বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব-১৫+১৬

0
233

#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৫
#লেখিকা: #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

“নীল তিমি এবং নীল তিমির জোড়া যুগল ওরা একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে। ওদের না একটা নিয়ম আছে ওরা একে অন্যের শূন্যতায় বেশিক্ষণ বাঁচে না নিঃসঙ্গতা ওদের সহ্য হয় না। তাই তো, সবসময় বিশাল সমুদ্রে একসাথে চলাফেরা করে আর যখন কোনো একজনের মৃত্যু হয় তখন বেঁচে থাকা অন্যজন সেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে। ওরা বাঁচলে একসাথে বাঁচে, আর ফুরিয়ে গেলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে একসাথে ফুরায়।

এতো কি ভাবছো ইয়ানা? ভেবো না, পরের জন্মে আমি-তুমি এই তিমিজোড়ার মতোই হবো।
ভীষণ ভালোবাসবো দুজন দুজনকে।
এই জন্মের মতো ওই জন্মে নিঃসঙ্গতা কখনও আমাদের ছুঁতে পারবে না। কেউ একজন ফুরিয়ে গেলে অন্যজন ফুরিয়ে যাবো সেচ্ছায়। তোমাকে হয়তো এ জীবনে আর পাওয়া হবে না। প্রজন্ম বলে সত্যিই যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে আমি সে জন্মে তোমাকে চাই। আমার একলা শূন্যতার মাঝে তুমি এক বিশাল পূর্ণতা। ”

ইয়ানার ছবির ওপর থেকে হাতটি নামিয়ে নিয়ে সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলল ইয়াসির। ইয়াসিরের রুমের পূর্ব দিকে দেয়ালে ইয়াসির ও ইয়ানার বড় এক কাঁপল ছবির ওয়ালমার্ট ঝুলানো। ইয়ানার ছবিতে হাত বুলিয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরল ইয়াসিরের নেত্র বেয়ে। এই ছবিটা আজ থেকে বহুবছর আগে, তখন অবশ্য ইয়ানা ও ইয়াসিরের বিয়ে হয়নি। তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের ছয় মাস চলছিল। ইয়ানা ও ইয়াসিরের প্রথম দেখা বড্ড অদ্ভুত ছিল। দু’জনে তারাহুরো করে বাসে ওঠতে গিয়ে এক অপরের সাথে ধাক্কা লাগে। তৎপর দু’জনে একসাথে বাসের দরজায় উপুড় হয়ে পড়ে। ঘটনাটি এত তারাতাড়ি ঘটেছিল যে, দু’জনা একদম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাসের সকল যাত্রী গুলো উৎসুক হয়ে ওদের দু’জনকে দেখতে লাগল। ইয়াসির ওঠে দাঁড়িয়ে ইয়ানাকে ওঠতে সাহায্য করে। দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে স্বচ্ছ মিষ্টি হেসে বাসে ওঠে। পাশাপাশি সিটে বসেও দু’জনার মধ্যে ছিল নিরবতা। ইয়াসির পাশাপাশি বসতে জোরে জোরে হার্ট বিট করছিল ইয়ানার। সে ভীষণ ইতস্তত বোধ করেছে। এমনটা নয়, ইয়ানা বাসে এর আগে ওঠেনি বা পাশের সিটে কোনো ছেলে বসেনি। বাবা মা’র একমাত্র মেয়ে ইয়ানা। ইয়ানার বাবা ও মা’র বিয়ের পর কোনো সন্তান হচ্ছিল না। একটি সন্তানের জন্য কত হাহাকার করেছেন উনারা তৎপর ‘আল্লাহ’ উনাদের দিকে মুখ তুললেন। বিয়ের আট বছরের মাথায় ইয়ানার জন্ম। অনেক আনন্দিত ছিলেন উনারা অবশেষে একটি সন্তান কোল আলো করে আসল। ইয়ানাকে চোখের মনি করে রাখতেন। ইয়ানার জন্মের পর তারা দ্বিতীয় বার সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেননি তারা আল্লাহ’র ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন। মেয়ের ছোট থেকে ছোট বিষয় টির খেয়াল রাখতেন। ইয়ানা বড় হল কলেজে ভর্তি হল, কলেজ পাশ করে ভার্সিটিতে উঠল। তাদের ছোট্ট চঞ্চল মেয়েটি সময়ের সাথে সাথে বড় হয়ে গেলো। বড় হলেও ইয়ানার চঞ্চলতা শেষ হয়নি।
গাড়ির জার্নি থেকে বাসে ওঠে জানালার পাশের সিটে বসতে জার্নি করতে ইয়ানার বেশি ভালো লাগে। তাইতো মাঝেমধ্যে ড্রাইভার কে এনিয়ে বেনিয়ে ছলচাতুরী করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে, এবং বাসে ওঠে জানালার পাশের সিটটা দখল করে নেয়। আজকেও তাই শুধু অন্য দিনের থেকে আজ একটু ভিন্ন হয়েছে। একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না। তাই নিজ থেকে ইয়ানার সাথে কথা বলতে চাইল ইয়াসির। ইয়ানা ও ইয়াসিরের সাথে নর্মালি কথা বলল। দু’জন দু’জনার পরিচিত হল।
এরপরও ইয়ানার সাথে বেশ কয়েকবার রাস্তা ঘাটে, ক্যাফে, শপিংমলে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ইয়াসিরের সাথে ইয়ানার দেখা হত লাগল। এভাবে দু’জন দু’জনার সাথে এক সময় বন্ধুত্ব করে নেয়। ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার পর একদিনও ভার্সিটিতে যায়নি ইয়াসির। তার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ওদের বিজনেস ওর চাচা দেখতো। ইয়াসির সাবালক হতে আস্তে আস্তে তাকে ব্যবসায় ইনভল্ভ করল তার চাচা। পড়াশোনার পাশাপাশি বিজনেস টাও বেশ ভালো করে হ্যান্ডেল করতে লাগে ইয়াসির। ব্যবসার কাজের জন্য ভার্সিটি আসতে পারেনি। এক মাস পর যখন ভার্সিটিতে আসল তখন ক্যাম্পাসে ইয়ানাকে দেখতে পায়, জানতে পায় ভার্সিটিতে ইয়ানা ইয়াসিরের জুনিয়র। এবং এভাবেই দুজনার বন্ধুত্ব আরও ঘাড়ও হলো। ইয়াসির হয়ে উঠল ইয়ানার বেস্ট ফ্রেন্ড। ইয়াসির কে মাঝেমধ্যে বাড়িতে নিয়ে যেতো ইয়ানা। ওদের বন্ধুত্ব টাকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়ে ছিল ইয়ানার বাবা মা।
রাত দশটা বা এগারো টা সময়ের কোনো পরোয়া করত না ইয়ানা। যখন ইচ্ছে করতো তখন ইয়াসিরের বাড়ির সামনে চলে যেতো কিংবা ও’কে ‘ওর’ বাড়ির সামনে আসতে বলত।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকে বাড়িতে ঢোকবার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত দু’জনে একসাথেই থাকতো। দু’জনের বন্ধুত্বের গভীরতা ছিল বিশাল। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না এমন অবস্থা। অসুস্থতা বা কোনো কারণ বসত কেউ একজন ভার্সিটিতে না আসলে অন্য জন তার বাড়ি চলে যেতো। রাত জেগে জেগে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলত।
হঠাৎ একদিন, ইয়াসির ও ইয়ানা একটা লেকে মিট করল। ইয়ানার আসারও বিশ মিনিট সময় পূর্বে আসে ইয়াসির। লেকের পাশে একটা বেঞ্চে পায়ের ওপর পা তুলে বসে পুকুরের স্বচ্ছ জলে দৃষ্টি বুলাচ্ছে। হুট করে পিছন থেকে ইয়ানা ইয়াসিরের চোখ দু’টি আবদ্ধ করে নেয় তার শীতল হাতে। হাতের স্পর্শ চোখে পরতে মলিন হাসল ইয়াসির। এবং ইয়ানার নামটি মুখে উচ্চারণ করল। বিরক্ত হয়ে চোখ থেকে হাত ছাড়িয়ে ইয়াসিরের সামনে এসে দাঁড়ালো ইয়ানা এবং অভিমানী কণ্ঠে শুধালো,
— ” না দেখে তুমি বুঝলে কিভাবে এটা আমি? ”
ইয়ানা হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরে আসছে। এবং ইয়াসির একটা ধূসর রঙের শার্ট।

ইয়াসিন নিপুনভাবে ইয়ানার পা থেকে মাথা অব্ধি চোখ বুলাচ্ছে। এ জেনো অন্য এক ইয়ানা এই প্রথম ইয়ানাকে শাড়িতে দেখছে ইয়াসির। মুগ্ধ আহা কি অপরূপ লাগছে ইয়ানাকে আজ। ইয়াসিরের চোখ জেনো থমকে গেছে। পলকহীন চোখে তাকাই আছে। ইয়াসির হাত বাড়িয়ে ইয়ানার হাত ধরে তাকে ওর পাশে বসালো। ইয়ানার খোলা চুলগুলো মৃদু বাতাসে হালকা উড়ছিল। সে অবাধ্য চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে ইয়াসির শান্ত কণ্ঠ বলল,
” আজ তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আমি যে তোমার ওপর থেকে চোখই সরাতে পারছি না। ”

ইয়াসিরের কথার পিঠে ফিক করে হাসি হেসে ফেলল ইয়ানা। দু’জনে হাসতে হাসতে অন্য কথায় চলে গেলো। আজকের দিন টাকে সরণীয় করে রাখবার জন্যে, ইয়ানা ইয়াসিরের গলা জড়িয়ে ধরে ও ইয়াসির তার ফোনে দু’জনার অনেকগুলো কাঁপল পিক তুলল। [এবং সেদিনের সে ছবি আজকের ওয়ালমার্ট।]

ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিল সবাই, এমন সময় একটা মেয়ে এসে ইয়াসির কে প্রপোজ করল। তখন বেশ রেগে যায় ইয়ানা। তার এই রাগের কারণ ও’র নিজেরও অজানা। সকলের সামনে মেয়েটার গালে কষে চড় বসায় সে। হতবিহ্বল চোখে ইয়াসির ও ইয়ানার দিকে তাকিয়ে রইছে ক্যাম্পাসের সবাই। ইয়ানার হঠাৎ উত্তেজিত হওয়ার কারণ বোধগম্য হচ্ছে না কারো। মেয়েটাকে চড় মা’রার জন্য বেশ কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিলো ইয়াসির ইয়ানা কে। ইয়ানা সে সময় কান্না করে ইয়াসিরের সামনে থেকে দৌঁড়ে চলে যায়।
এরপর টানা এক সপ্তাহ সে ভার্সিটিতে আসেনি। এবং ইয়াসিরের সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ইয়ানার শূন্যতা ইয়াসির কে এত তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছিল যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ইয়াসির উপলব্ধি করতে পারে ইয়ানা যাকে সে শুধু ফ্রেন্ড ভাবতো আসলে সে শুধু তার ফ্রেন্ড নয়। দু’জনার অজান্তেই একে অপরকে ভালোবেসে ফেলছে তারা। এক সপ্তাহ পর হঠাৎ রাত একটা বাজে নির্ঘুম ইয়াসির কফি মগ হাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ শব্দ করে ফোনটা বেজে উঠল, রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে ইয়ানার নাম দেখে দ্রুত কল রিসিভ করে। অপরপ্রান্ত থেকে ভাঙা গলায় ইয়ানা বলে,
” ইয়াসির আমি তোমাকে ছাড়া আর থাকতে পারছে না। এক একটা দিন আমার কাছে এক একটা বছরের মত লাগছে। ”
ইয়াসিরের অস্বস্তি হচ্ছিল, পুরো রুমে এতক্ষণ পায়চারি করেও অস্বস্তি কমাতে পারেনি বৈকি বেলকনিতে চলে যায়। ইয়ানার কথার পিঠে চোয়াল শক্ত করে একবাক্যে ইয়াসির বলল,

” ইয়ানা আই লাভ ইউ। ”

ইয়াসিরের মুখে ভালোবাসি বাক্যটি শুনে শব্দ করে কাঁদতে লাগে ইয়ানা৷ এরপর তাদের সম্পর্কের শুরু হয়, ফ্রেন্ড থেকে প্রেমিক প্রেমিকা হয়। দুজনের সকল সমস্যার কথা দু’জন দুজনকে জানাতো। তাদের মধ্যে কোনো কিছুর কমতি পড়েনি, না শ্রদ্ধা, আর না ভালোবাসা ও সম্মান দু’জনের দুজনার ওপর অটল বিশ্বাস ছিল।
ইয়ানার বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসল, ইয়ানার বাবার বন্ধুর ছেলের ইয়ানাকে বেশ পছন্দ এবং সে বিয়ে করলে ইয়ানাকেই করবে। ইয়ানার হাত চাইল ইয়ানার বাবার কাছে উনার বন্ধু তিনিও হাসি মুখে এ সম্পর্কে সম্মতি জানালেন। রাতের বেলা ডাইনিং টেবিলে যখন এই প্রসঙ্গে চর্চা হল তখন ইয়ানা সাফসাফ জানিয়ে দিল সে এই বিয়ে করবে না৷ সে ইয়াসিরকে ভালোবাসে বিয়ে করলে একমাত্র ইয়াসির কেই করবে। ডাইনিং টেবিলেই মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি হলো। মাত্রাতিরিক্ত রাগে মেয়ের গালে চড় মারলেন৷ কাঁদতে কাঁদতে রুমে চলে যায় ইয়ানা। এবং এই ঘটনা সে ইয়াসিরকে জানায়।
ইয়ানার বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে হেল্পলেস এর মতো চার দেয়ালে বসে রয় ইয়াসির অন্ধকার ঘরে সিগারেট ফুঁকছে।
বর যাত্রী বাড়িতে, বেলকনিতে এসে ইয়াসিরের নাম্বারে কল দেয় ইয়ানা। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলে,
” আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না। তুমি প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও। ”
প্রথমত পালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি হল না ইয়াসির। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে ইয়ানা বলল,
“আমি মরে যাবো তবুও অন্য কাউকে বিয়ে করবো না ইয়াসির।” ইয়ানার জেদের কাছে হাড় মেনে বাইক নিয়ে ইয়ানার বাড়ির পিছন দিকে আসে ইয়াসির। এবং সে রাতেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় ইয়ানা।
বিয়ের আসর থেকে কনে পালিয়েছে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর লোকসমাগমে অনেকটা অপদস্ত হতে হয় ইয়ানার বাবাকে৷ উনি লজ্জায় মাথা তুলে কারো দিকে তাকাতে পারছিলেন না। এখানের সব বিজনেস তার ভাতিজার ওপর দিয়ে মাস খানেকের মধ্যে ইতালি চলে যান। মাঝেমধ্যে আসেন কয়েকদিন থেকে আবার চলে যান।

অন্য দিকে একটা মেয়ে নিয়ে বাড়িতে আসায় বেশ ক্রোধিত হয় ইয়াসিরের মা। সে তো ছেলের জন্য অন্য কোথাও মেয়ে দেখেছে, সেখানে ছেলে বিয়ে করবে না বলে আজ একটা মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে৷ ইয়ানাকে কিছুতেই মানবে না। কিন্তু ছেলের ইয়ানার প্রতি অন্ধ ভালোবাসা দেখে পরেরদিন নিজ বাড়িতে ইয়াসির ও ইয়ানার বিবাহ করান। সময়ের সাথে সাথে ইয়ানা হয়ে উঠে তার শাশুড়ীর মেয়ে। সূবর্ণা মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করে বলতো,
” মা তুমি আমার থেকে বেশি ভাবীকে ভালোবাসো।”

শশুর বাড়ি থেকে ছয় মাসে বা বছরে একবার বেড়াতে আসত সূবর্ণা। আসার ইচ্ছা থাকলেও আসতে পারে না কেননা ছেলে বড় হচ্ছে তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিছে। সকালে নিয়ে যেতে হয় আবার সাথে করে নিয়ে আসতে হয়। একা সংসার সবই তো সূবর্ণার একা হাতের কাজ। আরিশকে পেয়ে ইয়ানা জেনো অনেক উল্লাসিত হত৷ অনেক আদর করতো এবং আহ্লাদী হয়ে একটা মেয়ে বাবু চাইতো আরিশের বউ করবে এবং আরিশকে নিজ কন্যার স্বামী বানাবে। ইয়ানা মাসে দুই তিনবার করে সূবর্ণা আপার বাড়ি চলে যেতো শুধু আরিশকে দেখার জন্য এবং ছেলেটাকে আদর করার আহ্লাদে।একদিন আরিশকে কোলে বসিয়ে দুইহাত দিয়ে আরিশকে জড়িয়ে ধরে ইয়ানা প্রস্ফুটিত হয়ে বলল,
” তোমরা সবাই শোনো, আরিশ বড় হলে আমি ও’কে আমার মেয়ের জামাই বানাবো।তখন কেউ আপত্তি করতে পারবা না।”

ইয়ানার কথায় সবাই হাসতে শুরু করে। কিন্তু সেদিকে ইয়ানার কোনো হুঁশশ নেই। সে তো মোহিত চোখে শুধু আরিশকে দেখছে, একটা বাচ্চা ছেলে যে কি করে এতটা সুন্দর আকর্ষণ হয়েছে তা সে ভেবে পায় না৷

বিয়ের পর নাকি ভালোবাসা কমে যায়। কিন্তু ইয়াসির ও ইয়ানার ব্যাপারে বিষয়টা ভুল প্রমানিত হল। দু’জনের একে অপরের প্রতি ভালোবাসাটা জেনো এখন আরও বাড়ছে৷ ইয়ানার প্রতি বেশ যত্নশীল ইয়াসির৷ ইয়ানার নিজের খাবারের প্রতি অনিয়ম করা কিংবা নিজের দেখভাল না করা নিয়ে সে প্রচন্ড বকাঝকা শুনে ইয়াসিরের কাছে। তবুও সে নিজেকে শোধরায় না, কেননা ইয়ানা সে ইয়াসিরের বকাঝকার মাঝেও ভালোবাসা খুঁজে পায়। ইয়াসিরের মা, হুট করে গ্রামে যেতে চাইলেন এবং ইয়ানা ও ইয়াসিরের থেকে বিদায় নিয়ে পরদিন সকালে চলে যান।
সাত দিনের দিন সকালে, ইয়ানা প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে এবং ‘ও’ কনফার্ম হওয়ার জন্য সেদিন বিকালে হসপিটালে গিয়ে দ্বিতীয় বার টেস্ট করায়। প্রতিবারই রিপোর্ট পজিটিভ। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ফিরে আসে ইয়ানা। খুশি হয়ে ইয়াসিরের সব পছন্দের খাবার রান্না করে। রাতে খেতে খেতে ইয়াসিরকে খুশির খবর জানাবে। ইয়ানার মন ভারী হয়ে আসে, ফোনের মধ্যে ওর বাবা মা’র ছবি দেখে বলে,
” আব্বু আম্মু নাতনীর মুখ দেখলে তোমরা নিশ্চয়ই আমাদের মেনে নিবা। এটা আমার বিশ্বাস। তোমরা মানবা না আমাদের? ”

অনেক অধৈর্য্য হয়ে, ইয়াসিরের ফিরে আসার প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছিল ইয়ানা। বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে রিং হচ্ছে কিন্তু ইয়াসির কল রিসিভ করছে না।
ঘন্টা খানেক পর, ইয়াসির বাড়ি ফিরে আসে। তার চেহারা দেখে ইয়ানার কোনো কিছু স্বাভাবিক লাগছিল না। যখন সে প্রস্তুত হল, এখন সে বেবির কথা ইয়াসিরকে জানাবে। তখন ইয়ানা একটা চরম শকট খায়। ইয়াসিরের মুখের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় ইয়ানা। কি বলছে ইয়াসির জুয়া খেলা, তাকে বাজি রাখা।
আর বন্ধু বলছে বলেই কি মেনে নিতে হবে শর্ত? এটা কেমন নীতি? সব কিছু জেনো গোলগোল ঘুরতে লাগল। ভালোবাসার মানুষ নিজ স্বামীর ওপর ভীষণ অভিমান জন্মালো। গোঁটা একটা রাত পেড়িয়ে গেলো, দু’জন দুই রুমে থাকলো। ইয়াসির আগ বাড়িয়ে গিয়ে ইয়ানার কাছে ক্ষমা চাইলো না কিংবা একটা কথাও বললো না। পরদিন যখন ডিভোর্স প্যাপারে ইয়ানা সই করে চলে যাচ্ছিল, তখনই ইয়াসির কিছু বলল না। একটা বার মেয়েটাকে আটকালো না। বলল না,
” আমাকে ছেড়ে যেও৷ তুমি চলে গেলে এই মানুষ টা বড্ড এলোমেলো হয়ে যাবে।”

সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসল। মাঝ রাস্তায় তায়েফ লোকটার থেকে মুক্তি চাইল ইয়ানা। ফিরে যেতে চাইল তার জীবনে। তার গর্ভের সন্তানের কথা জানালো। তায়েফ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” গর্ভাবস্থায় তো ডিভোর্স হয়না। আপনি এ কথা টা আগে বলেননি কেনো? ”
ইয়ানা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,
” যে লোকটা নিজ বউকে তার বন্ধু কে দিয়ে দিতে পারে আর যাইহোক তাকে এই সংবাদ টা জানানো যায় না।”
তায়েফের থেকে মুক্তি পেয়ে ইয়ানা তার ঘনিষ্ট বান্ধবীর বাড়ি চলে আসে। এবং তাকে অনুরোধ করে তার দেশ ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওর সম্পর্কে জেনো কাউকে কিছু না বলে। বান্ধবীর বাড়ি থেকে ইয়ানা ওর চাচাতো ভাই, যে বর্তমানে ইয়ানার বাবার বাংলাদেশের সকল প্রোপার্টির দেখাশোনা করছে। তার সাথে যোগাযোগ করে। এবং রিকুয়েষ্ট করে বাড়ি থেকে জেনো ওর পাসপোর্ট কালেক্ট করে দেয় এবং ইতালি যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেয়। এক সপ্তাহ সময় লাগে, তারপর এক সপ্তাহের মধ্যে সকল পিছুটান মায়া ত্যাগ করে দেশ পাড়ি দেয় ইয়ানা।

প্রথমত ইয়ানার প্রতি রাগান্বিত হন ইয়ানার বাবা। বাড়িতে জায়গা দেননা, চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বলে। কান্না করতে করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ইয়ানা। হোটেল রুমে ফিরে আসে ইয়ানা। ঘন্টা খানেক পর, ওর খালামনি কল দেয়। তারপর সে ইয়ানাকে নিজের কাছে চলে যেতে বলে। সন্তান যত বড় অন্যায় করুক না কেনো? সন্তান সন্তান হয়, দূরে গেলেও চিন্তা তো থাকেই। ইতালি বসে নিজ মেয়ের সকল খবরাখবর রাখতেন। ইয়ানার কানাডা যাওয়ার পর ওখানে ওকে স্যাটেল করে দেন ইয়ানার বাবা আড়ালে থেকে এবং জব + ফ্ল্যাট কিনে দেন। আড়ালে লুকিয়ে থেকে মেয়েকে আর্থিকভাবে সব সাহায্য করেন। মাস ঘনিয়ে যেতে লাগল। বছর শেষের দিকে, ইয়ানা কোল জুড়ে আসল একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান। ইয়ানা ও সবার আগে সে কন্যাকে কোলে তুলে নেয়, ইয়ানার বাবা৷ এবং উনিই কন্যার নাম রাখেন “রুহানি মেহেক সারা।”

ছোট মেয়ে নিয়ে ভালো দিন যাচ্ছিল ইয়ানার। তবুও মনের কোণে সুপ্ত এক আকাঙ্খা থেকেই যেতো।আর সেটা হচ্ছে ইয়াসিরের অনুপস্থিতি।
মেয়ে বড় করার সকল দায়িত্ব ইয়ানা নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। এবং সে সফল হয় মেয়েকে মানুষ করতে। ইতালি ব্যবসা বানিজ্য সামলে মাঝেমধ্যে মেয়ে ও নাতনীর সাথে মিট করতে কানাডা আসে ওর নানা ও নান্না।

রুহানির হঠাৎ বাংলাদেশে চলে আসার খবর উনাদের ও কানে পৌঁছেছে। কিন্তু কারো কিছু করার নেই। সবারই হাত বাঁধা।
.
এত বছর পর, এখনও ইয়াসির এই আশাতে বসে আছে। তার ইয়ানা একদিন তার জীবনে ফিরে আসবে। সব ভুলে তাকে আপন করে নিবে। ইয়াসিরের ফোন নাম্বার ইয়ানার মুখস্থ। ইয়াসির ভাবে ইয়ানা তাকে একদিন ফোন দিবে, সেজন্য ইয়াসির আজও তার ফোনের সিমটা চেঞ্জ করেনি। অপেক্ষা যে কতটা দীর্ঘ হয়, তা একমাত্র যে করে সেই বুঝে। ইয়ানার ছবির ওপর থেকে চোখ নামিয়ে রুমের মধ্য হতে বেরিয়ে যায় ইয়াসির। কেননা এখন এখানে থাকলে, সে কান্না করে দিবে। তাদের ভালোবাসাময় কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ঘরটায়। রুমটার মধ্যে একা থাকা কালীন ইয়াসিরের মনে হয়, ইয়ানার ওভাবে তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য এবং পুরানো স্মৃতি গুলো তার গলা চেপে ধরে। ধম বন্ধ হয়ে আসে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
_________________________
” শাড়ীর আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই মিস রুহানি,
কেবলমাত্র মেয়ে’রা পরে বলেই এটি এত সুন্দর!”

রুহানির হাত ধরে তাকে নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে আসে এ.স। তারপর মৃদুস্বরে উক্ত কথাটি বলল। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে নির্মূল কণ্ঠে আরও বলল,
” তবে সত্য বলতে, আমি সত্যি ভাবিনি। আমার গিফট করা শাড়িটা আপনি পড়বেন।”

ভ্রু যুগল কুঁচকানো করে তীক্ষ্ণ চোখে এ.স এর চোখে চোখ রাখে রুহানি। রাগী ও কর্কশকণ্ঠে শুধালো,
— ” এটা আপনার দেওয়া গিফট? ”
এ.স মুচকি হাসি হেসে বলল,
— ” জ্বি। ”

এ.স এর কথাশুনে রাগে রাগান্বিত গলায় রুহানি বলল,
” আপনি গিফট করেছেন জানলে আমি কখনো পড়তাম না। মামনি দিয়েছে বলে পড়েছি। কোনো ব্যাপার না আমি এখনই গিয়ে চেঞ্জ করে আসছি।”

কথাটি বলে, এ.স এর সামনে থেকে হনহনিয়ে চলে যেতে লাগে রুহানি। সে সময়ে সকলের চেঁচামিচি শুরু হয়। সকলে বলছে, বর এসেছে, বর আসছে। কথাটি শুনে চেঞ্জ করার কথা মাথা থেকে উবে গেলো। সকলের সাথে পাল্লা দিয়ে গেইট ধরেছে রুহানি। বর মুখে রুমাল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বরের পাশে তার ভাই ও বন্ধুরা সকলে কনে পক্ষের সাথে দুষ্টামি ফাইজলামি করছে। হলুদ ও লবণ মিশ্রিত লেবুর শরবত বরকে খেতে দিলো রুহানি। এক চুমুক শরবত খেয়ে উল্টি করার মত অবস্থা হয়ে যায়। বরের অবস্থা দেখে রুহানি সহ বাকিরা হো হো করে হাসতে লাগে। ছেলে পক্ষ কোনো অংশে কম নয়। ছেলেদের মধ্য হতে একজন ছেলে হঠাৎ রুহানির লম্বা চুল ধরে টান মারল। রুহানি অস্ফুটস্বরে, ‘আউচ’ বলে চেঁচাল। ঘটনাটি দেখে চেয়ার ছেড়ে ওঠে আসে এ.স রুহানির ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে ছেলেটার দিকে ক্ষিপ্ত চোখে তাকাই। ছেলেটা ভয়ে চুপসে যায়।
রুহানির একহাত ধরে ভিড়ের মধ্য থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে এ.স। এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলে,

— ” ছেলেদের সাথে এত গায়ে পরে ঢং করার কি আছে? দেখতে পাচ্ছো না, সুযোগ বুঝে ছেলেটা চুল ধরে টানাটানি করছে।”

রুহানি এ.স এর হাত থেকে নিজ হাতটি ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
— ” টাচ্ করলে আমাকে করেছে, তাতে আপনার কী?”

মাত্রাতিরিক্ত রাগে রুহানির হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে এ.স। রুহানির হাত ধরে টান মারে। রুহানির হাত পিছন দিকে নিয়ে নেয়, রুহানির পিঠ তার বুকের সাথে ঠেকিয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,

— ” আপনি মানুষ টাই আমার মিস রুহানি মেহেক সারা। আপনি অন্য কোনো পুরুষের সংস্পর্শে যান কিংবা কোনো পুরুষ আপনার ধারে কাছে ঘিরুক এর কোনো টাই আমি আরিশ শাহ বরদাস্ত করবো না। আপনি আমার, শুধু আমার। খুব ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে রাখুন।” কথাটি বলা মাত্র রুহানির হাত ছেড়ে এ.স বিয়ে বাড়ির গেইট দিয়ে বের হয়ে চলে যায়। অনেকক্ষণ হাত মোচড়ে ধরায় হাতের অংশ টুকুতে নীলচে দাগ হয়ে যায়।

চলবে… ইন শা আল্লাহ!

#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৬
#লেখিকা: #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

“আমি এক কথা বারবার পুনরাবৃত্তি করতে পছন্দ করিনা৷ তোমাদের এর আগেও কয়েকবার বলেছি আমার পারমিশন ছাড়া গোডাউনের মধ্যে কেউ জেনো প্রবেশ না করে. কিন্তু দেখো তোমাদের সকলের চক্ষু আড়ালে গতকাল রাতে কেউ একজন গোডাউনে প্রবেশ করেছিল। কোথায় ছিলে তোমরা? রাত বিরাইতে ঘাস চড়তে গিয়েছিলে? এত সিকিউরিটি এবং এতগুলো গার্ড থাকতে কেউ কিভাবে গোডাউনে প্রবেশ করে?”

রাগান্বিত কণ্ঠে কথাগুলো বলে ধপ করে চেয়ারে বসে পরলেন রাজেশ সরকার। রাগে হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপরের সব ছোট বড় জিনিসপত্র গুলো ছুঁড়ে ফ্লোরে ফেলল। পাশ থেকে রফিক করুণকণ্ঠে বলল,” বস! ইনস্পেক্টর নিহান কর্ণ’র ওপর কড়াকড়ি নজর রাখছি। আসল ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে কিছু ইনফরমেশন অ্যান্ড ওভার হয়েছে উনার কাছে। ইনস্পেক্টর নিহান প্রেসের সামনে বলেছেন, মার্ডা’রার এতগুলো মা’র্ডার করার পর্যায়ে একটা মস্তবড় ভুল করেছে আর উনি এটাও বলেছেন যে ওই ভুলের জন্য উনি ক্রিমিনাল দের খুব তারাতাড়ি হাতেনাতে ধরবেন।”

গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে, ইজি চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে মৃদু দুলে রাজেশ সরকার বলল,” পুলিশ কি করবে না করবে সেটা নিয়ে আমাদের এত কিসের চিন্তা ভাবনা? পুলিশদের কে তাদের কাজ করতে দাও। আর তোমরা তোমাদের কাজ করো। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি এ.স কে কাবু করতে হলে ওই মেয়েকে আমার লাগবে। ওইবার তো ম’রতে ম’রতে বেঁচে গেছে। কিন্তু এইবার উঁহু, বাঁচার সুযোগ আর দিচ্ছি না। এক মিনিটও জেনো মেয়েটা চোখের আড়াল না হয়। মেয়েটার ওপর নজর রাখো।” রাজেশ সরকারের কথা শুনে উপর নিচ মাথা নাড়ে তার ডানহাত রফিক। হাতের একটা ফাইল টেবিলের ওপর রেখে ফাইলটা রাজেশের দিকে এগিয়ে দেয় রফিক। সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলে ফাইলটা হাতে নেয় রাজেশ, হাতের ইশারায় রফিক কে চলে যেতে বলে। চোখের চশমাটি একটু নাড়িয়ে ফাইলটা দেখতে লাগে। পাশের ফোনটি শব্দ করে বেজে উঠে। সাথে সাথে কল রিসিভ করে, অপর পাশের মানুষটার কথাশুনে স্মিথ হাসল রাজেশ।

“মাম্মাহ বললাম তো আমি ঠিক আছি। আমার কিছু হয়নি। প্লিজ আমাকে নিয়ে টেনশন করিও না। সুমাইয়া আন্টি আমাদের খুব যত্ন করছেন। এবং আমরা যেদিন আসছি সেদিনই আমাদের রিটার্ন টিকেট কেটে ফেলছি। বাঙালি বিয়ের রুলস অনুযায়ী ফিরানির পর, আমরা বেক করব। আর মাত্র কয়েকদিন প্লিজ মা আমাকে নিয়ে টেনশন করিও না। আচ্ছা এখন রাখছি পরে কথা বলবো। শ্যামার সাথে আমরা ছেলের বাড়িতে আসছি।”

ঘন্টা খানেক আগে, বিয়ে সম্পূর্ণ করে শশুর বাড়ি আসে শ্যামা। নতুন বউকে রুমে বসিয়ে রাখছে। বাড়ির বড়রা এসে বারবার শ্যামাকে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। কোনো কিছু লাগবে কি না? কোনো সমস্যা হলে তাদের জানাতে বলছেন। মৃদু হেসে ডানেবামে মাথা নাড়িয়ে না বোধক ইশারা করে। কিছু লাগবে না।
শ্যামাকে দেখতে এলাকার অনেকে আসছে। অনেক শোরগোল লোক জনের সমাগমে শ্যামার পাশে বসে আছে ওর বন্ধুরা। হুট করে রুহানির ফোনটি বেজে উঠল। ফোনের স্কিনে মাম্মাহ দেখা মাত্র, সকলের উদ্দেশ্য ‘এক্সকিউজ মি!’ বলে ওঠে চলে যায়। ছাঁদের এক কোণে এসে ইয়ানার নাম্বারে কল লাগাল। প্রথমবার কল রিং হতে রিসিভ করে ইয়ানা। রুহানিকে নিয়ে বেশ চিন্তিত ইয়ানা। কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে মেয়ের সাথে কথা বলে। নিজের অসুস্থতার কথা এখনও জানায়নি ও’কে। কিছুক্ষণ কথা বলে ছাঁদ থেকে চলে যেতে নেয়। এমতাবস্থায় ছাঁদের ওপর থেকে দৃষ্টি গেলো বাড়ির সামনে একটা বড় গাছের ওপরে। এমন মনে হচ্ছে গাছের আড়ালে কেউ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের ভুল ভেবে সেদিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে ছাঁদ থেকে চলে যায় রুহানি।

” আরিশ শাহ কারো সাথে আপোষ করে না মি.রুদ্র। কিন্তু শান্ত মাথায় ভেবে দেখুন। সে নিজে এসেছে আপনার ফ্ল্যাটে এবং আপনার মুক্তিপণ দাবি করছে। আপনারা সবাই যে অন্যায় করছেন তার শাস্তি তো শুধু কেবল মাত্র মৃত্যু। অথচ দেখুন, আমরা এখন পর্যন্ত কেউ আপনার গায়ে হাত দেইনি। সেই সন্ধ্যা থেকে আপনার জন্য আপনার ফ্ল্যাটে এসে বসে আছি। তবে একটা বিষয় হচ্ছে, আপনার এই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে আমাদের একটু প্রবলেম হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যাপার না, কোনো কিছুই তো আর অসাধ্য নয়।
আমরা আপনার থেকে আহামরি কিছু চাচ্ছি না মি. রুদ্র। শুধু মাত্র ওই দু’টো ফাইল চাচ্ছি যে দু’টো আপনি লুকিয়ে রাখছেন। ও দু’টো আমাদের দিয়ে দিলে আমরা চলে যাবো। এবং আপনিও প্রাণে বেঁচে যাবেন।”

তাজ তীক্ষ্ণতার সাথে কথাগুলো বলল। সামনে সোফায় বসে আছে রুদ্র। হালকা শীতের মধ্যেও সে ঘামছে। হাতে টিস্যু পেপার দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছে নিয়ে সরু চোখে আরিশ শাহ এর দিকে তাকাল। আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন গ্যাংস্টার এত সুন্দর ও সুদর্শন কি করে হতে পারে বুঝে আসছে না তার। আরিশের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে চোখ জেনো সরাতে পারছে না রুদ্র। জড়ানো কণ্ঠে বলল, “আমি ফাইল দু’টো আপনাদের দিয়ে দেওয়ার পর আপনারা যে আমাকে মারবেন না তার কী গ্যারান্টি?”

অট্টহাসির শব্দ শুনে রুদ্র ভিতু চোখে আরিশের দিকে তাকাল। আরিশের ওষ্ঠদ্বয়ের কোণে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি। প্রবীর সাইড থেকে স্মিথ হেসে বলল,
” কিছু না বলে ম’রে যাওয়ার চেয়ে কিছু বলে বেঁচে যাওয়া বেটার মি.রুদ্র! কি বলেন? আর শুনেছি আপনার ছেলে ও বউ শহর থেকে গ্রামে গেছে আপনার মা অসুস্থ বলে। এখন একটু ভেবে দেখুন তো রুদ্র। আপনার অসুস্থ মা যদি শুনতে পায় আপনি আর নেই তখন তার কি অবস্থা হবে?”

কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটে আরিশ। তার হাতের পি’স্ত’ল টা সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখল। চোখের ইশারায় রুদ্র কে পিস্ত’লের দিকে তাকাতে ইশারা করে। সোফার সাথে হেলান দিয়ে বসে এক হাত দিয়ে খানিকটা কপাল চুলকে আরিশ বলল,
” আমাদের যদি একান্তই কিছু বলতে না যাস তাহলে সামনেই পি’স্তল রাখা আছে। পি’স্তল ওঠা আর নিজে নিজেকে শু’ট করে দে। কিস্সা খতম।”

রুদ্র কাঁপা কাঁপা হাতে পি’স্তল হাতে নিলো। উপস্থিত সকলের দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে পি’স্তল নিজের কপালের ডানপাশে পয়েন্ট করে। ভ্রুযুগল কুঁচকানো করে রুদ্রর মতিভ্রম বুঝবার চেষ্টা করছে আরিশ। মিনিট পরেই নিজের ওপর থেকে পি’স্তল সরিয়ে আরিশের ওপর তাক করল। হতবিহ্বল হয়ে পরল তাজ ও প্রবীর। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরিশের কপাল বরাবর শু’ট করে দেয় রুদ্র।

প্রবীর রাগে রুদ্রর দিকে এগিয়ে আসে। রুদ্রর চুলের মুঠি শক্ত করে টেনে ধরে দাঁত চেপে চেপে বলল, “তোর এত বড় সাহস তুই এ.স কে শু’ট করার জন্য পি’স্ত’ল তাক করিস। এবার দেখ আমরা তোর কি করি।”
প্রবীরের একটা কথায় ওদের কয়েকজন গার্ড এসে রুদ্র কে ফ্লোরে ফেলে ধোলাই দিলো। ফ্লোরে হামাগুড়ি দিয়ে আরিশের পায়ের কাছাকাছি আসে রুদ্র। আরিশের পা ধরে আকুতি মিনতি করছে।
আরিশ মলিন হাসল শানিতকণ্ঠে বলল,” সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুলটা একটা বাঁকাতে হয় মি. রুদ্র। এতক্ষণ ভাবছিলাম তোকে একা মারবো। কিন্তু আমি এখন আমার প্লানিংয়ে কিছুটা চেঞ্জ আনছি। আর সেটা হচ্ছে, তোকে মেরে আধমরা করে ফেলে রাখবো। তারপর তোর গ্রাম থেকে তোর মা, বউ ও সন্তান কে তুলে এনে তোর সামনে তিলেতিলে মা’রবো। তাদের মরতে দেখে তুই ছটফট করবি সেটা দেখে যে আনন্দ টা পাবো ওইটা তোর এমনি মরাতে পাবো না। ওয়াসিফ আর দেরি না করে, রুদ্রর পরিবারকে গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর।” শেষের কথাটি কর্কশকণ্ঠে ওয়াসিফের উদ্দেশ্য বলল, আরিশ। তার কথাশুনে স্তব্ধ হয়ে যায় রুদ্র। আরিশ শাহর সম্পর্কে কোনো কিছুই অজ্ঞাত নেই তার। সে জানে এ.স কতটা সাংঘাতিক। রুদ্র আহত অবস্থায় আহত কণ্ঠে আরিশকে অনুরোধ করে বলল,” আপনারা যা বলবেন আমি তাই করবো শুধু আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি করবেন না।”

ফ্লোরের ওপরে পা দিয়ে অদ্ভুত খটখট আওয়াজ করল আরিশ। শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলল,” ফাইল!”

রুদ্র কিছুক্ষণের মধ্যে ফাইল দু’টো এনে আরিশের হাতে তুলে দেয়। ফাইল দু’টো তে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে হাসল এ.স। ফাইল দু’টো নিয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো সকলে। তাদের যেতে দেখে, ভারী নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় হেলান দিয়ে বসে রুদ্র। এমন ভাবে ‘মারছে যে জাগা জাগা থেকে র’ক্ত বের হচ্ছে। চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। আস্তে করে চোখ জোড়া মেলতে রুদ্র দেখল, চোখের সামনে একজন মাস্ক পরা লোক রুদ্রর দিকে কিছু টা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র ওঠতে যাবে তার আগে লোকটা তার হাতের পিস্তলটা রুদ্রর বুকের বা পাশে রেখে পরপর দুই-তিন টা শুট করল। মূহুর্তে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলো রুদ্র। রুদ্র নিশাচরের মতো চোখ দু’টি দিয়ে তাকিয়ে আছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে। মাত্রাতিরিক্ত রাগে সামনে টেবিলের ওপরে সজোড়ে লা’ণ্থি মা’রল সে। চেঁচিয়ে বলল, “এইবার নয়। বারবার তুই জিততে পারিস না”

চলবে… ইন শা আল্লাহ!