বিরোধীদলীয় প্রেম পর্ব-১৪

0
206

বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ১৪
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]

সা’দের মাথায় একটা কথাই ঘুরঘুর করছে। ফিরোজ যে কথা বানিয়ে বলে না তা খুব ভালো মতোই জানে সা’দ। তবে তার প্রশ্ন ফিরোজ এত কনফিডেন্টলি কথাগুলো বলল কীভাবে। সা’দের এক ছোট ভাই তখনই সামনে এসে দাঁড়ায়। সা’দকে চিন্তিত দেখে সে বলে, ‘ভাই, আপনাকে চিন্তিত লাগছে। কিছু হয়েছে?’
সা’দ আশিকের দিকে তাকায়। বলে, ‘আশিক, ইলেকশন আর একটা সপ্তাহ পরে। ফিরোজের রঙ ঢং তো ভালো ঠেকছে না।’
আশিক কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কেন ভাই, কী হয়েছে?’
ফিরোজের কথাগুলো সা’দ আশিককে জানায়। আশিক বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। ফিরোজ কী করে এখনও এত ঠান্ডা আছে সেটাই বুঝতে পারছে না সে। আশিক ফের বলে, ‘ফিরোজের যেই চরিত্র, ও তো এত চুপচাপ থাকার মানুষ না। এক সপ্তাহ পর ইলেকশন আর ও এখনও চুপচাপ বসে আছে। ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না।’
‘ও আমাকে এমন ভাবে কথাটা বলল। আমার তো মনে হচ্ছে ও বেশ যদি মাঠে নামে তাহলে আটঘাট বেঁধেই নেমেছে।’
‘ভাই, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি ব্যাপারটা।’
‘হ্যাঁ। সেটাই দেখ। আমাকে জানতেই হবে ও কী প্ল্যান করেছে।’

★★

রাত প্রায় এগারোটা বাজে। সা’দের খবর নেই। মাহাকে বেশ কয়েকবার বলার পরেও রাতে খায়নি মাহা। সারাদিন পর রাতে সায়েমকে খানিক সময় দিয়ে ঘুমোতে হয় নওমির। তাই সে মাহার ঘরে আসে। মাহা তখন বই হাতে বসেছিল। ঘরে ঢুকতেই মাহা বলে, ‘ভাবী, কিছু বলবে?’
নওমি হাসিমুখে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ। তুমি তো কিছু খেলে না।’
‘আজকে ইচ্ছা করছে না।’
‘আচ্ছা। শোন, একটা কথা বলি। সা’দ তো এখনও বাসায় আসেনি। ও আসলে ওকে খেতে দিও। রাত তো বেশ হলো। আমি ঘরে চলে যাচ্ছি।’
সা’দকে খেতে দেওয়ার কথাটা মাহার ভালো লাগেনি। সে মুখের উপর না করে দিতে পারত। কিন্তু নওমিকে সারাদিন কাজ করতে দেখে তার বিবেক তাকে বাধা দিল। সে বিনাবাক্যে মাথা নেড়ে হ্যাঁসূচক ইশারা করল। মাহার এই হ্যাঁসূচক ইশারায় নওমি বেশ খুশি। হাসিমুখে সে বের হয়ে গেল।
মাহা তখন ফিরোজের সাথে টেক্সট করায় ব্যস্ত। তাই আর নওমির সঙ্গে কথা দীর্ঘ করেনি।

★★

ঘরে ঢুকতেই সিগারেটের গন্ধ নাকে লাগে নওমির। এদিক-সেদিক তাকাতেই দেখতে পায় সায়েম বারান্দায় সিগারেট টানছে। নওমি সরাসরি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সায়েমের পাশে দাঁড়ায়। সায়েম এক মনে সিগারেট টানছে। নওমি পাশ থেকে সায়েমের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে। নিজের কাঁধে নওমির মাথা লাগতেই সায়েম পাশ ফিরে নওমির কপালে চুমু খায়। নওমি কপাল কুঁচকে বলে, ‘সিগারেটের ঠোঁট দিয়ে চুমু খাও কেন?’
সায়েম মুচকি হাসে। বলে, ‘সিগারেট টানা মানুষটাকে জড়াতে পারো আর তার ঠোঁটের চুমু খেতে সমস্যা? এ কেমন বিচার!’
সায়েমের কথায় যুক্তি আছে। নওমির সঙ্গে লজিক্যাল আর্গুমেন্টে সব সময় সায়েম জিতে। আর শেষ পর্যন্ত নওমি হার মানে। এবারও তাই। ভেতর ভেতর সায়েম চিন্তিত। তার চিন্তার বিষয় সা’দের বিবাহিত জীবন। কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু কথা বলবেই বা কার সাথে। নওমিকে চুপ থাকতে দেখে সায়েম বলল, ‘নওমি, সা’দ আর মাহার মধ্যে সব ঠিক হয়েছে?’
পূর্বের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে নওমি। এবার আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সায়েমকে। বলে, ‘ঠিক হওয়ার চাইতে বিগড়ে যাচ্ছে বেশি।’
সায়েমের কপালে এবার চিন্তার রেখা গাঢ় হয়। সে বলে, ‘কী বলছ এসব!’
‘হ্যাঁ।’
‘সেদিন মাহার বাবার বাড়ি যাওয়া নিয়ে সা’দ কিছু মনে হয় বলেছে মাহাকে। তা শুনে মাহা নাকি বলেছে আই হেট ইউ। মা সবটা বাইরে থেকে শুনে ফেলছে। এটা নিয়ে মা মাহার সঙ্গেও একটু রাগ করেছে।’
‘আমার ভাইটা যে এই মেয়ের মধ্যে কী দেখল যে মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে করে ফেলল। এখন ভুগছে কে? সে নিজেই। এই মেয়ে সহজে নরম হবার মানুষ না। আর আমার ভাইটাও তার ভালোবাসা পাবে না।’
‘আমি দিনরাত বোঝাই। এখন যদি মানতে পারে আর কি। আর তাছাড়া তুমিও তো মাহার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকো। এইযে এতদিন হয়ে গেল, তুমিই বা ওর সাথে কয়টা কথা বলেছ শুনি।’
‘প্রথমত ও আমার ভাইকে পছন্দই করে। এটা একটা কারণ। আর দ্বিতীয়ত আমার আন-ইজি লাগে ওর সাথে কথা বলতে। ছোট ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে কীসের এত কথা।’
‘তোমাকে তো রাত-দিন কেউ কথা বলতে বলেনি সায়েম। মাঝেসাঝে বলবে। আচ্ছা সেসব বাদ দাও। শোবে না?’
‘হ্যাঁ। সিগারেটটা শেষ হোক। তারপর।’
‘তোমাকে এই রাতের বেলাতেও সিগারেট টানতে হবে।’
‘সিগারেট আর তুমি আমার কাছে সেরা।’
‘কিহ! শেষে কি-না আমায় তুমি সিগারেটের সঙ্গে মিলিয়েছ।’
‘সিগারেট যেমন চাইলেও আমি ছাড়তে পারব না। আর তোমাকে ছাড়া আমি মোটেও থাকতে পারব না।’
নওমি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। সায়েমের সঙ্গ তার ভালো লাগে। সায়েমের সঙ্গে লেপ্টে থাকতে তার ভালো লাগে। আরও কিছুটা সময় অতিবাহিত হবার পর নওমি হুট করেই সায়েমের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দেয়। তা দেখে সায়েম বেশ চমকে যায়। সে একবার নিচে তাকায়, পরবর্তীতে আবার নওমির দিকে তাকায়। নওমি তখন ঠোঁট কামড়ে হাসে। বউয়ের ইশারা বুঝতে বাকি রইল না সায়েমের। নওমির ঠোঁট জোড়ায় নিজের ঠোঁটের ছাপ ফেলতে তার এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি।
একটা নির্দিষ্ট সময় পর সায়েম নওমিকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। অতঃপর তাদের ভালোবাসা ভাগাভাগি করে নেওয়ার পর্ব শুরু হয়। এই পর্বে কারো জিত নেই। উভয়পক্ষেরই হার নির্ধারিত।

★★

রাত প্রায় বারোটা নাগাদ সা’দ বাসায় ফিরে। মাহা তখনও বসে আছে। এই বসে থাকা কি সা’দের জন্য অপেক্ষা করা সেটা নিয়ে আপাতত ভাবতে চাচ্ছে না মাহা। তবে সে চাইলেই পারত শুয়ে থাকতে। চাইলেই পারত ঘুমোতে। কিন্তু পারেনি। এই না পারা কি কেবলই সা’দের জন্য। সেটা নিয়েও ভাবতে চাচ্ছে না মাহা। সোফায় মাহাকে বসে থাকতে সা’দ তেমন কিছুই বলেনি। আজ-কাল মাহার সঙ্গে তার তেমন কথাই হয় না। সা’দ বাসাতেই থাকে না তেমন। তার মাথায় কেবল ইলেকশনের চিন্তা। পলিটিক্স যার মস্তিষ্কে টনিকের মতো লেগে আছে সেই মস্তিষ্কে যে কোনো নারীর ছায়া পড়েছে এই তো বেশি।
সা’দ ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মাহা বলে, ‘খেতে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।’
মাহার মুখে খেতে দেওয়ার কথাটা সা’দের হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল। সে ভাবছিল আজ তো সূর্য ঠিকঠাক দিকেই উঠেছে তবে মাহার এত পরিবর্তন কেন? সা’দের অপেক্ষা না করেই মাহা খাবার সার্ভ করে। সা’দও ডাইনিং টেবিলে বসে। গরুর মাংস ভুনা সা’দের খুব পছন্দ এটা তার চড়ুই মানে তার ভাবী জানে। সা’দ ভুনা মাংস দেখেই বলে, ‘আজকে চড়ুই গরুর মাংস ভুনা করেছে। চড়ুইয়ের হাতে এই রান্নাটা খুব মজার হয়।’
মাহা কিছুই বলেনি। চুপচাপ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সা’দ ভাতে হাত দেয়। লোকমাও বানায়। ভাতের প্রথম লোকমা মুখের সামনে নিয়ে তার নজর পড়ে মাহার মুখের দিকে। মাহার চোখ-মুখ বলছিল সে খায়নি। সা’দ ঠান্ডা মেজাজেই প্রশ্ন করল, ‘তুমি খেয়েছ?’
সা’দের প্রশ্নটা মাহার কানে গেলেও সে উত্তরে কিছুই বলেনি। সা’দ আবারও একই প্রশ্ন করে, ‘তুমি খেয়েছিলে?’
সা’দের প্রশ্নের উত্তরটা মাহা বাঁকা করেই দেয়, ‘আমি খেয়েছি কি খাইনি তা জেনে তোমার লাভ কী? বরং তুমি খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো।’
মাহার কথায় সা’দ কষ্ট পায়। লোকমাটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে সে বলে, ‘মাহা, তুমি আমার সঙ্গে স্বাভাবিক হবে কবে বলতে পারো?’
আগুন দৃষ্টিতে তাকায় মাহা। চাপা স্বরে বলে, ‘আমার জীবনে সব থেকে অস্বাভাবিক বস্তুটিই তো তুমি। অস্বাভাবিকের সঙ্গে আমি স্বাভাবিক হবো কী করে, বলতে পারো?’
সা’দ সহজে কষ্ট পায় না। কিন্তু কখনো কারো দ্বারা কষ্ট পেলে সহজে তার দিকে ফিরে তাকায় না। মাহার কথাতেও আজ সে কষ্ট পেয়েছে। যত যা-ই হয়ে যাক না কেন মাহার কাছ থেকে এই কথাটা সে আশা করেনি। প্রচন্ড ক্ষুধায় পেটটা হঠাৎই ঠান্ডা হয়ে গেল সা’দের। এই মুহুর্তে খাবার আর গলা দিয়ে নামবে না তার। প্রিয় মাংস ভুনাটা সেভাবেই প্লেটে পড়ে রইল। লোকমাটা ছেড়ে হাতটা ধুয়ে চেয়ার ছেড়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল সা’দ। সা’দের এইভাবে চলে যাওয়াটাও মানতে পারছিল না মাহা। সে সা’দের পেছন পেছন উপরে যায়। ঘরে গিয়ে দেখে সা’দ কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। মাহা সামনে এসে বলে, ‘খাবার ছেড়ে উঠে আসলে কেন?’
সা’দ কোন কথা বলেনি। মাহার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে সা’দের কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে দিয়ে আবারও বলে, ‘কথা বলছ না কেন?’
সা’দ নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। সে বিছানা থেকে নেমে মাহার থুতনি চেপে ধরে বলে, ‘আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না মাহা। পরে এমন না হয় উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি পেলে না।’
মাহা সা’দের চোখে পানি দেখতে পায়। সা’দ সেই পানি নিচে পড়তে দেয়নি। হাত দিয়ে মুছে নেয়। এই প্রথম তার মনে মাহার প্রতি ঘৃণার উৎপত্তি হলো। যেই ঘৃণা তীব্র আকার ধারণ করতে বেশি সময় লাগবে না।

চলমান…………………