বিরহ বীণার সুর (৪)
ইলমা বেহরোজ
আমার চোখ দুটো বর্ষার দিনের প্রশান্ত পুকুরের মতো টলটলে জলে ভরে গেল। দুই চোখ ভর্তি অভিমান নিয়ে বললাম, ‘তাহলে সব দোষ আমার? আমি কি কিছুই দিইনি তোমাকে? শুধু কষ্ট আর যন্ত্রণা দিয়েছি? এত নিষ্ঠুর ছিলাম আমি?’
বুকের গভীরে যেন কোনো অদৃশ্য হাত এক পাহাড়সম ভার চাপিয়ে দিয়েছিল। শ্বাস টানতে গিয়ে বারবার দম আটকে আসছিল, যেন ফুসফুস দুটো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। মস্তিষ্কের ভেতর সমস্ত চিন্তাভাবনা একসাথে তোলপাড় করতে করতে তৈমুর যা যা বলেছে সবই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল চেতনার পর্দায়। কোনো রকম বিকৃতি বা ভুল ব্যাখ্যা ছাড়াই। সবটুকুই ছিল নিরেট সত্য, কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেই। তাহলে এতদিন নিজেকে নির্দোষ ভেবে এসেছিলাম কীভাবে?
কেউই নিজের ভুল মুখের ওপর শুনতে চায় না, আমিও না। অন্তরে একটা গুমরে থাকা রাগ চিড়বিড় করে উঠছিল। একইসাথে তৈমুরের ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে মনটাও টাল খেয়ে যাচ্ছিল। অনুশোচনার কাঁটা হৃদয়ে খোঁচা দিয়ে যেন বলছিল, ‘তুইও তো দোষী… তুইও অপরাধ করেছিস।’
তৈমুর আমার চোখের জল দেখে অস্থির হয়ে কাছে এসে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ‘ভুল ভাবছো। যে ভালোবাসা তুমি আমাকে দিয়েছো, সেটা শুধু রেয়ার না, এক্সট্রা-অর্ডিনারি। এমন ভালোবাসা, এমন যত্ন হাজারে একজনও দিতে পারে না। তোমাকে পেয়ে আমি কতটা সৌভাগ্যবান, জানো তুমি? আমার জন্য রাঁধতে গিয়ে প্রথমবার রান্নাঘরে ঢুকে হাত পুড়িয়ে ফেলেছিলে। সেই দাগ এখনো রয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে একটু খারাপ কথা বলায় নিজের মামার বাড়িতে চার বছর পর্যন্ত যাওনি। শুধু আমাকে পাবার জন্য দিনের পর দিন নিজের বাবার সঙ্গে কথা বলোনি। এসব কী করে ভুলে থাকি? তারপর করোনা মহামারির সময়, আমি হাসপাতালে মৃত্যুর দোরগোড়ায়। যখন কেউ আমার পাশে দাঁড়াতে সাহস করেনি, তখন তুমি আমার পাশে দাঁড়ালে, আমার গায়ে হাত রাখলে, আমার সঙ্গে শুয়ে থাকলে…জানতে তুমি নিজেও ইনফেকটেড হতে পারো, তবুও আমাকে একা হতে দাওনি। হাসপাতাল জুড়ে তোমার আর্তনাদ, তোমার চিৎকার আজও কানে বাজে। তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমার ভেতরের যোদ্ধাটাকে জাগিয়ে তুলেছিলে। তাইতো বেঁচে গিয়েছিলাম।
তুমি রাগ করো, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নাও, কখনো কখনো দিনের পর দিন কথা বলো না। কিন্তু কখনো রান্না বন্ধ করোনি। প্রতিদিন আমার পছন্দের খাবার বানিয়ে রেখেছো। জানো তো, আমার ক্ষুধা সহ্য হয় না! রাগ থাকলেও আমার যত্ন নিতে ভুলে যাওনি কখনো। কতজন পারে এমন মমতায় জড়িয়ে রাখতে? মানুষ ভুল করে, অলকা। আমিও করেছি, তুমিও করো। কেউই নিখুঁত না। সেই ত্রুটিগুলোকে মেনে নিতে পারলেই সম্পর্ক গ্রো করে। প্রেম গভীর হয়। শুধু মাঝেমধ্যে নিজেদের আয়নায় তাকাতে হবে, একটু সংশোধন করে নিতে হবে। এইটুকুই তো।’
আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমার দায় ছিল, এই তিক্ত, কঠিন সত্যটা মানতে পারছিলাম না। মুছে ফেলতে পারছিলাম না থাপ্পড়গুলোর অপমানজনক স্মৃতি। দগদগে ঘায়ের মতো সেই দৃশ্যগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
অন্যদিকে, এত অন্যায় করেছি তবুও তৈমুর আমার ভালোবাসার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ত্যাগের কথা স্মরণ রেখেছে! সেই ভাবনা থেকে একটা তীব্র ব্যর্থতাবোধ জন্মাল অন্তরে। একটা গভীর আত্মগ্লানি পেয়ে বসল। ও পেরেছে, আমি কেন পারিনি ওর ভালো দিকগুলো মনে রাখতে? ওর প্রতিটি স্নেহ, প্রতিটি যত্ন? তাহলে কি ও বেশি ভালোবেসেছে? বেশি সহনশীল ছিল এই সম্পর্কে? বেশি পরিণত ছিল আমার চেয়ে? আর আমি? আমি কেবল ঝড় বইয়ে দিয়েছি। আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি সবটুকু। ধ্বংস করেছি আমাদের সাজানো-গোছানো সংসার। অন্তরে একসাথে জেদ, রাগ, অভিমান, অহংকার আর অনুশোচনার তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গেল। মাথা ঝিমঝিম করছিল। চারপাশে সব ঘুরে যাচ্ছিল। আবেগের উত্তাল সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, কোনটা ধরে রাখব, কোনটা ছেড়ে দেব? কোনটাকে ক্ষমা করব, কোনটাকে প্রতিরোধ করব?
নিজের অজান্তেই পুরনো ক্ষতগুলো টেনে এনে বললাম, ‘এতো ভালোবাসো তাহলে আমার গায়ে হাত তুললে কী করে? আর আমিই বা কীভাবে ওরকম ভাষায় অপমান করলাম তোমাকে? আমরা আসলে একজন আরেকজনের অভ্যাস ছিলাম। প্রকৃত ভালোবাসা হয়তো আমাদের মধ্যে ছিলই না। নইলে এভাবে আমাদের সম্পর্কে দাগ লাগত? লাগত না। আমাদের সম্পর্কে কালি লেগে গেছে, দাগ হয়ে গেছে।’
তৈমুর ধীরে ধীরে সামনে এলো। হাঁটুগেড়ে বসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। কেঁপে উঠলাম আমি। পেটের ভেতর তীব্র এক অনুভূতির স্রোত গড়িয়ে গেল। ও ভগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘প্রতিদিন নিজেকে এই প্রশ্ন করেছি- কী করে আমি তোমাকে আঘাত করতে পারলাম! কী করে আমার হাত উঠতে পারল তোমার গায়ে! সব অপরাধ আমার। তুমি যাই বলো, যাই করো আমার ধৈর্য ধরা উচিত ছিল। চেয়েছিলাম, তুমি আমার ব্যথা বুঝো। চুপ থেকে অভিমান আর কষ্ট পুষেছি। নিজের ভেতরকার অনুভূতি খোলাসা করে বলা উচিত ছিল। বলিনি। নীরবে সহ্য করেছি তারপর শেষদিনগুলোতে রাগে ফেটে পড়েছি। তুমি একা দোষী নও, বরং বেশি দোষটা আমারই। আমি অনুতপ্ত, অলকা। অনেক বড় শাস্তি পেয়েছি। এতো কঠিন শাস্তি দিয়েছো যে কল্পনাতেও আনতে পারব না আর এমন কিছু। প্লিজ, আমরা আবার নতুন করে শুরু করি।’
আমার কান্নার বেগ আরও তীব্র হয়ে উঠল। এভাবে কেন নিজের ভুল স্বীকার করে নিচ্ছে ও? কেন এতটা নিজেকে ছোট করছে? তর্ক করুক, প্রতিরোধ করুক। এতো মহৎ, এতো উদার কে হতে বলেছে? নিজের ঘাড়ে সব অপরাধ নিয়ে? তাহলে কেন আমার ভুলগুলো এতক্ষণ বলল? ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো দুই রকম পরস্পরবিরোধী চিন্তায়। দীর্ঘদিন যে গভীর অভিমান পুষে রেখেছি, যে ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছি তা কি এত সহজে হাল ছেড়ে দিবে?
নিজের অজান্তেই ওর থেকে একটু সরে গেলাম। ও আমার দিকে হতাশ, বিষণ্ণ চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। হয়তো ভাবছিল, এতকিছু বললাম, এত অনুনয়-বিনয় করলাম, এত কাতরভাবে ক্ষমা চাইলাম তবুও ওর হৃদয় গলল না! তবুও ওর মনে কোনো নরম ভাব এলো না!
সবকিছুই বুঝতে পারছিলাম। ওর প্রতিটি কথা, প্রতিটি অনুভূতি আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। কিন্তু নিজের গড়ে তোলা অহংকারের দুর্গ ভেঙে ফেলতে পারছিলাম না। যে মানসিক প্রাচীর গড়ে উঠেছে আমাদের মধ্যে, যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেই প্রাচীর ভেঙে আগের মতো কাছে ফিরে যাওয়া এত সহজ নয়!
চোখের জল মুছে শান্ত সুরে বললাম, ‘আগের মতো কিছু নেই, তৈমুর। পাঁচ মাসে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। পরিস্থিতি বদলেছে। আমিও বদলে গেছি। আমার মনও বদলেছে।’
ও অবাক চাহনি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘তুমি সত্যিই ভালো আছো… আমাকে ছাড়া?’
কে যেন জোর করে বলাল, ‘আছি। তোমাকে ছাড়াই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’
ওর চোখ মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল। কণ্ঠটা খানিক ঝাঁঝালো হয়ে উঠল, ‘তবে কেন এলে? কেন গেলে আমার ঘরে?’
আমি জবাব দিতে পারিনি। মনে হচ্ছিল হাজারটা শব্দ গলায় গিঁট বেঁধে আটকে গেছে।
তৈমুর তেড়ে এসে বলল, ‘বলো, কেন এসেছো?’
‘ডিভোর্স নিতে।’ কথাটা বলেই ওর চোখের দিকে তাকালাম। দেখতে পেলাম, বিস্ময় ভরা ছলছল চোখ দুটি। আমার বুকটা যন্ত্রণায় চিনচিন করে উঠল। তবুও হার মানলাম না। গর্বিত, অহংকারী মানুষেরা সহজে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে না। আমিও পারলাম না। কোনো কারণ ছাড়াই আমার অহংবোধ আরও বেড়ে গেল।
স্বভাব পাল্টানোর মতো কঠিন আর কিছু নয়। বরফের পাহাড় গলানোর চেয়েও দুরূহ। ছোট থেকে বাবা-মা আর কৈশোর থেকে তৈমুর আমার রাগ, জেদ, অহংবোধকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। লতানো গাছের মতো মুড়ে দিয়েছে আমার অহংকারকে। যে মাথা কখনো কারো সামনে ঝুঁকেনি, সে কি হঠাৎ করে নতজানু হয়ে যায়? অহংকার একদিনে গলে যায় না, যেমন হিমালয়ের বরফ এক বিকেলে মরে না।
তৈমুর দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘এখনো চাও?’
চোখ নামিয়ে স্যুটকেস তুলে নিয়ে বললাম, ‘চাই।’
বলেই চলে যাচ্ছিলাম। আমার ভেতরে তখন দুটি সত্তা মল্লযুদ্ধ করছিল। একটি চাইছিল ভেঙে গুড়িয়ে যেতে তৈমুরের বুকে, অন্যটি চাইছিল তৈমুর আরও আকুল হয়ে আমাকে চাক, তবেই আমার হৃদয় তৃপ্ত হবে। প্রকৃতপক্ষে, চলে যাবার বাসনা যখন তৈমুর প্রথম জড়িয়ে ধরেছিল তখনই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। আমি বরবরই ছিলাম মোমবাতির শিখা আর ও এক পশলা হাওয়া।
দরজার কাছাকাছি পৌঁছাতেই হঠাৎ তৈমুর বজ্রের মতো টেনে নিল আমাকে। ওর উন্মাদ বাহু জোড়া মুহূর্তেই আবদ্ধ করে ফেলল আমার সারা অস্তিত্ব। পিঠ, কাঁধ, গলা, চোখ, মুখ শরীরের প্রতিটি চৌখুপিতে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল ওর পাগলপারা চুমুগুলো।
প্রথমে আমি ছুটে পালাতে চাইলাম। বন্দী পাখির মতো ছটফট করলাম। কিন্তু শরীর ধীরে ধীরে আত্মসমর্পণের দিকে গলে যেতে লাগল। মানসিক প্রতিরোধ যতই জোরালো হোক, শিরা-উপশিরায় যে আবেগের রক্ত বইছে, সে তো তৈমুরেরই জন্য। মস্তিষ্ক অদম্য প্রতিবাদে গর্জে উঠছিল, ‘না!’
কিন্তু হৃদয় তীব্র প্রশান্তিতে ফিসফিস করে বলছিল ‘থেমে যা, এটাই সত্যি।’
একটা দম্পতির মধ্যকার মনোমালিন্য যখন শেষ হওয়ার পথে থাকে, তখন তাদের অনুভূতি তীব্র বেগে ফেটে পড়ে। ঠিক তাই হচ্ছিল আমার সারা শরীরজুড়ে। রক্তের প্রতিটি কণা কাঁপছিল গভীর আবেগে। যখন প্রতিটি শিরা-উপশিরা আমাকে সমর্পণ করে দিচ্ছিল, যখন শরীরের প্রতিটি অংশ অজান্তেই সাড়া দিচ্ছিল ওর স্পর্শে, ঠিক তখনই ও হঠাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল। চোখ নামিয়ে, ফ্যাকাসে গলায় বলল, ‘যাও, যেখানে যেতে চাও… চলে যাও।’
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম হতবাক হয়ে।
ওর বলা শব্দগুলো আমার হৃদয়ে ধ্বংসস্তূপের মতো ধসে পড়ল। বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেল। চোখে আঁধার নেমে এলো, মুখ থুবড়ে পড়ল ভেতরের সমস্ত প্রতিরোধ। তৈমুর মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, ও কাঁদছে। এক পা সামনে বাড়ালাম। মন চাইছিল ওর কাছে গিয়ে সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলতে। কিন্তু অহংকার আর সেই চিরচেনা প্রতিরোধের দেয়াল আমার পায়ে শিকল পরিয়ে দিল। নিজেকে ধরে রাখলাম। স্যুটকেসটা উঠিয়ে নিলাম হাতে। বেরিয়ে পড়লাম ভিলা থেকে।
রিসোর্টের নির্জন এক কোণে গিয়ে বসে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলাম শিশুর মতো। বুকফাটা আর্তনাদে ফেটে পড়ল আমার কান্না।
আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি আবার ওর প্রেমে পড়েছি… প্রেমের আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল আমার হৃদয়। আমি ওর অপেক্ষার প্রেমে পড়েছি, আমি ওর ব্যাকুলতার প্রেমে পড়েছি, আমি ওর অজস্র চুমুর প্রেমে পড়েছি। প্রেমে, প্রেমে ভেতরে থইথই আগুন জ্বলছে। সেই আগুনে আমার মন, মস্তিষ্ক পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। এই আগুন একমাত্র তৈমুরই নেভাতে পারে। অথচ, তৈমুর, আমাকে চলে যেতে বলল! কীভাবে পারল? আমার হৃদয়ে আবার জন্ম নিল নতুন অভিমান। যার আঁচ পুরোনো সমস্ত যন্ত্রণাকেও ছাপিয়ে গেল।
নারী জাতি বড়ই রহস্যময়। আমরা অভিমানের উপরও আবার অভিমান করি। চাই কেউ আমাদের ভুল বুঝুক, শুধু যাতে অভিমান করার একটা সুযোগ পাই। আবার সেই মানুষটিই যেন ভুল ভেঙে অনুনয় করে বলে, ‘থেমে যাও, প্লিজ… থেকে যাও।’
আমিও তাই চাচ্ছিলাম। তৈমুর আর একবার ছুটে আসুক। আমাকে জাপটে ধরুক। বলুক, ‘তুমি কোথাও যাবে না।’
আমি থেকে যেতাম। ওর বুকেই ফিরে যেতাম। সহস্রবার সরি বলতাম। সব ভুলে গিয়ে সব ঠিক করে ফেলতাম।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তাকিয়ে থাকলাম পেছনের পথের দিকে। কিন্তু তৈমুর এলো না। এটাই ওর ভালোবাসা?
যে মানুষটা পাঁচ মাস ধরে অপেক্ষা করেছে, সে ত্রিশ মিনিটের কথায় সমস্ত অপেক্ষার মহত্ত্ব মুছে দিল?
কান্নায় বুক ভাসিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছালাম। দুই দিন পর ভারত ফিরে যাওয়ার আগাম টিকিট কাটা ছিল। এই দুই দিন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য কক্সবাজারকে বেছে নিলাম। কিন্তু স্লিপার তো দূরের কথা, বিজনেস সিটও পেলাম না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা নন-এসি সিটের টিকিট কাটতে হলো।
বাস যখন চলতে শুরু করল, কষ্টটা বাসের গতি অনুসরণ করে আরও বেড়ে চলল। সম্পর্কটা সত্যিই শেষ হয়ে গেল? আমি কেন ছুটে যেতে পারছি না? কি এমন অহংকার আমাকে টেনে রাখছে? নিজের উপরই ঘৃণা হতে লাগল। রাগে, দুঃখে, নিজের প্রতি যন্ত্রণায় কেঁদে ফেললাম, হেঁচকি উঠে গেল।
পাশের সিটে বসা মহিলা একটু বয়স্ক, পরনে সাদা-কালো ছাপার শাড়ি, অনবরত পান চিবোচ্ছেন আর আড়চোখে আমাকে দেখছেন কৌতূহল নিয়ে। ঠোঁটের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল গাঢ় লাল পানির রেখা। গাল বেয়ে নামতে নামতে থেমে যাচ্ছিল থুতনির নিচে এসে। মাঝে মাঝে জিভের আগা দিয়ে সে পানি ঠেলে দিচ্ছিলেন ভেতরে, আবার নতুন করে চিবোতে শুরু করছিলেন। চিবোনোর শব্দটা মাথায় কেমন গুঁজি গুঁজি করে বিঁধে যাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি টিস্যু বের করে চোখের জল মুছলাম। জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম যেন কিছুই দেখতে না হয়।
ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ বাজল।
অবচেতনভাবে ফোনটা হাতে তুলে চোখ রাখতেই দেখি, তৈমুরের নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে,
তুমি চলে যাওয়ার পর, সূর্য উঠেছে ঠিকই, কিন্তু তার আলো আমাকে আর স্পর্শ করেনি।
সকাল হয়েছে, কিন্তু আমার ভেতরটা রাতের মতো অন্ধকারই থেকে গেছে।
চাঁদ উঠেছে আকাশে, কিন্তু তার মায়া আমার চোখে আর রূপ ছড়ায়নি।
তুমি ছিলে না, তাই পাখির কূজন কানে গিয়ে ঠেকেনি, ফুল ফুটেছে কিন্তু তার সৌরভ মনে পৌঁছায়নি।
তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর, পৃথিবীর প্রতিটা ঋতু আমার জন্য নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছিল।
শীত এসেছিল হাড় কাঁপানো শূন্যতা নিয়ে, আর বসন্ত এসে বলেছিল, ‘অলকা নেই, প্রেমও নেই।’ —
পড়তে পড়তে বুকের ভেতর কেমন হুহু করে উঠল। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
এমন সময় জানালার পাশে একটা তীব্র হর্ন বেজে উঠল। চমকে গিয়ে জানালার ওপারে তাকালাম। তৈমুর! বাইক নিয়ে পিছু পিছু এসেছে! হেলমেট পরেনি, এলোমেলো চুল, চোখে অস্থিরতা।
আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘আমার থেকে তোমার মুক্তি নেই, অলকানন্দা!’
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ঠোঁট কেঁপে উঠল। মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেললাম। অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠল বুক। হঠাৎ করেই মনে হলো, পৃথিবী সুন্দর, আকাশ সুন্দর, এমনকি সুন্দর পাশে বসে থাকা পান চিবোনো মহিলাটিও।
আমি অনুভব করলাম, আমি যতটা না বেহায়া হয়েছি, তৈমুর তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি নির্লজ্জ হয়েছিল এই সম্পর্কে। আমরা ভাবি, সম্পর্ক মানেই নিট অ্যান্ড ক্লিন হবে, কোনো দাগ থাকবে না, কোনো তিক্ততা আসবে না।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দাম্পত্য মানে শুধু ভালো সময় ভাগাভাগি করা নয়। বিয়ে মানে প্রতিশ্রুতি। জীবনের শেষ অবধি একসঙ্গে থাকার, ভালোবাসার, লড়াই করার। এই দীর্ঘ পথচলায় একঘেয়েমি আসবেই, ভুল হবে, কথার আঘাত লাগবে, কখনো কখনো দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু যারা ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে জানে, যারা অহংকারের দেয়াল ভেঙে বারবার ফিরে আসতে জানে, তারাই পারে সেই সম্পর্ক বাঁচাতে। আর যারা নিজের আমিতে আটকে থাকে, তারা কেবল একে অপরকে হারিয়ে ফেলে। আমরা বহুবার সম্পর্কের দাগ মুছে আবার নতুন করে লিখেছি আমাদের গল্প। চেষ্টাটা অবশ্য বেশির ভাগ সময় তৈমুরেরই ছিল। ওর ধৈর্য, ওর জেদ, আর ওর ভালোবাসাই আমাদের সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রেখেছিল। অনেকে বলে, একটা সম্পর্কের ভার দুজনকেই সমানভাবে নিতে হয়। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, সব সম্পর্কেই একজন একটু বেশি দেয়, একটু বেশি ভাঙে, আবার একটু বেশি জোড়েও। আমাদের গল্পে, সেই মানুষটা ছিল তৈমুর। ও বুঝিয়েছিল, ভালোবাসা মানে সমান সমান নয়। ভালোবাসা মানে প্রতিযোগিতা নয় যে, কে বেশি দিল, কে কম দিল তার হিসেব করতে হবে। ভালোবাসা আসলে একরকম দান, যেখানে হিসেব রাখলে প্রেমটা শুকিয়ে যায়। তোদের সম্পর্কে না হয় তুই বেশি দিবি।
কথা শেষ করেই হাসল অলকানন্দা।
তার একমাত্র মেয়ে, রূপকথা, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল, ‘বাবা বেস্ট… আমি কি বাবার মতো হতে পারব?’
অলকানন্দা মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল, ‘কেন পারবি না? তুইতো তোর বাবারই মেয়ে। শুধু বুঝে চলবি, কোনটা ক্ষমা করা যায়, কোনটা যায় না।’
রূপকথা মায়ের কোলে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা কি আর তোমার গায়ে হাত তুলেছিল?’
‘না। কখনো না। আমরা একে অপরের ছায়া হয়ে পাশে ছিলাম, যখন রোদ ছিল, যখন ঝড়ও।’
বলেই অলকানন্দা চোখ তুলে তাকাল দেয়ালের ছবিটার দিকে। ছবিতে তৈমুর দাঁড়িয়ে আছে, গাঢ় নীল স্যুটে, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে সম্মাননা হাতে। দেশের শীর্ষ শিল্পপতিদের একজন হিসেবে পেয়েছিল বর্ষসেরা সম্মাননা।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে, আলোর নিচে মাইক হাতে নিয়ে সেদিন বলেছিল, ‘মানুষ সাধারণত সাকসেস দেখে, তার পেছনের মানুষটাকে নয়। আমি ভাগ্যবান, কারণ আমার পেছনে শুধু একজন স্ত্রী নয়, ছিল একজন সহযোদ্ধা, একজন বন্ধু। সে না থাকলে, আমি হয়তো আজ এই মঞ্চে দাঁড়াতাম না। এই অ্যাওয়ার্ড যদি কারও প্রাপ্য হয়, তবে তা পুরোপুরি আমার স্ত্রী অলকানন্দার। আমি শুধু তার ছায়ায় হেঁটে এসেছি।’
রূপকথা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সেই ছবির দিকে। সে মা-বাবার গল্প থেকে উপলব্ধি করল, সম্পর্ক মানেই দুজনের একসঙ্গে সুখে থাকা না। সম্পর্ক মানে, একজন ক্লান্ত হলে অন্যজন তার জন্য পথ ধরে বসে থাকা। একজন হারিয়ে গেলে, আরেকজন আলো জ্বেলে তার জন্য অপেক্ষা করা। ভালোবাসা মানে, যে পারে, সে একটু বেশি ভালোবাসে।
রূপকথা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিল, রাগ-অভিমান ভুলে আজই কাবিরের কাছে ফিরে যাবে।
সমাপ্ত