বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ১৫
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]
বাবার বাসায় যাবে বলে মাহা সা’দদের বাড়ি থেকে বের হয়। বলেছিল বিকেলে চলে আসবে। কিন্তু এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। মাহার ফোন বন্ধ। সা’দ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাহাদের বাসায় যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারে মাহার আজ এখানে আসারই কথা ছিল না। সা’দ বুঝতে পারে মাহা ও বাড়ি থেকে মিথ্যা বলে বের হয়েছে।মোশাররফ হোসেন মেয়ে জামাইয়ের কথায় নিজের মেয়ের মিথ্যা বলার ব্যাপারটা অনায়াসে বুঝে গেলেন। লজ্জায় মাথা কাটা যায় তার।। এই মেয়েকে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন! আমিনা বেগমের উদ্বেগ বেড়েই যাচ্ছে এইভেবে যে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের মুখ দেখাবেন কী করে। এই ছিল কপালে! মেয়ের রাগ জেদ মেয়েকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।
সা’দ ওই বাসা থেকে বের হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। রাস্তার প্রতিটা অলিগলিতে মাহাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। কোথায় যেতে পারে মাহা। সা’দ মিমিকে ফোন দিয়ে জানতে পারে এই কয়েকদিন মিমির সাথেও যোগাযোগ করেনি মাহা। ইলেকশনের টেনশনে তার প্রতিটা রাতই নির্ঘুম কাটছে। আর এখন মাহার নিখোঁজ হওয়া। এই মুহুর্তে নিজের জীবনটা অসহ্য মনে হচ্ছে তার। ঘড়িতে নজর পড়লে সা’দ দেখতে পায় সাতটা বেজে গেছে। মোশাররফ সাহেব কিছুক্ষণ পর পরই সা’দকে ফোন করছেন। তিনিও বলেছিলেন সা’দের সঙ্গে বের হবেন। কিন্তু সা’দই নিয়ে আসেনি। আমিনা বেগমও কেঁদে কেঁদে অস্থির। মেয়েকে এত বোঝানোর পরেও মেয়ে এমন একটা কাজ কীভাবে করতে পারল।
ফোন বাজতেই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে নওমির ফোন। সা’দ এমনিতেই চিন্তায় অস্থির তার উপর এখন নওমির সঙ্গে কথা বললে সবটা ঘেটে ঘ হয়ে যাবে। ফোনটা কেটে অফ করে রাখে সা’দ। মাহার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে সা’দের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার।
★★
ক্যাম্পাসের ক্লাব ঘরে রাহাত চারপাশে তাকিয়ে ফোনে চাপা স্বরে বলছে, ‘মেয়েটা ঠিক আছে তো?’
ওপাশ থেকে কেউ একজন কিছু বলল। সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে রাহাত বলল, ‘সা’দের সব থেকে দুর্বলতাই কিন্তু মাহা। মাহার কিছু হলে সা’দ সব ধ্বংস করে দিবে। তাই বলছি, যা করবে ভেবেচিন্তে করবে।’
এতক্ষণ যাবৎ রাহাতের ফোনালাপ শোনার পর এক জোড়া পা সেখান থেকে সরে যায়।
★★
ফুটপাতের পাশেই হাঁটু গেড়ে বসে আছে সা’দ। সাড়ে আটটা বাজে। ফোন অন করে শ্বশুরকে ফোন করেছিল সে। মাহা ফিরেছে কি-না জানার জন্য। কিন্তু সেখান থেকে হতাশাজনক উত্তর পায় সে। কোথায় মাহা, কোথায় তাকে খুঁজবে এখন সে। কোথাও কোনো ক্লু নেই। এমন ক্লু লেস ভাবে কাউকে খুঁজে পাওয়াটা নিতান্তই হাজার কাঁচের মাঝে হিরা খোঁজার মতো।
মাথার চুলগুলো দুইহাতে চেপে ধরে রেখে মাহাকেই ভাবছিল সে। হঠাৎই ফোন আসে। সা’দ ভেবেছিল বাসা থেকে ফোন এসেছে। টেনশনের কারণে ফোনটা অফ করতে ভুলে গিয়েছিল সে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা নাম্বার দেখতে পায়। নাম্বার অপরিচিত হওয়ায় সা’দ দেরি না করে ফোনটা রিসিভ করে।
★★
তিনশো ফিটের রাস্তাটা বেশ চওড়া। কিছু কিছু জায়গায় ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে আবার কিছু কিছু জায়গা অন্ধকার। গাড়ির স্পিড তখন পুরো হাই। তিনশো ফিট থেকে কিছুটা দূরে একটা বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে গাড়ি থামে। বিল্ডিংয়ের চারতলার ছাদ পেটানো হয়েছে। তিনতলা পর্যন্ত কমপ্লিট। বিল্ডিংটা অনেক জায়গা দখল করে আছে। বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল ভেতরে অন্ধকার। সা’দ সাথে আরও দু’জনকে নিয়ে সরাসরি বিল্ডিংয়ের তিনতলায় পৌঁছয়। দরজা দিয়ে ঢুকেই হাতের বাম পাশের ঘরে চোখ যায় সা’দের। সেখানে দু’জন তাস খেলছে। যাদের সা’দ বেশ ভালোভাবে চিনে। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আশিক আর শুভ্র দৌড়ে গিয়ে ওই দু’জনকে ধরে ফেলে। সা’দ ভেতরে ঢুকে দরজা লক করে দেয়।
অন্ধকার একটা ঘরে মেঝেতে পড়ে আছে মাহা। গোলাকৃতির লাইটের আলো চোখে পড়তেই নড়ে ওঠে সে। ঘামে ভেজা মুখ আর পানি ভরা চোখে সামনে তাকায় মাহা। ফিরোজের কুৎসিত হাসিটা কানে লাগে তার। ভয়ার্ত চোখে ফিরোজকে দেখতে থাকে। যার সঙ্গে কথা বলে সে শান্তি পেত আজ তার হাসিটাই সব থেকে নিকৃষ্ট লাগছে। মাহা শোয়া থেকে উঠে বসে। দেয়াল ঘেঁষে গুঁজো হয়ে কম্পিত কন্ঠে বলে, ‘আমাকে এইখানে এইভাবে আঁটকে রেখেছ কেন ফিরোজ?’
মাহার কথা শুনে ফিরোজ অট্টহাসি দিয়ে বলে, ‘তোমার কি মনে হয় মাহা, আমি তোমাকে পছন্দ করি বা কিছু। নট লাইক দ্যাট বেবি। আমি তো তোমাকে জাস্ট টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছি। তোমাকে সরাতে পারলে সা’দ দুর্বল হবে। আর আমি দুর্বল সা’দকেই দেখতে চাই।’
সা’দের কথা শুনে মাহার নিজেকে এখন অসহায় লাগছে। ফিরোজ যে সা’দের ক্ষতি করার জন্য তাকে ব্যবহার করেছে এটা এখন সে বুঝতে পারছে। এই অন্ধকার কূপ থেকে তাকে কে বাঁচাবে, কী করে বের হবে সে এখান থেকে। ফিরোজের হাতে থাকা ছুরিতে নিজের মৃত্যুকে দেখছে মাহা। এই মুহুর্তে এই পরিস্থিতির জন্য সে নিজেই নিজেকে দায়ী করছে। কেন সে ফিরোজকে এতটা গুরুত্ব দিতে গেল। কেনই বা ফিরোজের সব কথাকে বিশ্বাস করতে গেল। আর কেনই বা ফিরোজের কথায় আজ মিথ্যা বলে বাড়ি থেকে বের হলো। সা’দকে প্রয়োজন এখন তার। কিন্তু সা’দ কি আদৌ আসবে এখানে? বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় মাহা। ফিরোজের কলার চেপে ধরে। চেঁচিয়ে বলে, ‘অ*মানু*ষের বা*চ্চা, এইজন্যই আমাকে এত ভালো ভালো কথা বলেছিলি তুই। সা’দের ক্ষতি করার জন্য তার বউকেই কাজে লাগিয়েছিলি।’
ফিরোজ মাহার হাত দুটো নিজের কলার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। ঠাটিয়ে এক চড় বসায় মাহার গালে। মাহার চুলের মুঠি ধরে বলে, ‘তুই কোথাকার দুধে ধোয়া তুলসীপাতা। বিয়ের পরেও আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করিস। সা’দকে যে তুই পছন্দ করিস না তা আমি জানতাম। জানতাম বললে ভুল হবে। জানতে হয়েছে আমায়। নয়তো ওকে শেষ করব কীভাবে আমি?’
মাহা গলা ফাটিয়ে বলে, ‘আমি বের হবো এখান থেকে। ছাড় আমাকে।’
ফিরোজ এবার মাহাকে ধাক্কা মারে। ধাক্কার টাল সামলাতে না পেরে মাহা ছিটকে পড়ে মেঝেতে। ফিরোজ খুব বিশ্রীভাবে গালিগালাজ করে মাহাকে। যা শুনে কানে হাত দিতে বাধ্য হয় মাহা। চিৎকার করে কান্না করে সে। দ্রুত গতিতে মাহার খুব কাছে আসে ফিরোজ। বলে, ‘অপেক্ষা কর। শুধু একটা দিন। এরপর তোর লাশ সাজিয়ে তোর স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দিব।’
ভয়ে মাহার আত্মা কেঁপে ওঠে। ফিরোজ মাহাকে আবারও ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায়। মাহা সেভাবেই কান্না করতে থাকে। কান্না করতে করতে সা’দকে মনে পড়ে তার। মনে পড়ে বউভাতের রাতে সা’দকে সে এইভাবেই ধাক্কা মেরেছিল। ঠিক একইভাবে সা’দ ছিটকে পড়েছিল মেঝেতে। গালে ব্যথা অনুভব করছিল মাহা। গালে হাত দিতেই সা’দের সেই স্পর্শের কথা মনে পড়ে তার। যেই স্পর্শের কারণেই সা’দকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। মুখ চেপে চিৎকার করে কান্না করছে মাহা। তার একটাই ভয়, ফিরোজের সঙ্গে তার এই মেলামেশার কথা যদি সা’দ জানতে পারে তাহলে সে কী রিয়্যাক্ট করবে? এখন মনে হচ্ছে নিজের পায়ে কুড়ালটা সে নিজেই মেরেছে।
মিমির বলা সেই কথাটাও মনে পড়ে তার। মিমি বলেছিল, শোন মাহা, এতটা বাড়াবাড়িও করিস না। পরে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে। আসলেই সে আজ হিমশিম খাচ্ছে। প্রচন্ড তৃষ্ণায় কণ্ঠনালী বন্ধ হয়ে আসছে তার। একটু পানির জন্য প্রাণটা ছটফট করছে।
তৃষ্ণায় মাহার মুখ থেকে বের হয়, ‘সা’দ, তুমি কোথায়? প্লিজ আমাকে বাঁচাও।’
চলমান…………………