বিষন্ন বিকেল পর্ব-০২

0
5

#বড় গল্প
#বিষন্ন বিকেল
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

হঠাৎ শব্দ হওয়াতে পাশের রুম থেকে রুপা রায়ানের রুমে চলে আসে। সামনে ওর এসএসসি পরীক্ষা। তাই রাত জেগে পড়ছিলো। রুমে এসে ওর মাকে মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখে। ও পাশে বসে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দেখে টেবিলের কোনা লেগে কপালটা কেটে গিয়েছে। কাটা জায়গা থেকে অঝোরে রক্ত ঝড়ছে। ও দৌড়ে গিয়ে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে এসে সাবেরার কাটা জায়গাটায় মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। এরপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আরোও বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তুমি তো জানো মা মাদকাশক্ত কোনো মানুষের মনুষ্যত্ব বোধ থাকে না। ওকে তোমার বাসায় রাখা ঠিক হয়নি। রিহ্যাব সেন্টারে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ হতো। ভাগ্যিস আমি পাশের রুমে বসে পড়ছিলাম। তা,নাহলে কি হতো একবার বুঝতে পারছো?

সাবেরার মুখে কোনো কথা নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দুটো বাজে। ও রুপাকে বলে,
—আমার বোরকাটা এনে দে।
—-এতো রাতে তুমি কোথায় যাবে?
—-এতো কৈফিয়ত কেন চাইছিস? যা বলছি তাই কর।
রুপা আর কথা বাড়ালো না। ও ঠিক বুঝতে পারছে মা রায়ানকে খুঁজতে যাচ্ছে। সাবেরাদের বাসা মগবাজার ওয়্যারলেস রেলগেটের পাশের গলিতে। ওর মনে হচ্ছে রায়ান মাদক না পেয়ে যদি রেলের নীচে পড়ে আত্মহত্যা করে তখন ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। সে কারনে সাবেরা বোরকা গায়ে জড়িয়ে নীচে নামলো। গেটে তালা দিয়ে দারোয়ানকে সাথে নিয়ে রায়ানকে খুঁজতে বের হলো। কিছুদূর এগিয়ে দেখে রেল লাইনের পাশে বসে রায়ান থরথর কাঁপছে। সাবেরা ওর কাছে এগিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে
—–বাড়ি চল বাবা,
রায়ান সাবেরার মা দুটো জড়িয়ে ধরে বললো,
—মা,আমাকে একটু হেরোইন কিনে দাও না মা। প্লিজ একটু হেরোইন দাও। তা,না হলে আমি বাঁচবো না।
রায়ানের এরকম কাকুতি মিনতি দেখে সাবেরার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ও ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—তুই আমার সাথে ঘরে চলো তাহলে তোকে হেরোইন কিনে দিবো।
মাঝরাতে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রায়ানের সাথে বাকবিতন্ডা করতে ওর অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু উপায় তো নেই। ছেলেকে নিয়েই তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। মনে মনে সাবেরা আল্লাহপাককে ডেকেই চলেছে। একসময় রায়ান বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—-আমাকে দিবে তো?
—-,বলেছি তো দেবো।
রায়ান কাঁপতে কাঁপতে সাবেরার সাথে রওয়ানা দিলো। ছেলেকে নিয়ে সাবেরা বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো। মনে মনে ভাবলো,ডাক্তার বলেছিলো এটা ডিটক্স পদ্ধতি। হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করালে ভালো হতো। তাহলে হয়তো ওকে এই ঝামেলা পোহাতে হতো না।দ্রুতই বাসায় পৌঁছে গেল। সাবেরা জানে রেললাইনের ধারেই মাদকের আড্ডা বসে। রায়ানেরও এ কারনে যোগাড় করতে বেগ পেতে হয় না। আজও যদি রায়ানের হাতে টাকা থাকতো ও মাদক কিনেই বাড়ি ফিরতো। নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মাঝে মাঝে টাকা উধাও হতো এটা ও বেশ অনেকদিন থেকেই টের পেতো। কিন্তু মন খারাপ থাকার কারনে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। ভেবেছে রায়ান কিংবা রুপা টাকা নিয়ে হয়তো বাইরে কিছু কিনে খায়। কিন্তু তা মাদকের মতো এক ভয়ঙ্কর জিনিস তা ওর ধারণার বাইরে ছিলো। বাসায় পৌছে সাবেরা এক গ্লাস দুধের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ওর সামনে এগিয়ে দিলো। রায়ান ক্ষিপ্ত হয়ে গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দিলো। এরপর প্রচন্ড রেগে বলে,
—-আমি কি তোমার কাছে এটা চেযেছি?
সাবেরাও বেশ কঠিনস্বরে বলে,
— দুধ না খেলে আমি তোকে হেরোইন দিবো না।
তারপর রায়ান কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—-মা,আমি আর বাঁচতে চাই না। ছোটোবেলা থেকে তোমার আর বাবার নিত্য অশান্তি দেখে আমি ক্লান্ত। আমার আর বাঁচতে মন চায় না। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। তাই এখনো বেঁচে আছি। তোমার ধারণা আমি খারাপ সঙ্গে পড়ে মাদক নিয়েছি। না,এটা তোমার ভুল ধারণা। আমি ইচ্ছে করেই মাদক নিয়েছি। এতে দুটো প্রবলেম সলভ হয়। একটা হলো দুঃখ গুলো ভুলে থাকা যায় আর একটা জীবন প্রদীপ আস্তে আস্তে নিভে যায়।
সাবেরা গ্লাসের ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোগুলো দ্রুত তুলে ফেলে। কারণ কখন আবার রায়ান এটা দিয়ে কি কান্ড ঘটাবে কে জানে? সবগুলো টুকরো একটা শপিং ব্যাগে ভরে কিচেনে গিয়ে বিনে ফেলে দেয়। এরপর একটা প্লাস্টিকের গ্লাসে করে ঘুমের ওষুধ মেশানো দুধ রায়ানের কাছে নিয়ে আসে। ও জানে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তাই আগে থেকে দুগ্লাস রেডি করে রেখেছিলো। রায়ানের দিকে গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,
—-তুমি দুধটা খেয়ে নাও। আমি দারোয়ানকে হেরোইন কিনে আনতে পাঠিয়েছি।
রায়ান ওর মায়ের কথা বিশ্বাস করে দুধটুকু খেয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর রায়ান ঘুমিয়ে পড়ে। সাবেরার কপালটা ব্যথায় টনটন করছে।ফজরের আযান শোনা যায়। অনেক কষ্ট করে ওয়াশ রুমে গিয়ে ওজু করে নেয়। আজ যে ভয়ঙ্কর রাত ও আল্লাহপাকের রহমতে পার করলো এর শোকরানা আদায় না করে বিছানায় শরীর ছোঁয়াবে না। অনেক বড় কিছু ঘটতে পারতো। ওকে ওজু করতে দেখে রুপা বললো,
—-তুমি এই অবস্থায় নামাজ পড়বে?
নামাজ তো সর্ববস্থায় পড়তে হয়। আমরা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ি না সেটাই তো আমাদের দোষ। রুপা জানে,মাকে এখন কিছু বলে লাভ নেই। সকালেই ওকে মডেল টেস্ট দিতে কোচিং এ যেতে হবে। অনেক কষ্টে বাবার কাছ থেকে কোচিং এর টাকা ম্যানেজ করতে পেরেছে। রেজাল্ট খারাপ হলে অনেক কথা শুনতে হবে। তাছাড়া ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ও ওর মাকে অনেক ভালেবাসে। পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জনম দুঃখী মাকে একটু সুখ দেওয়ার চেষ্টা করবে।ও নিজের ঘরে গিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। আসলে মা ঠিকই বলে নামাজ পড়লে অন্যরকম শান্তি অনুভব হয়।
সাবেরার মনটা বিক্ষিপ্ত। ও জানে জায়নামাজে বসে আল্লাহপাকের কাছে সেজদায় অবনত হলেই ওর মনটা শান্ত হবে। সাবেরা ফজরের নামাজ আদায় করে আল্লাহপাকের কাছে দুহাত তুলে মোনাজাত করলো আর অঝোরে চোখের পানি ছেড়ে দিলো।
নামাজ শেষ করে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সকালেই রিহ্যাব সেন্টারে ফোন করে রায়ানকে নিয়ে যেতে বলবে। ওএকটা প্যারাসিটামল খেয়ে সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। রায়ানের পাশেই আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসে অতীতের ভাবনায় হারিয়ে যায়।
সাবেরাদের পরিবারটাও খুব সুখী পরিবার ছিলো না। একে একে ওর মা যখন তিন মেয়ের জন্ম দিলো তখন ওর বাবা আর ফুফু মিলে ওর মাকে সারাক্ষণ খোঁটার উপরে রাখতো। ওর মায়ের ছেলে জন্ম দেওয়ার মুরত নাই। ওর বাপকে ফকির বানানোর জন্য একে একে মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। ওর মা খুব হীনমন্যতায় ভুগতো। ওর ফুফু ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কৌশলে নিজের ছেলে রায়হানের লেখাপড়া করার ভার চাপিয়ে দিলো। পরবর্তীতে সাবেরার সাথে বিয়ে দিয়ে ষড়যন্ত্রের পুরোটা সফল করলো। (সেই ষড়যন্ত্রের কথায় পরে আসছি।)আসলে উনি নিজেও ডিভোর্সি ছিলেন। সেকারনে সাবেরার বাবা বোনকে খুব আগলে রাখতো।
এইচএসসিপাশ করে রায়হান ঢাকায় এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। সেই থেকে সাবেরাদের বাসায় থাকা শুরু করে। রায়হান ভার্সিটিতে ম্যাথে চান্স পেয়েছিলো। ভার্সিটিতে পড়ার সুবাদে ওর বাবা রায়হানকে মাথায় করে রাখতো।বিয়ের আগে সাবেরা ঘূর্ণাক্ষরে বুঝতে পারেনি রায়হানের চরিত্রের এরকম একটা খারাপ দিক আছে। অবশ্য বুঝে হোক না বুঝে হোক ওর মায়ের এই বিয়েতে মত ছিলো না। ওর বাপের সংসারে ওর মায়ের মতামতের গুরুত্ব কখনোই ছিলো না। ওর ফুফুই ওর মায়ের সংসারে ছড়ি ঘোরাতো। তবে ওর ভাইয়ের জন্মের পর থেকে ওর মা আস্তে আস্তে নিজের মতামতের গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ওর বাপের উপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে। প্রথমে ওর বাবা মানতে না চাইলেও সাব্বির যত বড় হতে থাকে ওর বাবা ওর মাকে একটু সামঝে চলার চেষ্টা করে।
সাবেরারা তিন বোন রায়হানের কাছেই প্রাইভেট পড়তো। সাব্বির তখন ও স্কুলে ভর্তি হয় নাই। সাবেরা তখন এইটে পড়তো। আমিরা পড়তো সিক্সে আর তাহারা পড়তো ক্লাস ফোর এ। এ কারনে রায়হান সাবেরার পড়াশোনার দিকে বেশী খেয়াল রাখতো। সেসময় সাবেরা ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলো। ক্লাস নাইনে ফাস্ট হয়েছিলো। ওর রেজাল্ট ভালো হওয়ার সুবাদে রায়হানের আদর আপ্যায়ন আরো বেড়ে যেতে থাকে। এমনকি সাবেরাও ওর উপর দুর্বল হতে থাকে। এখন সাবেরা বুঝে ওটা ছিলো রায়হানের একটা মুখোশ।

চলবে