#বড় গল্প
#বিষন্ন বিকেল
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী
—মা,নানাকে বলে দিবে তোমার সাথে যা করেছে তা যেন আমার সাথে করতে না আসে। আমি এখন কিছুতেই বিয়ে করবো না। সে যদি কোনো দেশের রাজপুত্র হয় তাও না।
সাবেরা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আহা! আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে ও যদি এভাবে প্রতিবাদ করতে পারতো তাহলে হয়তো এমন অবহেলিত জীবন ওকে যাপন করতে হতো না। মেয়ের বয়স একুশ বছর। এবছর ঢাকা ভার্সিটিতে সিএসসি ডিপার্টমেন্টে চান্স পেয়েছে। মেয়েটাকে নিয়ে ওর অনেক আশা। আজ ওর একটা বিয়ের সমন্ধ এসেছে। সাবেরার বাবা এনেছে। ছেলে আমেরিকান সিটিজেন। ওখানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে একটা প্রমিন্যান্ট কোম্পানীতে জব করছে। ওদের পুরো পরিবার ওখানেই সেটেলড। কোনো দেওয়া থোওয়ার বিষয় নেই। বিয়ে করে ছেলে চলে যাবে। তারপর কাগজ পাঠিয়ে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে যাবে। প্রথমে গ্রীন কার্ড। পরে সিটিজেন। স্পাউসদের কাগজ হতে খুব বেশী সময় লাগে না। ছয় মাস থেকে একবছর। সাবেরা জানে এই সমন্ধ না করে দিলে ওর মেয়ের জন্য কেউ আর পাত্র দেখবে না। তবে জীবনের এতো বন্ধুর পথ ও পাড়ি দিয়েছে সেক্ষেত্রে কিছু সাহস ও আজ সে অর্জন করেছে। তাই মেয়ে যেহেতু চায় না তাই ওর ও মত নেই। আগে মেয়েকে দ্বীন এবং দুনিয়ার শিক্ষায় ও পরিপূর্ণভাবে মানুষ করে তুলবে তারপর বিয়ের কথা ভাববে।
সাবেরার বাবার কথা হচ্ছে মেয়েছেলেদের এতো লেখাপড়া শিখিয়ে লাভ নেই। সেই তো গিয়ে বাচ্চা পয়দা করবে আর হাড়ি ঠেলবে। ছেলেটা তো মানুষ হয়নি। আর মেয়েটা ভার্সিটি কখন কোন ছেলের সাথে পালিয়ে চলে যায় তখন মুখে চুনকালি পড়বে। সাবেরা ভাবে,ওর বাবা অবলীলায় কিভাবে এই কথাগুলো বলে গেল? সাবেরা অবশ্য কখনও প্রতিবাদ করতে পারেনি। কিংবা ওকে এমনভাবে বড় করা হয়েছে এই গুনটি ওকে আয়ত্ব করতে দেওয়া হয়নি। ও ওর বাবা মায়ের বড় সন্তান।
ওকে ওর বাবা এসএসসি পাশের পর নিজের বোনের ছেলের সাথে বিয়ে দিলো। কারণ হিসাবে যুক্তি খাঁড়া করলো ওর গায়ের রং। বরঞ্চ বোনের ছেলে সাবেরার মতো কালো মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে বলে ওর বাবার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সাবেরার তখন অল্প বয়স। রায়হান ওদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করেছে। আর সাবেরার মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। এতো অল্প বয়সে বিয়ে দিতে ওর মায়ের আপত্তি ছিলো। কিন্তু ওর বাবার ঐ এক কথা। মেয়ে সন্তান বাচ্চা পয়দা করবে আর হাড়ি ঠেলবে। সুতরাং এতো লেখাপড়া শিখিয়ে কাজ নেই।
এই কথাটা শুনলে সাবেরার খুব বিরক্ত লাগে। লেখাপড়ার সাথে কেন মেয়েদেরবেলায় এই প্রসঙ্গটা আনা হবে। কারণ সাবেরার কাছে বাচ্চা জন্ম দেওয়া একটা সম্মানের বিষয়। আল্লাহপাক নারী জাতিকে সম্মানিত করেছেন। অথচ অনেক পুরুষ মানুষ তো বটেই অনেক মহিলারাও এই বিষয়টা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। অথচ বাচ্চা জন্ম দেওয়া তাকে সঠিকভাবে লালন পালন করে বড় করে তোলা সবটাই ইবাদত। কারণ জন্ম দিয়ে নারীরা মা হয় কিন্তু আল্লাহপাকের তরফ থেকে ঐ বাচ্চা কিছুদিনের জন্য বাবা মায়ের কাছে আমানত থাকে। এই সময় বাবা মায়ের উচিত তাকে সঠিকভাবে দ্বীন এবং দুনিয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত করা। ওর বাবা ওর সাথে পেরেছে। কিন্তু ওর বাকি বোনদের সাথে পেরে উঠেনি। ওরা ঠিকই ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিয়ে করেছে। স্কুলে চাকরি করছে। তবে ওর ভাইটা পাবলিকে চান্স পায়নি। ওকে নর্থ সাউথে পড়িয়েছে। এতে অবশ্য ওর বাবার কোনো সমস্যা নাই। ছেলে সন্তান বলে কথা। সাব্বির এখন একটা প্রতিষ্টিত কোম্পানিতে চাকরি করছে। রুপার কথায় সাবেরা ভাবনার অতল থেকে ফিরে এলো।
—কি অত ভাবছো মা? তোমাকে কি বললাম? শুনেছো তো?
—-হুম,শুনলাম।
—-নানা ভাইকে বলে দিবে আমার বিয়ে নিয়ে তাকে অত ভাবতে হবে না। আমি আগে নিজেকে মানুষের মতো করে গড়ে তুলি। তারপর পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করে নেই এরপর বিয়ের কথা ভাববো।
—-,আমার তো সমস্যা নেই। দেখি তোর বাবা কি বলে?
—আমি জানি,বাবা আমার কথাটাই গ্রহন করবে। সমস্যা করবে তোমার বাবা। দরকার পড়লে বুড়োটাকে আবার একটা বিয়ে দিয়ে দাও।
একথা বলে দুম করে সামনে থেকে রুপা চলে গেল। মেয়েটাকে নিয়ে অবশ্য সাবেরাও অনেক স্বপ্ন দেখে। রুপা ছোটো। সাবেরার ছেলেটা বড়। কিন্তু ছেলেটাকে সঠিকভাবে গাইড করতে পারেনি। ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলো। যদিও এর দায়টা রায়হানের উপরে বর্তায় কিন্তু ঐ যে জন্ম দিয়েছে সাবেরা। তাই ওরই সব দায়। প্রতিদিন রায়হানের কাছে শুনতে হয়
” বাসায় থেকে করোটা কি? ছেলেকে তো মানুষ করতে পারলে না। কি করে এই মুখটা তুমি মানুষকে দেখাও। তোমার জায়গায় আমি হলে কবেই আত্তাহুতি দিতাম।”
সাবেরা রায়হানের কথাগুলো শুনে সত্যি খুব অবাক হয়। লোকে কি ভাবলো তা নিয়ে ভাবছে। অথচ বাচ্চাটার জীবন যে নষ্ট হতে চলেছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। অথচ ছেলেটার এই অধঃপতনের পিছনে ঐ দায়ী। সারাক্ষণ সাবেরার পিছনে লেগে থাকে। সেই সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতো আর বাসায় ফিরতো রাত দশটায়। তারপর সাবেরার সাথে খিটিমিটি করতো। সাবেরা দেখতে সুশ্রী না। এটা নিয়ে নিত্য খোঁটা দেওয়া চাই। সাবেরার ভালো রাঁধতে পারে না। ওর ফিগার সুন্দর না। ওর কোনো ক্যারিয়ার নেই। শুধু গান্ডে পিন্ডে গিলতে পারে এসব কত কি? এমনকি সাবেরাকে রায়হান কখনও হাতখরচ ও দেয়নি। মানুষের কত প্রয়োজন থাকতে পারে? সাবেরার মাঝে মাঝে মনে হতো রায়হান হয়তো ভুলেই যায় ও যে একটা মানুষ। নিত্য কথার খোঁচা তো আছে। তার কলিগরা শ্বশুর বাড়ি থেকে কত কিছু গিফট পায়। আর ওরই পোড়া কপাল। জুটেছে হাড়হাভাতে শ্বশুরবাড়ি। সাবেরা সে সময় ডিপ্রেশনে চলে যায়। ছেলেটার দিকে খেয়াল রাখতে পারেনি।
রায়ান তখন কেবল এসএসসি পাশ করে বাংলা কলেজে ভর্তি হয়েছে। এসএসসির রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি।ভালো হবে কি করে? টিচারের কাছে শুধু অংক আর ইংলিশটা পড়িয়েছে। আর কোনো টিচার দেয়নি।৩.৭৫ সিজিপিএ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাশ করেছে। রেজাল্ট আশানুরুপ না হওয়াতে ইন্টারে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে পারেনি। কমার্সে ভর্তি হয়েছে।রায়ানের রেজাল্ট ভালো না হওয়াতে রায়হান সাবেরাকে আরো বেশি কথা শোনানোর সুযোগ পায়। এদিকে রায়ান ওর বাবাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে।
নিত্য বাবা মায়ের এসব অশান্তি দেখে কবে থেকে যে রায়ান মাদক নিতে শুরু করেছে সাবেরা বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পারলো তখন অনেক সময় গড়িয়ে গিয়েছে। রায়ান যেদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়লো সেদিন সাবেরা আর রায়হান জানতে পারলো ছেলে তাদের মাদকাসক্ত। রায়ান মাদক বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। অনেক টাকা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ছেলেকে ওরা ছাড়িয়ে এনেছে। তবে সেদিন থেকে সাবেরা নিজেকে রায়হানের কাজ থেকে পৃথক করে ফেলেছে। তারা এখন শুধু কাগজে কলমে স্বামী স্ত্রী। সাবেরা প্রতিদিন রান্না করে। সংসারের সব কাজ কর্ম করে। রায়হানকে সময় মতো খাবার এগিয়ে দেয়। এছাড়া তাদের মাঝে আর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ সাবেরা তখন ছেলেকে নিয়ে এক নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে। রুপা অবশ্য ছোটোবেলা থেকে বেশ ম্যাচিউরড। লেখাপড়ায় মনোযোগী। এটা সাবেরার জন্য আল্লাহপাকের তরফ থেকে বিশেষ রহমত। কারণ সাবেরার যে সংসারে বাস এখানে কোনো মানুষ সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারবে না।
মাদক থেকে ছেলেকে বাঁচাতে সাবেরা একাই যুদ্ধ করেছে। ওর এই যুদ্ধে ও কাউকে কাছে পায়নি। শুধু আল্লাহপাকের উপর ভরসা করেছে। ছেলেকে রিহ্যাবে পাঠিয়েছে। কাউন্সিলিং এর জন্য সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে গেয়েছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থের দরকার। কিন্তু রায়হান ওকে সেই পর্যাপ্ত অর্থটুকুও হাতে তুলে দেয়নি। শুরু হলো সাবেরার টিকে থাকার লড়াই। নিজে তখন রাত জেগে সেলাইয়ের কাজ করতো। থ্রিপিচে সুতোর কাজ করতো। কখন বাটিক ব্লক করতো। পরে সেগুলো নিজের পরিচিত মহলে বিক্রি করতো। কখনও ক্যাটারিনের কাজ করতো। এইভাবে টাকা যোগাড় করতো। সেইটাকা ছেলের পিছনে খরচ করতো। ঐ সময় সমস্ত আত্মীয়স্বজনও দূরে সরে যায়। কিন্তু সাবেরা তো মা। ও পারেনি মাদকের কাছে হেরে যেতে। তাই ছায়ার মতো ছেলের পাশে থেকেছে। ওকে ডাক্তার বাসায় দিতে চায়নি। সাবেরা জোর করেই নিয়ে এসেছে। কার কাছে যেন শুনেছিলো অনেক মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নাকি সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরো বেশী অসুস্থ হয়। কারণ ওরাই তখন রোগীকে মাদক সাপ্লাই দেয়। এতে ঐ পেশেন্ট অনাদীকাল হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা হয়। আর ওরা তখন পেশেন্টের অভিভাবকের কাজ থেকে টাকা আদায় করার চান্স পায়। সে কারনে সাবেরা একরকম জোর করেই ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। প্রথমদিনের কথা সাবেরার আজও মনে আছে। হয়তো আমৃত্যু এই স্মৃতি ওর হৃদয়ে থেকে যাবে। সেই রাতটা ছিলো ভয়ঙ্কর। রায়ানকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো। ছয়ঘন্টা পর ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ও ঘুম থেকে উঠে সাবেরাকে বললো,
—-মা, আমাকে অল্প একটু হেরোইন দাও। আমি যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। তোমার পায়ে পড়ি মা। একবারের জন্য আমাকে একটু হেরোইন দাও।
সাবেরা দেয়নি বলে রায়ানও খুব সহিংস হয়ে উঠে। সাবেরাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সাবেরার কপালের একটা পাশ কেটে গিয়ে তখন দরদর করে রক্ত পড়তে থাকে।
চলবে