#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____
৯৬.
পায়ের নিচের মাটিকে বড্ড ফাঁকা মনে হচ্ছে রাসেলের। শরীরের শক্তি একটু একটু করে লোপ পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এখনই সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। কোনো রকমে সে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। চিঠির লেখাগুলো পড়েও তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না সুমি তাকে ঠকিয়েছে। তবে কি এটা প্রাঙ্ক? নিশ্চয়ই সুমি মজা করছে। সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। পকেট থেকে ফোন বের করে সুমির নাম্বারে ডায়াল করে। নাম্বারটি এখনো বন্ধ করে। সে রিয়ার নাম্বারে ট্রাই করে। ফলাফল একই। তবে সে হাল ছাড়ে না। ফেসবুকে যায়। সেখানে সুমি কিংবা রিয়া কারোরই আইডি খুঁজে পায় না। ব্লক করেছে নাকি আইডি-ই ডিএক্টিভ তা বোঝার জন্য ফেইক আইডি দিয়ে ওদের আইডি সার্চ করে। কিন্তু অবাক করা বিষয় একজনের আইডিও পাওয়া যাচ্ছে না। সে ইমো এবং হোয়াটসএপে যায়। ব্লক দিয়ে রাখা। হতে পারে একাউন্টও ডিলিট করে দিয়েছে।
রাসেল হতবুদ্ধির মতো কতক্ষণ শূন্যে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। পূণরায় চিঠিটি পড়ে। সে অবাক হচ্ছে। সত্যিই সুমি সবটা প্ল্যান করে করেছিল? এত নিঁখুত প্ল্যান! সে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য এখন এয়ারপোর্ট। কিন্তু সেখানে গিয়েও কোনো লাভ হয় না। খোঁজ নিয়ে জানা যায় আরও ত্রিশ মিনিট আগেই বাংলাদেশের ফ্লাইটটি চলে গেছে। এবার আর রাসেলের হাতে কোনো সুযোগ নেই। সুমি একটা রাস্তাও রাখেনি তার সাথে যোগাযোগ করার। রাসেলের শরীর হালকা হয়ে আসে। দু’চোখের কোটরে টলমল করছে পানি। সে সুমির এ রূপটা মানতে পারছে না। যে জায়গাটিতে সে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে, এই জায়গাটিতেই সেদিন ভূমি চলে যাওয়ার আগে বলে গেছিল,’যেই বিরহের চাদরে আজ আমি নিজেকে জড়িয়ে নিলাম, সেই বিরহের সংস্পর্শে কখনো তোমায় যেন না আসতে হয় দোয়া করি! তুমি সইতে পারবে না।’
কথাটির প্রতিধ্বনি সে চারপাশে শুনতে পাচ্ছে। সত্যিই সে পারছে না এই বিরহ সহ্য করতে। সে পারছে না সুমির বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে। সে কোনো রকমভাবে বাড়িতে ফিরে আসে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে রুমের সবকিছু ভাঙচুর করতে থাকে আর চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। সে কিছুতেই পারছে না তার কষ্টগুলোকে মেনে নিয়ে সহ্য করতে। তাকে লাগছে বদ্ধ উন্মাদের জন্য। যে মানুষটাকে ভালোবেসে সব ছেড়েছে আজ সেই মানুষটাই তাকে ছেড়ে চলে গেল। ধোঁকা দিলো! ওয়ারড্রবের ওপর থেকে ফুলদানি নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারে ড্রেসিংটেবিলের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর আয়নাটি অজস্র কাচের টুকরাতে পরিণত হয়। দু’হাতে মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে চেপে ধরে সে ফ্লোরে বসে পড়ে। তীক্ষ্ণ ফলার মতো কাচের টুকরাগুলো যেন তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। সে একটা কাচ তুলে নিয়ে অগণিত আঘাত করতে থাকে হাতের ওপর।
____
৯৭.
‘তুই কী মাইন্ড গেইমটাই না খেললি!’
সুমি সিটের সাথে মাথা হেলিয়ে বসে ছিল। রিয়ার কথা শুনে ঘাড় বাঁকা করে তার দিকে তাকিয়ে বলে,’এছাড়া আর কোনো উপায় আমার ছিল না। এমনটা তো নয় যে, আমি ওকে ভালোবাসিনি। সত্যিই তো ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু ও আমায় মিথ্যে বলে প্রেমে ফাঁসিয়েছিল। ও বিবাহিত হয়েও বিষয়টা আমার কাছে হাইড করে গেছে। এত সহজে ছেড়ে দেই কী করে বল? তাই নিজের প্রয়োজনে ওকেই ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করেছি। এক কথায়, টিট ফর ট্যাট। তাছাড়া আমার সাথে বিয়ের পর যে, ও নতুন করে এমন করবে না তার গ্যারান্টি কী? আবার এমনও তো হতে পারে, ও আমার থেকে আরও কিছু লুকিয়েছে যা আমি জানি না। সত্যি বলতে কি, আমি আর ওকে বিশ্বাস করার কথা ভাবতেই পারিনি। আমার মধ্যে শুধু তখন প্রতিশোধস্পৃহা এবং নিজ স্বার্থ লুকিয়ে ছিল। তাই বাধ্য হয়েই আমাকে ভালোবাসার অভিনয় করতে হয়েছে।’
রিয়া হেসে বলে,’ব্র্যাভো। যে যেমন, তার সাথে তেমনই করা লাগে। বেচারার কী অবস্থা এখন কে জানে!’
সুমি প্রত্যুত্তরে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। কিছু সময় চুপ করে থেকে বলে,’যা ইচ্ছে হোক। আমার তো কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমেরিকা ত্যাগ করার সাথে সাথে রাসেলের চ্যাপ্টারও সেখানেই ক্লোজড। আর তোকেও থ্যাঙ্কস, আমায় সঙ্গ দিয়ে তোর আইডিগুলো ডিলিট করার জন্য।’
রিয়ার সুমির কাঁধে হাত রেখে বলে,’চিল। আমি সবসময়ই তোর সাথে আছি। তবে যাই বলিস, তুই কিন্তু অভিনয়টা বেশ ভালো করিস। নয়তো বল, একসাথে থেকে আমিই বুঝতে পারলাম না? উলটো তুই যখন ওর কাছে ফিরে গিয়েছিলি তখন আমার অনেক বেশি রাগ হয়েছিল। বারবার ভাবছিলাম এমন নির্বুদ্ধির মতো কাজ তুই কী করে করতে পারিস। আর শেষ সময়টাতে এসে তো এসে দেখি, তুই একদম বাজিমাত করে দিয়েছিস।’
সুমি হাসে। যে হাসিতে রাসেল নামের প্রতারক মানুষটি মুগ্ধ হয়েছিল। প্রেমে পড়েছিল, ভালোবেসেছিল। সুমি বলে,’তোকে আগে জানাইনি, এজন্য আমি স্যরি। আসলে কি, আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইনি। এমনটা নয় যে, আমি তোকে বিশ্বাস করিনি। সাবধানের মার নেই জানিস তো? কোনোভাবে রাসেল আগে থেকে বুঝতে পারলে বা জানলে ঐ ভিনদেশে আমাকে অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হত।’
‘আরে ইয়ার! এত সেন্টি খাচ্ছিস কেন? যা হয়েছে সব অতীত। বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব এখন।’
_____
৯৮.
রেস্টুরেন্টের কর্ণারের টেবিল দখল করে বসেছে শোহেব আর ভূমি। ভূমির চোখে-মুখে ক্লান্তি। অফিস শেষ করে সরাসরি এখানে আসতে হয়েছে। শোহেবকে দেখাচ্ছে অপ্রস্তুত। সে তাকাচ্ছে অপ্রস্তুতভাবে। হাসছে অপ্রস্তুতভাবে। কথা বলার চেষ্টাতেও তার অপ্রস্তুতভাব। ভূমি অবাক না হয়ে পারছে না। এমন দাম্ভিক, নাকউঁচু লোকটার হলো কি হঠাৎ?
চামচ দিয়ে কফি নাড়তে নাড়তে ভূমি জিজ্ঞেস করে,’আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে?’
‘হ্যাঁ, কী? কতক্ষণ? বেশিক্ষণ না।’ শোহেবের কথাবার্তাগুলোও এলোমেলো। ভূমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। শোহেব হাসার চেষ্টা করে বলে,’কফি খাচ্ছেন না কেন? কফি খান।’
‘আপনি খান।’
‘ও হ্যাঁ’ বলে কাপে চুমুক দেয় শোহেব। সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে কফি ফেলতে গিয়েও বহু কষ্টে গিলে ফেলে। ভূমি বিস্মিতকণ্ঠে বলে,’আশ্চর্য! বলেছি বলে গরম কফিই পান করবেন?’
‘ইয়ে মানে! স্যরি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’
‘আপনি কে বলুন তো?’
শোহেব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকায়। আশেপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিজের দিকে আঙুল তাক করে প্রশ্ন করে,’কথাটা আমাকেই জিজ্ঞেস করেছেন?’
ভূমি বিরক্ত হয়ে বলে,’এ টেবিলে আপনি আর আমি ছাড়া তো কাউকে দেখছি না।’
শোহেব অসহায়ের মতো করে বলল,’আপনি কি আমাকে পাবলিক প্লেসে মাইর খাওয়ানোর চিন্তা-ভাবনা করে এসেছেন? অচেনার ভান করছেন কেন?’
‘আমি আসলে আমার সামনে বসা লোকটিকে ঠিক চিনতে পারছি না। আমি যাকে চিনতাম সে এত ভীতু, অপ্রস্তুত, বোকা স্বভাবের ছিল না। আমি দাম্ভিক, অহংকারি, নাকউঁচু, ঠোঁটকাটা, ঝগড়াটে স্বভাবের শোহেবকে চিনতাম।’
শোহেব অসহায়ভাবে তাকায়। ভূমির মনে নিজের সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ আছে জানতে পেরে কষ্ট কষ্ট অনুভব হয়। অবশ্য খুব একটা ভুলও তো বলেনি তাই না? মনে মনে নিজেকে বুঝ দিয়ে পূর্বের অপ্রস্তুত হাসিটা আবার ঠোঁটে ফিরিয়ে আনে। কথা বলার একটা টপিক পেয়েছে, তাই সে মনে মনে ভূমিকে ধন্যবাদ দেয়। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,’এতদিন আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। এজন্যই স্যরি বলতে এখানে আসতে বলেছি।’
ভূমি বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়। শোহেব বুঝতে পেরে বলে,’অবিশ্বাস করছেন নাকি?’
‘না। তারপর বলুন।’
‘আমরা একটা শান্তিচুক্তি করি?’
‘মানে কী?’
‘না, থাক। কিছু না। আপনার জন্য ছোট্ট একটা উপহার এনেছি।’
‘দুঃখিত। নিতে পারব না।’
‘প্লিজ! দেখুন তো।’ এই বলে শোহেব যে পাশে বসেছিল ওখান থেকে বড়ো একটা প্যাকেট বের করে। ভূমি জিজ্ঞেস করে,’কী আছে এখানে?’
‘দেখুন নিজেই। দয়া করে ফিরিয়ে দিবেন না। যদি উপহারগুলো গ্রহণ করেন তাহলে বুঝব, এতদিনের ব্যবহারের জন্য আমায় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’
ভূমি এক পলক তাকিয়ে প্যাকেটটি খুলে। র্যাপিং খোলার পর দেখতে পায় ১০টা বই আর একটা হলুদ ডায়েরী। ভূমি অবাক হয়ে বলল,’এসব কেন?’
‘পছন্দ হয়েছে?’
ভূমি একটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। শোহেব ভয়ে ভয়ে বলে,’গ্রহণ করবেন তো?’
শোহেবের ইনোসেন্ট লুক দেখে ভূমি হেসে ফেলে। বলে,’জি।’
‘থ্যাঙ্কিউ সো মাচ শিশিরের আপু।’
ভূমি ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। শোহেব জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে,’ইশ! স্যরি। আবার বলছি দাঁড়ান। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ বমি।’
ভূমি চোখ পাকিয়ে তাকায়। শোহেব জিজ্ঞেস করে,’কী হলো? চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে বানিয়ে তাকিয়ে আছেন কেন?’
‘বমি মানে কী?’
শোহেব আবার জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,’ওপস! স্যরি। ভূমি।’
‘আপনি ঝগড়া ছাড়তে পারবেন না।’
‘না, সত্যি। পারব। আসলে আপনার হাসিটা অনেক সুন্দর। আরেকবার যেন হাসিটা দেখতে পাই তাই মজা করে বললাম।’
‘ফ্লার্টিং?’
‘নাউজুবিল্লাহ্! অসম্ভব।’
শোহেবের রিয়াকশনে ভূমি খিলখিল করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে,’এবার বলুন। আসল কথা কী?’
‘আসল কথা মানে কী?’
‘আপনি শুধু স্যরি বলতে আসেননি। অন্য কোনো কথা বলতে এসেছেন।’
‘মন পড়তে পারেন?’
‘না। মনে হলো এমনি।’
‘আপনার মনে হওয়া সঠিক।’
ভূমি মনোযোগ সহকারে একটা বই পড়ছিল। শোহেব চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। মৌনতা ভেঙে বলে,’আসলে আমি নিজের মধ্যে আর কথাটা চেপে রাখতে পারছিলাম না বলেই সরাসরি আপনাকে বলতে এসেছি।’
আবার নিরবতা। ভূমির দৃষ্টি তখনও বইয়ের পাতায়। শোহেব বলল,’আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।’
ভূমি একটুও চমকাল না। যেন সে আগে থেকেই বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছিল। বইটা বন্ধ করে শোহেবের দিকে তাকায়। চোখে চোখ রেখে বলে,’আপনি জানেন, আমি ডিভোর্সি?’
শোহেবের দ্বিধান্বিত মুখটার রঙ পাল্টে যায় মুহূর্তেই।
_______
৯৯.
চারদিকে অন্ধকার। মানুষজনের আনাগোনা নেহাৎ-ই কম নয়। অফিস ছুটি হয় এ সময়টাতে। তাই সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। সূচনা প্রাইভেট শেষ করে ডাক্তারের দোকানে এসেছে। ফাতেমার জন্য কিছু ওষুধ নিতে হবে। সে ডাক্তারের দিকে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দেয়। অপেক্ষা করতে করতে নখ খুঁটতে খুঁটতে থাকে। ওষুধ নিয়ে টাকা দিয়ে ফিরে আসার সময়ে আচমকা থমকে যায়। চোখের ভুল ভাবে কিছুক্ষণ। সন্দেহবশত সেদিকে এগিয়ে যায়। না, সে ভুল নয়। ছেলেটি জয়। সে ডাকতে গিয়েও থমকে যায়। বিধাতা তো তাকে কথা বলার সামর্থ্য দেননি। সে প্রাণপনে ছুটতে থাকে। মানুষের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে এগোতে থাকে সামনের দিকে।
মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে সূচনা। চারদিকে এত মানুষ। সে কোনদিকে যাবে। কোথায় গেল জয়? সে দেখতে পায় অদূরে জয় একটা শপিংমল থেকে বের হচ্ছে। সূচনা আবারও দৌঁড়ে সেদিকে যেতে থাকে। তার চিৎকার করে জয়কে ডাকতে ইচ্ছে করছে। আল্লাহ্’র কাছে একটাবার চাইতে ইচ্ছে করছে, একটাবার যেন আল্লাহ্ তাকে কথা বলার শক্তি দেন। একটাবার যেন সে জয়কে নাম ধরে ডাকতে পারে। কিন্তু হায়! এই ইচ্ছে কি আর পূরণযোগ্য? হ্যাঁ, সূচনার এ মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়নি। এমনকি সে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে ফেলে জয়কে। আজ অনেকদিন বাদে সে জয়কে দেখতে পেয়ে নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কেন জয় তাকে এভাবে ফেলে চলে গেছিল? তার যে অনেক কিছু জানার আছে। সে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বসে পড়ে। অসহায়ের মতো কাঁদতে কাঁদতে রাস্তার এদিক-ওদিক তাকায়। কী নিঃস্ব দেখাচ্ছে পরীর মতো ক্রন্দনরত সুন্দর মেয়েটিকে। কী দরকার ছিল এতগুলো দিন বাদে এভাবে সেই ছেলেটিকে সামনে আনার?
সূচনা কাঁদতে কাঁদতে লক্ষ্য করে তার সামনে একজন আগুন্তুক হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে হাতের দিকে আগে লক্ষ্য করে চোখ তুলে মুখের দিকে তাকায়।
চলবে…
#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_৩৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________
১০০.
সম্মুখে হঠাৎ উদীয়মান লোকটিকে দেখে অজানা এক কারণে সংকুচিত হয়ে পড়ছে সূচনা। তার নেত্রপল্লবদ্বয় তখনও ছিল জলে টইটুম্বুর। ঠোঁট দুটো কাঁপছিল ঈষৎ। সামনের লোকটি চাপাস্বরে বলল,’কী হলো? ওঠো। মানুষ দেখছে।’
দু’চোখের কোটর থেকে আরও কয়েক ফোঁটা জল উপচে পড়ার পর সূচনা শোহেবের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে কিয়ৎক্ষণ। শোহেব অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে বলল,’চলো তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেই।’
সূচনা ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ কিছুই বলল না। তার চুপ থাকাটাকেই শোহেব সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সূচনাও তাকে নিরবে অনুসরণ করে গাড়িতে গিয়ে বসে। শোহেব স্টিয়ারিং সিটে বসার পর আড়চোখে পাশে বসে থাকা সূচনাকে লক্ষ্য করে। মেয়েটার হাতে আধছেঁড়া কাগজের একটা প্যাকেট। ছেঁড়া অংশ দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ওষুধপত্র। সে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। ঐ বাড়িতে যেতেও প্রচণ্ড রকম সংকোচ তার হচ্ছে। তবে পথিমধ্যে এভাবে সূচনাকে সে একা তো ফেলে যেতে পারে না। এমন তো নয় যে, সে শুধু ভূমিকারই বোন! সে তার ভাইয়ের বন্ধুর হবু বউ। তার নিজেরও তো এহেন পরিস্থিতিতে একটা দায়িত্ব রয়েছে। গাড়িতে আর কোনো কথা না বলে শুধু একটা পানির বোতল এগিয়ে দেয় সে। সূচনা পানি পান করল না। হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। দৃষ্টি তার গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে।
বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেয় ভূমিকা। শোহেবকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। একইভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে শোহেবও। তবে সে কিছু এক্সপ্লেইন করার আগেই ভূমিকার দৃষ্টি পড়ে লম্বা মানুষটার পাশে কাচুমুচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সূচনার দিকে। সে আতঙ্কিতস্বরে জিজ্ঞেস করল,’কী হয়েছে তোর?’
শোহেব শান্তকণ্ঠে বলল,’আস্তে! এভাবে জিজ্ঞেস করে কেউ? আগে ওকে ভেতরে যেতে দিন।’
ভূমি সূচনাকে নিয়ে অস্থির ও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে ভেতরে নিয়ে যায়। এদিকে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে শোহেব। সে বুঝতে পারছে না, ভেতরে যাবে নাকি যাবে না। সে সময়ে তাকে অস্বস্তিকর পরিস্থতি থেকে রক্ষা করে ফাতেমা খালামনি। তিনি বললেন,’আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।’
শোহেব গোপন একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ভেতরে গিয়ে বসে। বাড়ির সব মানুষ আছে একটা ঘরে, যেখানে সূচনা রয়েছে। আর সে একা বসে রয়েছে ড্রয়িংরুমে। আনমনে যখন ফোন চাপছিল ভূমি তখন এসে ক্ষিপ্তস্বরে জিজ্ঞেস করে,’সূচনার কী হয়েছে? ও কাঁদছে কেন এভাবে?’
শোহেব আরও বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,’আমি কিছুই জানি না। রেস্টুরেন্ট থেকে বাড়ির ফেরার পথে দেখি, সূচনা শপিংমলের সামনে বসে কাঁদছে। সেখান থেকেই আমি ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি।’
ভূমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,’বুঝতে পারছি না, হঠাৎ কী হলো। কেউ কিছু বলেছে কিনা তাও বলছে না।’
‘আপনি চিন্তা করবেন না। আগে ওকে একটু শান্ত হতে সময় দিন।’
ভূমি বলে,’আপনি আদিলকে আগেই কিছু জানিয়েন না।’
শোহেব অপরাধীর মতো কয়েক সেকেন্ডে তাকিয়ে থাকে। অপরাধীর মতো করে বলে,’আমি অলরেডি আদিলকে টেক্সট করে জানিয়ে দিয়েছি। আপনি রাগ করবেন না প্লিজ! আমার মনে হয়েছিল এ সময়টাতে সূচনার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আদিলকে।’
ভূমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কলিংবেলের শব্দ শুনেই বুঝতে পারে দরজার ওপাশে থাকা লোকটি আদিল ছাড়া অন্য কেউ নয়। হলোও তাই!
আদিল পাগলের মতো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। ভূমিকে দেখেই উতলা হয়ে জিজ্ঞাস করল,’সূচনা কোথায় আপু? ওর কী হয়েছে?’
‘ঘরেই আছে। কী হয়েছে কিছুই বলছে না।’
আদিল রুমে প্রবেশ করে দেখে সূচনা চুপচাপ বসে থাকে। নিশ্চুপে ফেলছে চোখের পানি। আদিলকে দেখা মাত্রই সে এক কোন জবুথবু হয়ে বসে থাকে। আদিল কথা বলতে চাইলে সূচনা সরে যায়। সুখী তখন বলে,’সবাই পরে কথা বলো আপুর সাথে। আপুকে আগে কিছু সময় দাও।’
সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আদিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিঃশব্দে সেও বের হয়ে যায়। সুখী সূচনাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,’এখন আমায় বলো তো আপু, কী হয়েছে?’
সূচনা চুপ করেই থাকে। সুখী হাল ছাড়ে না। পূণরায় জিজ্ঞেস করে। এক সময় সূচনা খাতায় সব লিখে। সুখী পড়ে বলে,’কী বলছ! এটা কীভাবে সম্ভব? এতগুলো দিন বাদে সে কেন আসবে?’ সুখীর কণ্ঠে বিস্ময়ের শেষ নেই। সূচনা তখনো নিরব। সুখী নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,’আপু, আমার মনে হচ্ছে তুমি ভুল দেখেছ।’
সূচনা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। সে মানতে নারাজ। ভূমি আড়ালেই ছিল। সে সুখীর কথা তো শুনেছে, তবে বুঝেনি কিছুই। অবশেষে ভেতরে এসে খাতার লেখাটুকু পড়ে কাঠ কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করে,’এসব কী? জয় কে?’
সুখী ঠোক গিলে ভয়ে। ভূমি পূণরায় জিজ্ঞেস করে,’জয় কে সুখী?’
সুখী ভয়ে ভয়ে সূচনার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। ভূমি ওকে আর কিছু না বলে ফাতেমা আর সাথীকে এ ঘরে ডেকে নিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,’তোমরা জয়কে চেনো?’
দুজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সূচনার দিকে তাকায়। খালামনি জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
ভূমি খাতাটি এগিয়ে দেয়। লেখা পড়ে ফাতেমা এবং সাথীও অবাক। ভূমির থেকে ওরা আর কিছু লুকায় না। শুরু থেকে সবটাই জানায়। আর সব শুনে ভূমি বিস্ময়ে ‘থ’ বনে যায়। তৎক্ষণাৎ কথা বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলে। মাঝখানে সূচনার এত পরিবর্তন কি তবে এ কারণেই? সে কীভাবে বোনের সাথে কথা শুরু করবে বুঝতেই পারছে না।
সে গিয়ে সূচনার পাশে বসে। দু’বাহুতে হাত রেখে বলে,’তুই কি অবুঝ সূচনা? জেনেশুনে কেন ভুল পথে আগাচ্ছিস? তুই জানিস না তুই একজনের বাগদত্তা? তারচেয়েও বড়ো কথা হচ্ছে জয় ছেলেটা তোর জন্য নিষিদ্ধ। কখনোই তোরা এক হতে পারবি না। এমনও তো নয়, সে তোকে ভালোবাসে। ভালোবাসলে নিশ্চয়ই এভাবে চলে যেত না? নিজের মনকে বাঁধ সূচনা। আদিলের কথা ভাব। ছেলেটা তোকে অনেক বেশি ভালোবাসে। তুই ওকে একটু ভালোবাসার চেষ্টা কর। তুই পারবি। জয় তোর একপাক্ষিক ভালোবাসা। তুই চাইলেই ওকে ভুলতে পারবি।’
সূচনা এবার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে পূণরায় কেঁদে ফেলে। সে তো কতবার চেষ্টা করেছে জয়কে ভুলে গিয়ে আদিলকে ভালোবাসার। জয়কে সে পুরোপুরি ভুলতে পারেনি, আবার আদিলকেও সে ভালোবাসতে পারেনি। আজ এতদিন বাদে জয়কে দেখতে পেয়ে পুরনো ঘা আবার দগদগে হয়ে উঠেছে। সে কী করে সবাইকে বোঝাবে, মনকে নিয়ন্ত্রণে আনা এত সহজ নয়। সে তো চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। সে পারছে না। তবুও তার বিশ্বাস ছিল বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার পর ঠিকই একটা না একটা সময়ে আদিলকে ভালোবেসে ফেলবে। কিন্তু ঐযে পুরনো অতীত! পিছু ছাড়ছে না।
সূচনাকে নিরব-নিশ্চুপ দেখে আপাতত আর কেউ কোনো কথা বাড়ায় না। পুরোপুরি শান্ত হলে তখন বুঝিয়ে বলা যাবে। তাই সবাই ওকে একা থাকতে দিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে যায়। মায়ের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ভূমিকা সকলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,’চিন্তা কোরো না। শান্ত হলে তখন ওর সাথে আমি কথা বলব।’
আদিল তবুও নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। উশখুশ করছিল। সে শোহেবকে নিয়ে অনেকক্ষণ ওদের বাড়িতে থাকে। শোহেবের মন ছিল দোটানায়। এক তো সে চাচ্ছিল এখান থেকে চলে যেতে। দ্বিতীয়ত মন বলছিল ভূমিকে দেখার লোভে আরও কিছুক্ষণ থেকে যেতে। ঘণ্টাখানেক পর চলে যাওয়ার সময়ে বহু কষ্টে আদিল ভূমিকাকে বলে,’সূচনাকে একবার দেখে যাই আপু?’
ভূমি সরল হাসে। বলে,’যাও।’
আদিল ঘরে গিয়ে দেখতে পায়, সূচনা গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছে। সে নিঃশব্দে পাশে বসে। আদুরে হাতে আলতো করে সূচনার চুলের মাঝে বিলি কেটে বলে,’মিষ্টিপরী কেঁদো না প্লিজ! ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।’
______
১০১.
গভীর রাত। চারদিকে ঘনকালো অন্ধকার। কোথাও কোনো মানুষজন নেই। হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার মোড়ে থাকা নেড়ি কুকুরগুলো উচ্চশব্দে ডেকে উঠছে। ভূমিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে বারান্দার গ্রিল ধরে। দৃষ্টি তার অস্পষ্ট আকাশের দিকে। আজ আকাশে নেই চাঁদ। এমনকি নেই একটাও তারা। সে ভাবছে সূচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভীষণ চিন্তিতও আছে। আদিলকে তার খারাপ মনে হয় না। তবে প্রথমদিকে কেই বা তার আসল রূপ দেখায়? যদিচ তার বিশ্বাস এখন ভঙ্গুরের ন্যায়, তথাপি মন আদিলকে বিশ্বাস করতে চায়। মনেপ্রাণে চায় সূচনা আদিলকে মেনে নিক।
সে এবার দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। শোহেবের কথা মনে পড়ছে। সে মানুষটা কেমন যেন ভীষণ অদ্ভুত স্বভাবের। ভূমি যে ডিভোর্সী এটা শুনে একটুও বিস্মিত হয়নি। উলটো ভূমিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। একবার তো সে ভেবেই নিয়েছিল শোহেব সব জানে। কিন্তু পরক্ষণে শিওর হয়েছিল, সে আসলে ভূমির ব্যাপারে কিছু জানতোই না। ভূমি যখন বলল,’আপনি জানেন, আমি যে ডিভোর্সী?’
সে সময়ে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে শোহেব হো হো শব্দ করে হেসে উঠেছিল। কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলেছিল,’আপনি যেভাবে ডিভোর্সি কথাটা বললেন, আমার তো মনে হচ্ছিল খুনের আসামীও এভাবে কথা বলবে না। শুনেন, ডিভোর্স কোনো ক্রাইম নয়। বনিবনা হয়নি। অথবা এমনটা হওয়ার ছিল বলেই হয়তো হয়েছে। তাছাড়া চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমি অতীত নিয়ে কখনো টানাটানি করব না।’
‘আপনি স্বাভাবিকভাবে দেখলেও সমাজ দেখে না। এরপরও কেন ভালোবাসেন?’
‘ভালোবাসার কোনো কারণ থাকে না। মানুষ অকারণেই যখন কাউকে ভালোবাসে সেটাই হয় সত্যিকারের ভালোবাসা।’
‘আমার প্রাক্তন স্বামীও কিন্তু আমায় অকারণেই ভালোবেসেছিল। পরবর্তীতে অবশ্য সে এই ভালোবাসার নাম দিয়েছিল মোহ।’
‘হাতের পাঁচটা আঙুল কিন্তু সমান নয় ভূমি।’
‘আমি ভালোবাসা, বিয়ে এসবে আর বিশ্বাস করি না।’
‘স্বাভাবিক। তবে সুযোগ দিতে ক্ষতি কী?’
‘ভয়! ভয় পাই আমি সম্পর্ককে। একবার ভেঙে উঠে দাঁড়াতে পারলেও দ্বিতীয়বার আর পারব না।’
ভূমির কথার পিঠে শোহেব আর কিছুই বলেনি। এরপর আর তারা বেশিক্ষণ রেস্টুরেন্টে ছিলও না। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে দুজনে দু’পথে চলে গিয়েছিল।
______
১০২.
দু’দিন হবে রাসেল বাড়ি থেকে কোথাও বের হয়নি। অফিসেও যায়নি। কলিগ, ফ্রেন্ড, অফিসের বস সকলে কতবার কল দিয়েছে হিসাব নেই। রাসেল কারও সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করেনি। ফোনই বন্ধ করে রেখেছে। এরকম করলে চাকরী থাকবে নাকি সেটাও তার জানা নেই। তবে তার যেই মানসিকতা বর্তমানে, সে ভালো-মন্দ কোনো কিছুই আর ভাবতে পারছে না।
ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকানোর পর ভূমির কথা মনে পড়ে। মনে হচ্ছে একই ঘটনাগুলোর পূণরাবৃত্তি ঘটছে। যা যা ভূমির সাথে হয়েছিল, তাই-ই যেন চক্রাকারভাবে তার সাথেও হচ্ছে। একেই কি বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ? প্রকৃতির প্রতিশোধ বলতেও কিছু হয় নাকি? রাসেলের জানা নেই। তবে মন বলছে, এসব হয়তো তার কৃতকর্মেরই ফল। তার মানসিক ভারসাম্য নিম্ন কোঠায়। সে কোণঠাসা হয়ে রয়েছে বাড়ির এক কোণে। আচ্ছা ভূমিও কি ঐ সময়গুলোতে এরকমভাবেই কোণঘেঁষা হয়ে ছিল? ওরও কি এরকম কষ্ট হচ্ছিল? নাকি এরচেয়েও বেশি?
রাসেল বিছানায় শুয়ে পড়ে। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে নিরবে। ভূমি তো তাকে হঠাৎ দেখতে পারত, কিন্তু রাসেল! সে তো চাইলেও কখনো সুমিকে দেখতে পারবে না। অস্থিরতায় তার মাথার রগ ছিঁড়ে যাওয়ার জোগার। সে শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। সুমির কথার সাথে বারবার কেন তার ভূমির কথাও মনে পড়ছে? এসব তার পাপ আর অন্যায়ের ফল বলে?
রাসেল সিদ্ধান্ত নেয় সে লিন্ডার কাছে যাবে। এসময়ে তার এমন একজনকে প্রয়োজন যে তাকে বুঝবে, সময় দেবে। এসব ক্রাইসিস থেকে বের হতে সাহায্য করবে। সে ভাঙা মন নিয়ে যায় লিন্ডার বাড়িতে।
রাসেলকে দেখে লিন্ডা অবাক হয়ে যায়। আগের চাকরীটা ছেড়ে দেওয়াতে রাসেলের সাথে তার যোগাযোগ নেই অনেকদিন হবে। তার এমন করুণ অবস্থা দেখে লিন্ডা হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এরপর ভেতরে এসে বসতে বলে। হাত ব্যান্ডেজ করা দেখে জিজ্ঞেস করে,’তোমার হাতে কী হয়েছে?’
রাসেল দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে সব বলে। সুমির বিষয়টা লিন্ডা জানলেও; ভূমির বাংলাদেশে চলে যাওয়া,রাসেলের সাথে ভূমির ডিভোর্স, সুমির প্রতারণা এসব শুনে সে অবাক না হয়ে পারল না। শেষে রাসেল লিন্ডার হাত ধরে অনুরোধ করে বলে,’আমার ফ্রেন্ড হয়ে আমার পাশে থাকবে লিন্ডা? আমায় সময় দেবে? থাকবে আগের মতো?’
লিন্ডা হাত সরিয়ে দেয়। অপমান করে বলে,’এখন কেন এসেছ আমার কাছে? আমি তোমার প্রয়োজন? তোমার কি ধারণা আমি তোমায় গ্রহণ করব? নেভার! আমি ভুলে যাইনি, তুমি আমায় কীভাবে অপমান করেছ! বউয়ের প্রতি খুব ভালোবাসা না তোমার? সে রাতে তো খুব সাধু সেজেছিলে, তাহলে এখন কোথায় গেল সেই পবিত্রতা? মন পাল্টে গেল কেন বলো? লিসেন রাসেল, সে রাতে যখন তুমি আমায় প্রত্যাখান করো তখন আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল। আমি কষ্টও পেয়েছিলাম অনেক। কিন্তু পরেরদিন সকালে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম, আমাদের আমেরিকানদের কাছে ইন্টিমেট হওয়াটা স্বাভাবিক হলেও, তোমাদের বাঙালিদের কাছে বিষয়টা অনেক বড়ো। এছাড়া তুমি সবসময়ই বলতে, তুমি ভূমিকে অনেক ভালোবাসো। তোমার এই পার্সোনালিটি আমার ভালো লেগেছিল। কেননা ঐ সময়টাতে তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে, ঠিকই আমার সাথে ইন্টিমেট হতো। যা হোক, এত কথা বললাম এজন্যই যে, তোমার প্রতি যতটুকু শ্রদ্ধা আমার ছিল সেটা আর অবশিষ্ট নেই। তুমি হাজবেন্ড, বয়ফ্রেন্ড তো দূরে থাক; বন্ধু হওয়ারও যোগ্য নও।’
কথাগুলো বলে লিন্ডা রাসেলকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]