বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব-০৩

0
434

#বিষাক্ত_ভালোবাসা
পর্ব: ০৩
লেখনীতে : শারমিন আক্তার বর্ষা

ইয়ানার খোঁজ পাইনি এখনও,তায়েফের কাছ থেকে মুক্তি নিয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে গেছে সে। বোধগম্য হচ্ছে না, সে এরইমধ্যে কোথায় ও কার কাছে গেছে? ওর আত্মীয় বলতে শহরে কেউ নেই। ও মাঝেমধ্যে বলতো ওর অধিকাংশ আত্মীয় দেশের বাহিরে থাকে। শুধু মাত্র ওর বাবা মা আর এক চাচা বাংলাদেশে আছে। ওর মুখে বার কয়েক ওর বাড়ির ঠিকানা শুনেছি, তাই আর দেরি না করে বাসে ওঠে পরলাম।
হৃৎস্পন্দন তীব্র গতিতে ছুটছে। বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে,আসার সময় ফোনটা বাড়িতে ফেলে আসছি। বাড়িতে মা একা রয়েছে নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। ভুল করেছি আমি, আর সে ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে সবাইকে। এমন এক নির্বিকার পরিস্থিতিতে পরেছিলাম যে,আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। চোখের সামনে সব ঘটছিল কিন্তু আমি পারিনি কিছু করতে বা করতে চাইনি। যা ঘটতেছিল শুধু দেখে গেছি।
জানি না, আমার ইয়ানা এখন কোথায় আছে কোন পরিস্থিতিতে আছে। রাত থেকে কিছু খায়নি সে। এমন অবস্থায় খালি পেটে না জানি কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? এ সবের জন্য আমি দ্বায়ী,শুধু আমি। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানালাম।
এমনিতে মনের মধ্যে অজানা ভয় বাসা বাঁধছে,আমার ইয়ানা ঠিক আছে তো?
বার বার মনে হচ্ছে আমি ইয়ানাকে যদি ফিরে না পাই। লোকাল বাস যাতায়াত করা বড্ড কষ্টের। মানুষের ঠেলাঠেলিতে জীবন অতিষ্ঠ। চোখ জোড়া বন্ধ করতে চোখের সামনে ভেসে ওঠছে, ইয়ানার মুখশ্রী।
কর্ণকুহরে হানা দিচ্ছে, ইয়ানার ডাক। চোখের পাতায় ভেসে ওঠছে ইয়ানার শেষ চাহনি। শেষবারের মত ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে,ওর ওই তীক্ষ্ণ চোখে তাকানো,ভয়াবহ সে দৃষ্টি যে চোখে ছিল হাজারও ঘৃণা। ইয়ানার চোখে ভালোবাসা ব্যতিত ঘৃণার এক ঝলকও আমি এর আগে কখনো দেখিনি। আমার জীবনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ইয়ানা, আর আমি কি না শুধু মাত্র একটা বাজিতে হেরে গেছি বলে, তাকে অন্যের হাতে তুলে দিলাম। একটা বাজি আমার কাছে, আমার ইয়ানার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কি ভাবে হয়ে গেলো? নিজের বোকামির জন্য নিজের ওপর ভীষণ রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে সব কিছু ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে,নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালাম,খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টি তাক করে সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলে মনে মনে বললাম,

— হে আল্লাহ। আমাকে আমার ইয়ানার সাথে দেখা করিয়ে দাও।প্রয়োজনে ওর পা ধরে আমি আমার ভুলের ক্ষমা চাইবো। আমার জীবনে দ্বিতীয় বারের মত তাকে ফিরিয়ে দাও। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে ভারী দীর্ঘশ্বাস। পাশের সিটে বসে আছে একজন মধ্য বয়স্ক লোক,উনি বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাকে লক্ষ্য করছেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন,

— কি হয়েছে বাবা? তোমাকে দেখে সুস্থ বলে মনে হচ্ছে না। চোখ দু’টো কেমন রক্তবর্ণ হয়ে আছে। তাছাড়া তোমার হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে তুমি অসুস্থ।
চাচার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললাম,

— আমার কিছু হয়নি চাচা। শুধু প্রিয় মানুষ টা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তাকে ফিরে আনতে বের হয়েছি।
আমার কথাশুনে চাচা মলিন হাসলেন,ঠোঁটে হাসি ধরে বলেন,
— চিন্তা করো না,সে যদি তোমার হয়ে থাকে তাহলে তুমি তাকে অবশ্যই ফিরে পাবে।

চাচা হয়তো আরও কিছু বলতেন কিন্তু তার আগে উনার স্ট্যান্ড চলে আসে আর উনি নেমে পরেন। যাওয়ার আগে বলে যান,বেশি দুঃশ্চিন্তা কইরো না। আল্লাহ’র উপর ভরসা রাখবে, যাকে খুঁজতে বের হয়েছো নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে।

দুই ঘন্টা জার্নির পর,আসলাম ত্রিপুরা অনেক মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করলাম। মেহফাজ আইবেক এর বাড়ি কোথায়? কেউ বলতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর,একজন কৃষককে দেখলাম ক্ষেতে হাল চাষ করছে, তাকে ডাক দিলাম। তিনি আমার কাছে আসেন,এবং প্রশ্ন করেন তাকে কেনো আসতে বললাম? উনার কাছে ইয়ানার বাড়ির খোঁজ করলাম। উনি আমাকে বললেন,

— এখান দিয়া সোজা হাঁইটা যাও। সামনে একটা টংয়ের দোকান পাইবা ওখানে একটা বাচ্চা পোলা বইসা থাকে। ওরে গিয়া কইবা সে তোমারে জেনো মেহফাজ মেনশনে নিয়া যায়,তাহলেই নিয়া যাইবো।
লোকটাকে ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানিয়ে উনার কথামত চলতে লাগলাম। দোকানের ছেলে টাকে জিজ্ঞেস করতে সে আমাকে পথ দেখালো,মিনিট দশেক হাঁটার পর,সে আমাকে নিয়ে আসে এক আলিশান মহলের সামনে। বেশ চাকচমক। বাড়ির সামনে দুজন দারওয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে প্রশ্ন করে,আমি কে? এখানে কি চাই?
উনাদের সাথে কথা বললাম। কিয়ৎক্ষণ পর, হতাশাজনক শ্বাস ফেলে শহরের উদ্দেশ্য চলতে লাগলাম। গ্রামের মেঠু পথ দিয়ে হাঁটছি। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, ইয়ানা তুমি কোথায়? ওর বাবার কাছে আসেনি। আর আসবেই বা কিভাবে ওর বাবা মা কেউ বাংলাদেশে নেই উনারা ইতালি চলে গেছেন তাও দুই মাস আগে। বাড়ির দেখাশোনা করার জন্য দুজন মানুষ রেখেছেন। হুট করে একজন মানুষ হারিয়ে গেলো? ভাবতেও অদ্ভুট লাগছে।

আমার বন্ধুদের মধ্যে একজন পুলিশ অফিসার আর একজন জার্নালিস্ট। শহরে এসে ওদের দুজনের সাথে একটা ক্যাফেতে মিট করলাম। দু’জন কে বললাম আমার ইয়ানাকে খুঁজে এনে দাও বিনিময়ে যা করতে হয় করো। যত টাকা লাগে আমি দিবো। ওরা আমাকে আশ্বাস দিলো,ইয়ানাকে আমায় খুঁজে এনে দিবো।
বাড়ি ফিরে আসতে মা দরজা খুলে দেয়। আমাকে একা দেখে আগেই প্রশ্ন করে,বউমা কোথায়?
কণ্ঠে গাম্ভীর্য রেখে বললাম,পাইনি?
মা অবাক কণ্ঠে বলে,পাইনি মানে?

গম্ভীর কণ্ঠে মা’কে ঘটনা খুলে বললাম। মা মুখে কিছু বলল না। মাত্রাতিরিক্ত রাগে কষে এক চড় মারলেন। জীবনে এই প্রথম বার আমার গায়ে হাত তুলল মা। মায়ের হাতে চড় খেয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে করুণকণ্ঠে বললাম,মা!
মা শক্ত ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

— তোর মত জঘন্য ছেলে আমি পেটে ধরেছি ভাবতেই ঘৃণায় আমার শরীর শিরশির করে ওঠছে। ইচ্ছা করছে তোকে গ’লা টি’পে মে’রে ফেলতে।ছিহহ, আমি কখনো কল্পনাও করিনি আমার পেটের ছেলে এতটা জঘন্য হবে। লানত হচ্ছে আমার তোর ওপর। এটা বাস্তব জীবন ইয়াসির, কোনো সিনেমা নয়। বাজিতে হারছি বলে বউ দিয়ে দিবো। এটা কোথায় পাইছিস তুই? তোর মাথায় কোনো আক্কেল বুদ্ধি আছে কি না নাই? তুই না বলেছিলি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসিস তুই ইয়ানাকে তাহলে আজ কিভাবে পারলি সে ভালোবাসাকে ছেড়ে দিতে? আমার পছন্দের মেয়ের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করে ছিলাম, তখন তুই কি বলেছিলি মনে নেই তোর? থাক আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি।
তখন তুই আমার পা ধরে বলেছিলি,
মা আমি ইয়ানা ভালোবাসার পর নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে গেছি।
কেননা, আমি ইয়ানাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।

— তোর ইয়ানার প্রতি পাগলামি ও ভালোবাসার জন্য আমি রিনা খান তোদের ভালোবাসা ও পালিয়ে বিয়েটা মেনে নিয়ে ছিলাম। একটা সময় ছিল, যখন তুই ইয়ানা বলতে মু’গ্ধ ছিলি, আর সেই তুই কাল রাতে তাকেই বাজি রেখে জুয়া খেললি। ছিহহহ, এটাই দেখার বাকি ছিল আমার, এটা দেখার জন্যই হয়তো আল্লা’হ আমাকে বাঁ’চিয়ে রাখছেন। এখন মনে হচ্ছে আমি এতদিন দুধ কলা দিয়ে কা’ল’সাপ পুষেছি। আমি খুশি হয়েছি, ভালোই হয়েছে বউমা তোর কাছে ফিরে আসেনি। তাহলে দেখা যেতো তুই অন্য দিন তাকে দিয়া দে’হ ব্যবসা করাতিস।

— এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন আর চুপ থাকতে পারলাম না,অস্ফুটস্বরে চেঁচিয়ে বললাম, মা’হহ কি সব যাতা বলছো তুমি?

মা রাগান্বিত হয়ে শাহাদাত আঙুল তুলে আমার মুখের সামনে ধরে কর্কশকণ্ঠে বলল,
— খবরদার তোর ওই মুখে আমাকে মা বলে ডাকবি না। আজ থেকে মনে করবি তোর মা ম’রে গেছে। তোর মত ছেলের মুখে মা ডাক শোনার চেয়ে ম’রে যাওয়া ঢের ভালো।

তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কথাগুলো বলে মা সামনে থেকে চলে যায়। হাঁটু ভাজ করে ফ্লোরে বসে নিঃশব্দে কান্না করে ফেলি। সেলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বললাম,
— হে আল্লাহ! মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি। এই ভুলের কি কোনো ক্ষমা নেই?

চলবে?