির।
‘সূচনার সাথে গিয়ে একটা পাঞ্জাবি কিনে দিতে পারবে? আসলে অফিস থেকে ফিরে এখনো রেস্ট নেওয়া হয়নি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারলে আমার জন্য খুব ভালো হতো।’
‘কেন না? অবশ্যই। আমার কোনো সমস্যা নেই।’
‘ধন্যবাদ ভাই।’
ভূমি সূচনাকে টাকা দিয়ে বলল,’একটা পারফিউমও কিনে নিস।’
সূচনা মাথা নাড়িয়ে শিশিরের সাথে চলে যায়। শোহেব সব শুনেও এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিল। এবার সে মুখ খুলল। বলল,’এখন আমার বেশ সন্দেহ লাগে। এটা আমার ভাই নাকি তার তথাকথিত আপুর!’

ভূমিকা দু’ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সে শোহেবের কথাবার্তার আগামাথা কিছুই তো বুঝতে পারছে না। লোকটার কি আপনমনে কথা বলার স্বভাব রয়েছে নাকি? শোহেব এবার ভূমির দিকে তাকিয়ে বলল,’ওভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই। কথাগুলো আমি আপনাকেই বলেছি।’
‘কেন বলেছেন?’
‘কেন বলব না?’
‘এখানেও আপনার সমস্যা? আপনার মন এত ছোটো কেন?’
‘আমার মন ছোটো হতে যাবে কেন? আমার মন বিশাল বড়ো। বিশ্বাস না করলে প্রবেশ করে দেখুন।’
‘বিরক্তিকর!’
‘পুরনো কথা শুনতে ভালো লাগে না। নতুন কিছু ট্রাই করুন।’
‘আপনি মস্ত বড়ো একটা ফাজিল।’
‘সবার সামনে না। আপনার সামনে আসলেই কেন জানি ফাজিল হয়ে যাই। কেন বলুন তো?’
ভূমি আর একটা কথাও না বলে হাতে ধরে রাখা ঘড়িটা প্যাক করতে বলে সেলসম্যানকে। শোহেব জিজ্ঞেস করে,’বোবায় ধরেছে নাকি? আচ্ছা এই টপিক বাদ। এটা বলুন যে, আপনি আমায় ফলোটলো করেন নাকি? না মানে, হুটহাট যেখানে যাই সেখানেই চলে আসেন। প্রেমেট্রেমে পড়েননি তো?’
ভূমিকা বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হওয়ার সময় বলল,’এত ফালতু সময় নেই আমার।’
দুজনের ঝগড়া দেখে মেয়ে সেলসম্যানটি এতক্ষণ হাসছিল। ভূমি চলে যেতেই শোহেব সেলসম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল,’আশ্চর্য! মেয়েটা এত কাঠখোট্টা স্বভাবের কেন?’

চলবে…

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
৯৩.
ম্যাপল বাগানে রাসেল আর সুমি হাত ধরে হাঁটছে। পরীক্ষা শেষ সুমির। তাই এখন সে পুরো ফ্রি। বেশিরভাগ সময়টা তার রাসেলের সাথেই কাটানো হয়। হাঁটতে হাঁটতে রাসেল জিজ্ঞেস করে,’তারপর? প্ল্যান কী?’
‘কীসের প্ল্যানিং? ফ্যামিলি প্ল্যানিং? এখনই করব?’ চোখ টিপে বলে সুমি। রাসেল হেসে ফেলে। বলে,’তুমি দিনদিন অনেক দুষ্টু হয়ে যাচ্ছ।’
‘তাই বুঝি?’
‘জি তাই।’
‘তো এখন আমার কী করা উচিত? চুপচাপ হয়ে যাব? তাহলে ভালো লাগবে?’
‘একদম না। তুমি সবসময়ই এমন চঞ্চল থাকবে। আমার তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে।’

সুমি সুন্দর করে হাসে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। পৃথিবীর বুকে নেমে আসতে থাকে ঘনকালো অন্ধকার। কিন্তু তাতে কী? চতুর্দিকের আলোর কাছে এ অন্ধকার যে মূল্যহীন। দুজনে বাড়ির দিকে ফিরছে। রাসেল তখন দাঁড়িয়ে যায়। সুমি জিজ্ঞেস করে,’কী?’
‘একটা কাজ এখনো বাকি।’
সুমি ভ্রুঁ বাঁকিয়ে প্রশ্ন করে,’কী?’
রাসেল পকেট থেকে সেই ডায়মন্ডের রিং টা বের করে বলে,’এটা কিন্তু এখনো তোমার আঙুলে স্থান পায়নি। সেদিন তো একদম তুফানের মতো রেস্টুরেন্ট থেকে চলে গেলে।’

সুমি মাথা নত করে লজ্জিতভাবে হাসে। বলে,’আমি তো শুধু চলে গেছি। অন্য কেউ হলে তোমার মাথা ফাটাত।’
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলে,’রাসেল, অতীতের কথা আমরা না তুলি?’
রাসেলের সুমির ডানগালে আলতো করে হাত রেখে বলে,’অতীত নিয়ে আমরা আর কখনো কথা বলব না। কেমন?’
সুমি রাসেলের হাতটি নিজের হাতে নিয়ে চুমু খায়। রাসেল বলে,’এবার আংটি-টি গ্রহণ করবেন ম্যাম?’
‘ইশ! সেদিন রেস্টুরেন্টে প্রপোজ করা হলো, আর আজ খোলা আকাশের নিচে? এত সাধারণভাবে? কী একটা নরমাল ড্রেস পরে আছি আমি ধুর! আচ্ছা ব্যাপার না। দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকলেই হবে।’ এই বলে, সে হাতটি রাসেলের দিকে এগিয়ে দেয়। রাসেল আংটি-টি পকেটে ঢুকিয়ে নিল। সুমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী হলো?’
রাসেল দু’কদম এগিয়ে যায়। একদম সুমির কাছাকাছি দাঁড়ায়। তার দু’গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,’কাল বিয়ে করবে সুমি?’
সুমির দু’চোখ তখন অশ্রুতে ভরে যায়। সে তৎক্ষণাৎ কোনো কথা বলতে পারে না। মাথা ঝাঁকিয়ে সে জানায়, সে রাজি। কালকের দিনটা হতে যাচ্ছে তাদের সবচেয়ে সুখের দিন।
_______
৯৪.
জারিফদের বড়ো ফ্ল্যাটটিতে এখন লোকে লোকারণ্য। খুব কাছের আত্মীয়-স্বজন ছাড়া এখানে কেউ নেই। তবুও যেন লোকজনে ফ্ল্যাটটি গমগম করছে। ভূমি আর সূচনা সকালেই চলে এসেছে। চাচা-ই ফোন করে বলেছেন। গায়ে হলুদ তো আর আনুষ্ঠানিকভাবে হচ্ছে না। তাই সকালে একটু হলুদ ছোঁয়াবে সবাই মিলে। জারিফের এক খালা হলুদ বেটে এনেছে। ছাদে ছোটোখাটো একটা জটলা। বড়ো যারা আছে তারা সকলে একটু, আধটু হলুদ মাখিয়ে নেমে গেছেন। রান্নাবান্নার কাজ এখনো বাকি পড়ে রয়েছে। ছাদে রয়েছে কাজিনদের গ্যাং। তারা সকলে চেপে ধরে রেখেছে তাকে। জারিফ কঠিন গলায় বলে,’তোদের মতলবটা কি? হলুদ দিয়ে আমায় ভূত বানাবি? খবরদার, বলছি! এ কাজ ভুলেও করবি না।’
জারিফের মামাতো বোন শিমু তখন বলে উঠল,’ইশ! এই সুযোগ আমরা আবার হাতছাড়া করব নাকি?’

কথা বলতে দেরি, কিন্তু হলুদ নিয়ে সবার ঝাঁপিয়ে পড়তে একটুও দেরি হয় না। এ গ্যাং এর সাথে জারিফ একা পেরে ওঠে না। ওর গোবেচারা মুখটা দেখে সূচনা খিলখিল করে হেসে ওঠে। জারিফের দৃষ্টি আলাদাভাবে না চাইতেও সূচনার দিকে আটকে যায়। সূচনার ফোনে কল আসে তখন। সে তৎক্ষণাৎ নিচে নেমে যাওয়ার পর জারিফের দৃষ্টি পূণরায় কাজিন গ্যাং এর দিকে ফিরে আসে।

সূচনা নিচে নেমে দেখে আদিল দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর এখনই আসার কথা ছিল না। দুপুরের দিকে ওদের আসার কথা। তাকে দেখতে পেয়ে আদিল মিষ্টি করে হাসে। তখনই তার গালের টোল ভেসে ওঠে। ভারী সুন্দর দেখায় তখন ছেলেটিকে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদিল বলে,’একটা গিফট্ আছে তোমার জন্য। চোখ বন্ধ করো।’
সূচনা একবার আশেপাশে তাকায়। এখানে সে চোখ বন্ধ করবে? মানুষজন কী ভাববে?
‘কী হলো? বন্ধ করো চোখ।’ বলল আদিল। সূচনা চোখ বন্ধ করে। আদিল বলে,’হাত পাতো।’
সূচনা সংকোচের সাথে হাত পাতে। একটা বক্স টাইপ কিছু সে হাতের তালুতে অনুভব করতে পারে।
‘চোখ খোলো এবার।’
সূচনা চোখ খুলে বিস্মিত হয়। তার হাতে একটি স্মার্ট ফোন। আদিল বলল,’ভাইয়ের বিয়েতে এসেছ, ছবিটবি তুলবে না? তাই এই ফোন তোমার।’
নতুন ফোন পেয়ে সূচনা খুশি হলেও প্রকাশ করতে পারে না। কেমন যেন এক জড়তা তার মধ্যে কাজ করছে। মন করছে দোনামনা। ইচ্ছে করছে ফোনটি ফিরিয়ে দিতে। আদিল বোধ হয় ওর মনের কথাগুলোও পড়তে পারে। তাই সে সূচনার মাথায় হাত রেখে বলে,’সংকোচের কিছু নেই। আমি ভালোবেসে আমার ভালোবাসাকে ছোট্ট উপহারটি দিয়েছি। তুমি খুশিমনে গ্রহণ করলে আমি খুশি হব।’
সূচনার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুঁটে ওঠে। আদিলের বলা কথাগুলোর জন্য নয়। এইযে সে যখন আদুরেভাবে সূচনার মাথায় হাত রাখে, তখন তার ভালো লাগে। শুধু ভালো নয়! ভীষণ ভালো। এমনটা কেন হয়? জানা নেই। তবে, এর রেশ থাকে অনেক অনেকক্ষণ।
দুপুরের দিকে নুসরাতকে নিয়ে চলে আসবে বলে আদিল বাড়িতে চলে যায়। নতুন ফোন নিয়ে সূচনাও খুশিমনে বাড়ির ভেতর আসে।

কিছুক্ষণ বাদে প্রীতির পরিবার এবং কয়েকজন কাছের আত্মীয়জনরা এ বাড়িতে চলে আসে। সঙ্গে আণ্ডাবাচ্চা তো ফ্রি। এখন বাড়িটা আরও বেশি গিজগিজ করছে। বিয়েটা ঘরোয়াভাবে হলেও প্রীতির সাজগোজ করানো হয় পার্লারের লোক দিয়েই। সূচনা আগে যেই রুমটিতে থাকত সেই রুমটিতেই এখন প্রীতিসহ সকল উঠতি এবং তরুণী মেয়েরা তৈরি হচ্ছে। সবার আগে প্রীতিকে সাজানো হয়। বাকি মেয়েদের সাজগোজ শেষ হলে কেউ কেউ ছাদে চলে যায় ছবি তুলতে। কেউ আবার বারান্দায় গিয়ে ছবি তুলছে। সবার শেষে সাজের পালা আসে ভূমিকা আর সূচনার। ভূমিকা হাসিমুখে জানায়,’আমি মেকাপ করব না। আমায় শুধু শাড়িটা পরিয়ে দিন।’

পার্লারের মেয়েটি শাড়ি পরানো শেষ হলে বলে,’মেয়েদের তো সাজগোজ খুব পছন্দ। আপনি সাজতে চাচ্ছেন না কেন?’
ভূমিকা কেমন করে যেন একটু হেসে বলল,’কালো মেয়েদের সাজলে নাকি ভূতের মতো লাগে। ছোটোবেলায় একবার খুব শখ করে ভাইয়ের বিয়েতে সেজেছিলাম। ঠিক তখন একজনের থেকে এমনকিছু কথা শুনলাম যে, এরপর থেকে সাজগোজের প্রতি ভালোবাসা আমার পালিয়েছে। এরপর একটা সময়ে একজন মানুষ আসে আমার জীবনে। খুব অল্প সময়েই মানুষটা আমার প্রিয় থেকে প্রিয়তম হয়ে ওঠে। সে আমায় জানিয়েছিল, তুমি সাজো বা না সাজো চোখে কাজল দিও শুধু। এতেই দেখবে তুমি কতটা অপরূপ, মায়াবী!’
এইটুকু বলে ভূমি হাসে। তার চোখের জমা হয় নোনাজল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,’আমার ছোট্ট পরীটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিন তো।’

কথাটা সে সূচনাকে ইঙ্গিত করে বলেছে। এতক্ষণ পার্লারের দুটি মেয়ে, প্রীতি আর সূচনা নিশ্চুপ হয়ে ভূমির কথা শুনছিল। প্রীতি আর সূচনার বুঝতে একটুও সমস্যা হয়নি, ভূমি কোন প্রিয় মানুষটার কথা এতক্ষণ বলছিল।

ভূমিকা পরেছিল আকাশী রঙের একটা জামদানি শাড়ি। আর সূচনা পরেছে কালো রঙের সুতি শাড়ি। সেও মেকাপ বিশেষ তেমন করেনি। যে দেখতে এমনিতেই এত সুন্দর, তার আবার মেকাপের প্রয়োজন হয় নাকি?
আস্তে আস্তে বাকি লোকজনও চলে আসে। আদিলের বাড়ি সবাই এসেছে। চাচা বেশ যত্নসহকারে তাদের আপ্যায়ন করে বসতে দেন। সকল আত্মীয়-স্বজনদের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেন। আদিল বারবার চোখ ফিরিয়ে শুধু সূচনাকে খুঁজছিল। নুসরাত বুঝতে পেরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,’বউকে খুঁজছ?’
আদিল ধমক দিতে গিয়েও থেমে যায়। ওর মতো করেই ফিসফিস করে বলে,’দেখ তো গিয়ে, কোথায় আছে।’
নুসরাত হাসতে হাসতে উঠে যায় সেখান থেকে। সেই মুহূর্তে ভেতরে প্রবেশ করে শিশির, আসলাম আর শোহেব। আদিল ওদেরকে দেখে অবাক হয়ে যায়। কাছে গিয়ে আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে বলে,’এটা কিন্তু সারপ্রাইজ ছিল।’
শিশির হেসে বলে,’বুঝতে হবে বস! জারিফ ভাইয়া ইনভাইট করে রেখেছিল। তাই বলে কি আর ট্রিট মিস করব? ওটাও নিয়ে ছাড়ব।’
‘তোর পেটুকপনা বন্ধ কর শা*লা।’
শিশির হেসে বলে,’চল জারিফ ভাইয়ার কাছে যাই।’
আদিল ইতিউতি করে অবশেষে জারিফের ঘরে যায়। তার মন যে সূচনাকে দেখার জন্য ছটফট করছে সেটা এদেরকে বোঝাবে কী করে?

চাচি মেয়েদের রুমে এসে দেখেন, প্রীতি, ভূমিকা, সূচনা আর নুসরাত ছাড়া কেউ নেই। পার্লারের দুটি মেয়েও ইতিমধ্যে তাদের কাজ শেষ করে চলে গেছে। চাচি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,’বাকি মেয়েগুলো কোথায়?’
ভূমিকা চুলের খোঁপায় গাজরা গুঁজতে গুঁজতে উত্তর দিল,’সবাই ছাদে গেছে চাচি। কোনো দরকার?’
‘হ্যাঁ, একটু দরকার ছিল। আচ্ছা থাক, আমি অন্য কাউকে পাঠাচ্ছি।’
খোঁপায় গাজরা লাগানো শেষে ভূমি চাচির কাছে এগিয়ে এসে বলল,’আমায় বলো না কী করতে হবে? আমি করে দিচ্ছি।’
‘জারিফের বন্ধু-বান্ধব সবাই এসেছে বুঝেছিস। ওদেরকে কিছু নাস্তা, মিষ্টি এগুলো দিতে হবে। এখন বাড়ির মেহমানদের তো আর এসব বলা যায় না। তোর মা, আমি আর আমার বোনরা তো হেঁশেল সামলিয়েই সময় পাচ্ছি না। বেশি মানুষ হবে না, হবে না করেও কতগুলো মানুষ হয়ে গেল। শেষমেশ তোর চাচা নাকি তার খুব কাছের তিনজন বন্ধুদের দাওয়াত করেছে। তারাও সপরিবারে আসবে। এটা আমায় আলাদা বলবে না আগেই? এখন আবার নতুন করে তাদের জন্যও রান্নার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কতদিক সামলাব বল তো?’

বোঝা যাচ্ছে ছেলের বিয়ের আয়োজন নিয়ে সে খুবই ব্যস্ত। মূলত ঘরোয়াভাবে সবকিছুর ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেই চাচিকে এত ঝামেলা নিজে পোহাতে হচ্ছে। ভূমি অভয় দিয়ে বলল,’আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি। তুমি রান্নাঘরে যাও।’
চাচির সাথে ভূমিও ঘর থেকে বের হয়। ট্রে-তে করে নাস্তা, মিষ্টি, ফলমূল নিয়ে জারিফের ঘরে ঢোকে। ঝটকা খায় শোহেবকে দেখে। এই লোক এখানে কেন? সে তার মনের প্রশ্ন কাউকে বুঝতে দিলো না। এমনকি শোহেবকেও নয়। শোহেবের দিকে মিষ্টির পিরিজ এগিয়ে দেওয়ার সময়ে খেয়াল করে, সে ড্যাবড্যাব করে ভূমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভূমি ইতস্তত করতে থাকে। অন্তত আজকের দিনে, এ বাড়িতে সে কোনো রকম ঝগড়া করতে চাচ্ছে না। সকলকে খাবার দিয়ে ফিরে আসার সময়ে শোহেব তড়িঘড়ি করে বলে,’শুনুন, শুনুন।’
ভূমি থমকে দাঁড়ায়। শোহেব ওর কাছে এসে জারিফের দিকে তাকিয়ে বলে,’জারিফ, তোমার বোনের ফেসটা দেখো। কোনো কমতি দেখতে পাচ্ছ?’
ঘরভর্তি সকলের দৃষ্টি এখন ভূমির দিকে। জারিফ বুঝতে না পেরে বলল,’না, তো!’
‘কী বলো? তোমার আর প্রীতির না লাভ ম্যারেজ? তোমার তো বোঝার কথা ছিল।’
একটু চুপ করে থেকে সে ভূমিকে বলল,’এইযে শিশিরের আপু, চোখে একটু কাজল দিন। কাজলের কমতিটা ভীষণভাবে মুখে ফুটে উঠেছে।’
ভূমির বুকটা ধক করে ওঠে। মনে পড়ে যায় সেই কৃষ্ণমানবটার কথা। সঙ্গে সঙ্গে সে বের হয়ে যায় রুম থেকে। শোহেব একটু বিব্রতবোধ করতে থাকে। জারিফের দিকেই তাকিয়ে বলে,’ভুল কিছু বলে ফেললাম নাকি?’

আদিল তখন ভূমির সাথে কথা বলবে বলে ঘর থেকে বের হয়। ড্রয়িংরুমের সাইডে তখন সূচনাকে অনেকগুলো বাচ্চার সাথে দেখতে পায়। সেও পা টিপে টিপে সকলের দৃষ্টির অগোচরে সেদিকে যায়। হুট করে সূচনা খেয়াল করে অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি পরা একটা সুদর্শন ছেলে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার মনে পড়ে যায় সেদিন রাতে বলা আদিলের কথাটি। বাচ্চাগুলো ছুটে সেখান থেকে ছাদে চলে যায়। এদিকটায় এখন সে আর আদিল একা। সে ভয়ে ঢোক গিলে পিঠময় ছড়িয়ে থাকা খোলা চুলগুলো দ্রুত হাতখোঁপা করে নেয়। এরপর এক প্রকার প্রায় দৌঁড়েই চলে যায় ছাদে। আদিল ওর কাণ্ড দেখে শব্দ করেই হেসে ফেলে।
_____
৯৫.
সকাল থেকে রাসেল ভীষণ ব্যস্ত। একটা রেস্টুরেন্ট সে বুক করেছে বন্ধুদের ট্রিট দেওয়ার জন্য। তার আগে সে সুমির জন্য অনেক কিছু শপিং করে। ফোন করে জেনে নেয়,সুমির কী কী লাগবে। শপিং সুমির বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সে কাজে লেগে পড়ে। এর মাঝে অফিসে একটা ইম্পোর্ট্যান্ট মিটিং থাকায় সেখানেও তাকে সময় দিতে হয়। বিকেলের দিকে সে রেডি হয়ে সেই রেস্টুরেন্টে চলে আসে, যেখানে সুমিকে প্রথমবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। আজ সে আবার এখানেই বিয়ের প্রস্তাব দেবে। তারপর এখান থেকে যাবে বিয়ে করতে। সব কাজ শেষ হলে সে সুমিকে ফোন করে। সুমি জানায়,’কী এক শাড়ি পাঠিয়েছ! পরতেও পারছি না, সামলাতেও পারছি না। ধুর!’
রাসেল হেসে বলে,’সমস্যা নেই। আমি তো আছি।’
‘ফালতু কথা বাদ দাও তো এখন। শাড়ি পরতে দাও।’
‘আচ্ছা তুমি রেডি হও। আমি তোমার বাড়ির সামনে আসছি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

রাসেল ওয়েটারকে বলে যায় এই টেবিলটা যেন ওর জন্যই রাখা হয়। সে সুমিকে পিক করার জন্য রওনা হয়। বাড়ির সামনে গিয়ে কয়েকবার কল দেয়। রিসিভ হচ্ছে না। মেয়েদের সাজগোজ করতে যে এত্ত সময় লাগে! সে অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আবার কল করে। এবার নাম্বার বন্ধ। কেটে দিয়ে আবারও কল করে। এবারও নাম্বারটি বন্ধ বলছে। কী করবে বুঝতে না পেরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। রুমের বাইরে দেখতে পায় তালা লাগানো। তাহলে কি ওর দেরি হচ্ছে বলে সুমি আগেই চলে গেছে? সে রিয়ার নাম্বারে ফোন করে। ওর নাম্বারও বন্ধ বলছে। এবার রাসেলের ভয় হচ্ছে। দুজনের ফোনই অফ। কোনো অঘটন ঘটল নাকি? ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। সে নিচে নেমে আসে। বাড়িওয়ালার দরজায় নক করে। আমেরিকার মধ্যবয়স্কা এক মহিলা দরজা খুলে জিজ্ঞেস করে,’কী চাই?’
‘সুমি আর রিয়া কোথায় গেছে বলতে পারেন?’
‘আপনি কে?’
‘আমি রাসেল।’
মহিলাটি ভেতরে চলে যায়। কিছুক্ষণবাদেই আবার ফিরে আসে। একটা খাম রাসেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,’ওরা চলে গেছে। রাসেল নামে কেউ আসলে এটা দিতে বলেছিল।’

রাসেল খামটি হাতে নিয়ে হতবুদ্ধির ন্যায় কতকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। মহিলাটি দরজা লাগিয়ে দিতেই তার ভ্রম ভাঙে। কাঁপা কাঁপা হাতে সে খামটি খোলে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে সুমির হস্তলিখনী চোখের সামনে ভেসে ওঠে,’স্যরি রাসেল,
আমি তোমায় বিয়ে করতে পারব না। প্রথমদিকে তোমার প্রতি আমার অনুভূতি সত্য থাকলেও পরবর্তীতে তা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে যখন জানতে পারলাম তোমার বিয়ে হয়েছিল। তুমি আমার থেকে এটা লুকিয়ে খুব বড়ো ভুল করেছিলে। আর আমার এত খারাপ সময়ও আসেনি যে, একটা ডিভোর্সি ছেলেকে বিয়ে করতে যাব। এরপরও আমি তোমার সাথে সম্পর্ক রেখেছিলাম শুধু টাকার জন্য। কথাটা শুনতে খারাপ লাগতে পারে, তবে এটাই সত্য। আমার মনে হলো, শেষ সময়টিতে তোমারও সত্যগুলো জানা প্রয়োজন। আর সত্য এটাই যে, তুমি ম্যারিড ছিলে, তোমার ডিভোর্স হয়েছিল এসব জেনেও আমি পরবর্তীতে তোমার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করেছিলাম শুধুমাত্র টাকার জন্য। আমাদের আর্থিক অবস্থাটা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। প্রতি মাসে আমার জন্য টাকা পাঠানোটা বাবা-মায়ের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। আবার পার্ট টাইম জব করে পড়াশোনা করাটাও আমার জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। নিজের জন্য, পড়ার জন্য কোনো সময়ই পাচ্ছিলাম না। অন্যদিকে পড়াশোনা চালানোর জন্য টাকার খুব প্রয়োজন ছিল আমার। ঐ সময়েই তুমি আমার জীবনে এসেছ। পরিচয়ের এক পর্যায়ে আমি তোমায় সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তুমি যেভাবে আমার পাশে থেকেছিলে,কেয়ার করেছিলে, টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলে এরপর আর তোমায় ভালো না বেসে থাকতে পারিনি। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ধাক্কাটা আমি খেয়েছিলাম, যখন আমি তোমার কাছেই জানতে পারলাম তুমি বিবাহিত ছিলে। এসব জানার পর সত্যি সত্যি আমার মন ভেঙে যায়। আমি আবারও আগের জবটা নিই। আবারও সেই পুরনো সমস্যা ফিরে এসেছিল আমার জীবনে। এদিকে আমার ফাইনাল পরীক্ষাও খুব কাছে ছিল। তাই আমি একটা প্ল্যান বানাই। তুমি আমায় ঠকিয়েছিলে মিথ্যে বলে। আমিও তোমায় মিথ্যে বলে ঠকানোর প্ল্যান করলাম। যাকে বলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। তোমার কাছে ফিরে গেলাম আবার। ভালোবাসার অভিনয় করা শুরু করলাম। আসলে সব জানার পর এবং নিজ স্বার্থে আমারও একটু অভিমান করার অভিনয় করতে হয়েছে। আমার কান্না, ভালোবাসি বলা এগুলো কখনোই সিরিয়াস ছিল না। যা হোক, এইটুকু মিথ্যে অভিনয় করার জন্য আমি মন থেকেই দুঃখিত। বাংলাদেশে চলে যাচ্ছি আমি। আমায় খোঁজার বৃথা চেষ্টা করো না। এমনকি বাংলাদেশেও নয়। আমায় পাবে না তুমি। যতক্ষণে তুমি চিঠিটি পাবে, ততক্ষণে আমি তোমার থেকে অনেক দূরে। ধরাছোঁয়ার বাইরে! ভালো থেকো।
ইতি…’

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]