বিরোধীদলীয় প্রেম পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
302

বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ২০
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]

সা’দের ঘুম ভাঙে ঝুপঝুপ বৃষ্টির শব্দে। আড়মোড়া ভেঙে এপাশ ওপাশ করতেই দেখে পাশে মাহা ঘুমোচ্ছে। স্লাইড ডোর খোলা থাকায় বারান্দায় বৃষ্টির পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। মাঝরাতে সা’দ উঠেছিল একবার। সিগারেট টানার জন্যই স্লাইড ডোর খুলে সেখানে ধোঁয়া ছেড়েছিল। সিগারেটে শেষ টান দিবে তখনই মাহা এসে সেখানে উপস্থিত হয়। শরীরে বস্ত্র বলতে সাদা ধবধবে তোয়ালে। তোয়ালেটা সা’দের। মাহার বাম হাত তার কাঁধ স্পর্শ করে। তার মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় কোনো সুখ তাকে স্পর্শ করছে। জ্বলন্ত সিগারেটটা বাইরে ফেলে সে মাহার খুব নিকটে চলে আসে। মাহা ততক্ষণে চোখ দিয়েই তাকে খুন করেছে। মাহার এই উষ্ণ অভ্যর্থনা সে নাকচ করার সাহস পায়নি। কোলে তুলে বিছানার দিকে অগ্রসর হয় সা’দ। দ্বিতীয়বারের মতো ডুব দেয় মাহার গভীর ভালোবাসায়। বাইরে তখন মুশলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। তপ্ত মাটি আর বৃষ্টির পানি একত্রিত হয়ে সোঁদা গন্ধের সৃষ্টির করেছে। সেই মাতাল করা গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সা’দ মাহা উভয়ের উপোস শরীর। মাঝরাতের পর দু’জনের মধ্যে আর কথা হয়নি। পুরো ঘরে কেবল সুখের আর্তনাদ।
মাঝরাতের কথা মনে পড়তেই সা’দের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় সা’দ। সিগারেটে আগুন জ্বালায়। প্রথম টান দেওয়া মাত্রই মাহার স্পর্শ অনুভব করতে শুরু করে। দরজার সামনে থেকেই সে ঘরের দিকে তাকায়। মাহা তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সিগারেট শেষে সা’দ ফের বিছানায় আসে। কমফোর্টের ভেতর নিঃশব্দে ঢোকে। মাহার কাছে এসে ঘুমন্ত মাহাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সা’দের স্পর্শে ঘুম ভাঙে মাহার। চোখের সামনে সা’দকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাহা। শরীরটা হালকা হয়। মাহা সা’দের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমার বিরোধীদলীয় প্রেমিক, ঘুম কখন ভাঙল?’
সা’দ মুচকি হেসে জবাব দেয়, ‘আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো!’
‘একদম দুষ্টুমি করবে না। আমাকে ছাড়ো।’
সা’দ এবার মাহাকে নিজের বুকে জড়ায়। বলে, ‘আমার ভালোবাসাকে পরিপূর্ণ করার জন্য তোমাকে কী দিই বলো তো?’
‘আমার কিছুই লাগবে না সা’দ। নিজের ভুল বুঝতে পেরে তোমার ভালোবাসাকে আপন করতে পেরেছি। সত্যি বলতে আমি কখনো ভাবিনি এভাবেও ভালোবাসা যায়। কথায় আছে না মানুষ হারিয়ে তারপর শেখে। আমি হারানোর আগেই শিখেছি। হারিয়ে গেলে তোমার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারতাম না তো।’
সা’দ মাহাকে আবারও জড়িয়ে ধরে। মাহার কথা শোনার পর সা’দের সেদিন রাতের কথা মনে পড়ে। কী ভয়ংকর দৃশ্য ছিল! মুখোমুখি ফিরোজ আর মাহা। মুহুর্তের মধ্যে ফিরোজ মাহাকে ঘুরিয়ে তার গলা চেপে ধরল। উফফ! আর কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে মাহাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারত না সে।

★★

পড়ন্ত বিকেলে ছাদে বসে আছে মাহা। হাওয়া এসে তার খোলা চুলে খেলা করছে। নওমি পাশে এসে দাঁড়ায়। মাহার ধ্যান তখন সামনে ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে। পাশের খালি জায়গায় নওমি বসে পড়লেও মাহার ধ্যান ভাঙেনি। যা নওমিকে হতাশ করল। পাশে বসে সে মাহার কাঁধে হাত রাখে। হালকা ধাক্কায় মাহার ধ্যান ভাঙে। জা’কে পাশে দেখে খানিক ভড়কে যায় মাহা। মাহাকে ভড়কে যেতে দেখে নওমি চাপা হাসি হাসে। বলে, ‘ঘটনা কী! এত উদাস কেন?’
মাহা নড়েচড়ে বসে। বলে, ‘কিছু না ভাবী।’
‘সা’দের কথা ভাবছিলে মনে হচ্ছে।’
‘নাহ। তেমন কিছু না।’
মাহা যে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে নওমি। তবুও সে মাহার সঙ্গে দুষ্টুমি শুরু করে।
‘এই মাহা, শোন।’
‘হু ভাবী।’
‘সেদিন রাতে কী কী করলে গো তোমরা?’
নওমির কথা শুনে মাহার চোখ বড় হয়। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা টানে। এরপর বলে, ‘তুমি আর ভাইয়া রাতে যা যা করো।’
নওমি চোখ পাকিয়ে বলে, ‘পাজি মেয়ে!’
‘এখন কেন পাজি। তুমি কেন এমন প্রশ্ন করলে?’
‘আমি করতেই পারি। আমি বড় না?’
‘আমিও বলতে পারি। আমি তোমার ছোট বোন না?’
নওমি হাসে৷ এ বাড়িতে তার বান্ধবী হিসেবে মাহাকে পেয়ে সেও ভীষণ খুশি। তার থেকে বেশি খুশি সা’দ আর মাহার সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়েছে। নওমি আবারও বলে, ‘বলেছিলাম না তোমাকে, একবার সা’দকে ভালোবেসে দেখ। দেখবে সা’দ তোমাকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে। জানো মাহা, এ বাড়ির প্রত্যেকটা পুরুষ তাদের স্ত্রীকে অদ্ভুতভাবে ভালোবাসে। বিয়ের পর এখন পর্যন্ত আমি দেখিনি বাবা মা’কে ধমকের সুরে কথা বলেছেন। কিংবা মা বাবার সঙ্গে মুখ কালো করে কথা বলেছেন। তদ্রুপ তোমার ভাইও। ভীষণ ভালোবাসে আমাকে। আমিও তাকে তার মতো করে ভালো রাখার চেষ্টা করি। সা’দও তার বাবা আর ভাইয়ের মতো। তবে সা’দ একটু রাগি। আর কিছুই না। বলেছিলাম না, ওর দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালেই বুঝতে পারবে সা’দের পুরোটাতে কেবল তুমি মিশে আছো।’
মাহা নওমির দিকে তাকায়। তারপর উঠে ছাদের কোণায় গিয়ে দাঁড়ায়। নওমিও তার পিছু পিছু সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘কী হলো?’
মাহা দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বরাবরই নিজেকে ঠিক প্রমাণ করতে গিয়ে তাকে ভুল বুঝলাম যে আমায় ভালোবাসে। ভুলকে সঠিক ভাবলাম। সত্যি বলতে ভাবী, আমি এখন ভাবি আমি বোধ হয় সা’দের যোগ্য নই। সা’দের মধ্যে সত্যিই এমন কিছু আছে যা আমাকে বাধ্য করেছে সা’দকে ভালোবাসতে। ভাবী জানো, ফিরোজ যখন আজরাইল হয়ে আমার জান কবজ করছিল তখনই সা’দ ফেরেশতা হয়ে আমার জান বাঁচাল। আমি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেই বুঝেছি আমার জীবনে কার অবদান বেশি, কোনটা আমার জন্য ঠিক।’
‘আমি জানতাম, তুমি একদিন ঠিক বুঝবে যে সা’দ তোমার জন্য কী। আমি দোয়া করি তোমরা এইভাবেই ভালো থাকো। আর জলদি জলদি আমাদের ঘরে নতুন মানুষের আগমন ঘটুক।’
মাহা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে মুচকি হেসে সিঁড়িঘরের দিকে পা বাড়ায়। নওমি পিছু ডেকে বলে, ‘ওই মেয়ে, দাঁড়াও। আমিও নামব।’

★★

গভীর রাত। বন্ধ ঘরে চাপা নিঃশ্বাস পড়ছে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সা’দ আর মাহা উভয়েই ভালোবাসার খেলায় মেতে থাকার পর কমফোর্টের তলা থেকে মাথা বের করে। এসির ঠান্ডাতেও সা’দ ঘামিয়ে গেছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম মাহার কপালেও জমেছে। সা’দের বুকে নাক ঘষছে মাহা। সা’দ নিজ হাতে মাহার কপালের ঘাম মুছে দেয়। মাহাও নিজের হাত সা’দের কপাল পর্যন্ত নেয়। তখনই সা’দ মাহার হাত ধরে ফেলে। তারপর খানিক নিচে নেমে মাহার নগ্ন বুকে মাথা গুঁজে। বলে, ‘ঘাম মুছতে হবে না মাহা। আমায় জড়িয়ে ধরো।’
মাহাও পরম যত্নে সা’দকে নিজের বুকে ঠাঁই দেয়। বলে, ‘ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছ।’
‘তোমার কষ্ট হয়নি তো?’
‘নাহ তো। কষ্ট কেন হবে?’
‘এইযে আমি তোমাকে এতক্ষণ এত জ্বালাতন করলাম।’
মাহাও এবার নিচু হয়ে সা’দের মুখোমুখি শোয়। তারপর সা’দের কপালে চুমু খায়। জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘তোমার এই জ্বালাতনে আমি সুখ অনুভব করি সা’দ। তোমার ভালোবাসাগুলোকে আগলে রাখতে আমারও ভালো লাগে।’
‘আমি তোমাকে কি বেশিই জ্বালাই?’
‘নাহ। একদমই না। আমি চাই তুমি আমায় সারাক্ষণ জ্বালাও।’
‘তাহলে একজন জুনিয়র আসতেই পারে আমাদের মধ্যে। কী বলো?’
মাহা লজ্জা পায়। সা’দের বুকে মুখ লুকায়। নিচু স্বরে বলে, ‘জানি না।’
সা’দও শব্দ করে হাসে। বলে, ‘জানতে হবে না। পড়াশোনা শেষ করো। তারপর দেখা যাবে।’
‘আমাদের বিরোধীদলীয় প্রেমের সমাপ্তি ঘটল তাহলে। তাই না?’
‘এখন কি তবে একদলীয় প্রেমের অধ্যায় শুরু হবে?’
‘হোক না তবে। এই প্রেমে দু’জনেই ঘায়েল হলাম।’
‘প্রেমের তীরে ঘায়েল হতে আমার আপত্তি নেই।’
মাহা সা’দের বুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সা’দের এই ভালোবাসাটা তার প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রয়োজন।
অন্যদিকে সা’দ বুক ভরে নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, সারাজীবন যাতে এভাবেই তোমাকে কাছে রাখতে পারি। আমার ভালোবাসাকে যেন যত্নে রাখতে পারি। ভালোবাসি মাহা।
মাহা শব্দ করেই বলে, ‘ভালোবাসি সা’দ।’
প্রতুত্তরে সা’দ কিছু বলেনি। সে মাহার ঘাড়ে নিজের ঠোঁট ডোবায়। বিরোধীদলীয় প্রেমের সমাপ্তি ঘটে একদলীয় প্রেমের শুভ সূচনা হোক। সুখী হোক সা’দ মাহা দম্পতি। সুখী হোক সমস্ত একদলীয় প্রেমীরা।

সমাপ্ত