বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ১১
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]
ভার্সিটির অডিটোরিয়াম থেকে কারো বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। মাহাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হওয়া মিমি এক সময় মাহাকে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা মেহগনি গাছের নিচে বসে থাকতে দেখে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে মাহার হাত ধরে বলে, ‘চল আমার সাথে।’
‘কোথায়?’
‘অডিটোরিয়ামে।’
‘কেন?’
‘সা’দ ভাই বক্তব্য দিচ্ছে।’
‘তাতে আমার কী?’
‘তোর-ই তো সব। ওইখানে কয়েকজনকে বলতে শুনলাম সা’দের বউ কই?’
‘এইসব নোংরা ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নাই। আর যারা এইসবে জড়িত তাদের প্রতি তো কোনো আগ্রহ-ই নাই।’
‘এইভাবে কেন কথা বলিস তুই মাহা। তোর চোখে সা’দ ভাই কি কখনও ভালো হবে না?’
‘ভালো মানুষগুলো ভালো-ই থাকে। ওর মতো খারাপ মানুষ কখনও ভালো হবে না।’
‘তাহলে পড়ে আছিস কেন? ছেড়ে কেন দিতেছিস না? শোন মাহা, এতটা বাড়াবাড়িও করিস না। পরে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে।’
‘সা’দ সম্পর্কে কোনো কথাই আমি শুনতে চাই না।’
‘তোর ভাগ্য ভালো যে সা’দ তোর বর। ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে প্রত্যেক রাতে রেপ হইতি।’
মিমির কথা শুনে ভ্রু কোঁচকায় মাহা। কথাটা অত্যন্ত অশ্রাব্য শোনালো। মাহা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাগে তার হাত পা কাঁপছে। ইচ্ছে করছিল মিমিকে কষে একটা থাপ্পড় মারতে। মিমি মাহার অঙ্গভঙ্গির দিকে না তাকিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেই চলছে।
‘আর কয়েকদিন পর ইলেকশন। পুরো ক্যাম্পাস চাচ্ছে সা’দ ভাইকে যেন লিডারশীপ দেওয়া হয়। আর একমাত্র তুই-ই আছিস যে সা’দ ভাইকে পারছিস না খুন করে ফেলতে। তুই কিন্তু এতটাও আহামরি সুন্দর না মাহা। তোর থেকেও সুন্দরী এই ভার্সিটিতে আছে। কিন্তু সা’দ ভাইয়ের নজর তোর দিকে ছিল বলেই সে তোকে আপন করে নিয়েছে। আর তুই? ধুর, তোর সঙ্গে কথা বলা-ই বৃথা।’
মিমি চলে যায়। নিজের প্রিয় বান্ধবীর কাছ থেকে এমন ব্যবহার মাহা আশা করেনি। সে সত্যি আজ আহত। কিছুই ভালো লাগছে না তার। বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় মাহা। গেট থেকে প্রায় বিশ পঁচিশ কদম পেছনে একজনের সঙ্গে ধাক্কা খায় মাহা। আলগা করে ধরে রাখা ব্যাগটা ধাক্কার টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে। মাহা নিচু হওয়ার আগেই অন্য কেউ তার ব্যাগটা তুলে হাতে দেয়। অত্যন্ত নরম স্বরে বলে, ‘আই এম সরি মিস।’
মাহা তার মুখে মিস শুনে হালকে হাসে। এই ভেবে হাসে যে, যেখানে পুরো ক্যাম্পাস জানে সে এখন আর মিস নেই। সে এখন মিসেস। সেখানে এই একজন তাকে মিস বলে ডাকল। মাহা হেসে জবাব দেয়, ‘ইটস ওকে।’
‘আপনি অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন। আর আমারও একটু তাড়া ছিল। তাড়াহুড়োয় আপনাকে খেয়াল করিনি। সেইজন্যই এই অঘটন।’
‘এর থেকেও বিরাট বিরাট অঘটন ঘটে মানুষের জীবনে। এ আর এমন কি অঘটন।’
‘বাই দ্য ওয়ে, আপনার নাম কী?’
‘মাহা।’
‘কোন সেমিস্টার?’
‘ফিফথ। আপনার?’
মাহার প্রশ্নের উত্তরে সে শুধুই হাসল। হেসে বলল, ‘আপনার নামটা আপনার মতোই সুন্দর।’
‘আপনার নামটা তো জানা হলো না।’
আগন্তুক ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, ‘ফিরোজ।’
★★
ফেসবুকে অন করতেই ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট লিস্টটা চেক করে মাহা। নতুন কিছু নোটিফিকেশন এসেছে। কেউ হয়তো রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে। মাহা চেক করতেই গতকালকে ধাক্কা খাওয়া সেই ছেলের আইডি দেখতে পায়। আইডিতে ছেলেটির ছবিই দেওয়া ছিল। মাহা কিছু না ভেবেই রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করে নিল।
মিনিট পাঁচেক পর তার নোটিফিকেশন লাভ রিয়্যাক্টের বন্যা বসিয়ে দিল ফিরোজ। মাহা নোটিফিকেশন দেখে হাসতে লাগল। মেসেজও দিল ফিরোজকে।
– এত লাভ রিয়্যাক্ট কেন?
ফিরোজের রিপ্লাই যেন সেট করাই ছিল। মাহার মেসেজ সেন্ড হতে না হতেই ফিরোজের রিপ্লাই আসল,
– এত সুন্দর একজন মানুষ এই অধমের রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করেছে। সেই আনন্দে লাভ রিয়্যাক্ট দিচ্ছি।
– তাই বলে এত?
– আপনি আসলেই সুন্দর। খুব সুন্দর।
– ধন্যবাদ। আপনি কী করেন?
– তেমন কিছুই না।
– পড়াশোনা?
– চলছে।
এইভাবেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে তাদের কনভারশেসন। সা’দ খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মাহাকে। মাহাকে এতক্ষণ ধরে ফোন টিপতে দেখে খানিক সন্দেহ হয় সা’দের। গভীর রাত পর্যন্ত মাহা আর ফিরোজের কথোপকথন চলতে থাকে। হাত থেকে ফোন রেখে মাহা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। শিরশিরে বাতাসে শরীরটা ফুরফুরে লাগছিল মাহার। সা’দ ততক্ষণে ঘুমের রাজ্যে। অনেকদিন পর মন খুলে কারো সঙ্গে কথা বলেছে মাহা। তার মনে হচ্ছিল ফিরোজ খুব ভালো একজন মানুষ। যার সঙ্গে তার ভাইভ ম্যাচ হয়। এমন একজনকে নিজের জীবনে পেলে মন্দ হতো না। বইয়ের ভাষায় মানুষ তার বিপরীত মেরুর কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে থাকে। মাহার ক্ষেত্রেও তাই-ই। এ নিয়ে আফসোসের অন্ত নেই মাহার।
★★
হোয়াইট শার্টে অত্যন্ত সুদর্শন লাগছে সা’দকে। সাথে ব্ল্যাক জিন্স। শার্টের হাতা ফোল্ড করায় আরও বেশি ভালো লাগছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোলাটে ফিল্টারে নিজের একটা ছবি তোলে সা’দ। সোস্যাল মিডিয়াতে তার রেসপন্স অনেক ভালো। সেইদিক থেকে সে যেই ছবিই তুলে না কেন সবই ঘোলাটে। নিজেকে কখনোই খোলামেলা রাখে না সা’দ। তার মেসেজবক্স নিট এন্ড ক্লিন-ই বলা চলে। কিছু টেক্সট গ্রুপে জড়িত। আর কাছের কিছু ভাই ব্রাদারের সঙ্গে তার কনভারসেশন। ভার্সিটির অনেক মেয়েই তাকে পছন্দ করে। তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কিন্তু ভয়ে এগিয়ে আসে না। ফার্স্ট সেমিস্টারের এক মেয়ে ফেসবুকে মেসেজ করেছিল, ইউ লুকিং সো হট এন্ড হ্যান্ডসাম। সা’দের তরফ থেকে মেয়েটার মেসেজের রিপ্লাই ছিল, সামনে পাইলে মাড়ির দাঁত একটাও থাকবে না। ইঁচড়েপাকা পাকা হাঁটুর বয়সী মেয়ে, টেনে এক চড় মেরে সিধে করে দিব। রিপ্লাই সিন হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে মেয়েটি ভয়ের চোটে সা’দকে আনফ্রেন্ড করে দেয়। সা’দ খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে মেয়েটা ভার্সিটি আসা বন্ধ করে দিয়েছে সা’দের ভয়ে৷
সা’দ সিঁড়ি দিয়ে নামছিল, মাহা একই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিল। আচমকা সা’দের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে সা’দ সরে যায় ওমনি মাহা পা পিছলে পড়ে যেতেই নেয় ওমনি সা’দ মাহার হাত ধরে ফেলে। সা’দকে দেখে কয়েক মিনিটের জন্য স্তব্ধ মাহা পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে। সা’দ মাহাকে টেনে দাঁড় করায় নিজের সামনে। সা’দের এমনভাবে টান দেওয়ায় মাহা অবাক-ই হয়। আশেপাশে তাকিয়ে সা’দ মাহার কানের কাছে মুখ এনে ধীর কন্ঠে বলে, ‘কাউকে ফেলে দেওয়ার রুচিবোধ আমার এখনও হয়নি। চাইলেই পারতাম সেদিনের প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু ওইযে, রুচিবোধে সমস্যা।’
সা’দ মাহার হাত ছেড়ে চার সিঁড়ি নেমে আবারও পেছনে ফিরে তাকায়। সালগ্লাসটা চোখে লাগাতে লাগাতে সা’দ বলল, ‘গুড বাই মিসেস সা’দ।’
মাহা কেবলই চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সা’দের কর্মকান্ড দেখে যায়।
চলমান………………….