বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ১৩
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]
ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে যে সব ঠিক নেই তা বেশ বুঝতে পারছেন রাহেলা বেগম। সা’দ আর মাহা তাদের ব্যবহার দেখে আগেই আন্দাজ করতে পেরেছেন তিনি। আর সেই আন্দাজটা সত্যি হয় গত দু’দিন আগে রাতের পর। কিছু বিশেষ প্রয়োজনে তিনি সা’দের ঘরে এসেছিলেন। তখনই ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথোপকথন শুনে নেন। সেখান থেকেই তার সন্দেহ বাস্তবে রুপ নেয়।
নাস্তার পর শাশুড়িকে চিন্তিত দেখে নওমি এগিয়ে আসে। পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার মা, আপনাকে বেধ চিন্তিত লাগছে। কোনো সমস্যা?’
রাহেলা বড় বউয়ের দিকে তাকান। আশেপাশে তাকিয়ে সব খুলে বলেন। শাশুড়ির কাছ থেকে সব শুনে নওমি মনে মনে ভাবে এতদিন সে যা জানত আজ শাশুড়িও সব জেনে গেছে। তারপরেও নওমি শাশুড়িকে ভুজুংভাজুং বোঝায়, ‘আমার মনে হচ্ছে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে মা। আপনি যা ভাবছেন এমন কিছুই না। আর সা’দ এমনিতেও রাগারাগি করে। হয়তো মাহার সঙ্গেও রাগারাগি করেছে তাই মাহাও সেইভাবেই রিয়্যাক্ট করেছে।’
রাহেলা কিছুতেই এটা মানতে পারছেন না যে তার ভুল হচ্ছে। তিনি বললেন, ‘চুল আমার এমনি এমনি পাকেনি বউমা। ক বললে কলিকাতা বুঝতে আমার সময় লাগে না। আর ছোট বউমা’র বলা কথাগুলোও আমি শুনেছি। কীভাবে বলল, আই হেট ইউ। সে নাকি আমার ছেলেকে কখনোই ক্ষমা করবে না। চিন্তা করে দেখো তো তুমি।’
‘মা, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এমন কত কথাই হয়। এইগুলো নিয়ে পড়ে থাকলে চলে না মা। সময় দিন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
বড় বউয়ের কথার পরে রাহেলা কিছুই বললেন না। তবে তিনি নিজের মনকে শান্তু করতে পারছেন না।
★★
ভার্সিটির তিন তলায় সা’দ আর ফিরোজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আর এক সপ্তাহ পরই ইলেকশন। ফিরোজ এবার সব দিক থেকে আটঘাট বেঁধে নেমেছে। সা’দ আপাতত কোনো ঝামেলায় যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু সা’দকে একা পেয়ে ফিরোজ নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। নিজের নোংরা খেলা খেলতে শুরু করে সে। সা’দের দিকে দুই কদম এগিয়ে বলে, ‘ভালোয় ভালোয় বললাম তোকে, তুই রিজাইন কর। করলি না।’
ফিরোজের কথার জের ধরে সা’দ বলল, ‘তুইও তো পারিস রিজাইন করতে। তুই কর।’
‘আমার কেন যেনো মনে হচ্ছে তুই মুখ থুবড়ে পড়বি।’
‘সা’দ কখনো মুখ থুবড়ে পড়ার মতো কাজ করে না।’
‘তোর অসহায়ত্ব দেখলেও কষ্ট লাগে সা’দ। আমি ফিরোজ তোকে কথা দিচ্ছি খুব শীঘ্রই তুই ভেঙে চুড়ে গুড়িয়ে যাবি৷ আর ইলেকশনের কথা একেবারেই ভুলে যা তুই। এমন যেনো না হয় একা মাঠে আমিই রইলাম। আমার প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে দাঁড়ানোর জন্য তুই-ই রইলি না।’
ফিরোজের কথাগুলো মেলাতে পারছে না সা’দ। ফিরোজকে এর আগে কখনো এত কনফিডেন্টলি কথা বলতে দেখেনি সে। ফিরোজ চলে যাওয়ার পরেও তার কথাগুলো ভেবে যাচ্ছিল সে।
★★
মাহাকে রান্নাঘরে দেখে নওমি অনেকটাই অবাক। এতদিনে মাহাকে রান্নাঘরে খুব কমই দেখা গেছে। রাহেলা বেগম কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছেন না। নওমির নিষেধাজ্ঞা তাকে বাধা দিচ্ছে। মাহাকে উদ্দেশ্য করে নওমি বলে, ‘আরে মাহা! কিছু লাগবে তোমার?’
নিচু স্বরে মাহার উত্তর হয়, ‘নাহ।’
‘চা খাবে? নাস্তায় তো চা খেতে দেখলাম না তোমাকে।’
‘ভাবী, আমি চা তেমন একটা খাই না।’
‘ওহ আচ্ছা। তা আজ তোমার ক্লাস নেই?’
‘নাহ। পলিটিক্যাল কিছু ইস্যুর কারণে ভার্সিটি অফ।’
‘বেশ তো। তাহলে সা’দকে বলব তোমাকে তোমার বাবার বাসায় দিয়ে আসতে। কিছুদিন ঘুরে এলে।’
বড় ছেলের বউয়ের এমন কথায় নারাজ হলেন রাহেলা বেগম। তিনি কর্কশ কন্ঠে বললেন, ‘এইসব কী বলো তুমি নওমি। বিয়ের পর এখন পর্যন্ত তুমি কয়দিন গিয়েছ বাবার বাড়ি? এত ঘন ঘন বাপের বাড়ি গেলে মানুষও খারাপ বলে। মানুষ ভাবে, শ্বশুর বাড়িতে জ্বালায় বেশি সেইজন্য মেয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে।’
রাহেলা বেগমের কথায় নওমি চুপ হয়ে যায়। মাহাও দরজার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাহেলা বেগম এবার মাহার দিকে তাকান। গলায় কাঠিন্যতা বজায় রেখে বললেন, ‘তার চেয়ে বরং এই সময়টাতে রান্নার কাজে হাত লাগাও। নওমির কাছ থেকে টুকটাক শিখে নাও। পড়াশোনা যতই করো না কেন চুলায় হাতা খুন্তি কম বেশি সব মেয়েকেই চালাতে হয়। আমার বড় বউও কিন্তু এম বি এ কমপ্লিট করা। আমাদের এত বড় ব্যবসায় আমার বড় বউয়েরও ভূমিকা আছে। অথচ দেখো, সে যখন থাকে আমাকে কোন দিক দেখা লাগে না। বড় বউয়ের মতো হওয়ার চেষ্টা করো।’
মাহার এবার শাশুড়ির কথাগুলো গায়ে লাগছে। তিনি একতরফা কথা বলে মাহাকে ছোট করছেন। নওমি মাহার চেহারা দেখে কিছু আন্দাজ করতে পারে। আর তখনই সে শাশুড়িকে বলে, ‘মা, আপনার নাতি কী করে দেখুন তো। আজ সে স্কুলেও গেল না। গিয়ে দেখুন কী করছে?’
নওমি যে তাকে এখান থেকে চলে যাওয়ার ইশারা করছে তা বেশ ভালো বুঝতে পারছেন রাহেলা বেগম। তিনি হাতে থাকা গ্লাসটা রেখে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে যান। বের হয়ে যাওয়ার আগে মাহার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ছেলে জন্ম দিয়েছি কোনো মেয়ের ক্ষমা পাওয়ার আশায় নয়। ছেলে যদি অন্যায় করে সেটা এক হিসাব। আমার জানা মতে আমার ছেলে কখনো কোন অন্যায় করেনি আর করবেও না।’
নওমি পেছন থেকে আবারও শাশুড়িকে সতর্ক করে বলে, ‘আহ মা! আপনাকে কী বললাম আমি। যান এখান থেকে। মাহা তুমি এখানে আসো। আজকে তোমাকে গরুর মাংস ভুনা করা শেখাব।’
রাহেলা বেগম চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর অবধি মাহা তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। পেছন থেকে নওমি এসে মাহার কাঁধে হাত রাখে। বলে, ‘আসো। আজকে গরুর মাংস ভুনা করব। তুমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখবে।’
মাহা নওমির দিকে তাকায়। নওমির মুখে হালকা হাসি দেখে মাহা বলে, ‘ভাবী, মা এইভাবে কথা বললেন কেন আজকে।’
‘মাহা, মা তোমাদের সব কথা শুনে ফেলেছে। সেদিন রাতে মা ঘরের বাইরেই ছিলেন। তোমার আর সা’দের কথা শুনে ফেলেছে। তাই একটু রেগে আছেন।’
‘মা তো এমন ভাবে কথা বলছেন যেনো উনার ছেলের কোন দোষই নেই।’
‘আমি তো সা’দের কোন দোষ দেখছি না মাহা।’
‘তাহলে তো মনে হচ্ছে আমিই দোষী।’
‘তুমি দোষী সেটাও কেউ বলছে না। আমি বলছি, সা’দের দোষ নেই তবে তার কিছু কার্যকলাপ ঠিক না।’
‘আমি তোমাকে এর আগেও বলেছি একটু সময় দাও। সা’দের দিকে ঘৃণা না সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাও। দেখবে তাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে।’
মাহা নওমির কথায় আর বাড়তি কিছু বলেনি। নওমির সঙ্গে হাতে হাতে রান্নাঘরের সব কাজ সামলাতে শুরু করে। হঠাৎই নওমির ফোন বেজে ওঠে। হাত ব্যস্ত থাকায় মাহাকে বলে ফোনটা দেখতে। মাহা ফোন হাতে নিয়ে দেখে সায়েমের ফোন। ফোন হাতে এগিয়ে আসে মাহা। বলে, ‘ভাবী, ভাইয়ার ফোন।’
সায়েমের ফোনের কথা শুনে এক গাল হেসে বলে, ‘একটু রিসিভ করে স্পিকার অন করো। আমার হাতে তো মশলা লেগে আছে।’
মাহাও ফোন রিসিভ করে স্পিকার অন করে পাশেই রাখে। ফোন রিসিভ হওয়ার পর পর ফোনের ওপাশ থেকে সায়েম বলে, ‘হ্যালো মাই জানেমান, হোয়াট আর ইউ ডুইং?’
সায়েমের কথা শুনে মাহা ফিক করে হাসে। নওমিও মুচকি হেসে বলে, ‘কাজ করছি। কাজ।’
‘আমার জানটা কী কাজ করে?’
‘আহ সায়েম! কী বলো তুমি?’
‘কী বললাম। বউকে ভালোবেসে কত কিছুই ডাকা যায়।’
‘আশেপাশে মানুষ থাকতে পারে এটা ভুলে যাও কেন?’
‘ফোন স্পিকারে নাকি?’
‘জি জনাব। আমার হাতে মশলা লেগে আছে। তাই মাহাকে দিয়ে ফোন রিসিভ করিয়েছি।’
‘আচ্ছা! আগে বলবে না।’
‘এখন বললাম তো।’
‘ওকে। আমার লক্ষী বউটা নাস্তা খেয়েছে?’
মাহা এবার মুখ চেপে হাসা শুরু করে। নওমি বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। সে একটু চেঁচিয়ে বলে, ‘সায়েম! হোয়াট ইজ দিস?’
সায়েম শব্দ করে হেসে বলে, ‘আই লাভ ইউ জান। আই মিস ইউ, আই মিস ইউ।’
এবার মাহা আর থাকতে না পেরে নওমিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নওমির পিঠে মুখ লাগিয়ে হাসে। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ভাবী তুমি বলো, আই কিস ইউ। বলো, বলো।’
নওমি মুচকি হেসে সায়েমকে বলে, ‘থামবে তুমি?’
সায়েম না থেমে বলে, ‘কাল রাতটা যতটা না স্পেশাল ছিল আজকের রাতটা আরও বেশি স্পেশাল হবে। কথা দিচ্ছি।’
কথাটা শুনে মাহা দুই হাতে নিজের মুখ ডাকে। নওমিরও চোখ বড় হয়ে যায়। সে মশালা মাখানো হাতেই ফোন কেটে বলে, ‘অসভ্য!’
মাহা ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘ইস! ভাবী, ভাইয়া কত ভালোবাসে তোমাকে।’
নওমি স্বীকার করে বলে, ‘এটা সত্যি। সায়েম আমাকে অনেক ভালোবাসে। এর কারণও আছে। সায়েম আমার কাছ থেকেও ঠিক একই ভালোবাসা পাচ্ছে। আমি ওকে ভালোবাসায় কখনো কার্পণ্য করিনি। মাহা, তোমাকেও বলছি, সা’দকে একবার ভালোবেসে দেখো। দেখবে সে তোমাকে এর থেকে হাজারগুন ভালোবাসবে৷ ভালোবাসায় কার্পণ্য করতে নেই মাহা। ভালোবাসায় কার্পণ্য করেছ তো হেরে গেছ।’
★★
ঘরে এসে নওমির কথাগুলো ভাবছে মাহা। সত্যিই কি তার সা’দের দিকে এক পা এগুনো উচিত? সা’দ কি তার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? সা’দ কি আদৌতে তাকে ভালোবাসে? নাকি তাকে বিয়ে করে আজীবনের জন্য নিজের কাছে রাখার জন্যই এইসবটা করেছে?
মাথায় হাজারটা প্রশ্নের ঘুরপাক। উত্তর খুঁজতে রাত দিন পার হয়ে যাবে। সা’দকে বোঝা কঠিন। সা’দ নিজের চারপাশে এমন গন্ডি তৈরি করে রেখেছে যে গন্ডিতে ঢোকা সহজ নয়।
হঠাৎই ফোনের শব্দে সম্বিত ফিরে আসে মাহার। ফোনে ফিরোজের ইনকামিং কল।
চলমান……………………