বিষচন্দ্রিমা পর্ব-০৮

0
2

#বিষচন্দ্রিমা
#পর্ব৮
#তামান্না_আনজুম_মায়া
বৃষ্টিতে মুখরিত নিস্তব্ধ রাতে কেমন নিশ্চুপ সব কিছু,প্রতিটি মানুষ ব্যস্ত নিজ কাজে,কেউ জানালার কাঁচ ভেদ করে ছুটে আসা বৃষ্টি ছোঁয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে,কারো বা কাঁথা মুড়িয়ে বসে থেকেও তীব্র ইচ্ছে জেগেছে ঝুম বৃষ্টিতে রাতের আকাশের নিচে মন খুলে ভিজতে।কতো শতো অবাধ্য ইচ্ছের আনাগোনা।
ফাঁকা ড্রয়িং রুমটার প্রতিটি কোনায় ছেয়ে গেছে তরীর হাসির শব্দ, শব্দের প্রতিধ্বনিতে স্তব্ধ পরিবেশ ও কিছু সময়ের জন্য কম্পিত হয়েছে।
ফারাবী মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দেখলো সে হাসি।মেয়েটার হাসি এতো সুন্দর কেনো এই হাসি দেখার জন্য ফারাবীর মনে হলো সে সব করতে পারবে সব!
এতোটা উতলা কেনো হচ্ছে সে?নিজেকে কি মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে ফেলছে!

হাসতে হাসতে সোফাতে ঢলে পড়া হরিণীর ন্যায় চোখের অধিকারি মেয়েটি তার রিনিঝিনি কন্ঠে বললো

,,আপনি তো দেখছি মজা ও বুঝেন না,আপনি তো পুরো সিরিয়াস হয়ে গেছেন মশাই!

ফারাবী চুপ রইলো কিছুক্ষণ, তরীর হাত টেনে বললো
,,চলো এবার খাবার খাবে। বেশি কথা বলেছো তো তুলে বাহিরে ফেলে দিয়ে আসবো।

তরী গেলো ফারাবীর সাথে হাসতে হাসতে ওর চোখের কোনে জল জমা হয়ে গেছে,তরীর কথা শুনে ফারাবী যে ভাবে তাকিয়ে ছিলো তরী আর নিজের হাসি আটকে রাখতে পারেনি।
শোয়া নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে থাকলেও করা হয়নি আর ফারাবী বলে দিয়েছে কথা বললে মুখে কস্টিপ আটকে দিবে।তাই মাঝে কোলবালিশ দিয়ে বর্ডার করে ঘুম দিয়েছে দুজন।

——-
তরীর ঘুম সকালে আগে ভাঙ্গলো,সারারাত ভারি বর্ষণের পর সূর্য মামা একদম নিজের সব তোড়জোড় সাথে নিয়ে উঠেছে।জানালার কাঁচ ভেদ করে রোদ এসে সরাসরি তরীর মুখে পড়েছে,সকালে সে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে,পাশে থাকা কুম্ভ*কর্ণটাকে ডেকেও উঠাতে পারেনি,অযথা ভোর বেলা পানি ঢেলে দিলে আরেক দফা ঝা*মেলা হতো তাই বেশি ঘাটেনি তরী ফারাবী কে।তরীর নিজের চিন্তার মাঝে মনে হলো ওর মুখের উপর গরম কিছু একটা পড়ছে বার বার,চোখ উপরে তুলে যা দেখলো তাতে একটা বড়সড় চিৎকার দিতে ভুললো না তরী।
চিৎকার দিয়ে তরী এক ঝটকায় দূরে সরে গেলো।চিৎকারের ঠেলায় বেচারা ফারাবী লাফ দিয়ে বিছানায় বসে পড়েছে।তরীর দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকালো কি হয়েছে জানার জন্য।

তরী ফারাবীর দিকে তাকিয়ে বকতে বকতে বললো

,,খারা প, অস ভ্য, অভদ্র ছেলে এই ছিলো আপনার মনে, আমাকে ওরকম ভাবে চেপে ধরে ঘুমিয়েছিলেন কেনো আপনি?লজ্জা করে না শয়*তান মার্কা ছেলে আমাকে কি কোলবালিশ মনে হয় আপনার?কাল থেকে ভুলেও আমি আপনার সাথে ঘুমাবো না।না জানি আমি ঘুমানোর পর কি কি করেন!

ফারাবী বড় বড় চোখ করে তাকায় অবাক হয়ে বলে

,,এ্যাহ!আমি কখন তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি মিথ্যা বলার জায়গা পাও না নাকি!

তরী তেড়ে এসে বললো
,, আপনি যে একটা ছুঁচো বিড়াল তা তো জানতাম না,খেয়ে দেয়ে মুখ মুছে একদম সাধু সেজে গেছেন।এমন ভাব আপনি আমাকে চিনেনই না!

,,কখন কি খেলাম?কিসের মধ্যে কি বলো।তোমাকে খেতে যাবো কেনো আমি?

তরী কান চেপে ধরে বলে
,,ছি!ছি! কি অশ্লী*ল কথা বার্তা। আপনাকে একটু হলেও ভালো মনে করেছিলাম।আপনি তো দেখছি পুরোটাই নষ্ট!

তরী দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে,ফ্রেশ হয়ে সোজা চলে গেলো ড্রয়িংরুমে, যাওয়ার সময় ফারাবী কে একটা ভেংচি কাটতে ভুলেনি।ফারাবী তখন তৈরি হচ্ছে,মেয়েটা সব সময় মুখটাকে কার্টুন বানিয়ে রাখে কোন দুঃখে তার বুঝে আসে না।ফারাবী শার্টের উপরের অংশের দুইটা বোতাম খুলে রাখা,চুল গুলো সুন্দর করে সেট করা, হাতা ফোল্ড করতে করতে বেরিয়ে আসছে রুম থেকে তরী একবার তাকিয়েও চোখ ফিরিয়ে নেয়।এ ছেলেকে দেখার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই তার।
আজকে তরী ভার্সিটি যাবে না সে বাসায় চলে যাবে, শাড়ি পড়ে ভার্সিটি যাওয়াটা ওর কাছে কেমন যেনো লাগে,কোনো অনুষ্ঠান হলে তা ভিন্ন কথা।কলিং বেলের চাপ লাগতেই আওয়াজ শুনে তরী উঠলো দরজা খোলার জন্য ও খাবার অর্ডার করেছিলো ভেবেছে ডেলিভারি ম্যান এসেছে।কিন্তু না ফারাবী ডেকে বললো

,,এই তুমি এসে বসো দরজা আমি খুলছি না হয় দরজার অপর পাশের ব্যক্তি তোমাকে দেখে অ জ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে!

তরী বিরবির তরে ফারাবী কে দুই চারটা গা লি দিয়ে দিলো। আবার এসে সোফায় বসলো।
মনোনিবেশ করলো নিজের মোবাইলে কে আসলো কে গেলো এসব দেখে ওর লাভ নেই।

ফারাবী দরজা খুলতেই ভিতরে ঢুকলো তন্ময়,তামিম,অয়ন তিন জনের দল বেঁধে আসার পিছনে অবশ্য কারন আছে,তাদের বন্ধু কি রহস্য ভেদ করবে তা তো দেখতেই হতো।
অয়ন এসেই টেবিলের উপর থেকে একটা পেয়ারা উঠিয়ে তাতে কামড় বসালো, পেয়ারা মুখে নিয়ে
অয়ন বলতে নিছিলো
,,ফারাবী তোর রুম এতো পরি,,,,
বেচারার আর পুরো কথা শেষ করা হলো না সোফায় শাড়ি পড়িহিত রমনীকে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকতে দেখেই কথা সব কর্পুরের ন্যায় উবে গেলো।অয়ন কে হা করে থাকতে দেখে তামিম এসে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করলো,দুজনই নিজেদের মুখ দেখলো একবার করে তরী এখনো দেখেনি একজনকেও সে খুব মনোযোগ দিয়ে গেইম খেলছে।তন্ময় এসে দুজনের পিঠে চাপড় মেরে বললো

,,কিরে এমনে বেআক্ক লের মতো হা হয়ে গেছিস কেনো দুজনে?

তামিম আঙুল দিয়ে ইশারা করলো তরীর দিকে।তন্ময় তো এবার চেঁচিয়ে বলে উঠলো

,,তরী তুমি এখানে?

ফারাবী ততক্ষণে গিয়ে তরীর পাশে সোফায় বসে পড়েছে,ওর মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। আপন মনে নিজের চুল ঠিক করছে।তরী কানে হেড ফোন গুঁজে রেখেছে তাই সে তন্ময়ের ডাক শুনতে পায় নি।
তরীর মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য ফারাবী তরীর চুলে এক টান মারলো।তরী ফুঁসে উঠলো কি সমস্যা এই ছেলের শান্তিতে থাকতে দিবে না নাকি,তরী হেড ফোন কান থেকে খুলে নিলো এক হাত দিয়ে নিজে ফারাবীর দিকে ঝুঁকে ওর চুল এলোমেলো করে দিয়ে নিজেও একটা টান মেরে দিলো।
দর্শকের মতো সব কাহিনি দেখে যাচ্ছে অয়ন, তন্ময়,তামিম।তামিমের বলতে মন চাইলো আরে আমরা তো এখানে আছি আমাদের তো অন্তত একটু দেখ তোরা দুজন।
ফারাবী ডাকলো
,,তোরা ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো সোফায় এসে বস।তরী ওদের কে দেখেই পা নামিয়ে ঠিক ঠাক হয়ে বসলো।
সবার উদ্দেশ্য বললো
,,আরে ভাইয়ারা আপনারা কখন আসলেন,সরি আমি আসলে খেয়াল করিনি।
তরী সবার এরকম সন্দিহান চোখে তাকানো দেখে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলো,আঁড়চোখে একবার তাকালো ফারাবীর দিকে।

ফারাবীও তাকিয়ে আছে তরীর দিকে।তন্ময়, অয়ন, তামিম ও তাকিয়ে আছে,তরী এবার বিরক্ত হয়ে বললো

,,আপনারা সবাই আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?

অয়নের অবাক কন্ঠ
,,তুমি এখানে কেনো?

তরী সরল মনে বললো
,,আমি মোটেও আসতে চাইনি ভাইয়া,মা জোর করে পাঠিয়েছে,না হয় কে আসে বাঘের গুহায়!

তন্ময় চোখ পিট পিট করে তাকায় ফারাবীর দিকে,তরীর দিকে তাকিয়ে বলে

,,তোমার মা তোমাকে ফারাবীর বাসায় কেনো পাঠাবে?

,,আমার মা বলতে আমার শাশুড়ী মা ভাইয়া!

তিনজন একসাথে বলে উঠে

,,তুমি বিবাহিত!

তরী এবার ফারাবীর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়, এ ছেলে নিশ্চিত নিজের বন্ধুদের কিছু বলেনি,বিয়ে করে সিঙ্গেল থাকা বের করবো আমি।

তরী দুঃখী দুঃখী ফেইস বানিয়ে বলে

,,হ্যাঁ ভাইয়া কি আর বলবো দুঃখের কথা।আমাকে এক প্রকার জোর করে আমার স্বামীর বাড়ি থেকে তুলে এনেছে আপনার বন্ধু।আমাকে নাকি স্বামীর সংসার করতে দিবে না, কোন সকাল থেকে এখানে বসিয়ে রেখেছে জানেন নড়তে চড়তে পর্যন্ত দেয়নি।বলুন ভাইয়া আমার কি দোষ এখানে,উনাকে ভার্সিটিতে ভাইয়া ডাকায় এমনটা উনি কিভাবে করলেন আমার সাথে!

তন্ময় তো অবাকের চরম সীমায়,কি বলছে কি মেয়েটা!তন্ময় অবিশ্বাস্য সুরে বললো

,,এসব কি সত্যি ফারাবী?তুই তরীর সাথে,,,

এর মধ্যেই ফারাবী তরীর হাত চেপে ধরে বললো

,,আঙ্গিনার বাচ্চা আজকে তোমার একদিন কি আমার।আমি তোমাকে তোমার স্বামীর সাথে সংসার করতে দিচ্ছি না?তুলে এনেছি?

তামিম বলে উঠলো

,,কি করছিস কি ওর হাত ছাড় ফারাবী!

ফারাবী রেগে গেছে পুরো চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে
,,আমার বউয়ের হাত আমি ধরেছি,ছাড়বো না তাতে তোর কি!

তরী প্রতিবাদী সুরে বলে
,,এই কে আপনার বউ?আমি আপনার বউ না!

ফারাবী যেনো দ্বিগুণ রেগে গেলো,তরীর হাত আরো কিছুটা চেপে বললো

,,রুমে চলো বুঝিয়ে দিচ্ছি তুমি আমার কে হও!

তরী চোখ বড় বড় করে তাকালো,কি নির্লজ্জ এই ছেলে,সবার সামনে কিভাবে বললো রুমে চলো।তরী নাক মুখ কুঁচকে ফেললো।মিনমিন করে বললো

,,ভুল হয়েছে, আর বলবো না এবার হাত টা ছাড়ুন।

ফারাবী মাছি তাড়ানোর মতো করে বলে
,,এবার বলো তুমি আমার কে হও?

,,ব,,উ বউ!

অয়ন বলে উঠলো
,,ফারাবী তুই বিয়ে করেছিস?একবার বললিও না আমাদের,কিভাবে হলো কবে হলো?

তন্ময় একবার তাকায় তরীর দিকে একবার ফারাবীর দিকে।
তরী কাচুমাচু হয়ে বসে আছে।ফারাবী তিন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললো

,,বুঝলি তো ওইদিন আমার বাপ আমারে কেনো কিছু বলেনি?সোজা ধরে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে। আর শা*লা আমি ভাবতে ভাবতে শেষ কার না কার সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।

তন্ময় বুঝলো সব কিছু,তার মানে আংকেল তরীর সাথর ফারাবীর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
তন্ময় হাসলো,কারন তরী যথেষ্ট ভদ্র মেয়ে ব্যবহারের দিক দিয়েও মেয়েটা যথেষ্ট নম্র, ফারাবী ভুল করে হলেও, তরীর মতো একটা হীরের টুকরো বউ পেয়ে গেছে, বন্ধুর ভাগ্য সত্যি ভালো!
চলবে…..